#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-০৮]
#আফরোজা_আনজুম
সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিলাম। সাড়ে আটটায় ভার্সিটির গাড়ি আসে। বেশিরভাগ সময়ই ঘুমের কারণে মিস করে ফেলি। তখন অন্য গাড়িতে যেতে হয়। একা একা চলাফেরা করলে আব্বু আম্মু ভয়ে তটস্থ থাকে। তাই তাঁরা বলে ভার্সিটির গাড়িতেই যেন যায়। তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি রুবা আর তিশা খেতে বসেছে। দুজনে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। হাতে পাউরুটি আর কলা। দেখেই আমার বমি পেলো। সবচেয়ে অপছন্দের খাবার। রুবা আমাকে দেখে প্লেট এগিয়ে দিলো। দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, ” আপু, এগুলো তোমার ভাগের। খাও।”
চোখ পাকিয়ে তাকালাম তার দিকে। চেয়ারে টেনে বসে উঁচু গলায় বললাম অন্যকিছু থাকলে আনতে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে আম্মুর চিরাচরিত ডায়লগ শুনতে পেলাম ‘ ভাত খা ‘। রান্নাঘরে গিয়ে সমুচা নিলাম। নিঠুল ভাইয়ের পছন্দের খুব। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য বাইরের ভাজাপোড়া খায় না সে। তবে ঘরে বানানো সমুচা খেতে পছন্দ করে। ভাবলাম তার জন্য নিয়ে যায়।
” চাচী আম্মু, কয়েকটা সমুচা একটা বক্সে করে দাও না!” ছোট চাচীকে বললাম আমি।
আম্মু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো, ” স্কুলে থাকতে তো জোর করেও কোনোদিন টিফিন নেওয়াতে পারলাম না। তোর পছন্দের কিছু রান্না করলেও নিতি না। আর আজকে তুই টিফিন দিতে বলছিস?”
” ভালো হয়ে গেছি আম্মু। তখন নিতাম না বলে খুব কষ্ট পেতে না! এখন থেকে নিবো। তবে যেদিন পছন্দের খাবার বানাবে সেদিন। তোমার ভালো মেয়ে না আমি! ”
আম্মু বললো, ” আমার ভালো মেয়ে হলে ভাত খেয়ে যা।”
মুখ কুঁচকলাম আমি। আম্মুর এই কথা শুনতে শুনতে কান গেলো আমার। আম্মুদের একমাত্র লক্ষ্যই বোধ হয় আমাকে ভাত খাইয়ে খাইয়ে মোটা করা। রুবা দেখেই নাকিকান্না করে বললো, ” রোজা আপু যেটা খেতে চায় সবসময়েই সেটা খাওয়ায় তাকে। তার সব কথা শুনে। আমি আর তিশা ছোট বলে পঁচা খাবারগুলো দেয়। তিশাও শুরু করলো একই কথা। বললাম ছোট বেলায় আমার উপরও খাবার নিয়ে এমন অত্যাচার চলতো। তাহলে তোদের উপর কেন নয়! এগুলো খেতে খেতে বড় হয়েছি আমি। তোরাও খা! খা!
তাদের উস্কে দিয়ে চলে আসলাম।
ভার্সিটিতে যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক পরও নিঠুল ভাইয়ের দেখা পেলাম না। তার জ্বর কী সারে নি! ভাবলাম বাসায় যাই। নিঠুল ভাই আমাকে দেখে অবাক হলো। দরজার হাতল ধরে আমার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, ” আমাকে দেখতে এসেছিস?”
হাসছেও সে। আমি সোজা গলায় ‘না’ বললাম। সে ভ্রু কুচকে বললো, ” তাহলে কেন এসেছিস?”
আমার কিছু বলতে হলো না। আন্টিকে দেখলাম। আন্টি নিঠুল ভাইকে সরিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বললো, ” কেন এসেছে মানে? এটা কী ধরনের কথা! তুই কেন যাস ওদের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে?!”
” শ্বশুরবাড়ির প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না! খবরাখবর নিতে যাই। ” আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সোফায় গিয়ে বসলো সে।
আন্টি অবাক হয়ে বললো, ” শ্বশুরবাড়ি মানে!”
” ভাইয়ার শ্বশুরবাড়ি। সেটাই বললাম। ”
আন্টি ভেতরে নিয়ে গেলো আমাকে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম আজ নিলু আপু আসবে।
” এখানে আয়।” আদেশের সুরে ডাকলো।
গেলাম না আমি। একটু আগে আসার কারণ জানতে চায়লো। কেন আমি আসতে পারি না এমনি! গত সন্ধ্যার মুহূর্তগুলো সে ভুলে গেছে! কোথায় একটু প্রেমিকাকে মতো আচরণ করবে, প্রেমময় চোখে তাকাবে তা না ; সারাক্ষণ কাট কাট গলায় কথা বলবে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম রিনি আপু খুবই ব্যস্ত। সাথে নিলয় ভাইও আছে। অনেকদিন পর দেখলাম। চাকরির জন্য শহরের বাইরে থাকতে হয় তাকে। আমাকে দেখে হেসে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো। আন্টি এসে নিলয় ভাইকে জোর করে পাঠিয়ে দিলো।বললো, ” তুই যা। তোর বউয়ের সাথে আমি আছি তো! কথা শুনছিস না কেন? রোজার সাথে কথা বল, যা।”
নিঠুল ভাই সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখছে। নিলয় ভাইকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, ” চারপাশের মানুষজনের প্রেম পিরিতি দেখতে দেখতে গা জ্বলে গেলো আমার। ঘরে এসে দেখি রান্নাঘরেও প্রেম চলছে। কোথায় যাই আমি!”
‘ চুপ ফাজিল’ বলে নিলয় ভাইয়া রিমোটটা কেড়ে নিয়ে নিলো। নিলয় ভাই লাজুক, শান্ত প্রকৃতির। নিঠুল ভাই ঠিক তার উল্টো। রিনি আপু আসলে টিফিনবাক্সটা তাকে দিলাম। রিনি আপু বাক্স খুলে দেখে বললো, ” কী এনেছিস এগুলো? ”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, ” সমুচা। চাচী আম্মু বানিয়েছিলো সকালে।”
” সমুচা! ছোট চাচীর বানানো সমুচা, না সমুচা না ছোট চাচীর রান্নার হাতটাই ভালো। দাও ভাবী। ” নিঠুল ভাইদের বললো।
রিনি আপু বাক্স নিচু নেমে দেখাতেই মুখ হা হয়ে গেলো আমার। এরাও একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর সশব্দে হেসে উঠলো হু হু করে।
” কী এনেছিস রে রোজ? ছেঁড়া পাউরুটি আর অর্ধেক খাওয়া কলা! আম্মা দেখে যাও তোমার রোজ মামনি কী এনেছে? কন্জুস কী আর সাধে ডাকি!” হা হা হা করে হাসতে হাসতে বললো নিঠুল ভাই। ততক্ষণে আমি বুঝে গেলাম এগুলো রুবা, তিশার কাজ যখন রুমে গেলাম তখনই করেছে। খেতে পারে নি বলে আধখাওয়া গুলো এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে সমুচা গুলো তাদের পেটে চালান করেছে। সেজন্যই তো আসার সময় রুবা ভদ্র মেয়ের মতো বললো, “আপু, টিফিনবাক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তুমি আবার নিতে ভুলে যাবে।”
আন্টিও এসে হাসিতে যোগ দিলো। লজ্জায় আমার কান্না চলে এসেছে। “সমুচা’ই দিয়েছিল। রুবা, তিশা করেছে এগুলো “, বলে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
নিঠুল ভাই এসে আঁটকালো। বললো, ” কিছু না খেয়ে যাচ্ছিস কই! এতো কিছু এনেছিস। খালি মুখে যাবি?”
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে সে আমার হাত ধরে আটকালো। হেসে বললো, ” আরে মজা করছি। কাঁদছিস কেন গাধীর মতো?”
” রুবা, তিশা করেছে এগুলো। জানতাম না আমি। জানলে আনতাম না।”
” তুই জেনে শুনে এনেছিস এমন বলেছি নাকি আমরা! দেখে একটু হাসি আসলো তাই…”।
” একটু হেসেছো! হা হা করে হেসে আমাকে লজ্জায় ফেলেছো।”
” ঘরের মানুষ’ই তো আমরা।” আবারও হাসলো সে।
তার হাসি দেখে রেগে বললাম, ” সরো! আর কোনোদিন আসবো না আমি।”
” তোর আসতে হবে না। বিয়ে করে আমিই নিয়ে আসবো।”
এই কথায় লজ্জা পেলেও দেখালাম না তা। তবে রাগ কমলো। সে আমার হাত টেনে নিয়ে গেলো। দরজার সামনে যেতেই আবার বললো, ” তুই’ই মনে হয় প্রথম যে ছেঁড়া পাউরুটি, অর্ধেক কলা নিয়ে প্রেমিককে দেখতে এসেছে।”
কথা বাড়ালাম না আমি। কিছু বললেই উল্টো আরেকটা বলবে। আন্টিরা দেখে স্বাভাবিকভাবেই অন্য কথা চালিয়ে গেলো। আর নিঠুল ভাই! সে পাউরুটি, কলার বক্স নিয়ে মজা করতে লাগলো।
.
.
.
নিলু আপুুর সাথে সিয়াম ভাইয়া আর দিশা আপুও এসেছে। সিয়াম ভাইয়া আমাকে দেখে অবাক হয়ে হয়ে বললো, ” তোমাকে এখানে পাবো ভাবিনি। এসে ভালোই করেছি দেখছি।”
নিঠুল ভাই শুনে আমার দিকে কটমট চোখে তাকালো। সেদিন একটুখানি শুনতে পেলাম যে সিয়াম ভাইয়ার জন্য নাকি আমার কথা বলেছে হালকা পাতলা। আমি অবাক হলাম মাত্র কয়েকঘন্টা সাথে ছিলাম। এর মাঝেই সে আমাকে নিয়ে ভেবে ফেললো আর আমি বুঝতেই পারি নি! নিঠুল ভাই কয়েকবার বললো আমাকে, ” তোর ক্লাস নেই! ক্লাস মিস করছিস কেন? চল দিয়ে আসি।”
আন্টিরা বাঁধ সাধলো তাই তারও চুপ থাকতে হলো। কিছুক্ষণ পর সে রুমে ডাকলো। আমি যেতেই আমার হাত চেপে ধরে বললো, ” সিয়াম ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিস কেন বেয়াদব মেয়ে! জানিস না সে বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে তোর জন্য!”
” হ্যা জানি। এখন কী তার থেকে পালিয়ে বেড়াবো? আমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবে?” মনে মনে হেসে বললাম আমি।
” আবার বড় বড় কথা! আমার জিনিসের দিকে চোখ দিচ্ছে সে। জানেনা বলেই এতো সাহস হয়েছে তার। বিমান থেকে টুপ করে পড়ে মেয়েদের পিছু লেগেছে। আর তুই… তুই তার সামনে সামনে হাঁটছিস বলেই তো পিছু নিয়েছে! ”
” কী আশ্চর্য! এক ঘরে উপস্থিত থাকলে সামনে পিছু তো হবোই। চলে যাওয়াই উচিত ছিলো আমার।” রাগ দেখিয়ে বললাম। তখন তো অনেক হাসলো, মজা নিলো। এবার জ্বেলাসিতে জ্বলুুক।
তাকে দেখিয়ে দেখিয়েই সিয়াম ভাইয়ার সাথে কথা বললাম, হাসলাম, আপ্যায়ন করলাম। পরে দেখলাম সেও দিশা আপুর সাথে কথা বলছে। তাকে রুমে নিয়ে গেলো আমার সামনেই। বেচারা মনে করেছে আমি জ্বেলাসিতে জ্বলবো। কিন্তু আমি তো জানি দিশা আপুকে একদমই নিতে পারে না সে। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকলো। দিশা আপু বারান্দায় ফোনে কথা বলছিলো তখন। আমাকে এক টানে তার পাশে বসিয়ে বললো, ” আমি ডিসিশান নিয়েছি দিশাকে একটা চান্স দিবো। বেচারী আমার পেছনে অনেক ঘুরেছে।”
আমি হেসে বললাম, ” তো যাও। আমাকে ডেকেছো কেন? ”
নিঠুল ভাই সত্যি সত্যিই গেলো। দিশা আপুর পেছনে দাঁড়িয়ে রেলিঙে হাত রাখলো। তার নাকটা দিশা আপুর চুল ছুঁইছুঁই। খুব কাছে। মুহূর্তেই বুকটা কেমন করলো আমার। এরমধ্যে দিশা আপু পেছনে ফিরে হঠাৎ নিঠুল ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। দিশা এমন করবে তা নিঠুল ভাই নিজেও ভাবতে পারে নি হয়তো। সে চমকে উঠে ছাড়িয়ে নিলো জোর করে। আমিও দৌড়ে চলে আসলাম সেখান থেকে। হঠাৎ কান্না পেলো আমার। রিনি আপুর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটু পর দরজায় কড়া নাড়লো। নিঠুল ভাই এসেছে ভেবে খুললাম না। রিনি আপু ওপাশ থেকে বললো দরজা খুলতে। সে’ই কড়া নেড়েছে। অমন দৃশ্য দেখে আমার মনের অবস্থা কী হতে পারে সেটা জেনেও নিঠুল ভাই আসলো না একবারও। তাহলে কী সত্যি সত্যিই..। আর ভাবতে পারলাম না। খেতে বসলে নিঠুল ভাই আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, ” সিয়াম ভাইয়ের পাশে বসিস নি কেন? যা, আপ্যায়ন কর।”
খাবার টেবিলেও দিশা আপুকে নিয়ে আদিক্ষেতা দেখালো। তাদের আশেপাশে গেলাম না আর। বিকেলের দিকে তারা চলে গেলে নিঠুল ভাই রিনি আপুকে বলে, ” ঘরে মন টিকছে না ভাবী একদম। তারা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মনটাও নিয়ে গেলো।”
রিনি আপু হেসে বললো, ” দিশাই তাহলে সে। এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিস। আজ তো সব দেখলাম। ”
আমি বললাম, ” আপু, চলে যাবো আমি। আব্বু মন খারাপ করবে।”
সবাই থাকতে বললো নিঠুল ভাই ছাড়া। রুম থেকে ব্যাগ আনতে গেলে পেছনে নিঠুল ভাই এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমাকে তার কাছে টেনে মুখ কাছাকাছি এনে বলে, ” যাওয়ার আগে একটা চুমু দিয়ে যা তো! দিশাও দিয়েছে। কোনটার ফ্লেভার কেমন টেস্ট করি!”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকালাম। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ” আন্ডা চোখে এভাবে তাকাস কেন? দিশা চোখে এক সমুদ্র প্রেম নিয়ে কী সুন্দর তাকায়! চোখের দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। ”
আমি এবার ঠোঁট টিপে কেঁদে দিলাম। নিঠুল ভাই হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” আমাকে জেলাসিতে জ্বালাতে আসবি তো নিজে দশগুণ জ্বলবি জেলাসিতে।”
” সে তোমাকে জ..জড়িয়ে ধরেছে। ” বললাম আমি।
সে বললো, ” আচ্ছা আমিও ধরবো..”
তার কথা শুনে আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করলে সে আরো জোরে চেপে ধরে তার বুকের সাথে। হাসছে সে আর বললো, ” তোকে।”
#চলবে…
#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -০৯]
#আফরোজা-আনজুম
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আম্মুর রুমে গেলাম। আব্বু ডেকেছিল। আমি যেতেই আব্বু আমাকে বসিয়ে দিল হিসাব-নিকাশের খাতা দিয়ে। চোখের সমস্যার জন্য প্রায় সময় হিসাব আমাকে দেখান। মাঝে আব্বুর ফোন বেজে উঠে। আমাকে নিতে বললে দেখি রেবা আন্টির কল। আব্বুকে দিয়ে আবারও হিসাবে মনযোগ দিলাম। মনযোগ সরে গেলো আব্বুর কথা শুনে। আব্বু বললো, ” আপা, সেদিন তো বললাম মেয়ে বিয়ে দিবো না এখন।”
আন্টির আগের কথা খেয়াল করি নি। তবে এখন শুনতে পেলাম,
” হ্যা। সেটাই তো বলেছি। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। সরাসরি আপনাদের বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দেবে বলছে। নিলয়ের আব্বাকে ফোন করে বললো সেও যেন সাথে গিয়ে বলে। আপনি বরং ফোন করে তাদের সরাসরি জানিয়ে দিন যে প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবেন না। এটাই ভালো হবে। এর আগে অন্য কথা বলায় তারা হালকা ভাবে নিয়েছে।”
” হ্যা সেটাই করবো।”
প্রবাসী বলায় বুঝে গেলাম কার কথা বলছে। হঠাৎ নিঠুল ভাইয়ের আওয়াজ পেলাম। আন্টির পাশেই ছিল বোধহয়। সে বললো,
” আঙ্কেল, তুমি এখন ফোন করে জানিয়ে দাও।”
আব্বু বললো, ” এখন কেন? রাত এগারোটা বাজছে। কাল সকালে বলবো।”
” কাল সকালে না। এখন বলো। তারা জেগে আছে।”
তার গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেলো। আব্বু আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। তারপর মনে পড়লো নিলু আপুর শ্বশুর বা শাশুড়ি কারো নাম্বার নেই। ফোন করবে কীভাবে? আব্বু আমাকে বললে নাম্বারটা নিতে। আন্টির কাছে কল করে নাম্বার দিতে বললাম। নিঠুল ভাই আমাকে শুনিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, ” সব দোষ ওর। সেদিন দেখলে না সিয়ামের সাথে কেমন লেগে থেকেছে! তার মধুর মধুর কথা শুনেই তো সে মনে করেছে এও পছন্দ করে হয়তো তাকে। এই বেয়াদবটাই পাগল করেছে সিয়াম ভাইকে। নয়তো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর এখন আবার উতলা হচ্ছে কেন? বেয়াদব মেয়ে! কাজই হচ্ছে ছেলেদের পাগল করা।”
আরো কিছু বলতো; আন্টি ধমক দেওয়ায় চুপ হয়ে যায়। এদিকে অপমানে আমার কান্না চলে আসে। আন্টির সামনে কীভাবে বলতে পারলো এটা! সিয়াম ভাইয়ার সাথে সেদিন কথা বললেও এমন কিছু করি নি যাতে মনে হয় আমার তাকে পছন্দ। এখানে আমার দোষটা কী!
.
.
.
পিউ ফোন করে লাইব্রেরিতে যেতে। ক্লাস অফ থাকায় এমনিতেই বসে ছিলাম বিরক্ত হয়ে। পিউ বলার পর আর দেরি করি নি। একটা ছেলেকে দিয়ে নিঠুল ভাই খবর পাঠালো দেখা করতে। সে ভবনের সামনে আছে। ইচ্ছে করেই যাই নি আমি। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি পিউ কোণার একটা বেঞ্চে বসে মেবাইল টিপছে। খানিকটা ঝুঁকে দেখলাম ছবি দেখছে রুপম ভাইয়ের। আমাকে দেখে মোবাইল রেখে অস্থির গলায় বললো, ” আমি মরে যাবো, রোজ। আমি মরে যাবো। ”
“কত সুন্দর হাসিমুখে রুপম ভাইয়ের ছবি দেখছিলি এইমাত্র। আর এখন আমাকে দেখেই মরে যাচ্ছিস!”
” রুপমের ছবি দেখলে শত দুঃখের মাঝেও হাসি ফোটে। কী করবো বল! ”
” রু..প..ম! ভাইয়াটা কেটে দিলি! তো মরে যাবি বলেছিস। কারণ কী? ”
পিউ এমন প্রশ্নে আহত হলো মনে হচ্ছে। বললো, ” আমি মরে যাবো শোনার পরও তুই এতো স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করছিস কারণ কী! তোর একটুও টেনশন হচ্ছে না?”
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো পিউ। আমি বললাম, ” নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে বলেছিস। সত্যিই যে মরে যাবি না সেটা জানি আমি। এখন বল তো কী নিয়ে দুঃখ! ”
” রুপমকে নিয়ে। সারাক্ষণ তার পিছু ঘুরি, তাকে নিয়ে ভাবি কিন্তু সে একদম দুধের বাচ্চার মতো থাকে। যেন কিছুই বুঝে না। আর আমাকে ডাকে বোন। আমি নাকি তার ছোট বোন। এইতো একটু আগেও বোন ডেকে গেলো।”
আমি হাসলাম। বললাম, ” তার হয়তো ছোট বোন নেই। তাই তোকে ছোট বোন হিসেবে দেখে।”
পিউ রেগে উঠে বললো, ” ভার্সিটিতে মেয়ের অভাব আছে নাকি! আমাকে কেন বোন ডাকে! আজকেই বুঝিয়ে দিবো আমি তার বোন নাকি অন্য কিছু। ”
সে চলে যাচ্ছে। আমিও তার পিছু নিলাম। সিড়ি দিয়ে নামতে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইকে দেখলাম। রুপম ভাই জিজ্ঞেস করলো পিউ এমন করে কোথায় গেলো৷ আমি না লুকিয়ে সরাসরি বললাম, ” ভাইয়া, পিউ আপনাকে ভালোবাসে। আপনি তাকে বোন বলে ডাকেন তাই সে রেগে আছে। এখন সে নাকি মরে যাবে।”
রুপম ভাইয়া নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালো। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমি পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। ক্লাস জলদি শেষ হওয়ায় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। সবাই আসলে গাড়ি ছাড়বে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। সেও দেখলো। মুহূর্তেই আবার আড়াল হয়ে গেলো। হঠাৎ পাশে কেউ গা ঘেঁষে বসায় চমকে উঠলাম আমি। নিঠুল ভাই আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পানি আছে কি না! বলার সাথে সাথে ব্যাগের চেইন খুলে নিয়েও ফেললো বোতল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বোতলটা বাইরে ছুড়ে মারলো। আমি রেগে গেলাম তা দেখে। বললাম, ” বোতলটা ফেলেছো কেন?”
সে আমার ওড়নার কোণা টেনে হাত মুছে বললো, ” বোতলে পানি খাওয়া সেইফ না। একটা ওয়াটার পট কিনতে পারিস না! নাকি তোর কন্জুস বাপ এখানেও বলে যে বোতল থাকতে ওয়াটার পট কেন কিনতে হবে টাকা খরচ করে! শুধু শুধু খরচ! ”
” আমার আব্বুর কাছে টাকার পাহাড় নেই আমাদের। বলাটাই স্বাভাবিক। ”
” নেই! তোর বাপের কতো টাকা আছে সব জানা আমার। এতো টাকা কেন জমাচ্ছে রে না খেয়েদেয়ে! তোর বাপের যা বুদ্ধি… ”
আমি উঠে চলে আসতে চাইলাম। সে আমাকে বসিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলো। বললো, ” আমি প্রচুর রেগে আছি তোর উপর। মাথা ঠান্ডা রাখতে চাইছি। তুই আবার আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস! সকালে আধঘন্টা মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম ভবনের সামনে। কয়বার ডেকে পাঠিয়েছি? আসিস নি কেন? ”
” কেন! বেয়াদব, খারাপ মেয়েটাকে কেন প্রয়োজন তোমার যে ছেলেদের পাগল করে দেয়! ”
” কারণ মেয়েটা আমাকেও পাগল করে দিয়েছে। তাকে অন্য কেউ চাইলে আমার ইচ্ছে করে তাকে খুন করতে। আমার তাকে অন্য কেউ কেন চাইবে! কেন ভাববে তাকে নিয়ে! এতো বছর ধরে তাকে ভালোবেসে আসছি, আগলে রেখেছি। হুট করে অন্য কেউ কেন তার জীবনে আসতে চাইবে! সে শুধু আমার। একান্ত আমার। তাকে নিয়ে ভাববোও আমি।”
কেঁপে উঠলাম আমি। পাশাপাশি সিটে বসায় খুব কাছে দুজনে। আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলেছে নিঠুল ভাই। তার কণ্ঠে কী যেন ছিলো! চোখ নামিয়ে নিলাম আমি লজ্জায়। নিঠুল ভাই একহাতে আমার মুখ তুললো। তার মুখটা কাছাকাছি আনছে। সে কী চুমু খাবে এখন! আমি কাঁপছি, বুকে ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
” যেটা ভেবে আন্ডা চোখগুলো বন্ধ করে ফেলেছিস সেটা একদমই করবো না এখন। তার জন্য স্পেশাল প্লেস, স্পেশাল মোমেন্ট চাই।”
তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কানের কাছে অনুভব করছি। চোখ খুললেই লজ্জায় পড়তে হবে তাই চোখ বন্ধই রাখলাম। অন্যদের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ঠিক হয়ে বসলাম। নিঠুল ভাই পাশের সারির সোজাসুজি সিটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এপাশ ফিরে হাসলাম আমিও।
#চলবে…