ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ৪২

0
1840

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪২
.
হৈমীর মা হবার কথা শুনে রুদ্রর পর কেউ যদি সবচেয়ে বেশী খুশি হয়ে থাকে সে হলো সুরভী বেগম। রেদওয়ান শেখও প্রচন্ড খুশি হয়েছেন। বাড়িতে দু দুটো বাচ্চা আসবে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। রাদিফ নয়নার সাথে নয়নার বাবার বাড়ি রয়েছে তাঁকেও খবরটা দেওয়া হলো। তাঁরাও খুব খুশি রুদ্রকে ফোন করে কনগ্রেস জানিয়েছে সবাই। নয়ন তো হৈমীর সাথে দেখা করবে বলে সারারাত ঘুমাতেই পারেনি।

ফজরের সময় ওঠে রুদ্র আর হৈমী নামাজ পড়ে নেয়৷ নামাজ শেষে বিছানায় গিয়ে বসে রুদ্র। হৈমী তাঁর কাছে যেতেই কোলে বসিয়ে জরিয়ে নিয়ে জিগ্যেস করে কি খাবে সে? প্রশ্ন শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে হৈমী উত্তর দেয় ‘ফুসকা’।

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে রুদ্র। তা দেখে হৈমী তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,

—- দেখুন আপনি কিন্তু একদম বকাবকি করবেন না বলে দিলাম। বাবুর মা কে বকতে হয়না বেশী বেশী আদর করতে হয়৷ আর যা যা খেতে চায় সব খাওয়াতে হয়।

এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুদ্র। বললো,

—- যাক তোমার ক্যাসেট যে চালু হয়েছে এই অনেক। এ কদিনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।

—- আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।

—- উহুম বাবুর মা কে ভালোবাসছি। বলেই গলায় কিস করলো কয়েকটা। শিউরে ওঠলো হৈমী। দুহাতে খামচে ধরলো রুদ্রর পিঠে। অনেকটা সময় একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করলো।

সকালের খাবার খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো হৈমী। রুদ্র রুমে এসে বললো,

—- বিকেলে যাবো। বাড়ির সবাই কে মিষ্টি মুখ করাতে হবে। ভাবিদের বাড়ি আর সুখনীড়েও মিষ্টি পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ শুক্রবার মসজিদেও মিষ্টি দেবো৷ এবার তুমি ঠিক ভাবে বলো তোমার কি কি খেতে ইচ্ছে করছে।

বিছানায় বসলো রুদ্র। হৈমী চুল খোপা করতে করতে রুদ্রর পাশে গিয়ে বসে বললো,

—- ফুসকা আর আইসক্রিম ছাড়া কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা৷ চকলেট দেখলেই গা গোলায় কেমন।

—- সকাল বিকাল চকলেট খাওয়া লোক কিনা এই কথা বলছে?

—- আমি জানিনা কিছু আমি ফুসকা খাবো।

—- না ফুসকা খাওয়া যাবেনা আর আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।

—- তাহলে আমি না খেয়েই থাকবো। খাওয়াতে হবেনা আপনাকে৷ আমি আর আমার বাবু না খেয়েই বড় হবো হুমহ। রাগে গটগট করতে করতে বিছানা থেকে ওঠে পড়লো সে।

রুদ্র মুচকি হেসে তাঁর হাত টেনে কাছে নিয়ে কোমড় জরিয়ে ধরে বললো,
—- এতো ছটফট করো কেনো? শুনো লাফালাফি কমিয়ে করবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এসব খেলে বাবুর ক্ষতি হবে বুঝোনা কেনো? মায়েদের এমন বাচ্চামি করতে নেই এবার তো বড় হও।

—- আমি তো ভাত খেতে পারিনা। যা যা পছন্দ ছিলো তাই খাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু সেগুলোতেও বমি হয়৷ মন খারাপ করে বললো হৈমী৷

রুদ্র হৈমী কে চুপ করে বসিয়ে দিলো তারপর ফোন করলো সুবর্ণা কে৷ হৈমীর খাওয়ার এই পরিবর্তন জানাতেই সুবর্ণা বললো,’এগুলো চিন্তার কোন বিষয় না। এসময় রুচির পরিবর্তন হবে। যা আগে পছন্দের তালিকায় ছিলো তা অপছন্দের তালিকায় চলে যাবে। কখনো খুব খাবে কখনো বা একেবারেই খাবারে রুচি চলে যাবে’ রুদ্র মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনছিলো। তখন হৈমী রুদ্রর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
—- আপুকে জিগ্যেস করুনতো পেটে কিছু বুঝিনা কেনো? বাবু যদি থাকেই তাহলে বুঝিনা কেনো?

রুদ্র বোকার মতো হৈমীর কথায় তাল মিলিয়ে প্রশ্ন করলো সুবর্ণাকে। তাঁর প্রশ্ন শুনে সুবর্ণা অট্টহাসি দিলো। বললো,

—- সিরিয়াসলি রুদ্র তুই এখন ঠিক বাচ্চা দের মতোন করছিস। তোর প্রশ্ন গুলোও বাচ্চা দের মতোন হয়ে গেলো। আরে গাধা বাচ্চার হার্টবিটই আসে তিন,চারমাসে। সেখানে তোর বউয়ের কেবল দুমাস৷ হার্টবিটই আসেনি বাচ্চা এখনি রিসপন্স কি করে করবে?

রুদ্র কঠিন চোখে তাকালো হৈমীর দিকে। হৈমী চেঁচিয়ে বললো,
—- দেখুন একদম রেগে তাকাবেন না৷ এর আগে কি আমি দশ বাচ্চার মা হয়েছি যে আমি এসব জানবো।

হৈমীর কথা শুনে সুবর্ণা হাসতে হাসতে রুদ্রর কান যেনো ফাটিয়ে ফেলছে এমন অবস্থা। বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলো রুদ্র। হৈমী মুখটা কাচুমাচু করে বসে রইলো। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—- রেডি হও হসপিটাল যাবো আসার সময় সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসবো৷

—- হসপিটাল যেতে হবে কেনো? আমি যাবো না নয়ন আসবে একটু পর নয়না আপুও আসবে আমি যাবোনা আপনি যান৷

—- আশ্চর্য পরীক্ষা কি আমার করবে নাকি তোমার করবে? এতো বেশী বুঝো কেনো রেডি হতে বলেছি রেডি হও৷

—- কেনো সব পরীক্ষা আমি একা করবো কেনো? সব কি বাচ্চার মায়ের ঠ্যাকা নাকি পারবোনা আমি আপনিই গিয়ে পরীক্ষা করুন আমি কোথাও যাবোনা।

—- হৈমী??? দাঁত কিড়মিড় করে বললো রুদ্র।

হৈমী জিহ্বে কামড় দিয়ে ছুটে কাবার্ড খুলে নিজের কাপড় বের করতে করতে বললো,

—- যাচ্ছি যাচ্ছি এতো রেগে যান কেনো সব সময়? প্রেগ্নেন্ট মহিলাদের সাথে রেগে কথা বলতে নেই।

—- দৌড়াচ্ছো কেনো তুমি? কথা না শুনলে হাত, পা বেঁধে রাখবো বলে দিলাম। ধীরে চলা ফেরা করো।

হৈমী থেমে গিয়ে পিছন ঘুরে খিলখিল করে হেসে ওঠলো। রুদ্র আড় চোখে একবার সেই হাসি দেখে নিজের কাজে মন দিলো। বিরবির করে বললো,’এই মেয়ে জীবনে ঠিক হবেনা’।
.
ডক্টর দেখিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো রুদ্র আর হৈমী। মিষ্টি কেনার দায়িত্বে আছে আবির আর নিরব। সাদমান গেছে হৈমীর জন্য খাবার কিনতে। রুদ্র তাঁকে বলে দিয়েছে বাড়িতে ফুসকা বানাতে যা যা লাগবে সব কিনে আনতে। বাড়িতেই ফুসকা বানিয়ে খাওয়াবে সে হৈমীকে। তবুও বাইরে খেতে দেবেনা।
.
বাড়িতে যেতেই নয়ন আর নয়নাকে পায় হৈমী। পুরো বাড়ি যেনো রমরমা হয়ে গেলো। সকলের চোখে,মুখেই খুশি উপচে পড়ছে। সুরভী বেগম আর নয়ন মিলে ফুসকা বানিয়ে ফেললো। ফুসকা সবাই খেতে পারলেও হৈমী খেতে পারলো না৷ একবার মুখে দিতেই বমি হলো তাঁর। বমি হয়ে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে হৈমীর। রুমে বসে কাঁদছে সে তাঁর পাশে নয়না৷ নয়নারও অনেক সমস্যা হয়৷ শুরুতে তাঁরও বমি হতো কিন্তু এখন কমে গেছে। সাতমাস পড়বে তাঁর ইদানীং পেটে পেইন হয় মাঝে মাঝে৷ সে সেসবই হৈমীকে বোঝাচ্ছে এরকম অনেক সমস্যা হবে। অল্পতেই ভেঙে পড়া যাবেনা৷ এভাবে কাঁদাও যাবেনা তাহলে শরীর খারাপ করবে৷ বাবুও অসুস্থ হয়ে যাবে। নয়নার বোঝানোতে চুপ করলো হৈমী৷ কিছুক্ষণ পর সুরভী বেগম এক বাটি আঙুর নিয়ে এসে বললো,

—- দু বউ খেয়ে নাও তো ঝটপট৷

নয়না মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বাটিটা নিয়ে হৈমীর সামনে বসলো৷ নিজে মুখে দিয়ে হৈমীকেও ইশারা করলো নিতে৷ হৈমীর খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও কয়েকটা নিলো মুখে। রুদ্র হৈমীর অবস্থা দেখে সুবর্ণাকে তিনবার ফোন করেছে। সে বার বার তাঁকে বুঝিয়েছে এটা স্বাভাবিক এতে ভয়ের কিছু নেই। যা খেতে পারবে তাই খাওয়াতে বলে দিয়েছে।

সুরভী বেগম রুদ্র কে এ বাড়ি থেকে যেতে নিষেধ করলেন। নয়নার পাশে তাঁর শাশুড়ি আছে তাঁর নিজের মা আছে। তাছাড়া নয়না যথেষ্ট ম্যাচিওর এবং বাচ্চা নেওয়ার জন্য শারীরিক এবং মানসিক ভাবেও স্ট্রং সে। আর হৈমী এসবে কতোটা ভিতু হয়ে আছে তা তাঁর চোখ, মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। যতোই লুকানোর চেষ্টা করুক মারাত্মক ভয় পাচ্ছে সে। প্র্যাগ্নেসির শুরুতেই এই অবস্থা আর কয়েকমাস পর কিভাবে কি হবে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে সুরভী বেগমের৷

রুদ্ররও টেনশন হচ্ছে বার বার মনে হচ্ছে অনেক বড় ভুল হয়ে গেলো তাঁর দ্বারা৷ আবার বাবা হওয়ার লোভটাও সামলাতে পারছেনা৷ মায়ের কথায় সমর্থন দিয়ে সে আর গেলো না৷ কিন্তু কয়েকদিন থাকার পর বুঝলো হৈমীকে নিয়ে আলাদা থাকাই ভালো। বউ আর বাচ্চা কে নিজে একা ঠিক সামলাতে পারবে সে। তবুও কারো কুনজরে পড়তে দিতে চায়না বউ বাচ্চা কে। দাদির চাহনী ঠিক লাগেনা তাঁর। হয়তো কিছু বলবেনা বা করবেনা তবুও তাঁর মনের অসন্তুষ্টির জন্য তার বউ বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক সে চায়না। বৃদ্ধ মানুষের অসন্তুষ্টির কারনে না জানি কোন বিপদ ঘটে যায়। নানারকম চিন্তা করেই হৈমীকে নিয়ে সুখনীড়ে চলে যায় রুদ্র।
.
হৈমীর পাঁচ মাস রানিং ইদানীং অনেক সমস্যা হচ্ছে তাঁর। পেট টা খানিক উঁচুও হয়েছে মাঝে মাঝে পেইন ওঠলে তাঁর অবস্থা এমন হয় যে একদিকে হৈমী কাঁদে অন্যদিকে হৈমীকে জরিয়ে ধরে রুদ্র কাঁদে। যখন পেইন শুরু হয় চোখ, মুখ লাল হয়ে যায় হৈমীর৷ ব্যাথায় কুকাতে থাকে কেমন। যা দেখে রুদ্রর মাথা আর ঠিক থাকে না৷ এমনও হয় কখনো কখনো রাতে ঘুমাতে পারেনা । কেমন ছটফট করে অস্বস্তি তে ভোগে৷ কান্নাকাটি করে খুব। কি করলে ভালো লাগবে সেটা করারই চেষ্টা করে রুদ্র। সারারাত কোলে নিয়ে রুমে না হয় ছাদে ঘুরাঘুরি করে। নতুন বাড়ির এক সাইট কমপ্লিট। কিন্তু তাঁরা সেখানে ওঠেনি। বাচ্চা হলে সপরিবারে ওঠবে এটাই প্ল্যান৷

সুখনীড়ের বাচ্চা দের জন্য রুদ্র পাঁচ জন পুরুষ আর পাঁচ জন মহিলা নিয়োগ দিয়েছিলো। ফাঁকা কিছু জমিতে টিনসেট বিল্ডিংও করেছে। বলতে গেলে বেশ বড়সড় আশ্রমই তৈরী করে ফেলেছে সে। ভবিষ্যতে হৈমী যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় তো এখানে যে স্কুল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানেই শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করতে পারবে। সবটা রুদ্রর প্ল্যান মাফিক হচ্ছে। তবে ইদানীং সে তেমন রাগতে পারেনা৷ চোখের সামনে হৈমীর কষ্ট দেখে তাঁর রাগ কমে গেছে অনেকটাই। সেদিন রাতে ব্যাথায় বিছানায় ছটফট করেছে হৈমী৷ নিজের শরীরের সাথে এমন কঠিন লড়াই করে একটা মেয়েকে মা হতে হয়? অবাক হয়ে যায় রুদ্র। নিজের স্ত্রীকে সামনে থেকে এমন অবস্থায় না দেখলে হয়তো কোনদিন সে জানতেই পারতো না তাঁর মায়ের যন্ত্রণা টা,এ পৃথিবীর প্রত্যেকটা মায়ের লড়াইয়ের কথাটা। তাঁকেও তাঁর মা ঠিক এমনটা কষ্ট করেই জন্ম দিয়েছে ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠে। দূর হয়ে যায় মায়ের প্রতি সব অভিমান সব অভিযোগ। মায়ের ভালোবাসা নিয়ে কতো শতো প্রশ্ন ছিলো মনে কতো শতো অভিযোগ সবটাই দূর হয়ে গেছে আজ৷ যে মা এতো যন্ত্রণা সহ্য করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে তাঁকে সেই মা তাঁকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে সেই মায়ের ঠিক কতোটা প্রিয় সে তা আর বলে বা দেখিয়ে বোঝাতে হবেনা। এখন প্রায় প্রতিদিন মায়ের সাথে সকাল বিকাল কথা হয় রুদ্রর। সপ্তাহে একদিন দেখা করেও আসে। মাঝে মাঝে সুখনীড়েও নিয়ে আসে মা কে। যখন সুখনীড়ে আসে সুরভী বেগম তখন তাঁর কোলে মাথা রেখে গল্প শুনে রুদ্র আর হৈমী। তখন মনে হয় পৃথিবীতে তাঁদের থেকে সুখী আর কেউ নেই।
.
নয়নার ডেলিভারি হয়েছে রাত দশটায়। মেয়ে হয়েছে তাঁর। সকাল হতে না হতেই হৈমীর বায়না সে বাবু দেখতে যাবে। রুদ্র খুব বুঝিয়েছে এ অবস্থায় যেতে হবে না৷ কিন্তু হৈমী নাছোড়বান্দা সে যাবেই। তাই হসপিটাল নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনে বাবুকে।
.
দেখতে দেখতে কেটে যায় দুটো মাস৷ দুমাসে হৈমীর পেট আরো উঁচু হয়ে গেছে। এসেছে চেহারায় নাদুসনুদুস একটা ভাব। দাদির ভাষ্যমতে একদম গোল হয়ে গেছে সে। হাত, পা ফুলে ফুলে গেছে কেমন। ইদানীং হাঁটা চলায়ও সমস্যা হয়৷ বসলে ওঠতে পারেনা ওঠলে বসতে পারেনা৷ রুদ্ররও কাজের চাপ বেশী ইদানীং এ সপ্তাহ পুরোটাই ব্যাস্ত থাকবে সে৷ তাই সুরভী বেগম এসেছেন। সকালে বেরিয়ে গেছে রুদ্র। হৈমী বিছানার সামনে মেঝেতে বসে আছে আর সুরভী বেগম তাঁর মাথায় তেল দিয়ে বেনি করে দিচ্ছেন৷ চুলগুলোও ওঠে কেমন পাতলা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালী পড়ে গেছে। মা মা ভাব বুঝি একেই বলে ভেবেই কষ্টের মাঝেও হেসে ফেলে হৈমী। ছোট থেকে সে কথার আঘাত অনেক সহ্য করলেও একটা সুঁচ এর আঘাত সহ্য করতে পারেনি। আজ তাঁর বাবুর দেওয়া কিক ঠিকই সহ্য করতে হচ্ছে।

রুদ্র, হৈমী দুজনই বুঝে গেছে বাবা,মা হওয়া সহজ কথা নয়। হৈমী তো সেকেন্ডে সেকেন্ডে বুঝতে পারে মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করা মানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধে জয়ী হওয়া। আর সেই যুদ্ধ এখন করছে সে। তাঁর এই যুদ্ধে তাঁর স্বামী যেভাবে তাঁকে সাপোর্ট করছে জয়ী হতে না পারলে তাঁর স্বামীর ভালোবাসাকে অপমান করা হবে। তাঁর স্বামীর মান রাখতে হলেও জিততে হবে তাঁকে একটি সুখী পরিবার উপহার দিতে হবে তাঁর রাগী গম্ভীর বদমেজাজি আপন সেই মানুষ টাকে। এসব ভেবেই নিজের কষ্টগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে হৈমী৷
.
আটমাস পড়লো৷ যতোদিন ঘনিয়ে আসছে ততো ভয় আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরছে হৈমী আর রুদ্রকে। রাত বাজে দুটা পেটে ব্যাথায় ছটফট করছে হৈমী৷ শুধু পেটে না হাত, পা, ঘাড় ব্যাথায় অকুলান সে। মেঝেতে বসে আছে রুদ্র তাঁর বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে হৈমী৷ কখনো হাত কখনো ঘাড়ের দিকে আস্তে আস্তে টিপে দিচ্ছে রুদ্র। হৈমী একটু আরাম পেয়ে বুকে মুখ গুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। যখন বুঝলো ঘুমিয়ে গেছে তখন ওভাবেই কোলে করে নিয়ে ওঠে বিছনায় গিয়ে শুইয়িয়ে দিলো। চোখ মেলে তাকালো হৈমী৷ রুদ্র অসহায় চোখে চেয়ে জিগ্যেস করলো,

—- ঘুমাওনি?

হৈমীর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো। রুদ্র তাঁর দিকে ঝুঁকে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। হৈমী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো। রুদ্ররও চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। মেয়েটাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে শুধুমাএ তাকে বাবা হওয়ার সুখ দেবে বলে। ভাবতেই বুকটা হুহু করে ওঠলো তাঁর। আগে যদি জানতো মা হওয়ার পিছনে এই তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করার কথা তাহলে কোনদিন এমন আবদার সে করতো না। সারাজীবন হৈমীকে নিয়েই কাটিয়ে দিতো। তবুও তাঁর প্রেয়সীকে এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে দিতো না সে।

হৈমী যখন বুঝলো রুদ্রও কেঁদে ফেলবে তখন নিজেকে সামলে নিলো৷ এ কমাসে বেশ বুঝেছে সে রুদ্র তাঁকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে। সে জীবনেও কোনদিন শুনেনি প্র্যাগ্নেস্নিতে বউয়ের পেইন ওঠলে বর কাঁদে। কিন্তু নিজের চোখের সামনে নিজের বরকে কাঁদতে দেখেছে। এতো ভাগ্য নিয়ে সে জন্মেছিলো জানা ছিলো না তাঁর। তাঁর রাগি বদমেজাজি, কর্কশ, রোবট মার্কা বরটার মাঝেও এতো ভালোবাসা দিয়েছে উপরওয়ালা বাবু পেটে না এলে জানতেই পারতো না সে।

—- আহ!

—- কি হয়েছে কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

রুদ্রর ভয়ার্ত মুখ দেখে হৈমী মনে মনে হাসলো। আর পেটের দিকে ইশারা করলো। রুদ্র আর কোন কথা না বলে তাঁর পরিহিত মেক্সিটা খুলে বুকের দিকে ঢেকে দিয়ে পেটটা খোলাই রাখলো। কিছুক্ষণ চুপ করে পেটের দিকে চেয়ে থেকে বেশ শাশানো গলায় বললো,

—- দেখ বাবু এতো জ্বালাবি না মাকে। মায়ের কষ্ট কেনো বুঝিস না বলতো? এটুকুন মা কে কেউ এতো কষ্ট দেয়।

রুদ্রর শাসানী বাক্য শুনে শব্দ করে হেসে ওঠলো হৈমী৷ একটু আগে ব্যাথার এক্টিং করলেও শব্দ করে হাসায় পেটে চাপ পড়ে সিরিয়াস ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। রুদ্র হৈমী বলে চিৎকার দিয়ে একহাতে হৈমীর মাথায় হাত বুলায় তো আরেকহাতে পেটে। কান্নার মাঝেও হেসে ফেলে হৈমী। বলে ভয় না পেতে একটু ব্যাথা হচ্ছে। রুদ্রর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে পাগলের মতো চুমু খায় হৈমীর কপালে, গালে। আদর করতে থাকে সীমাহীনভাবে৷ পেটের ওপর কয়েকটা চুমু খেয়ে আবার চলে যায় মুখের কাছে। কপালে চুমু দিয়ে গলায় কয়েকটা চুমু খায়। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

—- আর বাবু নিবো না আমরা একটাই ব্যাস। বাচ্চা একটা যে কথা দশটাও সেই কথা। কষ্ট ভোগ একবারি করো আর না। অনেক শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। অনেক শিক্ষা পেয়েছি আমি প্রতিটা সেকেন্ড প্রান হাতে নিয়ে আছি। আল্লাহ আল্লাহ করে আর দুমাস গেলেই বাঁচি।

চলবে..
ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here