#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৫ (শেষ পার্ট)
(প্রথম অংশ)
ফোনের শব্দে হৈমীর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো রুদ্র। সাদমান ফোন করেছে রিসিভ করতেই জানালো তাঁর ব্লাডগ্রুপ O নেগেটিভ। অর্থাৎ হৈমীর ব্লাডগ্রুপের সাথে তাঁর ব্লাডগ্রুপ মিলেছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো রুদ্রর। বুকের ওপর থেকে যেনো পাথর সড়ে গেলো তাঁর। সুবর্ণা যখন তাঁকে জানায় হৈমীর ডেলিভারির পর ব্লাডের প্রয়োজন পড়তে পারে৷ তখনি সে তাঁর সকল আত্মীয়,বন্ধু, বান্ধব কে জানায় আর তাঁরা সকলেই তাঁদের ব্লাডগ্রুপ জানায়৷ কারো সাথেই ম্যাচ করছিলোনা৷ এদিকে রক্ত কিনে স্ত্রীর শরীরে প্রবেশ করাবে এতেও সে নারাজ৷ অবশেষে সাদমানেরটাই ম্যাচ করেছে। আল্লাহ তায়ালা কে অনেক অনেক শুকরিয়া জানালো রুদ্র। দুহাতে চোখ মুখ মুছে ফোন করলো সুবর্ণাকে।
” রক্ত কেনাবেচা ইসলামে নিষেধ রয়েছে। ইসলামে কোনো বিনিময় ছাড়া রক্তদান বৈধ, তবে কেনাবেচা অবৈধ। আরব-অনারবের সব আলেমের ঐকমত্যেই মানব অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় হারাম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা মুফতি শফি (রহ.) ‘জাওয়াহিরুল ফিকহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যেহেতু কোনো রকমের কাটাছেঁড়া ছাড়াই রক্তের দেহান্তর সম্ভব, তাই ইসলামে রক্তদান বৈধ। একজন মুসলিম অমুসলিমকেও রক্ত দিতে পারবে। তবে তা বিক্রি করা সম্পূর্ণ হারাম। এর যৌক্তিকতা হলো, রক্ত ও মায়ের দুধ দুটোই শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর দ্রুতই তার অভার পূরণের ব্যবস্থা আল্লাহপাক কুদরতিভাবে মানবদেহে করে রেখেছেন। রোগীর সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে অর্থ ছাড়া রক্ত পাওয়া না গেলে অর্থের বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ করা বৈধ। কিন্তু যে ব্যক্তি এর বিনিময় গ্রহণ করল, সে হারাম গ্রহণ করল”।
আজ যদি রুদ্র বিপদে পড়েও টাকার বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ করতো তাহলে যিনি রক্ত বিক্রয় করতেন তিনিই গুনাহগার হতেন৷ আর একারনেই রুদ্র রক্ত ক্রয় করতে নারাজ ছিলো।
.
পেটে ধরে আস্তে করে ওঠে দাঁড়ালো হৈমী। রুদ্র ফোনে কথা বলা শেষ করে হৈমীকে টেনে কাছে নিয়ে এলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
—- সরি। আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। আজকের দিন অন্তত এমনটা করতে চাইনি আমি৷
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো হৈমী৷ রুদ্র তাঁর দুগালে চেপে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
—- প্লিজ, আমার মাথা ঠিক নেই। অতিরিক্ত টেনশনে আমি ঠিক থাকতে পারছিনা৷
—- আপনি কাঁদছেন কেনো? আমি কাঁদবো আপনি আমাকে মেরেছেন। দেখুন বাবুও কাঁদছে কেমন ব্যাথা হচ্ছে।
কপালে চুমু খেলো রুদ্র। তারপর ঠোঁটের কোনায়ও আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালো৷ এক হাতে পেটের ওপর আলতোভাবে ধরে জিগ্যেস করলো,
—- আজ রাতে আমি তুমি আর ও অনেক গল্প করবো।
রুদ্রর চোখের পানি দুহাতে মুছিয়ে দিয়ে রুদ্রর কপালেও চুমু খেলো হৈমী। তারপর দুগালে, দুহাতে, গলায়ও চুমু খেলো। একজন অপরজনকে আদর করতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। অনেকটা সময় রুদ্র হৈমীকে নিজের বুকে চেপে ধরে ছিলো। হৈমীও চোখ বুজে রুদ্রর বুকের প্রতিটি অশান্ত স্পন্দন শুনেছে।
দুপুর দুটা বেজে গেছে দুজন একে অপরের মাঝে যেনো হারিয়ে গেছে৷ কেউ কোন কথা বলছেনা শুধু অনুভব করছে দুজন দুজনের হৃদয়ের কথাগুলোকে।
—- হৈমী তুমি কিন্তু ভয় পাবেনা জাষ্ট ওরা তোমাকে ভিতরে নিয়ে যাবে বাবুকে বের করেই পেটে সেলাই করে দেবে। তারপর সব ঠিকঠাক। নরমালে রিক্স হবে বলেই কিন্তু সিজার করাচ্ছি। তুমি শুধু ভয় না পেয়ে স্ট্রং থাকবে।
চোখ, মুখ খিচে রুদ্র কে জরিয়ে ধরলো হৈমী৷ কেঁদে দিয়ে বললো,
—- ওরা তো আমার পেট কাটবে অনেক ব্যাথা পাবো আমি, অনেক চিৎকার করবো, অনেক রক্ত বের হবে, আমিতো সেসব সহ্য করতে পারবোনা। আপনি আমার হাতটা ধরে থাকবেন প্লিজ আপনিও সাথে থাকবেন৷ আপনি আমাকে সাহস দেবেন। আপনি ছাড়া আমি যে খুব দূর্বল রুদ্র, খুব দূর্বল।
রুদ্র আরো গভীরভাবে জরিয়ে নিলো হৈমীকে। এবং কথা দিলো সে সাথে থাকবে সুবর্ণা যেহেতু আছে সেহেতু সমস্যা হবেনা৷
.
ডেলিভারি করানোর আগে আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখে নিলো বাচ্চা টা কোন পজিশনে আছে। কিন্তু যা দেখলো এতে বিষম খেলো সুবর্ণা। রিপোর্ট টা যখন রুদ্র দেখলো বিস্ময় নিয়ে তাকালো হৈমীর দিকে। হৈমী তো কেঁদে দেবে প্রায়৷ তাঁর সে কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে মুচকি হাসলো রুদ্র। হৈমীর পাশে গিয়ে বসে তাঁর মা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
—- মা একটু বাইরে যাও আর হ্যাঁ সবাইকে বলো তোমার নাতি-নাতনির নাম ঠিক করতে।
সুরভী বেগম খুশিতে কেঁদেই দিলেন৷ হৈমীও কেঁদে ফেললো। ওদের দুজনকে কেবিনে একা রেখে সকলেই বেরিয়ে গেছে৷ এই সুযোগে রুদ্র দ্রুত হৈমীর মেক্সি উপরে ওঠিয়ে পেটের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে এক হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
—- এই পিচ্চি পেটে দুদুটো বাবু আছে ভাবা যায়?
—- দুজন মিলে ঝগরা করে বলেই হয়তো আমি এতো ব্যাথা পেয়েছি। নয়না আপুরতো একটা ছিলো তাই কম ব্যাথা পেয়েছে৷
হেসে ফেলে রুদ্র পেটে পরপর দুটো চুমু খেয়ে বলে,
—- মাই প্রিন্স এন্ড প্রিন্সেস তারাতাড়ি বাবার কোলে এসে পড়ো৷
.
কেবিনের বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে আছে। রুদ্রর দাদি আর সুখনীড়ের দাদু আসেনি। বয়স্ক মানুষ তাই তাঁদের নিয়ে আসা হয়নি৷ রুদ্র ভিতরে রয়েছে৷ একজন মহিলা ডক্টর, একজন নার্স আর রুদ্র রয়েছে। হৈমীর বেডের পাশের মোড়ায় বসে আছে রুদ্র। হৈমীর একহাত চেপে ধরে আছে সে। হৈমী তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্রও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইনজেকশন দেওয়াতে তাঁর কোমড় থেকে শুরু করে পা অবদি অবশ রয়েছে। যখন পেট কাটছিলো তখন টের পায় হৈমী কিন্তু তাঁর কোন অনুভূতি কাজ করেনা।
সিজার করানোর ইচ্ছে রুদ্রর ছিলোনা কিন্তু হৈমীর শারীরিক কন্ডিশন দেখে সিজার না করে উপায় ছিলো না। জরুরি অবস্থা বলে একটা কথা আছে। সুতরাং একান্ত অপারগতাবশত সিজার করতে কোনো সমস্যা নেই। অর্থাৎ যখন বাচ্চা বা মায়ের জীবননাশের বা বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কা হয় এবং কোনো বিজ্ঞ চিকিৎসক সিজার করাতে বলেন, তখন সিজার করানো যাবে। তবে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হলে সিজার করা জায়েজ নেই। কোনো চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে সিজার করাতে বাধ্য করলে তারা অবশ্যই গুনাহগার হবেন। দুনিয়াবি দিক থেকেও এটা মারাত্মক অপরাধ।
রুদ্র যখন এ বিষয়ে সুবর্ণার সাথে কথা বলে তখন সুবর্ণা জানায় হৈমীর শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে খুব দূর্বল। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায়ই যে ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে দুবার সে কি করে প্রসব বেদনা সহ্য করবে? তাই হৈমীর সিজার করানোই উচিত। সে যেহেতু একজন ডক্টর তাই রুদ্র কে দুটি উদাহরণ দেয় যে কন্ডিশনে নরমাল ডেলিভারি করানো উচিত নয়। এক; গর্ভস্হ শিশুর মাথার আয়তন যদি প্রসব রাস্তার চেয়ে বড় হয়৷ তখন সিজার করা ছাড়া উপায় থাকেনা৷ কারন যদি এই মূহুর্তে আপনি সিজার না করান তাহলে মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।তাই নয়মাসের সময় বাচ্চার মাথার সাইজ বা ডক্টরের সাথে কথা বলে নিতে হয় সিজারের দরকার হবে কিনা। দুই; যদি গর্ভবতী মা স্বাভাবিকের চেয়ে দূর্বল হয়ে থাকেন। তাহলে নরমাল ডেলিভারিতে না যাওয়াই ভালো। কারণ বাচ্চা প্রসবের সময় যে ব্যাথা বা যন্ত্রণা হবে সেটা সহ্য করার শক্তি যদি না থাকে তাহলে সিজার করিয়ে নেওয়াই ভালো। এ বিষয়ে আগেই ডক্টরের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।
দ্বিতীয় রিজনের জন্যই হৈমীর সিজার করার সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্র এবং সুবর্ণা৷
.
আল্লাহর অশেষ রহমতে এক কন্যা এবং এক পুএ সন্তানের জনক,জননী হয় রুদ্র, হৈমী। আল্লাহ তায়ালার রহমত, রুদ্রর মনোবল, নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা,এবং সমস্ত সচেতনতা অবলম্বনের ফলে জয় হয় দুজন মানুষের পবিএ ভালোবাসার। রুদ্রর সন্তানদের মা হয় হৈমী, হৈমীর সন্তানদের বাবা হয় রুদ্র।
কিন্তু বিপদ ঘটে কন্যা সন্তান কে নিয়ে। পুএ সন্তান কান্না করলেও কন্যা সন্তান কাঁদেনি। তবে প্রাণ আছে। পুএ সন্তানের শারিরীক সুস্থতা নিশ্চিত করলেও কন্যা সন্তান না কাঁদায় ডক্টর এবং নার্স চিন্তিত হয়ে পড়লেন৷ কিন্তু রুদ্রর মুখে কোন চিন্তার ছাপ দেখা গেলো না। তাঁর সন্তান দের দেহে প্রান আছে এতেই উপরওয়ালা কে শুকরিয়া জানাচ্ছে সে। ডক্টর কন্যা সন্তান কে উল্টে পাল্টে দেখছে যাতে কান্না করে সে চেষ্টা করছে। মেয়েটা কাঁদলো প্রায় নয় মিনিট পর৷ খুশিতে চোখে পানি এসে গেলো রুদ্রর৷ ডক্টর এবং নার্সরাও আলহামদুলিল্লাহ বলে বাচ্চা দুটোকে একসাথে বাবার কোলে দিলো।
.
রাত আটটা বাজে। হৈমীর পাশে বসে আছে রুদ্র।সুরভী বেগমের কোলে রয়েছে রুদ্রিক, রুদ্র এবং হৈমীর একমাএ ছেলে রুদ্রিক শেখ। রেদওয়ান শেখের কোলে রয়েছে রুদবা রুদ্র এবং হৈমীর একমাএ মেয়ে রুদবা শেখ।
রুদ্রিক মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কান্না করলেও রুদবাকে সেই একবারই কাঁদতে শুনেছে সবাই। ডক্টর বলেছে রুদবা একটু দুর্বল এটা তেমন কোন সমস্যা নয়৷ জমজ সন্তান হলে একটা আরেকটার থেকে একটু দূর্বল হয়ই।
বাচ্চা দের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে হৈমী। ডেলিভারির পর তাঁকে কথা বলতে দেখা যায়নি। শুধু রুদ্রিক আর রুদবাকে যখন রুদ্র তাঁর কাছে নিয়ে আসে মৃদু হেসেছিলো সে। তৃপ্তি ভরে চেয়েছিলো তাঁর সন্তানদের দিকে। মনে মনে আওড়িয়ে ছিলো আমার বাবা,মা কে একসাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা৷ কে বলে উপরওয়ালা শুধু কেড়ে নেয়? যা কেড়ে নেয় তা দ্বিগুণ করে যে ফিরিয়ে দেয় সেটা কি মানুষরা বুঝেনা? আমি আমার বাবা,মা কে আমার সর্বস্ব দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবো। উপরওয়ালার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার আমার সন্তানরা৷ আমি মা এরা আমার সন্তান, এরা আমাদের সন্তান, আমার আর রুদ্রর সন্তান ভেবেই সুখের অশ্রু বিসর্জন দেয়।
.
একে একে প্রায় সবাই ফিরে যায়। রুদ্র, সুরভী বেগম, মনিকা বেগম আর সূচনা রয়েছে শুধু। নয়ন থাকতে চেয়েছিলো, সে বাচ্চাদের রেখে যেতেই চাইছিলো না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছে বলা হয়েছে সকাল সকালই আবার এসে পড়তে।
.
রুদ্রিক রাত দশটা থেকে কাঁদতে শুরু করেছে থামার নাম নেই। রুদবা হৈমীর বুকেই ঘুমিয়ে আছে৷ কিন্তু রুদ্রিক ঘুমাচ্ছে না সে কেঁদেই চলেছে। একবার সুরভী বেগম একবার রুদ্র তাঁকে কোলে করে পুরো রুম ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপায় না পেয়ে সুরভী বেগম রুদবাকে কোলে নিয়ে রুদ্রিক কে হৈমীর কাছে দিতে বললো৷ রুদ্র তাই করলো৷ সুরভী বেগম আবারো ছেলেকে ফিডিং করাতে বললো। রুদ্র হেল্প করলো হৈমীকে৷ কিন্তু রুদ্রিক কান্নায় ব্যাস্ত৷ খাচ্ছে না বলে হৈমীও কেঁদে দিলো বললো,
—- ও এমন কাঁদে কেনো? আমরা কি ওকে বকেছি নাকি কতো ভালোবাসছি সবাই তবুও কেঁদেই যাচ্ছে।
রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
—- মায়ের ছেলে মায়ের মতোন হতে হবেনা? মা রেডিও, ক্যাসেট জুরে বসে আর ছেলে ব্যান্ড বাজাচ্ছে।
#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৫ (শেষ পার্ট)
(২য় অংশ)
.
আজ সূচনার জন্মদিন। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন তাঁর। অথচ,অফিসের কাজে এতোই বিজি ছিলো মাহের যে গিফ্ট কেনার সময়ই পায়নি৷ ভেবেছিলো বাড়ি ফেরার পথে কিনবে৷ কিন্তু এমন ঝড়, বৃষ্টি শুরু হলো যে সেই উপায়ও রইলো না৷ মুড অফ করে বাড়ি ফেরে সে। ফ্রেশ হয়ে দুজন একসাথে খেয়ে নেয়। রাত তখন দশটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। বৃষ্টি থেমে গেছে চারদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে শুধু। সূচনা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় মাহের তাঁর গিটার বের করে সূচনাকে বললো তাঁকে অনুসরণ করতে। সূচনা মাথার ওড়নাটা ভালোভাবে চাপিয়ে নিলো। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো মাহেরের পিছু পিছু৷
বৃষ্টির পর আকাশটা ভীষণ স্বচ্ছ। পুরো আকাশ জুরে তাঁরাদের মেলা বসেছে যেনো। আকাশের দিকে চেয়েই মনটা ভালো হয়ে গেলো সূচনার৷ ছাদের বর্ডারে কোমড় ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সে। মাহের বর্ডারের ওপর বসলো। সূচনার দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
—- সরি আসার সময় এতো বৃষ্টি ছিলো যে দাঁড়ানো উপায় ছিলোনা। রাস্তার কি খারাপ অবস্থা হয় বৃষ্টির সময় বোঝোইতো বাইক নিয়ে আসতেই বেশ হিমশিম খেয়েছি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আজকের টা কাল পুষিয়ে দিবো।
—- ছিঃ ছিঃ এভাবে বলছো কেনো? গিফ্টটাই কি সব? এতো সুন্দর রাত এতো সুন্দর সময়টা কি কিছুই নয়? প্রকৃতির স্নিগ্ধ অনুভূতি পাওয়ার থেকে বড় কোন পাওয়া হতে পারেনা। তাছাড়া আমার জীবনে তুমিই সবথেকে বড় এবং স্পেশাল গিফ্ট।
একহাতে কাছে টেনে নিলো সূচনাকে পিছনদিক ঘুরিয়ে কোমড় জরিয়ে একদম কোলে বসিয়ে দিলো। নিজের থুতনিটা সূচনার কাঁধে রেখে গিটার সামনে ধরে বাজাতে শুরু করলো, টুংটাং শব্দে গাইতেও শুরু করলো,
“এ নীল ধ্রুব তাঁরা এ স্বপ্ন দিশাহারা এ রাত জেগে লেখা কবিতা, এ নীল ধ্রুব তাঁরা এ স্বপ্ন দিশাহারা এ রাত জেগে লেখা কবিতা।
আজ এই শুভ দিনের উপহারে, আজ এই শুভ দিনের উপহারে দিলাম তোমায়, অন্য কিছু নেই জানা শুধু শুভ কামনা সুরে সুরে গানেরই ভাষায়,অন্য কিছু নেই জানা শুধু শুভ কামনা সুরে সুরে গানেরই ভাষায়…
ইদানীং মাহেরের এমন মধুর কন্ঠস্বরে নেশা ধরে যায় সূচনার৷ চারদিকে মৃদু বাতাস বইছে। ওদের দুজনকে ছুঁয়ে দিচ্ছে খুব করে৷ দুজনই যেনো চলে গেছে অন্যরকম এক সুখের জগতে। দুজনেই দুজনকে আরো গভীরভাবে চাইছে। চরিদিকের পাগল করা হাওয়ায় মাহেরের সুরের নেশায় যেনো মাতাল মন।
.
পুরো দুমাস রুদ্র কাজের থেকেও হৈমীকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশী৷ নতুন বাড়ি সুখরাজ্যে ওঠেছে হসপিটাল থেকে ফিরেই। বাচ্চাদের বয়স দুমাস৷ কিন্তু বাচ্চা দের ঠিকভাবে এখনো কোলে নিতে পারেনা হৈমী৷ সুরভী বেগম, নয়ন,নয়না, সূচনা সকলেই এসে মাঝে মাঝে থেকে যায়। সুখনীড়ের অনেক মেয়েরাই বাচ্চা দের সারাদিন রাখে। খাওয়ার সময়টা হৈমী রাখে। গোসল করায় সুরভী বেগম। রাতে রুদ্র সামলায়। হৈমীর শরীরের অবস্থা ভালো যায় না। নরমাল ডেলিভারি হলে হয়তো এতোটা ভোগান্তি হতোনা৷ সিজারে ডেলিভারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আছে অনেক ক্ষতিকর দিক। শুধু প্রসবের সময়েই নয়, সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে সারাজীবন একজন মাকে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হয়। মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য সিজার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সিজার করে বাচ্চা নেওয়া মানে প্রতিটি মা কে পঙ্গুত্ব বরন করে নেওয়া। একজন মা ই পারে নিজের জীবনের পরোয়া না করে সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখাতে। মায়েরা বড্ড লোভী হয় সন্তান লোভ তাঁরা কখনোই সামলাতে পারেনা৷
.
চারমাস চলছে। রুদ্র আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না। তাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে। যেতে হবে চট্রগ্রাম। সুরভী বেগম অসুস্থ থাকায় আসতে পারেনি। সুখনীড় থেকে এলা আর পরী এসেছে হৈমীর সাথে থাকতে। রুদবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে হৈমী৷ রুদ্রিক কান্না করছিলো বলে এলা তাঁকে নিয়ে বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করছে৷ ছেলেটার মধ্যে যেনো একটুও স্বস্তি নেই। বসে বা শুয়ে থাকা যেনো তাঁর লিষ্টে নেই। সারাদিন কোলে চড়ে ঘুরলে একদম শান্ত যেই বসবে অমনি কান্না শুরু করে দেয়। বড় হয়ে কি জ্বালানোটাই যে জ্বালাবে ভাবলেই ভয়ে ঢোক গিলে হৈমী।
পরীও ঘুমিয়ে গেছে রুদবার পাশে৷ ফোন নিয়ে রুদ্রকে কল দেয় হৈমী। কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিয়ে এলাকে জিগ্যেস করে রুদ্রিক ঘুমিয়েছে কিনা৷ বিনিময়ে রুদ্রিক মায়ের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঠোঁট উঁচু করে কেঁদে দেয়। হেসে ফেলে হৈমী রুদ্রিক কে কোলে নিয়ে কয়েকটা চুমু খায় গালে৷ তারপর এলাকে শুয়ে পড়তে বলে। তাঁদের বিছানাটা বেশ বড় হওয়াতে একসাথেই শুয়ে পড়ে সবাই৷ রুদ্রিকের চোখে ঘুম নেই হয়তো বাবাকে খুঁজছে কিন্তু আজ তো বাবা আসবেনা৷ বুকে নিয়ে শুয়ে পড়তেই হাত,পা ছোড়াছুড়ি করে কাঁদতে থাকে। ছোট্ট পায়ের কয়েকটা লাথি লাগে হৈমীর তল পেটে৷ পেট চেপে ওমাগো বলেই কুকিয়ে ওঠে সে। এলা ভয় পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে। রুদ্রিককে কোলে নিয়ে নেয় সে৷ হৈমী নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বলে,
—- এলা বোন আমার ও বোধহয় এখুনি ঘুমাবেনা। তুমি আরেকটু বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করো আমি বাথরুম থেকে আসছি।
এলা চলে যেতেই পেট চেপে ধরে ওঠে দাঁড়ায় হৈমী৷ সারাদিন বেল্ট পড়া থাকলেও রাতটা বেল্ট ছাড়া ঘুমায় সে। বেল্ট পড়া থাকলে হয়তো এতোটা লাগতো না। সিজারিয়ান অপারেশনের পর থেকেই সেলাইয়ের স্থানে হঠাৎ হঠাৎ অল্প জ্বালাপোড়া করে। চারমাস হলেও তাঁর বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে ডক্টর বলেছে সতর্ক থাকতে সতর্ক না থাকলে সেলাইয়ের স্থানে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। রুদ্র কোন অসতর্কতায় রাখেনি তাঁকে। আজ রুদ্র নেই অথচ ঘটে গেলো অঘটন৷
সব ঠিক আছে। হৈমী ভেবেছিলে হয়তো ব্লিডিং হচ্ছে কিন্তু এমন কিছু নয়৷ তবে আঘাতটা ভিতরে লেগেছে। রুদ্র কে ফোন করে জানাতেই কয়েকটা বকা দিয়ে ফোন রেখে দিলো। মনটা তাঁর খারাপ হয়ে গেলো ভীষণ। তাঁর কি দোষ ছেলেটা যে বড্ড পাজি ।
অনেক সময় ফিডিং করানোর পর ঘুমালো রুদ্রিক। রাত দুটোর সময় রুদ্র ফোন করে বাচ্চা দের খোঁজ নিয়ে,তাঁর খোঁজ নিয়ে ফোন রেখে দেয়। জানায় সকাল দশটার মধ্যে ফিরে আসবে।
.
কেটে গেছে দীর্ঘ একটা সময়। তিনদিন পর ঈদ। বাচ্চা দের নিয়ে ঈদ কাটাতে শেখ বাড়ি এসেছে রুদ্র, হৈমী৷ মাহের, সূচনার মেয়ে মিশকাত বয়স তিন বছর। বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সে। নয়নার মেয়ে রাফসার বয়স সাড়ে পাঁচ, রুদ্রিক আর রুদবার বয়স পাঁচ বছর। বাচ্চারা সবাই একসাথে হয়ে ভীষণ খুশি। সূচনা এসেছে একদিনের জন্য। পুরো বাড়ি জুরে বাচ্চাদের কলরব। জামাকাপড় গুছিয়ে হৈমী রুদ্র কে বললো,
—- তুমি শুধু কাজেই মনযোগ দিয়ে রেখো না৷ রুদ্রিকের দিকে একটু নজর রেখো। ছেলেটা খুব পাজি হয়েছে সারাদিন দুষ্টামি করবে আর ব্যাথা পেয়ে কাঁদবে। মেয়ে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই এই ছেলেটাকে নিয়েই যতো চিন্তা আমার৷
আপনি থেকে তুমিতে এসেছে বাচ্চাদের জন্যই বাচ্চা রা যখন হৈমীকে অনুসরণ করে রুদ্র কে আপনি বলে রুদ্র হৈমীকে সেদিন খুব ধমকায়। এবং থ্রেট করে তাঁর জন্য যদি তাঁর বাচ্চারা বাবাকে আপনি বলে তো খবর আছে৷ সে যেমন বাচ্চা দের তুমি বলবে তেমন বাচ্চারাও যেনো তুমি বলে তুমি হচ্ছে মধুর ডাক, ভালোবাসার ডাক।
—- হুম মেয়েটার স্বভাব যে বাবার মতোন হয়েছে এবং ফিউচারে হবে এটা সবাই টের পেয়েছে তুমি বাদে৷ আর ছেলেটা কার স্বভাব পেয়েছে তা মুখে বলার প্রয়োজন নেই।
চোখ কটমট করে তাকালো হৈমী৷ বাঁকা হেসে রুদ্র বললো,
—- নিচে যাবে ভালো কথা এমন কিছু করোনা যাতে নিজের ক্ষতি হয়।
—- শুনবোনা আপনার কথা। আমি এখনি গিয়ে ভারী ভারী কয়েকটা কাপড় ধুবো।
—- তাই না? ওকে ফাইন যা ইচ্ছে করো। আমার বাচ্চা দের জন্য নতুন মা খুঁজে রাখি আগেই।
হৈমী তেড়ে আসতেই রুদ্র ওঠে দাঁড়ায় দুহাতে আঁকড়ে ধরে তাঁর কাঁধ৷ অপলক চোখে চেয়ে বলে,
—- বাবুর আম্মুকে রাগলে অস্থির লাগে।
লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো হৈমীর। রুদ্র তাঁর কপালে আলতো পরশ দিয়ে বললো,
—- যাও সাবধানে সব করবে।
.
সুরভী বেগম রান্না বসিয়েছে। হৈমী তাঁকে হেল্প করলো বেশ কিছুক্ষণ এক পর্যায়ে তাঁর ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়৷ সুরভী বেগম তাঁকে সোফায় গিয়ে বসে রেষ্ট করতে বলে। হৈমী গিয়ে সোফায় বসতেই রুদ্র নিচে এসে ওভাবে দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সিজার হওয়ার পর থেকে এই মেয়ের সমস্যার শেষ নেই। শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে৷ কাছে গিয়ে কোলে তুলে উপরে ওঠে গেলো। রুমে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। নিজে গিয়েও পাশে শুয়ে পড়লো।
—- এভাবে কেউ নিয়ে আসে কেউ যদি দেখতো?
—- সো হোয়াট আমার বাচ্চার মাকে আমি এভাবে নিয়ে আসবো না তো কে নিয়ে আসবে?
—- জানিনা। কথায় কথায় এই এক কথা ঢং।
রুদবা রুমে ঢুকলো চুপচাপ। রুদবাকে দেখে হৈমী মুচকি হেসে বললো,
—- এই তো আপনার কলিজার টুকরা হাজির৷
রুদ্র চট করে ওঠে গিয়ে রুদবাকে কোলে তুলে নিলো। কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে বিছানায় বসিয়ে জিগ্যেস করলো,
—- আমার মামনিটা কোথায় ছিলো?
রুদবা খানিকটা হাসলো এবং বাবার কপালে চুমু খেলো। ধীর গলায় উত্তর দিলো সে ভাই এবং আপুদের সাথে খেলছিলো।
বাবা,মেয়ের ভালোবাসা দেখে হৈমীর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। বিরবির করে বললো,
—- হায় আমার মেয়েটার এই এক টুকরো হাসি এতোই মূল্যবান যে বাবা ছাড়া কারো কাছে সে হাসে না৷ আমার পেট থেকে এমন গোমড়া মুখো মেয়ে কি করে বের হলো? ছেলেটা একদম আমার আমার লাগে মেয়েটা লাগে রুদ্রর রুদ্রর। অথচ এরা তো শুধু আমার এবং তাঁর না এরা হলো আমাদের।
রুদবা বাবার সাথে ওটা সেটা গল্প করছে। হৈমী ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
—- আমি কি কারো ভালোবাসা পাবো না?
রুদ্র দাঁত বের করে হাসতে লাগলো এবার৷ রুদবা চোখ পিটপিট করে মায়ের কোলে বসলো তারপর কপালে চুমু খেলো৷ হৈমী খুশিতে গদগদ হয়ে তাঁকেও চুমু খেলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বসে রইলো সে৷ রুদ্র ওঠতে নিলে হৈমী প্রশ্ন করলো,
—- আচ্ছা আমি একটা বিষয় লক্ষ করলাম তুমি যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরো সর্বপ্রথম রুদবাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খাও৷ এবং বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গল্প করো। এর মানে কি তুমি রুদবাকে বেশী ভালোবাসো?
মুচকি হাসলে রুদ্র। বললো,
—- আমি তো সব থেকে বেশী ভালোবাসি আমার বাচ্চাদের মা কে। আমার বাচ্চা দেরও সবথেকে বেশী ভালোবাসি৷ তোমরা তিনজনই আমার পৃথিবী হৈমী। কাউকে কারো থেকে কোন অংশে কম ভালোবাসি না৷ তোমরা তিনজন ছাড়া আমি নিঃশ্ব৷
আয়েশা রাঃ বলেছেন – রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাথে স্বভাব,চাল,চলনে সব কিছুই মিলে যায় ফাতিমা রাঃ এর। ফাতিমা রাঃ যখন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ঘরে প্রবেশ করতেন তিনি ফাতিমা রাঃ কে পরম স্নেহে প্রথম কপালে চুমু খেতেন এবং নিজ স্থানে বসাতেন৷
আমিও এক কন্যার জনক আমারো উচিত আমার শ্রেষ্ঠ নবীর সুন্নাত পালন করা।
.
পরেরদিন বিকেলের দিকে সবাই কাজে ব্যাস্ত। বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ নেই। আম গাছে বেশ কাঁচা আম। বহুদিন হয়ে গেলো গাছে ওঠা হয় না৷ কাঁচা আম খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে লুকিয়ে চুরিয়ে বের হয় হৈমী। তাঁর পিছনে রুদ্রিক আর রুদবাও যায়। হৈমী ওদের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ওড়না কোমড়ে গুঁজে গাছে ওঠে। যখনি আম ফেলে তখনি রুদ্রিক হেসে গড়াগড়ি খায়৷ সে খুব মজা পাচ্ছে। রুদবা চুপ করে দাঁড়িয়ে মা কে দেখছে৷ হৈমী রুদবার দিকে চেয়ে বললো,
—- কি সোনামুনি তুমি একটু হাসলে কি পাপ হবে? ভাইকে দেখে একটু হাসিটা রপ্ত করো। তোমার হাসি দেখে আমার কলিজাটা ঠান্ডা করি।
মেয়েকে হাসানোর জন্য নানারকম কান্ড করলো হৈমী। এবং সফলও হলো শব্দ করে না হাসলেও সে হেসেছে। রুদ্রিক রুদবাকে ধাক্কা মেরে বললো,
—- বনু হাসো হাসো।
ফলে রুদবা মাটিতে পড়ে গিয়ে কাঁদতে থাকে। হৈমী তারাতাড়ি করে নামতে গিয়ে পা পিছলে যায় পড়ে। মাটিতে পড়েই সে কি চিৎকার। একদিকে রুদবা কাঁদে, আরেক দিকে হৈমী কাঁদে দুজনের কান্না দেখে রুদ্রিকও কাঁদে।
.
কঠিন চোখ, মুখ নিয়ে বসে আছে রুদ্র। পরিবেশ গরম বুঝে রুদবা আর রুদ্রিক কে খাওয়িয়ে তাঁর রুমেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সুরভী বেগম।
আগের তুলনায় তল পেট ভারী হয়ে গেছে হৈমীর৷ ওভাবে পড়ায় ব্যাথা পেয়েছে খুব৷ রুদ্র এসে সুবর্নাকে সব জানিয়ে মেডিসিন খাওয়িয়ে দিয়েছিলো। যার ফলে আরাম পাচ্ছে এখন। রাগে, ক্ষোপে একটা কথাও বলছে না রুদ্র। বাচ্চা দের জন্য এখন আর গায়ে হাত তুলে না নয়তো আজ থাপড়িয়ে অবস্থা খারাপ করে দিতো। পারিবারিক কোন প্রকার ঝামেলা বিশেষ করে বাবা,মায়ের মন কষাকষি সন্তান দের বুঝতে দিতে চায় না সে। এতে ছোট্ট মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব পড়বে।
রাত গভীর হতে থাকলো তবুও রুদ্র হৈমীর দিকে ফিরেও তাকালো না। হৈমীরও খুব ভয় করছে। ভয়ে ঘুমও আসছেনা৷ একবার ভাবলো রুদবা আর রুদ্রিককে নিয়ে আসি আবার ভাবলো না থাক এতো রাতে ঘুম নষ্ট করা যাবে না ওদের৷ ধীরে ধীরে রুদ্রর পিঠে হাত রাখলো ফলস্বরূপ রুদ্র বিছানা থেকে ওঠে বেলকনিতে চলে গেলো।
এবার যেনো আর চুপ থাকতে পারলোনা হৈমী৷ মিনমিনিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। অনেকসময় নিয়ে সে বেশ গুছিয়ে কাঁদছে। চোখে পানি নেই কিন্তু সে কাঁদছে। আর বিরবির করে বলছে,
—- আমাকে এখন আর কেউ ভালোবাসেনা গো। এখন তো আমি পুরানো হয়ে গেছি৷ এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা৷ কেউ একটু কাছেও আসেনা৷ যতো আদর সব ছেলে,মেয়েদের। অথচ যার জন্য ছেলে,মেয়ে পেলো তাঁর কোন মূল্যায়নই করছে না। আল্লাহ জানে ভিতরে ভিতরে কিছু চলছে কিনা৷ সেদিনই তো নিউজ পড়ছিলাম৷ ঘরে বউ বাচ্চা রেখে স্বামী এক অবিবাহিত মেয়ের সাথে পরোকিয়ায় লিপ্ত। হায় রে আমার বুঝি কপাল পুড়লোরে।
বেশ শব্দ করেই দরজা লাগিয়ে দিলো রুদ্র। বিছানায় গিয়ে ধমকে বললো,
—- থাপড়িয়ে কান গরম করে ফেলবো একদম। মুখে লাগাম লাগিয়ে কথা বলো হৈমী।
হৈমী এগিয়ে গিয়ে রুদ্রর গলা জরিয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,
—- লাগাম ছাড়া কথা না বললে তো কাছেই আসতেন না।
রুদ্র জোর খাটিয়ে ছাড়িয়ে দিলো। বললো,
—- আজ যা করেছো এর শাস্তি কিভাবে দেবো বলতে পারো? এটা কোন মায়ের কাজ? বাচ্চা হয়ে গেছে আমাদের, আমাদের থেকেই তাঁরা শিখবে। আর তুমি তাঁদের বাঁদরামি শেখাচ্ছো? রুদ্রিক যে স্বভাবের কাল যদি ও গাছে ওঠতে যায় কোন এক্সিডেন্ট ঘটায়? মাটিতে পুঁতে ফেলবো একদম বলে দিলাম।
—- সরি আর হবেনা আমি সত্যি এভাবে ভাবিনি। আমি ওকে বলে দিব যাতে এসব করতে না যায়।
লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুদ্র। শুধু রুদ্রিকের জন্য নয় আসল ভয়টা সে হৈমীকে নিয়েই পেয়েছে। এই মেয়েকে আর কতোভাবে বোঝালে সাবধান হবে বুঝে ওঠতে পারেনা রুদ্র।
হৈমী শুয়ে পড়লো। একহাত দিয়ে রুদ্র কে কাছে ডাকতেই রুদ্র সব রাগ দূরে ঠেলে দিয়ে কাছে টেনে নিলো তাঁকে। একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে ভালোবাসার উন্মাদনায় মত্ত হয়ে গেলো। এই একটা মেয়েই তাঁকে ভীষণ ভাবে রাগিয়ে দেয়,ভীষণ ভাবে ভয় পাওয়িয়ে দেয়৷ আবার এই একটা মেয়েই তাঁর সমস্ত রাগ,ভয় দূর করে দেয়। সকল অশান্তি দূরে ঠেলে দিয়ে দেয় মানসিক তৃপ্তি।
.
একে অপরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। রুদ্র হৈমীর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে ওঠে পড়লো। প্রশ্ন করলো কে?
—- রুদ্র আমি, রুদবার ভীষণ জ্বর রুদ্রিকেরও গা গরম হয়ে আসছে। বললো সুরভী বেগম।
—- আচ্ছা রুমে যাও আমি ওদের নিতে আসছি।
সুরভী বেগম চলে যেতেই রুদ্র হৈমীকে ডাকতে শুরু করে। সবেই ঘুমিয়েছে সে। চোখ টেনে তুলতে পারছিলোনা যখনি শুনলো তাঁর ছেলেমেয়েদের জ্বর এক লাফে ওঠে পড়লো৷ দ্রুত দুজন শাওয়ার নিয়ে নিলো রুদ্র রুদবাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়িয়ে দিয়ে রুদ্রিককেও নিয়ে এলো। ছেলে,মেয়ে দুটো জমজ হলেও চেহেরায় তেমন মিল নেই। কিন্তু একজন অসুস্থ হলে তাঁর ঘন্টাখানেকর মধ্যেই আরেকজনেরও সেম অসুখ হবে৷ রুদবাকে বুকে জরিয়ে শুয়ে পড়লো হৈমী৷ মায়ের বুক পেয়ে মায়ের উষ্ণতায় মিশে রইলো সে। রুদ্রিক বরাবরই বাবার বুকে ঘুমায়৷ ঘুমানোর সময় তাঁর ছটফট করার স্বভাব আছে। হৈমীকে অসংখ্যবার তাঁর লাথি খেতে হয়েছে। দুবার তলপেটে ব্লিডিংও হয়েছে। তাই রুদ্র রুদ্রিক কে ঘুমন্ত অবস্থায় হৈমীর কাছে রাখে না। আগে বউয়ের ঘুমন্ত অবস্থায় পাগলামি সহ্য করেছে এখন ছেলের টা সহ্য করতে হয়৷ তবুও ভালো হৈমীর অভ্যেসটা বাচ্চা হওয়ার পর চেঞ্জ হয়েছে নয়তো ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হতো।
রুদ্রিকের কপালে চুমু খেয়ে হৈমীর দিকে ঝুঁকে গিয়ে হৈমীর কপালে আর রুদবার কপালে চুমু খেলো রুদ্র।
হৈমী বললো,
—- ভালোবাসি।
রুদ্রও বললো,
—- ভালোবাসি।
রুদ্রিক আধো আধো গলায় বললো,
—- আমিও ভালোবাসি।
রুদবা সচরাচর কথা বলেনা তেমন জ্বরের ঘোরে সেও বললো,
—- পাপা আমিও ভালোবাসি।
হৈমী রুদ্র হেসে ফেললো। সাত বছর আগে নিজের ভালোবাসায় একজনকে বন্দিনী করেছিলো রুদ্র। উপহারসরূপ পেয়েছে গোটা পৃথিবীকে। তাঁর এ পৃথিবী টায় ভালোবাসা আজীবন অটুট থাকুক। এ কামনাই রইলো।
সমাপ্ত।।