ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৫ ko
* * ১২ * *
পাঁচদিন হয়ে গেছে গরমের ছুটি পড়ে গেছে, তাই আমিও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ী ফিরে এসেছি। এখন টানা একমাস এখান ছেড়ে কোত্থাও নড়ছি না। বাবা আর ভাইয়ের সাথে চুটিয়ে উপভোগ করবো সময়টা।
আজ পাপাই ফোন করেছিলো। বলল কে যেন আমার খোঁজ করছিলো। ফোনের লাইনের ডিস্টার্ব থাকায় পরিষ্কার শুনতে পাই নি। তবে যেই খুঁজুক, আমার বয়েই গেছে। এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি খুঁজলেও আমার যায় আসে না। এখন আমি শুধু ছুটি উপভোগ করবো। আর বাবাকে ব্যবসায় হেল্প করবো।
তবে আজ একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। আমার ছোট্টবেলার বন্ধু পলাশের সঙ্গে আজ হঠাৎই দেখা হয়ে গেলো। আসলে এই ছুটিতে বাড়ী গেলে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল অবদি আমি বাড়ীর কাজ করি। ওই সময় হোটেলে ট্যুরিস্ট কম থাকে। সবাই ঘুরতে বেড়িয়ে যায়। তাই প্রেশারটা কম থাকে। কিন্তু বিকেলের পর থেকে সবাই ফিরে আসে, কাজ বাড়ে তাই বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আমি বাবাকে হেল্প করতে হোটেলে যাই। আজও গেছিলাম। ফেরার পথে বাড়ীর কিছু জিনিস কেনার জন্য একটা দোকানে ঢুকেছিলাম। সেখানেই জিনিসপত্র কিনে বেরোতে গিয়ে একজনের সঙ্গে জোরে ধাক্কা খেলাম আর আমার সব জিনিস পরে ছড়িয়ে গেলো। আমি বেরোচ্ছিলাম আর লোকটা ঢুকছিলো। দেখে ঢুকতে পারে না! সব পড়ে গেলো! মেজাজ গরম হয়ে গেলো আমার। চেঁচিয়ে উঠলাম লোকটাকে দেখে চলতে পারেন না? কানা নাকি? লোকটা আমার জিনিসপত্র তুলে দিচ্ছিলো কোনো জবাব দিলো না। কি অভদ্র রে বাবা! আবার আমি চেঁচিয়ে উঠলাম কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছেন না কেন? বোবাও নাকি? এবার লোকটা উঠলো সব জিনিসপত্র আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলল ভুল হয়ে গেছে! আশ্চর্য! এই উত্তর! লোকটা আমাকে জিনিসগুলো ধরিয়েই চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমি তখন ফুল অন ঝগড়ার মুডে। ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে ভুল হয়ে গেছে বলে চলে যাবে! ইয়ারকি নাকি? আমি আবার লোকটার সামনে গলা চড়িয়ে বললাম ভুল হয়ে গেছে মানেটা কি? ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে এখন বলা হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে? এবার লোকটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। কিন্তু এক সেকেন্ড! এটা কে? এই মুখ তো আমার ভীষণ চেনা! পলাশ! আমার ছোটোবেলার বন্ধু পলাশ ছেত্রী। একই পাড়ায় বাড়ী, আর একই স্কুল ছিলো আমাদের। হায়ার সেকেন্ডারীর পর আমি ঘুমেতেই কলেজে ভর্তি হলাম। আর পলাশ জয়েন্ট দিয়ে কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে চলে গেলো। তারপর আর যোগাযোগ থাকেনি। আজ এতবছর বাদে আবার ওকে দেখলাম। কিন্তু সেই চঞ্চল হুল্লোড়বাজ পলাশ তো এ নয়! এ যেন নিজের মধ্যেই নিজে নেই। আমাকে দেখেও পলাশ চিনতে পারল না! মানছি দুজনেই বড় হয়ে গেছি। কিন্তু তা বলে চিনতে পারবে না এমন নয়!
আমি অবাক হয়ে শুধু পলাশকেই দেখে যাচ্ছিলাম। আর ও আবার মাথা নিচু করে দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে জিনিস কিনে আমার দিকে না তাকিয়েই দোকান থেকে বেড়িয়ে গেলো। যেন আমাকে চেনে না এমন ভাব! নিশ্চয়ই পলাশের কিছু হয়েছে। না হলে ও এরকম ব্যবহার কেন করবে? না খোঁজ নিতেই হবে। দেখি কালই যাবো ওর বাড়ী। কি হয়েছে ওর আমাকে জানতেই হবে।
* * ১৩ * *
পরশু পলাশকে দেখার পর থেকেই মনটা অস্থির হয়ে আছে। কাল হোটেলের একটা ঝামেলার জন্য যেতেই পারিনি। আজ যাবো। বেশী দুর তো নয়। পুরোনো মনাস্ট্রির পথেই পড়ে ওদের বাড়ী। মিনিট তিনেকের দুরত্ব আমাদের বাড়ী থেকে। আসলে কাল বিকেলে একটা লোক এসেছে। আগে থেকে তার বুকিং নেই। ভরা সিজনে ঘর খালিও থাকে না। কিন্তু তার রুম চাই। অন্য হোটেলে যেতে বললেও যাবে না। সে আমাদের হোটেলেই থাকবে টানা সাতদিনের জন্য। সে নাকি কার কাছে শুনে এসেছে আমাদের হোটেলে সার্ভিস ভালো। আর তাকে ঘর না দিলে সে হোটেলের ব্যাড রিভিউ দেবে। কি জ্বালাতন। শেষে তাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে আগামী তিন দিনের জন্য। তারপর ওই ঘর তাকে ছেড়ে দিতে হবে অন্য বুকিং আছে। বদলে অন্য কোনো ঘর খালি হলে তা দেওয়া হবে। পাগল লোক একেবারে। আমি অবশ্য এক ঝলকই দেখেছি। ঘর ঠিক করে বেরোবার সময়। কিরকম জংলী দেখতে। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ, মাথার চুলগুলোও ঝাকড়া ঝাকড়া! চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে কালো লেদার জ্যাকেট, আর ডেনিম জিন্স।
কাল আসতে পারিনি, তাই আজই এসেছি পলাশের খোঁজ নিতে। ওর বাড়ীর দরজায় গিয়ে নক্ করতেই কাকিমা দরজা খুললেন, আর আমায় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন ওমা! সুজাতা! তুই! কত বছর বাদে! আয় আয়। ভেতরে আয়। আমিও হেসে ঢুকলাম ঘরের ভেতরে। পলাশদের বাড়ীটা আমাদের বেশ কটা বাড়ী পরে। ছোট্টো মতন। ওর বাবার জোড়বাঙলোর দিকে একটা দোকান আছে।
পলাশরা নেপালী হলেও কাকীমা আদতে বাঙালী, তাই পরিষ্কার বাংলা বলতে বা বুঝতে পারেন। কাকিমার দৌলতে পলাশও বাংলা শিখেছিলো। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তাই বাংলাতেই বললাম কেমন আছ কাকিমা?
-ভালো আছি রে। এতবছর বাদে মনে পড়ল কাকিমার কথা?
-না না কাকিমা। তা নয়। আসলে এখন তো কলকাতায় থাকি। এখানে ছুটি ছাড়া আসা হয় না। আর এলেও বাবা আর ভাইয়ের সাথে সময় কাটাতে কাটাতেই সময় ফুরিয়ে যায়!
-হাহাহাহা! জানি জানি। শুনেছি তুই কলকাতায় চাকরী করিস। তারপর বল কেমন আছিস?
-ভালো আছি কাকিমা। বলছি একটা প্রশ্ন ছিলো।
-হ্যাঁ রে বল না। বাব্বা খুব বড় হয়ে গেছিস না? কাকিমার কাছে কথা বলতে সংকোচ করছিস। বকব এবার। বল কি বলবি।
-কাকিমা পরশু পলাশকে দেখলাম। কিন্তু ওকে দেখে আমার কিরকম লাগল। ও আমাকে চিনতেও পারল না। ও কেমন আছে?
এবার দেখলাম কাকিমার উজ্জ্বল মুখটা হঠাৎই কেমন শুকিয়ে গেলো। চোখ দুটো আপনিই নীচে নেমে গেলো আর বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কাকিমাকে ওরকম দেখে আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লাম। কি হয়েছে কাকিমা? ও ঠিক আছে তো? এবার কাকিমা মাথাটা অল্প তুলে বলল জানি না রে। আজ একসপ্তাহ হলো এসেছে। চুপ করে নিজের ঘরে বসে থাকে। কি হয়েছে কিছু বলে না। এরপরই কাকিমা হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরে বলে উঠলেন তুই তো ওর বন্ধু হোস। দেখ না রে ওর সাথে কথা বলে। যদি তোকে বলে কিছু। ও ছাড়া যে আমাদের বুড়ো বয়সের অবলম্বন আর কেউ নেই। কাকিমাকে এরকম করতে দেখে আমারও খারাপ লাগছিলো। তাই আমি কাকিমাকে আস্বস্ত করে বললাম, চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি। ওর সাথে কথা বলছি। ও কোথায় এখন?
-ওই তো ওর ঘরেই আছে। যা না যা!
আমি মাথা নেড়ে উঠে পড়লাম। আর পলাশের ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরটা বড্ড অন্ধকার করে রেখেছে ছেলেটা। আমি ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই ও নিজের মাতৃভাষাতে চিৎকার করে উঠলো, আমা, লাইট বন্দ। (মা আলো বন্ধ করো) দরজার দিকে পিছন করে বসে আছে ও তাই আমাকে দেখতে পায় নি। কাকিমা এসেছে ভেবেছে। আমি আস্তে করে বললাম আলো বন্ধ করলেই কি তোর সব সমস্যা মিটে যাবে? এবার ও আমার দিকে চমকে তাকিয়ে বলল কো হো? (কে?) তারপর খানিকপরে আমাকে চিনতে পেরে পরিষ্কার বাংলায় বলল সুজাতা! তুই এখানে? আমি এবার হেঁসে বললাম চিনতে পেরেছিস তাহলে। সেদিন তো সামনে থেকেও চিনতে পারিস নি।
ও আমাকে দেখে কোনো রকম উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে বলল আয় বোস।
আমি ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর বললাম কি ব্যাপার রে তোর? কি হয়েছে?
-কিছু না।
-ছোটোবেলার বন্ধু আমরা। তোর কি মনে হয় মিথ্যে বললে আমি ধরতে পারবো না?
-দেখ আমাকে আমার মত ছেড়ে দে। তুই যা।
-আর তুই বাজে না বকে বল তোর কি হয়েছে?
-আমার কি হয়েছে জেনে তোর কোনো লাভ নেই।
-সেটা আমি বুঝবো। তুই বল।
-সুজাতা তুই চলে যা এখান থেকে।
-আমার জেদ বোধহয় তুই ভুলে গেছিস। যতক্ষণ না তুই বলবি আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না।
আমি এটা বলার পর পলাশ খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দরজার দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল বেশ। বলবো। তবে এখানে নয়। বাইরে কোথাও চল। আমিও রাজী হয়ে গেলাম। বললাম চল মনাস্ট্রির দিক থেকে হেঁটে আসি। ও আমার কথায় সম্মতি জানালো। আমরাও বেড়িয়ে পড়লাম। পলাশের কাহিনী শুনতে।
* * ১৪ * *
সিনেমাটা রিলিজের পর একমাসের ছুটি। তাই ছুটলাম নিউটাউনে। বাবা মার কাছে। আর আমার সুজাতার কাছে। কিন্তু গিয়ে দুদিন কেটে গেলো ম্যাডামের পাত্তা নেই। কতভাবে চেষ্টা করলাম মহারাণীর দর্শন পাবার। কিন্তু সব বিফলে গেলো। তিন দিনের দিন কি মনে হল বিকালে স্যোসাইটির ছাদে গেলাম। মায়ের কাছে শুনেছিলাম বিকালে স্যোসাইটির বেশীরভাগ মহিলা ও মেয়েরা এই ছাদেই আড্ডা জমায়। আমিও হাজির হলাম। কিন্তু পৌছনো মাত্রই মহিলারা ছেঁকে ধরলেন। অতি কষ্টে তাদের হাত থেকে নিজেকে যখন নীচে নামতে যাবো দেখলাম সমর্পিতাকে। ও-ও আমার ফ্যান। অনেক বার এসেছে আমার কাছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওকে আমার দরকার অনেক বেশী। কারণ আমি জানি ও সুজাতার বোন। সুজাতার খবর ওই দেবে আমায়। এবার যেচেই ওর সাথে আলাপ করতে গেলাম। প্রথমে তো রজতকুমার ওর সাথে আলাপ করতে এসেছে বলে ও গদগদ হয়ে গেলো। কিন্তু সটান সুজাতার খবর জিজ্ঞেস করলে সন্দেহ করতে পারে তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একথা-সেকথা বলে, সমর্পিতাকে বোন পাতিয়ে, অনেক কষ্টে সুজাতা সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশন বার করলাম। যার সারসংক্ষেপ হল এই যে-
ম্যাডামের বাড়ী দার্জিলিং জেলার ঘুম-এ। এখানে পড়তে এসেছিলো। এখন একটা স্কুলে পড়ায়। স্কুলে এখন গরমের ছুটি পড়ে গেছে তাই পাঁচদিন আগেই ম্যাডাম বাড়ী চলে গেছেন। আমারও পোড়া কপাল। কিন্তু না। রজত মিত্র তো ভাগ্যের ভরসায় বসে থাকে না। তাই সেদিনই ঠিক করে নিলাম আমি যাবো ঘুম-এ। সমর্পিতার থেকে জেনেছি সুজাতার বাবার হোটেল এর ব্যবসা আছে দার্জিলিং-এ। নাম ঠিকানা জেনে নিয়েছি এই বলে যে অনেক সময় শ্যুটিং করতে নর্থ বেঙ্গল বা দার্জিলিং চত্বরে যেতে হয়। পরিচিতের হোটেল থাকলে সেখানে উঠতে পারবো পুরো ইউনিটকে নিয়ে। বোকা মেয়েটা ঢপটা গিলেও নিয়েছে। সুজাতার বাড়ীর এড্রেসটাও জানতে চাইছিলাম। কিন্তু সেটা সম্পূর্ন বলে নি। শুধু বলেছে ঘুম স্টেশন থেকে মিনিট দশেক হাঁটা পথে পুরোনো ঘুম মনাস্ট্রির দিকে ওদের বাড়ী। এইটুকুই সই। বাকিটা আমি নিজে খুঁজে নেবো।
ছাদ থেকে নেমে এসেই গুগলে সার্চ করে সুজাতার বাবার হোটেলের লোকেশন ও ডিটেইলস বার করে নিলাম। কালই বেরিয়ে যাবো নর্থ বেঙ্গল। মাকে বাবাকে বললাম সে কথা। মা একটু আপত্তি করছিলো। কিন্তু বাবাই সহায় হয়ে বলল আচ্ছা ঘুরতে যেতে চাইছে যাক না। বাবার সাপোর্ট থাকায় মা কোণঠাসা। আর বারণ করতে পারল না। বাবা মায়ের পারমিশন নিয়ে ফ্লাইটের টিকিটটা কেটেই নিলাম। এখন আমার ভরা সিজন ওখানে। সুজাতাদের হোটেলেই উঠবো, সে যত ভিড়ই থাকুক। তবে ছদ্মবেশে। যাতে মহারানী কেন, কেউই চিনতে না পারে।
(চলবে)