ভালোবাসার সংসার পর্ব ৮

0
709

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৮
#ফারজানা

নিজের রুমের কাঠের জানালের পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সায়রা।নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।আলভির হাতে ছেঁ’কা লাগার ঘটনার পর থেকেই এমন চুপচাপ হয়ে আছে সে।কিছু বলছেওনা, কিছু করছেওনা।একভাবেই বসে আছে এতোক্ষণ ধরে।মুখের দিকে তাকিয়ে সায়রার মনে চলা ভাবনার কোনো ধারণাই করা যাচ্ছেনা।মুখশ্রী তার একদম শীতল, শা’ন্ত।

আলভি, সাইরিফ, আদনান রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সায়রাকেই দেখে চলেছে।সায়রার হঠাৎ এমন নির্বিকার ভাবটা কেউ মেনে নিতে পারছেনা।একটু চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও তো চলতো কিন্তু সায়রার এমন বি’ষ’ণ্ণ মুখ দেখতে তাদের মোটেও ভালো লাগছেনা।দুইভাই কিছু একটা ভেবে হঠাৎই মুখ তুলে আলভির দিকে তাকালো।আলভিও তাকালো দুইছেলের দিকে।ছেলেদের দৃষ্টি দেখে কিছু একটা বুঝে নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা দোলালো আলভি।বাবার ইশারা পেতেই দুইভাই তৎক্ষনাৎ একদৌড়ে সায়রার সমানে উপস্থিত হলো।শ’ক্ত করে দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে।

সাইরিফ, আদনানের ছোঁয়া পেতেই বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে ছেলেদের দিকে তাকায় সায়রা।আগের মতোই বসে আছে সায়রা চোখদুটো শুধু ছেলেদের দিকে নিক্ষেপ করা।একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে নিজের কলিজার টুকরোদেরকে।সাইরিফ, আদনানও একভাবে দেখে চলেছে তাদের মায়ের মায়াময় মুখশ্রী।ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই সায়রার চোখের কোণ দিয়ে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।মু’ক্তোর মতো পানির ফোঁটাগুলো পাপড়ি ভেদ করে গড়িয়েই চললো।মায়ের চোখে পানি দেখে বুকে চিনচিনে ব্য’থা’র উদ্ভব হলো দুইভাইয়ের, কা’ন্নারা ঠিকরে বেরিয়ে এলো।হাত বাড়িয়ে মুছিয়ে দিলো মায়ের চোখের অশ্রু।কিন্তু কোনো লাভই হলোনা তাতে।তাদের ছোটো ছোটো কোমল হাতের স্পর্শ সায়রার দলা পাকানো য’ন্ত্র’ণা’গুলো আরোই অবাধ্য হয়ে উঠলো।চোখের সীমানা পেরিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।এমন দৃশ্য দেখে আলভিও আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা।ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সায়রার কাছে।হাঁটু মুড়ে মেঝেতে সায়রার পায়ের কাছে বসে খুবই সন্তপর্ণে নিজের মুখ গুঁজে দিলো সায়রার কোলে।সে ও যে কাঁদছে।কিন্তু তার চোখের পানি যে কারো দেখতে মানা, তাইতো এভাবে নিজেকে লুকিয়ে নিলো প্রিয়মানুষটির আশ্রয়ে।চারটি মানুষের বোবা কা’ন্না’য় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো।আলাদাভাবে হলেও এই চারটি হৃদয়ে বেজে চলেছে একই বি’ষ’ণ্ণ’তা’র সুর।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো একইভাবে।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সায়রার কোল থেকে মুখ তুললো আলভি।ছেলেদুটো মাকে জড়িয়ে রেখেছে নিজেদের সাথে।কান্না কমলেও ক্রমাগত হেঁচকি উঠে চলেছে।তবে সায়রার চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রুরা গড়িয়েই চলেছে।কান্নার দমকে নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়রার কোলের উপরে থাকা হাতদুটি নিজের হাতের মধ্যে নিলো আলভি।আবেগী স্বরে বললো,,,

–“এখনো এতোটা অ’ভি’মা’ন নিজের মধ্যে কেনো পুষে রেখেছো মায়াপরী?আমি ভুল করেছি.. নাহ্ ভুল নাহ্ অ’ন্যা’য় করেছি তোমার সাথে।সেই অ’ন্যা’য়ে’র শা’স্তি’ও তো পেয়ে গেছি বলো?..এবার কি আমাদের একটু ক্ষমা করা যায়না?একটু ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয়া যায়না?..এতোটা নি’ষ্ঠু’র কবে থেকে হলো গো?আমাদের কষ্টগুলো কি তোমার চোখে পড়েনা?এতোগুলো দিন কি করে আমাদের ছাড়া থা..থাকতে পারলে?কষ্ট হলোনা?..কেনো করছো গো এরকম?এইযে আমাদের ছাড়া থেকে নিজেও কষ্ট পাচ্ছো আর আমাদেরকেও কষ্ট দিচ্ছো।..ফিরে চলো প্লিজ সাযরা।”

শেষের কথাটি অনেকটা বি’দ্ধ’স্ত অবস্হায় অনুরোধের স্বরে আটকে আটকে বললো অালভি।কথাগুলো বলতেও তার গলা বুজে আসছিলো ক’ষ্টে।অনেকটা আশা নিয়ে শ’ক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় সায়রার হাতদুটো ধরে রাখলো।

কিছুটা সময় নিরবে আলভির দিকে তাকিয়ে থাকলো সায়রা।কান্না থেমে গেছে তার আলভির কথাগুলো শুনে।কিন্তু অসহ্য য’ন্ত্র’ণা’র বি’ষা’ক্ত তীরের দংশনে হৃদয়টা বি’ষি’য়ে গেলো।চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলো যে তারও ক’ষ্ট হয়।তাদের থেকেও অনেকগুণ বেশি ক’ষ্ট নিজের মধ্যে পুষে রেখেছে সে।নিজের প্রিয় মানুষটি, নিজের কলিজার টুকরো সন্তানদের ছেড়ে থাকতে কতোটা য’ন্ত্র’ণা’ম’য় প্রহর পার করতে হয়েছে তাকে তা একমাত্র সে নিজেই জানে।একাকীত্বের নাগপামনিজের অনাগত সন্তানের আগমনের খুশির সংবাদটিও দিতে পারেনি প্রাণপ্রিয় মানুষগুলোকে।বিচ্ছেদের প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে ছিলো বিষাক্ত।দমবন্ধকরা কষ্টরা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছিলো।কিন্তু কিছুই বলতে পারলোনা সায়রা।একটি শব্দও তার কন্ঠস্বর ভেদ করে বেরিয়ে এলোনা।এমনকি একফোঁটা চোখের পানিও বেরিয়ে এলোনা। শুধু শান্ত চোখে নিনির্মেষ তাকিয়ে রইলো অপেক্ষমান মানুষগুলোর পানে।কিছুক্ষণ পরেই চোখ সরিয়ে নিলো সেদিক থেকে।উচ্চস্বরে জুলেখার উদ্দেশ্য বললো,,,

–“জুলেখা আমার জন্য কয়েকটা বরই পেড়ে নিয়ে আয়তো।”

সাথেসাথেই জুলেখার গলাও শোনা গেলো,,,
–“কিন্তু আপা ওগুলো তো বড্ড টক।তোমার খেতে হবেনা ওগুলো।আমি…”

জুলেখার কথা শেষ হওয়ার আগেই সাইরিফ উত্তেজিত হয়ে বললো,,,

–“আমি পেড়ে নিয়ে আসি।মা যখন বলেছে তখন তো মা খাবেই, আমি খাওয়াবো।”

কথাগুলো শেষ করেই ছুট লাগালো সাইরিফ ভাইয়ের হাত ধরে।এই ছেলেটা বড্ড ছটফটে।আদনান বেশ শান্ত ছেলে।সায়রার অভাবে এই কয়েকমাসে কেমন যেনো একটা হয়ে গেছিলো সায়রাকে কাছে পেয়েই আবার তার চঞ্চলতা ফিরে এসেছে ভেবেই আলভির মুখে একটা সস্তির হাসি ফুটে ওঠে।এদিকে সায়রা চেঁ’চি’য়ে সাইরিফ, আদনানকে যেতে নিষেধ করে চলেছে।গাছ তলার জায়গাটি বেশ এবড়োথেবড়ো। একটু অসাবধান হলেই পা হড়কে পড়ে গিয়ে চোট পেতে পারে।সেই আ’শ’ঙ্কা’ই চলছে সায়রার মনে।আলভির দিকে চোখ যেতেই তাকে হাসতে দেখে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,,,

–“শুধু শুধু হাসছেন কেনো?ছেলেদুটো যে চলে গেলো দেখতে পেলেননা?তাড়াতাড়ি ওদের গিয়ে ধরে আনুন।নাহলে পড়ে গিয়ে ব্য’থা পাবে।”

সায়রার ধমকি খেয়েই মুখ কাঁচুমাচু করে ফেললো আলভি।ছেলেদের কাছে যাবার জন্য উঠে পা বাড়াতেই সাইরিফের চিকন কন্ঠের চিৎকার কানে ভেসে আসলো।সাথে সাথেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সায়রা খাঁ’ম’চে ধরলো আলভির হাত।আতঙ্কিত হয়ে বললো,,,

–“কি হলো?চিৎকার দিলো কেনো?আপনি একটু তাড়াতাড়ি যান না গিয়ে দেখুন কি হলো?”

সায়রার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বাইরের দিকে ছুট লাগালো আলভি।ছেলেটার কা’ন্না শোনা যাচ্ছে।বরই গাছতলার কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলো সাইরিফ বাম পায়ে হাত নিচে বসে আছে।আশেপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলোর শিকড় ছড়িয়ে বরই গাছতলাটি ভীষণ এবড়োথেবড়ো হয়ে আছে।সেই শিকড়ের সাথে পা বেঁধেই পড়ে গেছে সাইরিফ।পা মু’চ’কে গেছে।ব্যথার চাইতেও ভ’য় বেশি পাওয়াতে এতো কাঁদছে ছেলেটা।আলভি এসেই ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের সামনে এসে টুলে বসিয়ে দিলো।সায়রাও ততক্ষণে চলে এসেছে।ছেলেকে ব্য’থায় কাঁদতে দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো সায়রার।ছেলের চোখে পানি দেখে তার চোখেও পানি চলে এলো।পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিলো ছেলেকে।সাইরিফও মাকে আঁকড়ে ধরলো।এদিকে আলভি অনেক কথা ভুলিয়ে রাখছে সাইরিফকে।নাহলে ছেলেটা পায়ে হাতই দিতে দিচ্ছিলোনা।সাইরিফ একটু অন্যমনস্ক হতেই বাম পা টা ধরে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতেই আবারও চিৎকার করে উঠলো সাইরিফ।সায়রাও তার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে নিলো।মায়ের বুকে মুখ গুঁজেই কাঁদতে লাগলো সাইরিফ।সায়রা ক্রমাগত মাথায়,পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেছে।সাইরিফের কান্না এখন কমেছে।সে এখনও সায়রাকে জড়িয়ে ধরে আছে। অপরপাশ থেকে আদনানও জড়িয়ে আছে সায়রাকে।আলভি তাদের সামনেই বসে আছে।জুলেখা পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আদর করতে করতেই সায়রাকে জিজ্ঞেস করলো,,,

–“আর ব্য’থা করছে সোনা?”

–“একটু একটু করছে আম্মু।”

সায়রার বুকে মুখ গুঁজেই বললো সাইরিফ।জুলেখা পাশে থেকে আফসোসের সুরে বলে উঠলো,,,

–“ইশ বরই পাড়তে না গেলে এরকমটা হতোনা।আপা আর আমি কতো করে মানা করলাম।এখন কতোটা ব্যথা লাগলো?”

–“সেই আমার কথার কি কোনো মূল্য আছে নাকি ওদের জীবনে?আমার কোনে কথাই ওদের ভালো লাগেনা, কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছে করেনা।অবশ্য আমি মানুষটাইতো ওদের কাছে অপছন্দের।”

সায়রার অভিমানি কথার প্রতিউত্তরে আলভি কিছু বলতে চাইলেও বাঁধা দিলো সায়রা।বললো,,,

–“থাক আর কিছু শুনতে চাইনা আমি আপনাদের থেকে।দয়া করে এবার আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দিন।আর জ্বা’লা বাড়াবেননা আমার।আজই চলে যাবেন এখান থেকে।”

সায়রাকে মমতাময়ী থেকে আবার আগে আগের রূপে ফিরে আসতে দেখতে তাকে ছেড়ে দিলো দুই ছেলে। তাতে ক’ষ্ট হলেও কোনো কথা বললোনা সায়রা।চুপচাপ উঠে চলে গেলো ভিতরে।আলভি, সাইরিফ, আদনানও নিশ্চুপ।তাদের মনেও কোনো কথা নেই।সায়রার মনে যে তাদের প্রতি অভিমান জমে আছে তা সায়রার একটু আগের কথা দ্বারাই প্রমাণিত হয়।তাই এবার তাদের একমাত্র মিশন হলো সায়রার অভিমান ভাঙানো।মুখ গোমড়া করে থাকা ছেলেদুটোকে কাছে টেনে কিছু একটা ফিসফিসিয়ে বলতেই তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।আবারও তিন বাবা-ছেলে মিলে লেগে গেলো প্ল্যান সাজাতে।

সায়রার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তিন বাবা-ছেলেকে ওরকম ফিসফিস করতে দেখেই ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে গেলো জুলেখার।কি এমন শলাপরামর্শ চলছে এই তিনজনের মধ্যে তা শোনার প্রয়াসেই নিচু হয়ে বসে কানটা তাদের দিকে এগিয়ে দিলো জুলেখা।আলাপে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো তা টের পেতেই ভ’স্ম করে দেয়া টাইপ একটা লুক দিলো জুলেখার উদ্দেশ্যে।ওমন দৃষ্টি দেখে জুলেখা বললো,,,

–“আমাকে বললে কিন্তু তোমাদেরই লাভ বেবে দেখো।”

তিন বাবা-ছেলে ভেবে দেখলো তারা যেটা করতে চাইছে তাতে জুলেখা সাহায্য করলে তাদেরই লাভ।তাই জুলেখাকেও তাদের দলের সদস্য বানিয়ে নিলো এবং চারজনে মিলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো শলাপরামর্শতে তাদের মিশনকে সফল করতে।

চলবে…

_____________________________________________________________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here