ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৪
* * ৯ * *
পরদিন সকালে ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা। যে পাপাইকে সকালে স্কুল পাঠানোর জন্য আমাকে আর পিসিকে ডেকে ডেকে আলা হতে হয় সেই পাপাই আজ সবার আগে ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে শুরু করে দিয়েছে। প্রিয় হিরোর বাড়ী যাবে বলে কথা। পাগলীটা পারেও বটে।
যাই হোক্! যথা সময়ে আমরা তৈরী হয়ে পৌছে গেলাম জয়তি আন্টি, থুড়ি পাপাইয়ের কথায় সুপারস্টার রজতকুমারের বাড়ী। ওখানে পৌছতেই আন্টি তো আমাদের সাদরে নিয়ে গেলেন ঘরে। কে বলবে যে কালই পিসির আর ওনার আলাপ হয়েছে। এমন ভাব করছে যেন কতযুগের চেনা দুজনে। তখনও পুরোহিত আসে নি, তাই আন্টি একা হাতে জোগাড় করছে দেখে পিসি এবং স্যোসাইটির আরো দুজন মহিলা মিলে ওনাকে সাহায্য করতে বসে গেলো। রমেন আঙ্কেলও এটা-ওটা-সেটা এনে দিয়ে হেল্প করছেন। পাপাই তো তার সমবয়সী দু-একজন বন্ধুকে পেয়ে গপ্পো জুড়ে দিয়েছে। যদিও ওই সুপারস্টারকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। অবশ্য তাকে দেখে আমার লাভও নেই। একে তো আমি সিনেমার ভক্ত নই, তার ওপর এরা সব বড়সড় লোকজন। আমি এখানে অন্য গাছের ফুল। তাই চুপচাপ একটা কোণে দাঁড়িয়ে পুজোর জোগাড় দেখছিলাম। আমার পেছনেই একটা বন্ধ দরজা আছে। ওটাতেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমিই বোকা! বন্ধ দরজা যে আচমকা খুলতে পারে এটা আমার আগে মনে রাখা উচিৎ ছিলো। মনে রাখি নি, তাই তার খেসারৎ দিতেই হল। আচমকা দরজাটা খুলে গেলো আর আমি টাল সামলাতে না পেরে পড়লাম উল্টে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠেছিলাম। কিন্তু কি হলো এটা!? আমার কোথাও লাগলো না কেন? এটা মনে হতেই এক চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম। আর যা দেখলাম তাতে আমার সেই মুহুর্তে একটাই কথা মনে হলো। “হে ধরনী দ্বিধা হও। আমি তোমাতে প্রবেশ করি।” পড়বি তো পড় ওই রজতকুমারের ঘাড়ে? কোনো রকমে সামলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। দুজনেই অপ্রস্তুতে পড়ে গেছি। আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গিয়ে ঘরের অন্য কোনে দাঁড়ালাম। রজতকুমারও দ্রুত বেড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। আমার চিৎকারে সবাই চমকে উঠেছিলো। জয়তি আন্টি আমার দিকে এসে জিজ্ঞেস করল ঠিক আছো তো? লাগেনি তো তোমার? আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। মাথা নেড়ে জানালাম না। পিসিও একটু ধমক দিয়ে বলল কোথায় দাঁড়াচ্ছিস দেখে দাঁড়াতে পারিস না? আন্টি সেটা শুনে বলল আরে আরে এতে ওর কি দোষ। ও বুঝতে পারে নি দরজা খুলে যাবে হঠাৎ করে। ঠিক আছে তুমি এখানে বোসো তো। এসো। বলে আমাকে নিয়ে পুজোর জায়গায় নিজের পাশে বসালেন।
যথাসময়ে পুজো শেষ হলো। এবার প্রসাদ বিতরণের পালা। আন্টি সবাইকে প্রসাদ সিন্নি দিতে বললেন আমাকে আর পাপাইদের দলটাকে।আমরা স্যোসাইটির কাকু জেঠুদের সবাইকে প্রসাদ দিচ্ছিলাম। রজতকুমারও ওখানেই দাঁড়িয়েছিলেন। আমি প্রসাদের থালা নিয়ে ওনার দিকেই একে একে এগোচ্ছিলাম। ওনার কাছে আসতেই উনি ওখান থেকে বেড়িয়ে চলে গেলেন। ইশ! ওই ঘটনায় নিশ্চয়ই উনি আমাকে গায়ে পড়া মেয়ে ভেবেছেন। ছি ছি ছি ছি! কেন যে ওখানে দাঁড়াতে গেলাম। আমিও আর ওখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারিনি। প্রসাদ বিতরণ শেষ হতেই আমি আমাদের ফ্ল্যাটে ফিরে চলে এসেছি।
* * ১০ * *
সকাল থেকে ওয়েট করছিলাম কখন সুজাতা আসবে তার জন্য। কিন্তু পুরোহিত আসার আগে স্নান সারার জন্য মা তাড়া দেওয়ায় বাধ্য হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা দিতে হয়েছিলো। তাতে যে এমন শাপে বর হবে ভাবতে পারিনি। স্নান সেরে মায়ের বের করে রাখা জামা প্যান্ট পরে দরজা খুলে বেরোতেই একজন কেউ হুমড়ি খেয়ে আমার ঘাড়ে পড়ল। আফটার শক কাটিয়ে ভালো করে দেখতেই বুঝলাম এ যে মহারানী স্বয়ং! ভয়েতে বেচারী চোখটা বন্ধ করে ছিলো। প্রথম ভয়টা কাটিয়ে চোখটা খুলতেই আমার দিকে বড় বড় চোখ করে এমন তাকিয়েছিলো, যে আবার ওই চোখে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ওই-ই তাড়াতাড়ি উঠে ছিটকে সরে গেলো ঘরের অন্য কোণে। যেন আমি কোনো অচ্ছুৎ। আমাকে ছুঁয়ে ফেলেছে ভুল করছ তাই ছিটকে সরে গেলো। এরকম করার কি আছে? আমার ঘাড়েই তো পড়েছে। অন্য কারোর তো নয়। যাকগে হয়ত লজ্জা পাচ্ছে। আচমকা তো। তাই আমিও আর ওখানে দাঁড়াইনি। সরে গেলাম ওর চোখের সামনে থেকে।
তবে পুজোর সময় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে ভালো করে দেখছিলাম। লাল সাদা রঙের চুড়িদার আর কোমর অবধি লম্বা বিনুনী। একদম সাদামাটা দেখতে। কিন্তু ওর এই অতি সাধারণত্বেই যে আকর্ষণ আছে আমি হাজার চাইলেও তা উপেক্ষা করতে পারছি না। ওর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি, পদক্ষেপ আমার মনে আলোড়ন তুলছে। আমি কি ওর প্রেমে পড়ছি?
পুজো শেষ হতেই মা ওদের সবাইকে প্রসাদ দিতে বলল। মহারাণী প্রসাদের থালা হাতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছিলো একে একে সবাইকে প্রসাদ দিতে দিতে। আমার মাথায় তখনই একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। একটা ছোট্টো বদলা নেওয়ার। সেদিন আমাকে ইগনোর করে চলে গেছিলো না? আজ আমি ওকে ইগনোর করে চলে যাবো। দেখাবো কেমন লাগে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। যেই আমাকে প্রসাদ দিতে ও এলো আমিও ওকে দেখেও না দেখার ভান করে সুড়ুৎ করে ওখান থেকে কেটে পড়লাম নিজের ঘরে। বোঝো এবার। রজত মিত্রকে এড়িয়ে যাবার ফল।
আমি ভেবেছিলাম ওকে মা হয়ত আমার ঘরেই পাঠাবে প্রসাদ দিতে। কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেলেও ও এলো না। কি হলো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে আমার মনেও অস্থির লাগছে। আদৌ আসবে তো ম্যাডাম? একঘন্টা মত কেটে গেলেও কেউই যখন এলো না। তখন বাধ্য হয়েই নিজেই বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে। কিন্তু ওমা! কোথায় কি? ওরা কেউই তো নেই। শুধু মা বাবা আর দু একজন আছে। মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বাকীরা সব কোথায় মা? তার উত্তরে মা বলল সব তো যে যার বাড়ী চলে গেছে। কেন? তোর কি কাউকে দরকার ছিলো? এই রে! আবার কেস খেয়েছি। তাড়াতাড়ী না না করতে করতে আবার ঘরে এসে সিঁধোলাম।
* * ১১ * *
পুজোর পরের দিনই আমি আমার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছি। কতদিন আর শ্যুটিং ফেলে রাখবো। তাই কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করতেই হলো। তারপরের তিনমাস যে কোথা দিয়ে ঝড়ের মত চলে গেলো টেরও পাই নি। সামনেই গরমের ছুটিতে সিনেমাটা রিলিজ করবে। তারপর আমি নেবো টানা একমাসের ছুটি। এই একটা মাস মা বাবার সাথে কাটাবো। অন্যান্যবার শিলিগুড়ি ছুটি, কিন্তু এবার ডেস্টিনেশন নিউটাউন। কারণ মা বাবাও ওখানে আছে আর সুজাতা ম্যাডামও। আগের বার নিজের মনের কথা নিজের কাছেই পরিষ্কার ছিলো না। কিন্তু গত তিনমাসের প্রতি মুহুর্ত, হাজার ব্যস্ততার মাঝেও ওর মুখ মনে ভেসে ওঠা, ওর কথা মনের মধ্যে বাজা আমাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে আমি সুজাতাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু ও আমাকে ইগনোর করেছিলো বলে, আর নিজেও অতটা সিওর না থাকায় ভালো করে আলাপ জমাতে পারি নি। ওর নাম ছাড়া, ওর ব্যাপারে সেরকম কোনো কথাই আমি জানি না। তাই এবার ঠিক করেই নিয়েছি, ভালো করে ভাব জমাতেই হবে। ওর ব্যাপারে সব কিছু আমাকে জানতেই হবে।
এইকমাসে ওই চোখদুটো যেনো কারণে অকারণেই আমার মনে ভেসে উঠেছে। ওই চোখদুটোকে আমি যে প্রচন্ড পরিমানে মিস করেছি সেটা আর বলে দিতে লাগে না। আর সেদিন ওর আমার ওপর পরে যাওয়ার পর ওর স্পর্শ! সেটাও যে আমি ভুলতে পারছি না। উফ! বারবার মনে হচ্ছে সেদিন ওই সময় এরকম করলে ভালো হতো, ওটা বললে ভালো হতো। মনের মধ্যে সেদিনটার সবকটা ঘটনার পুনর্দৃশ্যায়ণ করে চলেছি এই তিনমাসে। সেদিন ওরকম সামনে থেকে সরে গেছিলাম বলে হয়ত ওর খারাপ লেগেছিলো। তাই হয়ত ও চলে গেছিলো। আমিই বা কি করবো। আমাকে ইগনোর করেছে আমিও বদলা নিয়েছি। ব্যাস!
যাই হোক যা হবার হয়ে গেছে। এবার এই একমাসের ছুটিতে তোমার সব খবর জেনে তোমাকে আমার বন্ধু শুধু নয় একেবারে বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে তোমার মনে আমার জায়গাটা তৈরী করেই আসবো মহারাণী। উফ্! আমার যে আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে কবে যে সিনেমা রিলিজ করবে আর কবে যে আমি সুজাতাকে দেখতে পাবো!
(চলবে)