ভালোবাসা পর্ব ৯

0
659

 

ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৯
* * ২৪ * *


কালকের দিনটা এত ভয়ে দুশ্চিন্তায় কেটেছে যে কি বলব! আজ বেলায় পলাশ ফোন করে জানিয়েছে ওরা কলকাতায় পৌছে গেছে। রজতকুমার কলকাতায় ওদের থাকার ব্যবস্থা অবধি করে দিয়েছেন। সত্যিই! উনি যে এতটা করবেন দুজন অপরিচিত লোকের জন্য ভাবাই যায় না। আমিও তো ওনার অর্ধপরিচিতই। তাও আমার মুখের কথায় যে উনি এতটা করবেন আশা করিনি আমি।

সারাদিন সব কাজের মাঝেই বারবার আমার রজতকুমারের কথাই মনে পড়ছিলো কেন কে জানে! বিকালে বাবার হোটেলে পৌছলাম। কাল ডামাডোলে আমি হোটেলে আসতেই পারি নি। আজ তাই বিকালে এসেছি। রিশেপশনে বসে আছি হঠাৎ দেখলাম রজতকুমার আমার সামনে হাসি মুখে এসে দাঁড়ালেন যেন। ঠিক দেখছি তো! নাকি কাল থেকে এত ওনার কথা ভেবেছি যে এখনও মনে হচ্ছে উনি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরলাম যখন উনি বললেন কি এত ভাবছ? আমি চমক ভেঙে বললাম আপনি এখানে! সত্যিই এসেছেন? বলেই বুঝলাম বোকার মত কথা বলে ফেলেছি। কিন্তু উনি তাতে কিছু মনে করলেন না, উল্টে হেসে বললেন এখানে আসবো না তো যাবো কোথায়? আমার সর্বস্ব যে এখানেই আছে। বলে আমার দিকে ইশারা করলেন। আমার অদ্ভুত লাগল প্রথমে। তারপর মনে হলো, ঠিকই তো বলেছেন উনি। ওনার সব লাগেজ তো হোটেলেই রয়ে গেছে। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে বোকার মত হাসলাম। উনি বললেন এক্ষুনি একটু আমার ঘরে আসতে পারবে? খুব দরকারি কথা আছে। আমি ভাবলাম হয়ত পলাশদের নিয়ে কিছু বলবেন। তাই ওনাকে আসছি বললাম। উনি ঘরে চলে গেলেন, আমিও ভাইকে রিশেপশনে বসিয়ে পিছু পিছু গেলাম ওনার ঘরে।

ঘরে ঢুকতেই উনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর নিজে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর জুতো মোজা খুলতে খুলতে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। আশ্চর্য তো! কথা আছে বলে ডাকলেন তো কথা বলছেন কই? ওনার তাতে কোনো হেলদোল নেই। উনি জুতো মোজা খুলে জায়গায় রেখে লাগেজ থেকে জামাকাপড় বার করে হাসিমুখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্বস্তি হচ্ছে। এরকম একটা লোকের ঘরে দাঁড়িয়ে আছি, আর উনি নিজের ছন্দে বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ হচ্ছেন। কি অদ্ভুত। কথা বলবেন বলে ডেকে এ আবার কি! নিজের মনে ভাবছি এসব হঠাৎ কানের একদম পাশে গম্ভীর স্বরে সারাক্ষণ কি এত ভাবো? শুনে চমকে গেলাম। উনি কখন ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আমার ঠিক পাশটাতে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতেই পারিনি। ওনার মুখটা ঠিক আমার কানের পাশে নিয়ে এসে আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন। ওনার নিশ্বাস আমার কাঁধের ওপর পড়ছিলো। এঅবস্থায় আমার অস্বস্তি আরোও বেড়ে গেলো! আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে গেলো, চাইলেও আমি সরে যেতে পারলাম না। কোনোরকমে তুতলিয়ে বললাম কো-কোথায়! কি-ই-ছু ভাবি নি তো! এবার উনি মুচকি হেসে আমার পাশ থেকে সরে গেলেন। আমিও যেন চেতনা ফিরে পেলাম। উনি আবার খাটে গিয়ে বসে এবার একটা উটকো প্রশ্ন করলেন। আচ্ছা এবার একটা প্রশ্নের হ্যাঁ বা না তে জবাব দাও তো! তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে? এরকম বেয়াড়া প্রশ্নে চমকে গিয়ে বললাম মানে!?
-সোজা বাংলাতেই প্রশ্ন করেছি। তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে না নেই। সোজা কথাতেই উত্তর দাও। হ্যাঁ অথবা না তে।
আশ্চর্য লোক তো! এবার আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম তাতে আপনার কি?
– নাআআ! আমার কিছুই না। জানতে চাইছিলাম যে তোমার বন্ধুদের মত তোমারও এরকম পালিয়ে বিয়ে করার চান্স আছে কি না। থাকলে বলতে পারো। আমি হেল্প করবো।
-না ধন্যবাদ। আমার অনেক দায়িত্ব আছে। এসব প্রেম ভালোবাসার জন্য আমার সময় নেই।
– যাক্ বাঁচা গেলো।
-কি? কি বললেন আপনি?
-কই কিছু না তো!
-ওই তো বিড়বিড় করে কি যেন বললেন।
-ওহ। ও কিছু না। বললাম তাহলে তোমায় বলা যেতেই পারে।
-মানে? কি বলা যেতে পারে? কি বলবেন আপনি?
-তোমার বন্ধু পলাশ আমাকে তোমার সম্পর্কে এককা কথা বলছিলো।
-কি? কি বলেছে ও?
-বলতে পারি তবে দুটো শর্ত আছে।
-শর্ত! কি শর্ত?
-আগে বলো রাখবে।
-আগে শুনি কি শর্ত?
-আগে প্রমিশ করতে হবে। আগে প্রমিশ করো রাখবে।
-আমি কোনো প্রমিশ করবো না।
-তাহলে আমিও বলবো না।
-আচ্ছা জ্বালা তো! আচ্ছা বেশ বলুন।
-প্রমিশ করছো তাহলে?
-হুম।
-ওরকম করে নয়। ভালো করে বলো প্রমিশ করছ আমার শর্ত মানবে।
-হ্যাঁ কথা দিলাম। শর্ত মানব। এবার বলুন ওরা কি বলেছে।
-বলব আগে দাঁড়াও, শর্ত দুটো শোনো।
-বেশ বলুন।
-আমার প্রথম শর্ত। আমার বন্ধু হবে?
ওনার কথায় আমি চমকে উঠলাম! এত বড় সেলিব্রিটি বলে কি! আমাকে খামোখা ওনার বন্ধু করতে চান কেন? হঠাৎ আমাকে বন্ধু বানাতে চান কেনো?
-______________
-কি হলো বলুন? চুপ করে আছেন কেন?
-কারণ তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই তাই।
-মানে?
-সবেতে এত মানে খোঁজো কেন? এমনিই কি মানুষ মানুষের বন্ধু হতে পারে না?
-পারে। কিন্তু আপনার মত একজন সুপারস্টার, সেলিব্রিটি খামোখা আমার মত একজন অতি সাধারণ মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব কেন করতে চাইবে বুঝতে পারছি না।
আমার কথাটা শুনে উনি এবার বিছানা থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে এক পা, এক পা করে আমার দিকে এগোতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন
-কারণ আমার মত সুপার্স্টার সেলিব্রিটির তোমার মত সত্যিকারের বন্ধু একটাও নেই তাই। যারাই বন্ধুত্ব করে আমার স্ট্যাটাস দেখে আমার ফেম দেখে বন্ধুত্ব করে। কিন্তু তুমি সবার থেকে আলাদা তাই আমি চাই এই আলাদা মানুষটা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হোক। তারপর একদম আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে করুণ মুখ করে বললেন বন্ধু ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে বলো? আমাকে বাঁচাতে তুমি কি আমার বন্ধু হবে না? বলো?
আমার ওনার মুখটা দেখে হাসি পাচ্ছিলো। অনেক কষ্টে চেপে বললাম ঠিক আছে। হবো বন্ধু।

* * ২৫ * *

ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস! মহারাণী পথে এসেছে। বন্ধু হবে বলেছ যখন তখন বউও বানাবো তোমায় মহারাণী। শুধু সময়ের অপেক্ষা। মনে হচ্ছে এখনই তোমায় জড়িয়ে ধরি। কিন্তু না রজত! কন্ট্রোল!
-আর আপনার দ্বিতীয় শর্ত? বলল সুজাতা। আমি বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে ওর ওই গভীর চোখদুটোর দিকে তাকালাম। কতদিন পরে এই চোখদুটোকে আবার এত কাছ থেকে দেখছি। ওর চোখের গভীরতায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি আবার। সুজাতার কি হলো বলুন? বলায় কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরলাম। আমার দ্বিতীয় শর্ত হলো আমাদের এই নতুন বন্ধুত্বের সেলিব্রেশন হিসাবে কাল তুমি তোমার ইচ্ছামত আমাকে দার্জিলিং ও ঘুম ঘোরাবে। বলো রাজী? সুজাতা খানিকক্ষণ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল আমার ইচ্ছামত কেন?
-কারণ আমি চাই আমার নতুন বন্ধুকে আরোও ভালো করে চিনতে জানতে।
-হঠাৎ?
-হঠাৎ আবার কি? আমরা যদি এখন বন্ধু হই আমাদের একে অপরকে চিনতে জানতে হবে না? একে অপরকে না, চিনলে না জানলে ভালো বন্ধু হবো কি করে?
-কিন্তু আমিও তো আপনাকে চিনি না জানি না।
-তাই জন্যই তো বলছি। কাল আমরা একে অপরকে চিনবো জানবো।
এবার সুজাতা মাথা নীচু করে খানিকক্ষণ ভাবলো। তরপর বলল কিন্তু সারা কি করে? সকালে বাড়ীর কাজ থাকে আর বিকালে এখানে আসতেই হয়। কাল আসতে পারিনি বলে বাবার একটু অসুবিধাই হয়েছে। এখন ট্যুরিস্টদের ভীড় থাকে যে।
-হুমমমম। তাহলে আমরা দুপুরে বেরোতে পারি? আর সেই সুযোগে বাইরেই লাঞ্চ করবো।
সুজাতা আবার কিছু ভেবে বলল ঠিক আছে। আমি সময়টা আপনাকে জানিয়ে দেবো।

থ্যাঙ্ক গড! সুজাতা যে আমার দুটো শর্তই মেনে নিয়েছে এ যেন আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। অবশেষে আমার এখানে আসা সার্থক হলো। এবার কাল দুপুরের প্রতীক্ষা।

সুজাতা এবার যাওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারপর কি ভেবে থমকে দাঁড়ালো। তারপর আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল আপনার শর্ত তো আমি মেনে নিলাম, কিন্তু কই পলাশ আপনাকে আমার ব্যাপারে কি বলেছে বললেন না তো! আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম বলছিলো তোমার মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এমন বন্ধুকে কোনো মুল্যেই হারানো যায় না। ও আমার কথাটা শুনে মুচকি হাসলো তারপর আবার পিছন ফিরে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে।

* * ২৬ * *

সুজাতা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিলো না সুজাতা আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে কাল দুপুরটা আমার সঙ্গে কাটাতে রাজী হয়েছে।‌ সব স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। বিছানায় পড়ে পড়ে আমার এখানে আসা থেকে আজ খানিক আগের ঘটনা অবধি সব চোখের সামনে ভাসছিলো।

সত্যি আমি বড্ড বোকা! সেদিন সুজাতা আর পলাশকে এক সাথে দেখে কত কিই না ভেবে নিয়েছিলাম। সত্যিটা খোঁজ নিলেই আর এত কষ্ট পেতে হতো না। নাহ! আর কোনো দিন না জেনে সুজাতাকে সন্দেহ করবো না। আর এখন তো ও আমার বন্ধু হতেও রাজী হয়েছে এবার কোনো প্রশ্ন হলে সরাসরিই ওকেই জিজ্ঞাসা করবো। আর বন্ধু যখন হয়েছে ম্যাডাম খুব শিগগিরই আমার ভালোবাসাটাও বুঝবে। উফ! সেই দিনটা যে কবে আসবে! আমার যে আর তর সইছে না। না! না! না! তাড়হুড়ো নয় রজত। ধীরে ধীরে! সুজাতার সঙ্গে মিশে ওর মনটাকে আগে জানতে হবে। তবেই তো ওর মন শুধু তোর হবে। আর ওর বয়ফ্রেন্ড বা ভালোবাসা নেই তাহলে তোর রাস্তাও ক্লিয়ার।

সুজাতার কথা ভাবতে ভাবতে এবার অনেকক্ষণ হলো, একটা মেসেজ করি মহারাণীকে ভেবে “হাই!” লিখে পাঠিয়েই দিলাম ওর নম্বরে। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। মোবাইলটা সামনে রেখে সুজাতার ধ্যানে মগ্ন হলাম। এই উত্তর আসে, এই উত্তর আসে করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো! কোনো উত্তর নেই। ও কি রাগ করলো আমার ওপর? নাকি আমাকে আবার অ্যাভয়েড করছে! বুঝতে পারছি না। সাধারণত শ্যুটিং না থাকলে রাতে দশটার পর ল্যাপটপটা খুলে রোজ বসি, ফ্যান মেল গুলোর জবাব দিই রোজ। আজও বসলাম। কিন্তু মন পড়ে আছে মোবাইলের দিকে, মানে সুজাতার দিকে। সারে দশটা নাগাদ মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ ঢোকর আওয়াজে প্রায় ঝাপ দিয়ে পড়লাম মোবাইলটার ওপর। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠেছে “মহারাণী” (ওই নামেই সেভ করেছি ওর নামটা, আমার মহারাণীর)। তাড়াহুড়ো করে মেসেজটা খুললাম। ছোট্টো উত্তর, “হাই!” আমার প্রতীক্ষার অবসান হলো। সঙে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিলাম
-এতক্ষণে জবাব এলো তাহলে! থ্যাঙ্ক ইউ! কি করছ? এবার খানিক নীরবতা। মিনিট পাঁচেক পর আমার মেসেজ এলো, এই শুয়ে আছি, এবার ঘুমাবো। যাক! রেগে নেই তাহলে! আবার মেসেজ করলাম, এত তাড়াতাড়ি? আরোও মিনিট পাঁচেক পর জবাব এলো। হুম। এ আবার কি জবাব! কিছু মাইন্ড করলো না তো! ভয়ে ভয়েই এর পরের মেসেজটা করলাম। কাল কখন দেখা করবে বললে না তো! এবার আরেকটু দেরী করে জবাব এলো কাল সকালে জানিয়ে দেবো। একি রে! দেখা করবে তো? আবার মেসেজ করলাম, অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু। এবার তাড়াতাড়ীই উত্তর এলো আচ্ছা। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে দ্বিতীয় মেসেজ করার সুযোগ না দিয়ে আরেকটি মেসেজ পাঠালো। মেসেজটা খুলে দেখলাম লেখা আছে গুড নাইট। যাহ্! অগত্যা আমিও গুড নাইট লিখে পাঠিয়ে দিলাম।

এই ছোট্টো কথোপকথনের পর আমি বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে মাথার বালিশটাকে জড়িয়ে ধরে বসে বসে ভাবতে থাকলাম। সুজাতা কি এতই কম কথা বলে? না কি প্রথমবার মেসেজে কথা বলছি বলে আড়ষ্ঠতা আছে! সত্যিই কি ওর ঘুম পেয়েছে? নাকি আমার সাথে কথা বলবে না বলে বাহানা দিলো! কাল সত্যিই দেখা করবে তো? নাকি টালবাহানা করে এড়িয়ে যাবে! এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন যে বসে থাকতে থাকতেই নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়েছি টেরও পেলাম না। এক্কেবারে সকালে পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো।

 

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here