#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat
3.
দুই দিন অনায়াসেই পার হয়ে গেল আরিশ ভাইয়ার অনুপস্থিতে। আরিশ ভাইয়া সিলিটে গেছেন তাই এই দুদিন আমার কানদুটো প্রত্যাশিত ধমকগুলোর থেকে মুক্তি পেয়েছে। দিনগুলো যে খুব খারাপ যাচ্ছে তেমনটা মোটেও না, বড্ড শান্তিতেই কাটছে দিনগুলো, কেও সকাল সকাল ধমক দিয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছেনা, কেও তার নিজের পড়ার ফাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করছে না যে কোন্ দুষ্টুমি করছি কি না। শুধু মিস করছি আমার প্রান প্রিয় ফোন আর আমার প্রিয় সখী সানা কে। সে সেই কবে তার নানুর বাসায় গেছে ফেরার নাম গন্ধ নেই, সামনে যে এইচ এ সি এক্সাম তার সেদিকে কোন খেয়াল আছে কি আমার জানা নেই, তবে আমিই বা কন সা সিরিয়াস পড়াশোনা নিয়ে। হাহ!
আধাশোয়া হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে আছি, অবশ্যই বাসায় আমার চালচলন নবাবী ধাচের হয় তাতে সন্দেহ নেই।
সেদিন কলেজে ওনার হাতের হিটলারী থাপ্পড় খাওয়াতেই সবটা থেমে থাকেনি, আমার ফোনটা কেড়ে নিয়েছেন আর সাথে আমার গল্পের বই গুলোও। আর একটা বিরাট হুমকি দিয়েছেন যে,
‘রেজাল্ট খারাপ হলে রিকশা ওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো, আর তা থেকে আমাকে কেও আটকাতে পারবে না। তোমার বাপ ও না। ‘
কথার কি ছিরি! সেদিনের পর ওনার চড়ের একটা নাম ও দিয়ে ফেলেছি আমি, ‘হিটলারী থাপ্পড়।’
আমার সব ভাবনাগুলো রসাতল করে আম্মু ফোন হাতে নিয়ে হাঁক দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘরে এমন ভাবে ঢুকলো যাতে যেন ভিনদেশ থেকে কোন রাজপুত্র আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আম্মুর এমন উৎকন্ঠা দেখে বুঝলাম উনি ফোন করেছেন। কথা বলার ইচ্ছাশক্তি বিন্দু মাত্র না থাকলেও বলাটা বাধ্যতামূলক নাতুবা এক্ষুনি উনি সিলেট থেকে মিসাইল ছুঁড়ে আমার পুরো বাসা টাকেই উড়িয়ে দেবেন।
আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে আম্মু বেরিয়ে গেল এমন একটা ভাব নিয়ে যেন তার সাথে আমি প্রেমালাপ করতে চলেছি। আচ্ছা এরা আরিশ ভাইয়া আর আমাকে নিয়ে এতো বাড়তি ভাবনা চিন্তা করেন কেন? এরা কি যানে না যে উনি ফারিন আপুকে পছন্দ করেন। ফোনের দিকে একটু বিকট ভঙ্গিতে তাকিয়ে ফোনটা কানে নিলাম। চুপ করে থাকবো আমি যতখন না উনি ভালো ভাবে কথা বলেন।
ওপাশ থেকে ওনার শ্বাস প্রশ্বাস আমার কানে আসছে, যখনই ওনার সাথে ফোনে কথা বলি ততবারই এই জিনিসটা লক্ষ করেছি আমি। আমার নিস্তব্ধতা ভাঙতে উনি বলে উঠলেন ওপাশ থেকে,
‘আরুপাখি!’
এটার উত্তর দেওয়ার প্রায়োজন বোধ করলাম না কারন আমি জানি ওনার কাছে আমি আরুপাখি।
উনি জানেন আমি উত্তর দেবো না তাই পুনরায় বললেন,
‘পড়া কতোদূর কমপ্লিট হয়েছে? ম্যাথসে প্রবলেম হয়েছে কোন? আর কনভারশন গুলো? ‘
ওনার করা এতো গুলো প্রশ্নের বিপরীতেও আমি নিরব হয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে আমি কি করতে চাইছি আমি নিজেও জানিনা। আচ্ছা আমি কি আমার নিজের দোষভরা কাজকর্ম গুলোর জন্যই ওনার বকা খাই? আমার কি কোন সন্দেহ আছে তা নিয়ে?
ভাবনার অন্ত হলো না, উনি আগের থেকে একটু শক্ত ভাবে বললেন,
‘কালকে আমি ব্যাক করছি। পড়া রেডি রাখো। ‘
ওনার একথা আমার হজম হলো না সহজে। বিদ্যুৎ গতিতে জেগে উঠলাম, এবার কথা না বললেই নয়।
‘এই না না, আমি সব পড়েছি। এই তো এখনো পড়ছি। আপনার একদিন আগে আসার দরকার নেই। ‘
আমি এই মুহূর্তে ওনার রাগী মুখটা হয়তো কল্পনা করতে পারছি, তবে উনি আমার কর্মকান্ডে হাসলেও আমি জানতে পারবো না কারন উনি আমার কোন কাজে অন্তত হাসেন না। উনি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘কই তোমাকে তো আমি পড়তে দেখছি না। ‘
আমি ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠলাম। উনি কিভাবে জানলেন যে আমি পড়ছি না? আমি চোখ বাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘চার চোখ নাকি আপনার যে সব দেখতে পান। ৩০০.৪ কিলোমিটার দূরে বসে আপনি কি করে জানলেন?’
অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ উনি আমার কথাতে আলতো শব্দ করে হাসলেন, ওনার হাসিতে যে আমি কতোটা বিভ্রান্ত হলাম তা আমি কখনোই বলে বোঝাতে পারবো না।
‘আমি মুখ গোমরা করে বললাম,
‘কি হলো হাসছেন যে? ‘
উনি শান্ত ভাবে বললেন,
‘কিছু না। ঠিক করে পড়াশোনা করো, বাসায় গিয়ে দেখি যেন সব পারছো। নাহলে খবর আছে।সামনে এক্সাম কথাটা যেন মাথায় থাকে। ‘
আমার রাগ আর বিরক্ত দুটোই লাগছে ওনার কথাতে। যখনই উনি বাইরে যান এই কথা গুলোই বলেন। আমি আর কিছু বললাম না, চুপ করে রইলাম। দুজনেই নিরব। উনি নিরবতা ভঙ্গ করলেন,
‘কিছু লাগবে তোমার? মানে এখান থেকে কিছু নিয়ে যাবো তোমার জন্য।’
ওনার কথা শুনে আমি চমকিত, অবাকিত, টাস্কিত হলাম। অতি খুশিতে মুখ ফসকে বলেই ফেললাম,
‘আপনি এতো ভালো কবে হলেন আরিশ ভাইয়া?’
উনি আলতো ধমকের সাথে বললেন,
‘স্টুপিড। খালি আজাইরা কথা। কি লাগবে সেটা আগে বলো। ‘
‘কিছু লাগবে না হুহ! তবে আমার একটা ব্লু কালারের পশম ওয়ালা স্কাফ লাগতো। কিন্তু তবুও লাগবে না হাহ! ফারিন আপুকে জিজ্ঞাসা করেন ওনার যদি কিছু লাগে।’
কথাটা বলার পর ফোনের ওপাশ থেকে আর উত্তর এলো না, উনি মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিলেন সেটা নিশ্চিত হলাম। ওনার এমন পতিক্রিয়ার কারন বুঝলাম না তবে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে একটা মনে মনে অনেক কটা ঝাড়ি দিয়ে পড়তে বসলাম।
/
রাত নটার দিকে পড়া শেষ করে রুমের মধ্যে বসে আছি আমি, অনেক ক্ষিধে পেয়েছে তবুও আলসেমিতে নিচে যাচ্ছি না। হঠাৎ আচমকা রুমের দরজা খুলে সানা ঢুকে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়লো যেন। নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। মেয়েটার পিঠে সপাটে একটা চড় দিয়ে বললাম,
‘এই মেয়ে ছাড়। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘
সানা দ্রুত আমাকে ছেড়ে আমার গালদুটো টেনে দিয়ে বলল,
‘তুই জানিস না আমি তোকে কতোটা মিস করেছি।’
আরিশ ভাইয়া যেভাবে ধমক দেন ওনাকে দেখে দেখে আমিও তেমন ধমক শিখে ফেলেছি একদম নিখুঁত ভাবে আর তার প্রয়োগ করলাম সানার ওপর,
‘এই মেয়ে! একদম মিথ্যা না। তুই মোটেও আমাকে মিস করিসনি।’
ওনার ধমক শুরু হয় এই ‘মেয়ে শব্দটা ‘দিয়ে আর তা শুনে মনে হয় এই বুঝি কান ফেটে গেল।।
সানা আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘সত্যি বলছি তোকে অনেক মিস করেছি আমি। ‘
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। বিশ্বাস করলাম। ‘
সানা আমার ওপর কপোট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘তুই আমাকে এই দুদিনে একদম কল দিস নি কেন? ‘
আরিশ ভাইয়া যে ফোনটা আমার থেকে কেড়ে নিয়েছেন সেটা সানা জানে না, কথাটা মনে আসতেই রাগ উঠলো ভীষন।
‘তোর ভাইয়া আমার ফোনটা কেড়ে নিয়েছে। আমার ফোন এখন ওনার কাছে। তবে আমিও এমন এক লক দিয়েছি যে সারা জীবনেও খুলতে পারবে না। ‘
সানা মুখ চেপে হাসলো। তা দেখে আমি বিরক্তি ভঙ্গিমাতে প্রশ্ন করলাম
‘কি হয়েছে হাসছিস যে? ‘
সানা হাসি থামিয়ে বলল,
‘তুই তো জানিস বাসায় ফারিন আপু এসেছে, আম্মু আপু আসায় অনেক খুশি হয়েছে। আর একটা কথাও শুনলাম।’
‘কি কথা? ‘
‘খালা মনি তো ভাইয়ার সাথে ফারিন আপুর বিয়েও দিতে চাই, খালামনি বলল। কিন্তু আম্মু এখনো খালামনিকে তেমন কিছু ভাবে আশ্বাস দেইনি। যে মেয়ে এখনই এমন ভাব দেখায় না জানি সে মেয়ে আমার ভাবী হলে কেমন ভাব দেখাবে। আপু তো ভাইয়া বলতে পাগল। ‘
বিস্ময় এ আমার কপাল কুঁচকে এলো। আমাকে হতবিহ্বল দেখে সানা আচমকা আমার দু বাহু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
‘আরু তুই আমার ভাবী হয়ে যা না। ভাইয়াকে তোর সাথেই মানায়, আম্মুও বলে একথা।’
আমি সানার হাতটা ছাড়িয়ে রাগী গলায় বললাম,
‘বয়েই গেছে আমার ওনার সাথে বিয়ে করতে। আমি তো বিয়ে করবো তার সাথে যে আমাকে একদম ধমক দিয়ে কথা বলবে না আর কোথাও গেলে এটা জিজ্ঞাসা করবে না যে আরুপাখি কিছু আনবো? সে তো একেবারে সরাসরি এনে সারপ্রাইজ দেবে। এমন কাওকে বিয়ে করবো আমি। হু!’
সানা বিষ্ময় প্রকাশ করে বলল,
‘দেখবি ভাইয়া র শেষমেষ তোর সাথেই ভাইয়ার বিয়ে না হয়ে যায়। ‘
‘নো নেভার এভার।’
কথাটা বলেই নীচে নামলাম আমি, দেখলাম ফুপি বসে আছেন আর আম্মুর সাথে কথা বলছেন। বাবা মা এর পর ফুপি আমার সবচেয়ে প্রিয়। দৌড়ে ফুপি কে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ কেও জড়িয়ে ধরায় ফুপি চমকে গেল।
‘ কি ব্যাপার আমার আরু মা এতো খুশি যে। ‘
ফুপির কথাতে আমি হেসে ফেললাম।
‘এমনিই। তোমাকে দেখে আরও বেশি খুশি হয়ে গেলাম। ফুপা আসেনি? ‘
‘তোর ফুপা তো আজকে অফিসেই আছে, আজকে বাসায় ফিরতে দেরি হবে। ‘
‘ওহ আচ্ছা। ‘
আমি একটু চুপ হতেই ফুপি বললেন,
‘আমরা কালকে নারায়নগঞ্জ যাচ্ছি ফারিনকে বাসায় পৌছে দিতে। তুই যাবি? ‘
ফারিন আপুর নাম শুনতেই নারায়নগঞ্জ যাওয়ার মোহ মায়া ত্যাগ করলাম আমি। সরাসরি বললাম,
‘নাহ যাবো না।’
আমার না শুনতেই আম্মু কড়া স্বরে বলল,
‘কেন যাবি না কেন? ‘
আমি ফুপির গলা জড়িয়ে ফুপির কাধে মাথা রেখে বললাম,
‘আমার সামনে এক্সাম। পড়া বাকি। আর তোমার এই হিটলার বান্ধবী ওরফে তোমার ভাবীকে বলো আমার মতো মাসুম বাচ্চার ওপর এতো রেগে কথা না বলতে। ‘
ফুপি হাসলো।
‘আরে শুধু তো আমরা একা যাচ্ছি না। তোর আম্মু ও যাচ্ছে, সানা যাচ্ছে বিধায় তুই কেন বাদ যাবি? ‘
সানার মুখের দিকে তাকালাম আমি। নাহ তবুও যেতে ইচ্ছা করছে না একদম। আমি পুনরায় না করলাম।
ওই ফারিন কে আমার মিরজাফরের বউ বলে মনে হয়, কেন জানি না ওনাকে সহ্যই হয় না।
/
রাত বারোটা বাজে, সবাই নিশ্চয়ই এতখন ঘুমিয়ে পড়েছে। অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে এলাম আমি, টর্চটা হাতে নিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে দিয়ে আঙুলের কড়ি গুনতেই একটা ঘর এসেই থেমে গেল আমার দিন গননা শুরু করলাম,আর একটা দিন পার হলেই আমার জন্মদিন? সত্যি? নিজের জন্মদিন নিয়ে কেও এতোটা নাচানাচি করে তা আমাকে না দেখলে কেও বুঝতেই পারবে না। ভীষনরকম খুশি লাগছে আমার তবে আগের বারের জন্মদিনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। আরিশ ভাইয়া আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আমাকে আমার প্রিয় লেখকের বই কিনে দিয়েছিলেন আর বাইকে করে ঘুরতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার উনি আর নেই।কথাটা ভেবে আনন্দ দুঃখ কোনটাই আর কাজ করছে না। বিছানায় গিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম।
#চলবে,,,