ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ২৮

0
1905

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮

নয়না ভয়ে গুটিশুটি হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। মাহেরকে দেখে ভয় অনেক টাই কমে গেলো। সুরভী বেগম রুদ্রর হাত টেনে ফেরানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,

— বাবা আর মারিস না মরে যাবে। বিশ্বাস কর আমি ওকে বোঝাবো আর কোনদিন এমন করবেনা। দরকার পড়লে আমি নিজে গিয়ে তোর বউ এর কাছে মাফ চাইবো তবুও ওকে আর মারিস না। বলতে বলতে কেঁদে দিলো সে।

রুদ্র যেনো এবার প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো। মায়ের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে আঙুল ওঠিয়ে বললো,

— তোমার জন্য শুধুমাএ তোমার জন্য ওর এতো সাহস বেড়েছে। হৈমীর কাছে মাফ চাইতে হবে না। শুধু সঠিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করো। আমার মায়ের শিক্ষায় বড় হয়ে এমন জঘন্য কাজ ও করেছে ভাবতেই আমার ঘৃনা হচ্ছে।

রুদ্রর দাদি উপর থেকে নিচের সব কথা শুনে ভয়ে কয়েক ঢোক চিপে নিজের রুমে গিয়ে ছেলেকে ফোন করলো। ছেলেকে বেশ বাড়িয়ে কিছু বলে আবার ফোন করলো রাদিফকে। রুদ্র যতোটুকু করেছে তাঁর থেকে বানিয়ে বানিয়ে বেশ কিছু কথা বলে ফোন রেখে দিলো।

রুদ্রও নিচে বেশী সময় দাঁড়ালো না। নিজের রুমে চলে গেলো। যাওয়ার আগে সবাইকে জোর গলায় জানিয়ে দিলো সূচনার বিয়ের ব্যবস্থা করতে। তা যদি না করে তাহলে হৈমীকে একদিনের জন্যও শেখ বাড়িতে আনবে না সে।

রেদওয়ান শেখ রুদ্র কে কিছুদিন আগেই রাজি করিয়েছিলো হৈমীর পরীক্ষা শেষ হলেই শেখ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য এবং বেশ বড় সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য। হাজার হলেও বাড়ির ছোট ছেলে রুদ্র। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, বান্ধব, বিজনেস পার্টনার, পলিটিক্যাল বন্ধুরা সকলেই রেদওয়ান শেখের বড় ছেলের বিয়ের ব্যাপারে জানে। শেখ বাড়ির প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। রুদ্র একা বিয়ে করেছে জানলে নানারকম কথা ওঠবে। মানুষের মুখ আটকে তো রাখা যাবে না। বড় বাড়ির খুঁটিনাটি খবরও পাবলিকের মনে বিশাল আকার ধারণ করে। তাই রাদিফের বেলায় যেমন ভাবে সব টা করেছে রুদ্রর বেলায়ও তাই হবে বলেছেন রেদওয়ান শেখ।

সুরভী বেগমকে জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সূচনা। সুরভী বেগমও অঝড়ে কেঁদে চলেছে। সবকিছু যেনো হঠাৎই কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। কি হবে এই মা মরা মেয়েটার এখন?’ রুদ্র যা বললো তা সূচনা করেছে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। আমার সূচনা তো এমন মেয়ে নয়। তাহলে সে এমন টা কেনো করলো’? ভেবেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তবুও সূচনাকে একটা প্রশ্নও সে করলো না।

মাহের নয়নার রুমে গিয়ে শার্ট খুলে দিলো। নয়না শার্ট নিয়ে বাথরুম গেলো ধূয়ে দিতে। সূচনার ঠোঁট কেটে খানিকটা রক্ত মাহেরের সাদা শার্টে লেগে গেছে। অফিস যাওয়ার জন্য বের হতে নিতেই তাঁর মা মাংসপুলি পিঠে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। নয়না মাংসপুলি খেতে ভালোবাসে তাই। সেটা নিয়ে এসেই মাহের এসব ঝামেলার সম্মুখীন হলো। এবং জানতে পারলো সেদিন সুখনীড়ে গিয়ে সূচনা হৈমীর গায়ে হাত তুলেছে। এতোসব ঝামেলার মাঝে মাহেরের মাথায় শুধু একটা কথাই চলছে ‘হৈমী এ বাড়িতে বউ হয়ে এলে আরো জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না তো? সূচনা রুদ্রর প্রতি ভয়ংকর ভাবে আসক্ত। সে কি অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হবে? আজকে যা হলো এরপর হৈমীর প্রতি তাঁর আরো বেশী ক্ষোপ থাকবে না তো? কি দরকার ছিলো এতো জটিলতার? কি হতো যদি সবাই তাঁর ভালোবাসার মানুষ কে পেতো? না পেয়েছে তো শুধু রুদ্র পেয়েছে। দু দুটো হৃদয় ভেঙে তাঁর একটি হৃদয় করেছে মজবুত। এই আহত হৃদয়গুলোর এখন কি হবে? যাকে সুখী করার জন্য আমার ভিতরের হাহাকার কোনদিন জানতে দিলাম না তাঁর সুখ এতো সহজে কাউকে কেড়ে নিতেও দেবো না। আমি রুদ্রর মতো হার্ড লাইনে যেতে পারবো না। কিন্তু আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো যাতে হৈমীর জীবনে কোন প্রকার দুঃখ, কষ্ট স্পর্শ করতে না পারে’ গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহের।

নয়না বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাহেরের পাশে বসে বললো,

— ভাইয়া কি চিন্তা করছিস হৈমী কে নিয়ে কিছু ?

— না তেমন কিছু না। তুই খেয়েছিস?

— হ্যাঁ। তুই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিস।

— হুম ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি সমস্যায় আছি।

— ওহ! তুই চিন্তা করিস না। হৈমীর জন্য রুদ্র ভাই আছে সমস্যা হবে না। হলেও সামলে নিবে রুদ্র ভাই।

— এভাবে কি করে সামলাবে? আজ যা হলো এটাকে কি সামলানো বলে? নাকি আরো ঝামেলা বাড়ানো হলো? এ বাড়িতে হৈমী আসলে আদেও কি সুখে থাকবে? তোর শ্বাশুড়ি কি ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে? বোনের মেয়ের জন্য হৈমীর প্রতি তাঁর ক্ষোপের পরিমাণ টা কতো তা তাঁর চোখ দেখেই বোঝা যায়।

— জানিনা। সেসব নিয়ে তুই এতো টেনশন কেনো করবি তোর কি দায় পড়েছে? রুদ্র ভাইয়ের সমস্যা নিয়ে তুই অযথা টেনশন করছিস কেনো?

— এটা রুদ্রর সমস্যা না এটা আমার সমস্যা।

— ভাইয়া,,, আস্তে কথা বল। বলেই নয়না ওঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর মাহেরের পাশে বসলো।

মাহের বললো,

— দেখ হৈমীকে কেউ আঘাত করলে সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না। আর আমার মনে হচ্ছে এ বাড়িতে হৈমী আসলে বিপদ বাড়বে। তাই এখানে না আসাই ব্যাটার।

— আমি যতোদূর জানি পার্মানেন্ট কখনোই আসবে না। এ বাড়িতে বেশ কিছু সমস্যা আছে ভাইয়া। রুদ্র ভাই এ বাড়ির কাউকে সহ্য করতে পারেনা।আর আমার দাদি শাশুড়ীর কথার ধরন থেকে বোঝা যায় কিছু একটা ঘাপলা আছে।

মাহের চিন্তিত মুখে চেয়ে বললো,

— সূচনা এমনটা কেনো করলো?

— উফফ তুই এখনো ওটা নিয়ে পড়ে আছিস। সূচনা রুদ্র ভাইকে ভালোবাসে। তাঁর বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে সেই ছোটবেলা থেকে তাই করেছে সহজ হিসেব।

— নাহ এটা ভালোবাসা হতে পারেনা। এটা সহজ হিসেব নয়৷

— তোমার মতো সবাই হবে না ভাইয়া। তুমি আমার ভাই তুমি সবার থেকে আলাদা তোমার মতো মহৎ ব্যাক্তিত্ব সবার না।

— আমার কি মনে হয় জানিস সূচনা মেন্টালি সিক। নয়তো এমন কাজ কেনো করবে?

— তা জানিনা আমি। কিন্তু ও যে এমন কাজ করবে আমিও বিলিভ করতে পারিনি।

ভাই বোন নানারকম চিন্তার বিষয় তুলে ধরে গল্প করতে থাকলো। বিকেলে রেদওয়ান শেখ এসে সবটা শুনলো। কিন্তু তাঁর কিছু বলার নেই রুদ্র কৈফিয়ত দেবে না। তবুও সে জানে তাঁর ছেলে ভুল করেনি। ভুল করার মতো ছেলে রুদ্র নয়৷ রুদ্র ঠিক কি সেটা হয়তো সে প্রকাশ করেনা কিন্তু রুদ্র কি সেটা ধীরে ধীরে ঠিক বুঝতে পেরেছে রেদওয়ান শেখ। দুদিন আগেই রুদ্রর সাথে গভীর রাতে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। এমন এক সত্যের মুখোমুখি হয় যে ছেলেকে জরিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। যতোটুকু ভুল ধারনা ছিলো রুদ্রর বিষয়ে ততোটুকুও মুছে যায়। ছেলেকে নিয়ে তাঁর সব দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যায় সেদিনই।

রেদওয়ান শেখ রুদ্রর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে বললেন রুদ্রর বিয়ের অনুষ্ঠানের আগেই সূচনার বিয়ে দেবে৷ তাঁর সিদ্ধান্ত শুনে সূচনা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সরভী বেগম নিশ্চুপ রয়েছেন। এ বাড়িতে তাঁর জোর কোনকালেই ছিলোনা। আজো নেই তাঁর কথা কেউ শুনবে না কেউ না৷ তাই সে কথা বাড়ালো না।
.
মাহেরকে বেশ জোর করে নয়না রেখে দিয়েছে। সুরভী বেগমও বলেছে নিজ হাতে পিঠে বানিয়ে বেয়াই,বেয়ানকে পাঠাবে। এতো গুলা পিঠের বাটি এমনি এমনি ফেরত পাঠানো যাবে না। সকলের জোরাজোরি তে মাহের থেকে যায়। সন্ধ্যার দিকে রুদ্রর সাথে টুকটাক কথা হয়েছে মাহেরের। রুদ্র কি সব কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো। মাহেরের বেশ কৌতুহল হলো রুদ্র কি কাজ করে? তাঁর কাজের বিষয়ে তো কখনো কিছু শুনেনি। এ বাড়ির কেউ কিছু বলেও না। নিজের কৌতূহল টা নিজের মাঝেই চেপে রাখলো সে। সরাসরি তো আর প্রশ্ন করা যায় না আপনি কি করেন? তাছাড়া রুদ্র বেশ রগচটা ভালো কিছু না করলে রিয়্যাক্ট করতেই পারে।
.
রাতের খাবার শেষে নয়নার সাথে টুকটাক গল্প করে গেস্ট রুমে চলে গেলো মাহের। শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই কানে শব্দ এলো। সিঁড়ি দিয়ে কেউ উপরে যাচ্ছে। দোতালার কিনারার রুমেই ছিলো সে। ছাদের সিঁড়ির পরেই গেস্ট রুম। রাত এগারোটা বাজে এ সময় ছাদে কে যাবে ভেবেই দরজায় দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে ওকি দিতেই গাঢ় সবুজ ওড়নার এক কোনা নজরে পড়লো। এ বাড়িতে সেলোয়ার-কামিজ নয়না আর সূচনা ছাড়া কেউ পড়েনা৷ নয়না না বেশ বুঝলো তাহলে কি সূচনা? এতো রাতে সে ছাদে কেনো যাচ্ছে? নানারকম প্রশ্ন ওকি বুকি করতে লাগলো মনে। সেই সাথে দ্বিধায় পড়ে গেলো সে ছাদে যাবে কিনা। মন বলছে সূচনার সাথে কথা বলা উচিত। কারন সে জানে ভালোবাসা হারানোর কি যন্ত্রণা তাই সে সূচনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। এমন পরিস্থিতি তে একজন মানুষককে সত্যি পাশে খুব প্রয়োজন। তাঁর বেলায় অনেকেই ছিলো কিন্তু সূচনার বেলায় সত্যি সেরকম কেউ নেই। আজ মেয়েটা ডিপ্রশন থেকে হৈমীর ক্ষতি করেছে কাল যদি নিজের ক্ষতি করে ফেলে? মেয়েদের মন খুব নরম হয়। তাঁরা ছেলেদের মতো স্ট্রং হয় না। তাঁদের সহ্য ক্ষমতা এতোটা প্রখর হয় না। যা আমি সহ্য করেছি তা এই মেয়েটা সহ্য নাই করতে পারে। সবার পক্ষে সব সম্ভব হয় না৷

মাহের এক মূহুর্ত দেরী করলো না সেও চলে গেলো ছাদে। দরজার কাছে আসতেই কান্নার শব্দ পেলো। হ্যাঁ সূচনা কাঁদছে। এই কান্নায় রয়েছে গভীর শোক।
এক ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মাহের। সূচনা ছাদের বর্ডারে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে বসে কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। হয়তো এই কান্না সকলের থেকে গোপন করার জন্যই ছাদে চলে এসেছে।

সূচনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মাহের। দুহাত বর্ডারে রেখে আকাশের দিকে চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দে কান্না থেমে গেলো সূচনার। চমকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। আমতা আমতা করে বললো,

— আপনি এখানে?

— আপনাকে দেখেই এলাম৷ কাঁদছিলেন?

— কেনো এসেছেন এখানে চলে যান। চলে যান। আমি খুব খারাপ, খুব খারাপ আমি আসবেন না, আমার ধারে, কাছে আসবেন না। শুনলেন না রুদ্র কি বললো,আমি জঘন্য চরিএের একটা মেয়ে সড়ে যান চলে যান আপনি।

এমন অস্বাভাবিক আচরন দেখে মাহের খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো। বর্ডার থেকে হাত সরিয়ে সূচনার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— আপনি প্লিজ এমন করবেন না শান্ত হন।

সূচনা নিজের দুকান চেপে ধরে বললো,

— সরে যান আমার সামনে থেকে চলে যান আপনি।

মাহের তবুও পিছুপা হলো না। একটু জোর গলায়ই বললো,
— আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো। প্লিজ সেই সুযোগ টা দিন।

সূচনা কান থেকে হাত সরালো। ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে বললো,
— আমার মতো জঘন্য একটা মেয়ের সাথে কি কথা থাকতে পারে আপনার? আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে। আমি খুব খারাপ, খুব খারাপ।

— আপনি ভুল বলছেন আপনি হয়তো খনিকের জন্য কিছু নির্মম বাস্তবতার কাছে পরাজিত হয়েছেন কিন্তু আপনার ব্যাক্তিত্বের আসল আপনি টা কিন্তু ঠিকই রয়ে গেছে। দেখুন এখন কেমন কষ্ট পাচ্ছেন নিজের কাজের জন্য।

সূচনা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। দুহাটু জরিয়ে ডুঁকরে কেঁদে বললো,

— ও কেনো বুঝলো না? কেনো বুঝলো না ও? আমি ওকে ভালোবাসি সেই ছোট্ট বয়স থেকে ভালোবাসি ওকে আমি। যা করেছি শুধুমাএ ওকে পাওয়ার জন্য নিজের ভালোবাসা কে আপন করে পাওয়ার জন্য করেছি। যে মেয়েটা আজ অবদি গলা উঁচু করে কারো সাথে কথা বলেনি সে মেয়েটা হঠাৎ কারো গায়ে হাত তুলতে পারে কি করে? লজ্জায় ছেলেদের দিকে তাকানোর সাহস যার ছিলো না সে কি করে আজ এতো লজ্জাহীন হয়ে গেলো? কেনো একটাবার এই প্রশ্ন ওর মনে আসলো না? ভালোবাসা কি অপরাধ? ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পাওয়ার চেষ্টা করা কি অপরাধ?

— না। কিন্তু পাওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে আপনি যা করেছেন তা সত্যি ঠিক করেননি।

হুহু করে কাঁদতে লাগলো সূচনা। আবেগে বলেই দিলো,

— আমিতো এসব করতে চাইনি। দাদি বলেছিলো রুদ্র কে পাওয়ার এটাই একমাএ উপায়। সেই উপায়টাই কাজে লাগিয়ে আজ আমি সকলের চোখে নিচু হয়ে গেছি খালামুনি মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারছি সব।

মাহের থমকে গেলো রুদ্রর দাদি এমন কাজ কি করে করতে বলতে পারে। যেখানে এমন পরিস্থিতি তে মেয়েটাকে সঠিক জ্ঞান দেওয়া উচিত। সেখানে এমন একটা জঘন্য কাজ কি করে করতে বলতে পারে?

— আপনি শান্ত হোন কাঁদবেন না। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। দেখুন আপনি যে পরিস্থিতি দিয়ে যাচ্ছেন আমিও সেই একি পরিস্থিতির স্বীকার। আমি যদি নিজের ভালোবাসা কে সুখে রাখার জন্য নিজেকে সামলিয়ে নিতে পারি আপনি কেনো পারবেন না? শুনেছি মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অধিক ধৈর্যশীল হয়৷

সূচনা চুপ হয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকালো মাহেরের দিকে। মাহের মলিন চোখ,মুখে বললো,

— আপনি কি আমার কিছু কথা শুনবেন?

সূচনা বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। বর্ডার ঘেষে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে বললো,

— বলুন কি বলবেন?

মাহের কিছুটা স্বস্তি পেলো। সূচনার পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললো,

— গত চারবছর যাবৎ হৈমীকে ভালোবাসি আমি। হৈমীর সুখের কথা ভেবে সেই চারবছরের ভালোবাসা কে ত্যাগ করেছি আমি। আপনার মতোই চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো হতে দেখেছি।

সূচনার মাথায় যেনো আগুন ধরে গেলো। চিৎকার করে বললো,

— হৈমী,হৈমী, হৈমী। কি আছে? কি আছে ওর মাঝে? সবাই কেনো ওকে ভালোবাসে? আমার মাঝে কিসের কমতি আছে কিসের কমতি? কি নেই আমার? রুদ্র কেনো ওকে ভালোবাসবে? কেনো রুদ্র আমাকে ভালোবাসলো না৷ এরপরও আমাকে শান্ত হতে বলবেন? কি শোনাতে এসেছেন আমার যন্ত্রণা দ্বিগুন বাড়াতে এসেছেন? হৈমীকে ভালোবাসেন সেই গল্প আমাকে কেনো বলতে এসেছেন? সবাই হৈমীকে নিয়েই থাকুন না আমার সামনে কেনো এসেছেন।

গলা ফাটিয়ে কথাগুলো বলে রাগে,ক্ষোপে ছুটে নিচে চলে গেলো সূচনা। মাহেরকে কিছু বলার সুযোগ টাই দিলো না। সূচনার আচরনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাহের৷ চেয়েছিলো সবটা সমাধান করতে। বোঝাতে চেয়েছিল ‘ভালোবাসার আরেক নাম ত্যাগ’।
তাই কষ্ট না-পেয়ে নিজের যন্ত্রণা কে গভীর হতে না দিয়ে ভালোবাসার মানুষদের সুখেই নিজেকে সুখী করতে। কিন্তু সে উল্টো বুঝে নিজের দুঃখ, কষ্ট,যন্ত্রনা দ্বিগুন বাড়িয়ে ভুল বুঝে চলে গেলো। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশ পানে চোখ রাখলো মাহের।
.
বেলকোনিতে বসে সিগারেট খাচ্ছে রুদ্র। তখনি ফোন বেজে ওঠলো। রিসিফ করতেই ওপাশ থেকে হৈমী বললো,

— আপনি তো খুব বিবেকহীন পুরুষ। সারাদিনে একটা খোঁজ নিলেন না? বিকেলে চারটা ফোন দিয়েছি আপনাকে। রাতে ঘুমানোর আগে দুবার ফোন দিয়েছি। ধরেননি ব্যাকও করেননি। ফোনে টাকা না থাকলে একটা মিসড কল তো দিতে পারতেন নাকি?

— বাজে বকা বন্ধ করে আসল কথা বলো। দুটা বাজে এখনো জেগে আছো কোনো?

হৈমী জড়োসড়ো হয়ে বসে এক ঢোক গিলে নিয়ে বলতে শুরু করলো,

— আর বলবেন না একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো। আমি রাতে যখন কোন স্বপ্ন দেখি আর ঘুম ভেঙে যায় তখন নয়নকে ফোন করে স্বপ্নে কি কি দেখেছি সবটা বলে নিজেকে হালকা করে নেই। একটু আগেই একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো নয়নকে ফোন দিতেই দেখি ওর ফোন বন্ধ। বোধহয় চার্জ দিয়ে ঘুমিয়েছে আজ। কিন্তু স্বপ্ন টা কাউকে না বলতে পারলে তো আমার আর ঘুম হবে না। পেটের ভিতর স্বপ্ন গুলো জমা হয়ে কামড়াকামড়ি করবে। কি উপায়, কি উপায় ভাবতেই মনে পড়লো আমার তো এখন জামাই আছে। জামাই থাকতে চিন্তা কি? তাই ফোন করলাম আপনাকে। দেখুন কি অবস্থা স্বপ্নেরও আপনার মতো আক্কেল নেই। যদি তাই থাকতো এমন ভালো স্বপ্ন এ সময় দেখতাম না আর আপনার মতো অনুভূতিহীন মানুষ কে বলতেও আসতাম না। যেদিন নয়ন ফোন অন রেখে ঘুমায় সেদিন স্বপ্ন টা দেখলে কি খুব অসুবিধা হতো।

রুদ্র বসা থেকে ওঠে রুমে হাটাহাটি করছে। আর বাঁকা হেসে কথা শুনছে হৈমীর৷ হালকা কেশে ওঠে বললো,

— আসলে স্বপ্নের কোন দোষ নেই৷ যিনি স্বপ্ন দেখেছে তিনিই বেআক্কল। তাই তো সময় নেই অসময়ে স্বপ্ন দেখে মানুষকে বিরক্ত করে।

— আপনি আমাকে অপমান করলেন? আমি আপনাকে বিরক্ত করছি? কোন মেয়ের সাথে লাইন মারছেন যে আমি ফোন দেওয়াতে বিরক্ত হলেন? দিবনা ফোন আপনাকে কেটে দিবো এখুনি।

— রাতদুপুরে মার খেতে না চাইলে ফোন কাটার কথা ভাববেও না৷

— তাহলে অপমান কেনো করলেন?

মৃদু হাসলো রুদ্র বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে এক হাতে কানে ফোন ধরে আরেকহাতে বুকে হাত বুলাতে বুলাতে জিগ্যেস করলো,

— কি দেখেছো স্বপ্নে বলে ঘুমিয়ে পড়ো।

— আপনি শুনবেন?

— কেনো শোনানোর ইচ্ছে নেই?তাহলে ফোন করেছো কেনো? বিরক্ত করতে?

— মোটেই না আমার অতো ঠ্যাকা পড়ে নাই আপনাকে বিরক্ত করতে।

হালকা হাসলো রুদ্র চোখ বুজে গভীর এক শ্বাস নিয়ে ভারী আওয়াজে বললো,

— বলো?

— আমি একটা দ্বিপে ছিলাম। চারদিকে শুধু নীল আর নীল। আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিলেমিশে একাকার। তীরে বাঁধা নৌকায় বসে আছি আমি৷ ইচ্ছে হচ্ছিলো সমুদ্রের ঢেউগুলোর দিকে ভেসে যেতে। যতোদূর যাওয়া যায় ঠিক ততোদূর। কিন্তু একটা মাঝির অভাবে আমার আর ইচ্ছে পূরণ করা হলো না। জানেন একটা মানুষ ও পেলাম না যে তাঁকে বলবো আমাকে নিয়ে একটু ভেসে যেতে। তাই তো মন খারাপ করে ঘুম থেকে ওঠে পড়লাম।

রুদ্র চোখ বুঝে অনুভব করতে লাগলো হৈমীর স্বপ্ন টা৷

আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিলেমিশে একাকার। নোকার এক কিনারায় মাঝি বৈঠা নিয়ে বসে আছে৷ সাদা কাবলী পড়া রুদ্র নৌকায় ওঠে দাঁড়ালো এক হাত বাড়িয়ে দিলো হৈমীর দিকে পড়নে তাঁর সাদা পাতলা শাড়ি। সাদা রেশমি চুড়ি পড়া হাতটা বাড়িয়ে দিতেই রুদ্র একটানে নৌকায় তুলে ফেললো। টাল সামলাতে না পেরে হৈমী রুদ্র কে খামচে ধরে চোখ,মুখ খিঁচলো।
রুদ্র বাঁকা হেসে আলতোভাবে জরিয়ে নিলো হৈমীকে। তারপর তারপর কি হলো? কেমন হয় যদি স্বপ্ন টাকে বাস্তব করে তোলা যায়? মনের প্রশ্নটা প্রকাশ করলো না রুদ্র। গম্ভীর গলায় বললো,

— তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে? সামনে পরীক্ষা স্বপ্নে তো পড়াশোনা দেখা উচিত তা না দেখে এসব উল্টাপাল্টা কি দেখো। কয়েকটা ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিলো রুদ্র।

হৈমী ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলো। মাঝরাতে সেধে যেয়ে ধমক খাওয়ার কি দরকার ছিলো তাই বুঝে পাচ্ছে না সে।
.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা মাস। হৈমীর পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেলো। রেদওয়ান শেখ সুখনীড়ে এসে জানিয়ে গেছেন। হৈমীর পরীক্ষা শেষে হৈমী শেখ বাড়িতে থাকবে। বিয়ের অনুষ্ঠান সেখানেই হবে। এদিকে রুদ্রও সুখনীড়ে কাজ ধরেছে। কাজ সম্পন্ন হতে ছয়মাস লেগে যাবে। রেদওয়ান শেখের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ছয় মাস শেখ বাড়িতেই থাকবে। তারপর নতুন বাড়ি সুখরাজ্যে ওঠবে।
.
পরীক্ষা শেষ। হৈমীকে নিয়ে শেখ বাড়ি এলো রুদ্র।
যেহেতু বেশিদিনের জন্য না সেহেতু হৈমীর মন খারাপ হয়নি। দাদুও হৈমীকে অনেক বুঝিয়েছে। তাছাড়া যখন ইচ্ছে হবে সুখনীড়ে আসবে। বাচ্চা দের সাথে দেখা করবে। রুদ্রর কোন আপত্তি নেই। তাই হৈমী নিশ্চিন্তে শেখ বাড়ি এসেছে।
.
সব কিছু স্বাভাবিক। কেউ হৈমীর সাথে বাজে আচরন করেনি। যথেষ্ট সৌজন্যতা বজায় রেখেছে সকলেই৷ কিন্তু সূচনাকে একবারের জন্যও দেখতে পায়নি হৈমী৷

নয়না বাপের বাড়ি ছিলো। হৈমীর আসার কথা শুনে নয়নকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সে। হৈমী রুমে চুপ করে বসে ছিলো৷ রুদ্রর হুকুম রুমে চুপ করে বসে থাকা। হুকুম দিয়ে সে কোথায় গেছে জানেনা হৈমী৷
নিচের কথা অল্প উপরে যেতেই হৈমী আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না। নিশ্চুপ বাড়িটায় যেনো অল্প প্রান ফিরে এলো। হৈমীও রুম থেকে বেরিয়ে উপর থেকে নিচে চেয়ে দেখলো নয়ন পানি খাচ্ছে সোফায় বসে। নয়নকে দেখে এতো খুশি হলো হৈমী যে উপর থেকে চিল্লিয়ে ওঠলো। তাঁর চিল্লানো এতো জোরে ছিলো যে রুদ্রর দাদি পান মুখে দিতে গিয়ে চমকে যায় যার ফলে পান টা হাত ফসকে পড়ে যায় নিচে।

এদিকে হৈমী সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে নয়নের কাছে গিয়ে জাবটে ধরে নয়নকে।

— দোস্ত তুইও এসেছিস ওয়াও। জানিস এতোক্ষণ কি বিরক্তই না হচ্ছিলাম। ঐ গোমরামুখো রোবট, ভুতুম পেঁচাটা আমাকে একা রুমে বসিয়ে কোথায় গেলো কে জানে? এখন তো আমার হেব্বি খুশি লাগতেছেরে।

রুদ্রর মা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে হৈমীর দিকে। কি বলছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে সে।নয়না ভয়ে এক ঢোক চিপলো। নয়ন ফিসফিস করে বললো,

— আরে পাগুন্নি ছাড় আমারে। দেখ তোর সামনে জোম তোর শাশুড়ি।

সিঁড়ি দিয়ে দাদি নেমে আসছে আর রাগে হুংকার ছাড়ছে,

— বাড়িটা কি মাছের বাজার নাকি? কে চিৎকার করে? অসভ্য বর্বরের মতো আচরন এই বাড়িতে চলবে না৷ ভদ্রতা সভ্যতা না জানলে শিখে, পড়ে আসা উচিত ছিলো। বড় বাড়ির বউ হবার এতোই যখন শখ বড় বাড়ির বউ হওয়ার জন্য সঠিক শিক্ষা অর্জন করা উচিত ছিলো৷ বাড়ি ঢোকার সময় তো মেনি বিড়াল হয়ে ঢুকছে। এখন বিড়াল থেকে বাঘ হওয়ার শখ হইছে নাকি?

দাদির চেচামেচি শুনে ভয়ে নয়নকে ছেড়ে দিয়ে। অপরাধীর মতো ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের দিকে চোখ বুলালো হৈমী৷ মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগলো,

— এইবার তুই শেষ রে হৈমী। তোর কষাই জামাই যদি জানতে পারে তুই রুম ছেড়ে বেরিয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছিস নিশ্চিত তোকে কুঁচি কুঁচি করে কেটে তোর হাড়গোড় সহ হালিম বানিয়ে খাবে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here