#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ০৮+৯
এতো রাতে কে নক করে? হুট করে ফাইজান ভাইয়ের মামার মুখটা ভেসে উঠলো। সেই লোকটা নয় তো? শরীরে কাঁপুনি সৃষ্টি হলো। দৌঁড়ে গিয়ে ছিটকিনি আরো ভালো মতো আটকালাম। দরজার ওপাশে টোকার পরিমাণ বাড়ছে। এপাশে দম বন্ধ করে পড়ে রইলাম আমি। মিনিট কয়েক গত হতে ওপাশে শব্দ মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করেই! তবুও কান পেতে রইলাম। ওপাশে আর শব্দ হলো না। নিশ্চিত হতে অবশেষে শ্বাস ফিরে পেলাম।
গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম দ্রুত। পুরোনো কাঁথার তলায় লুকিয়ে ফেললাম নিজেকে। খুব করে কান্না পাচ্ছে। কাউকে পাশে পেতে মন চাইছে। বিশ্বস্ত কেউ! আপন কেউ। যে আমার দুঃখে দুঃখ পাবে, আমার কষ্টে যার কষ্ট অনুভূত হবে। এমন কেউ কি উপরওয়ালা আমার জন্য পাঠিয়েছেন?
বাকি রাতটুকু আর দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ঘুম এলো না। বুঝতে পারলাম, বিপদ আমার পিছু ছাড়েনি। এ বাড়িতে আরো বড় বিপদের মুখে পতিত হয়েছি।
__________
পরদিন দুপুরবেলা। সবার খাওয়া শেষ হতে অবশিষ্ট খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলাম। এঁটো থালাবাসন গুলো রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম। দেরি করলাম না। পরিষ্কার শুরু করে দিলাম। খালা এখনও ফেরেনি। এজন্য আমার কাজ একটু বেড়ে গেছে। আজ সারাদিন রুমের বাইরে বাইরে ছিলাম। বড় মা যতক্ষণ নিচে ছিল তার সাথে সাথে থেকে কাজ করেছি। ফাইজান ভাইয়ের মামা এখনো যায়নি। আমি নিশ্চিত গতকাল রাতে উনি দরজায় টোকা মেরেছে। দিন গড়িয়ে যত রাত হচ্ছে। তত ভয় বাড়ছে আমার। খালা এখনো ফিরছে না কেন!
‘জুঁই! এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে?’
থালাবাসন ধোয়া শেষ। গুছিয়ে রাখছিলাম। পেছন থেকে কেউ চায়ের কথা বলে উঠলো। কণ্ঠ পরিচিত। বহুবার শুনেছি এ বাড়িতে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঘুরে তাকালাম। দেখলাম জাবির দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা। এই ছেলেটা আমার সমবয়সী হবে। সবসময় হাসে। অথচ কতগুলো দিন হয়ে গেলো আমি হাসি না! আমার সবটুকু হাসি বাক্স বন্দি করে কেউ দূরের সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসেছে। সেগুলো হয়তো সমুদ্রের তলদেশে ছটফট করছে।
আমি মাথা নাড়লাম। চাপা সুরে বললাম,
‘দিচ্ছি।’
‘কষ্ট হয়ে যাবে? তাহলে না হয় থাক।’
তার কণ্ঠে অপরাধ বোধ ফুটে উঠেছে। চেহারায় অস্বস্তি। আমি ঝটপট বললাম,
‘কষ্ট হবে না! বানিয়ে দিচ্ছি এক্ষুণি। আপনি বসার ঘরে অপেক্ষা করুন।’
চুলায় পানি বসিয়ে দিলাম। আড়ষ্ঠতা নিয়ে দেখলাম সে এখনো যায়নি। বিশালাকার রান্নাঘরে হাঁটাহাঁটি করছে। ফ্রিজ খুলে একবার মিষ্টি বের করে খেলো। আমার চোখে চোখ পড়তে তার অর্ধ খাওয়া মিষ্টির টুকরো বাড়িয়ে দিল। বললো,
‘মিষ্টি খাবে?’
‘না!’
অসম্মতি জানিয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। সে বাকি অংশ মুখে পড়লো। চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিলাম। জাবির নামের ছেলেটা যাবে না বোধ হয়। তার চেয়ে দ্রুত চা বানিয়ে দেই।
‘বাড়ি কোথায় তোমার? পরিবারে কে কে আছে? কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছ?’
জাবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার এক হাতে চায়ের কাপ। আরেক হাতে ছাঁকনি। কণ্ঠ বেশ স্বাভাবিক। কত সহজ ভাবে কথা বলছে যেন আমি তার খুবই পরিচিত। কিন্তু না! আজ প্রথমবার ওর সাথে কথা হচ্ছে।
‘নবম শ্রেণিতে ছিলাম। অধ্যয়নরত। বিজ্ঞান বিভাগে।’
বাড়ি কোথায় বললাম না। পরিবারে কে আছে সেটাও বললাম না। শুধু পড়াশুনার ব্যাপারে বললাম। সে স্মিত হেসে বলল,
‘তাই ভেবেছিলাম। পড়াশুনা ছাড়া তো এত স্পষ্ট করে কথা বলা সম্ভব না।’
‘আমি কখন স্পষ্ট করে কথা বললাম? কখন শুনলেন?’
কৌতূহল দমন করতে না পেরে প্রশ্ন টা করেই ফেললাম। কারণ আমার যতদূর মনে পড়ে এদের সামনে আমি দুটো শব্দের বেশি কখনো উচ্চারণ করিনি। জাবির লাজুক হাসলো। বাচ্চাসুলভ হাসি। বললো,
‘কবে জানি রাতে সালেহা খালার সাথে বসার ঘরে কথা বলছিলে। অনেক কথা! তার কিছু শুনে নিয়েছিলাম আমি।’
ভারী অবাক হলাম আমি। প্রায় রাতে সবাই উপরে যাওয়ার পর খালা আর আমি বসে গল্প করি। আমি অবশ্য কম বলি। খালা বকবক করে, আমি শুনি। বুঝতে পারলাম জাবির আমাকে বহুদিন হলো লক্ষ্য করেছে। এইজন্য এত সহজ ব্যবহার।
চা হয়ে গেছে। ছাঁকনি হাতে ঢালতে নিতে জাবির বাঁধা দিল। বললো,
‘আমি ঢালছি। আরেকটা কাপ নিয়ে এসো।’
পাশের তাক থেকে আরেকটা কাপ আনলাম। সে নিজেই ছেকে দুই কাপে চা ঢাললো। একটা নিজের হাতে নিয়ে আরেকটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
‘আমি চা খাই না।’
‘অভ্যাস করো। চা ছাড়া মানুষ বাঁচে বুঝি? ধরো!’
চা ছাড়া মানুষ বাঁচে। ভালোমত বাঁচে। তিনদিন ভাত ছাড়াও মানুষ বাঁচে। এই যে আমি বেচেঁ আছি। শুধু ভালোবাসা ছাড়া, প্রিয় মানুষদের ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তবুও বাঁচতে হয় এবং ভীষণ কষ্ট হয়। এ বাঁচাকে বাঁচা বলে না। অমত প্রকাশ করে বললাম,
‘আমি খেতে পারি না চা।’
‘আহা! খাও না খাও, কাপটা ধরো তো! হাতে গরম লাগছে।’
চায়ের কাপ ধরলাম আমি। অনিচ্ছা নিয়ে! হাত খালি হতে জাবির নিজের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সুখানুভূতি নিয়ে বললো,
‘ভারী মিষ্টি। দুর্দান্ত হয়েছে। ধন্যবাদ তোমাকে।’
চা পেয়ে কোনো মানুষ এত খুশি হয় সেটা জাবিরকে না দেখলে অজানা থাকতো। চোখে মুখে প্রগাঢ় তৃপ্তির ছায়া। মুচকি হাসি দিয়ে সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কি অমায়িক ব্যবহার! বহুদিন পর ভেতরে একটু ভালো লাগা কাজ করলো আমার। চা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতো গরম চা কেউ খায় কি করে? কাপ নিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতে সামনে এসে দাঁড়ালেন ফাইজান ভাইয়ের মামা। ভয়ানক চমকে গেলাম। আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলেন তিনি। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
‘খুউব টেস্ট হইছে পাখি।’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
‘জুঁই আমার নাম।’
তিনি শুনলেন না হয়তো। কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতে আমি পা চালালাম। বেশিদূর এগোতে পারলাম না। কব্জিতে টান পড়লো। উসখুস করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন,
‘এমন করছো কেন? আসো কথা বলি। আমাকে মামা বলে ডাকবা। আলতাফ মামা।’
গা গুলিয়ে উঠলো আমার। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে। তার পদধ্বনি কানে আসছে। বুকে সাহস ফিরে পেলাম যেন। কয়েক সেকন্ডের ব্যবধানে বড় মাকে দেখতে পেলাম। আলতাফ মামা বড় মাকে দেখেও হাত ছাড়লেন না। উল্টো টেনে নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। বড় মা কাছে আসতে বললেন,
‘আপা। এতো ছোট মেয়ে কাজে নিছো ক্যান? এ কি কাজ পারবে? মেয়ে তোমার বয়স কত?’
আমি নিচু গলায় বললাম,
‘পনেরো!’
‘আরে সব কাজ পারে। মা মরা মেয়ে। জন্মের সময় মাকে হারাইছে। দাদীর কাছে বড় হইছে। দাদীও আর বেঁচে নাই। নিয়ে নিলাম কাজে।’
‘আহারে! বাচ্চা মেয়ে। এই বয়সে কতকিছুর মধ্যে দিয়ে গেছে।’
বলে আলতাফ মামা আমার মাথায় হাত ছোঁয়ালো। সেই স্পর্শে ছিটেফোঁটা স্নেহ ছিল না। ছিল অন্যকিছু! তবে বড় মার কথা শুনে বুঝলাম আব্বা এদের মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে। আমার কি উচিৎ এই মিথ্যে গুলো সংশোধন করা? হয়তো উচিত। কিন্তু এতবড় সত্য বলার সাহস নেই আমার। বললেও সেই একই জায়গা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মা মরা মেয়ে। বড় মা ফের বললেন,
‘জুঁই ঘুমাসনি? সারাদিন কাজ করলি গিয়ে বিশ্রাম নে।’
আলতাফ মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলেছিস? আসবে কবে কিছু বলেছে?’
‘আসবে আপা। কিছুদিন পর আসবে। বড় কাজে গেছে।’
বড় মার এদিকে নজর নেই। তিনি সামনের সোফায় বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাঁজ করছেন। আলতাফ মামা হাত ছেড়ে দিয়েছে আমার। সুযোগ বুঝে উঠে দাঁড়ালাম আমি। বড় মাকে বললাম,
‘আমি রুমে যাই তাহলে।’
‘যা। ঘুমা গিয়ে। আমি সন্ধায় ডেকে দিবো।’
বড় মায়ের অনুমতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলাম না। দ্রুত হেঁটে চলে গেলাম। বসার ঘরে বড় মা আর তার ভাই কথা বলছে। আমি রুমে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। এই ছিটকিনি বড় মা না ডাকার আগ পর্যন্ত খুলবো না।
___________
খুবই চমকপ্রদ হলেও সত্য যে এ বাড়িতে আমার লেখাপড়ার কথা উঠেছে। বসার ঘরে মোটামুটি সবাই উপবিষ্ট। আমি এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্কুল যাওয়ার কথা প্রথম কে তুলেছে জানি না। আমার অনুমান শক্তি বলছে, ফাইজান ভাই। ফাইজান ভাই কথা বলে না আমার সাথে। কিন্তু যতবার চোখে চোখ পড়ে বা অসাবধানতা বশত তার সামনে পড়ে যাই কেমন অপরাধবোধ নিয়ে তাকায়। যেন আমার আজকের এই দুর্দশার জন্য তিনি দায়ী। আমি যে পড়াশুনা না করে এ বাড়িতে কাজ করছি এসবের জন্য একমাত্র তিনি দায়ী। আমি অবাক হই। ভারী অবাক হই। এই মানুষটা এত ভালো কেন?
নানা মুনির নানা মত! আমার স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটাতে একেক জন একেক রকম মত দিতে লাগলো। দু-চারজন রাজি। তাদের অভিমত বাচ্চা মেয়ে। আর কিছুদূর পড়ুক। প্রয়োজনে বিজ্ঞান বিভাগে না পড়ে অন্য বিভাগে পড়ুক। তবুও পড়ুক।
আবার কারো কারো অভিমত ভিন্ন। পড়লে বাপের বাড়ি থেকে পড়তো! ঢাকা কেন এসেছে? কাজের জন্য এসেছে কাজ করুক। পড়াশুনা দিয়ে কি হবে? নাম লিখতে পারে, টুকটাক পড়তে পারে তাতেই হয়েছে।
এসব কথোপকথনে আমি নিরব দর্শকের মতো রইলাম। একসময় বৈঠক ভাঙলো। আমার হাতের চা খেয়ে। কেউ কেউ চায়ের কাপ নিয়ে উপরে চলে গেল। আমি পূর্বের জায়গা দাঁড়িয়ে রইলাম। গত পরশুদিন আলতাফ মামা চলে গেছে। জরুরী কাজ পড়েছে নাকি। এজন্য একটু নির্ভয়ে আছি। আমার চিন্তার মাঝে হঠাৎ ফাইজান ভাইয়ের ডাক পড়লো। বললো,
‘জুঁই তোমার কি ইচ্ছে? পড়াশুনা করবে নাকি করবে না?’
থতমত খেলাম আমি। কি উত্তর দিবো? পড়াশুনা করতে চাই তো। খুব করে চাই। আমি চিরকাল কষ্টে থাকতে চাই না। ঘরবন্দী থাকতে চাই না। নিজের পরিবর্তন চাই। অনেক কিছু শিখতে চাই। জানতে চাই। মানুষের জন্ম তো একটাই। সেই একজন্ম অন্যের বাড়িতে কাজ করে কাটিয়ে দিবো? কাঁচুমাচু স্বরে বললাম,
‘যদি সম্ভব হয় তাহলে পড়তে চাই।’
আর কোনো কথা হলো না। ফাইজান ভাই তার রুমে চলে গেল। এই মানুষটার সাথে কোথায় যেন রাফি ভাইয়ের মিল পাই। কিন্তু কোথায় তা ধরতে পারি না। কিন্তু কোথাও মিল আছে। ঘুরেফিরে যতবার তার দিকে চোখ পড়ে রাফি ভাইয়ের মুখটা মানসপটে ভেসে উঠে।
সব চিন্তা উড়িয়ে কাজে হাত দিলাম। সালেহা খালা চলে এসেছে। একা একা মাছ কাটছে। আমি যেতে খালা বললো,
‘পড়াশুনাডা কর ফুল। আমি বড় বু-রে কবোনে। পড় তুই। সারাডা জীবন অন্যের বাড়ি কাম করবি নাকি রে? পড় ভালো কইরা।’
আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। এ বাড়িতে আছি অনেক দিন হয়ে গেছে। আব্বা একবারও খোঁজ নেয়নি। আমি জানতাম সে খোঁজ নিবে না। এটা নিয়ে মন খারাপ হয় না আর। আমি জানি আমার ভালো চাওয়ার মত এখনো অনেক মানুষ আছে। এ ধরাতে-ই আছে। আমার আশপাশে-ই আছে!
_________
আব্বা এসেছিল। গতকাল রাতে এসেছিল। কিন্তু আমার সাথে দেখা করেনি। বাড়ির ভেতরেও আসেনি। এ বাড়ির ড্রাইভার আর আব্বা নাকি বন্ধু মানুষ। তার সূত্র ধরে আজ আমি এ বাড়িতে। গতকাল আব্বা শুধু সেই ড্রাইভারের সাথে দেখা করে চলে গেছে। সকালবেলা নাস্তা বানানোর সময় খালা আমায় জানালো বিষয়টি। এতো কষ্ট পেলাম! আব্বার উপর চরম ঘৃণা জমে আছে। তবুও তিনি আমার সাথে দেখা না করে চলে গেছেন মানতে পারলাম না। রুমে ঢুকে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিলাম।
কান্না থামলো মিনিট বিশেক পর। বড় মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে। দ্রুত চোখ মুছে দরজার বাইরে এলাম। বড় মা কাছাকাছি এসে বললেন,
‘ঝটপট তৈরি হয়ে নে জুঁই। ফাইজান দাঁড়িয়ে আছে। তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে।’
ভারী অবাক হলাম আমি। আমার স্কুল যাওয়ার কথা উঠেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। এতদিন এই ব্যাপারটা নিঃশব্দ ছিল বলে ধরে নিয়েছিলাম আর স্কুলে যাওয়া হবে না বোধহয়। আস্তে আস্তে সূক্ষ্ম এক খুশির অনুভুতি ভেতরে ছড়িয়ে পড়লো। দৌঁড়ে তৈরি হতে গেলাম।
ফাইজান ভাইয়ের হাতে একটা ফাইল। ফাইলে কিছু কাগজপত্র। দুজন নিশ্চুপ হেঁটে চলেছি। গেট থেকে উনি বলেছেন স্কুলটা কাছাকাছি। গার্লস স্কুল। কোনো ভয় নেই। হেঁটে রোজ আসা যাওয়া করা যাবে। ফাইজান ভাই বেশিক্ষণ নিরব থাকলো না। আশপাশের রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিল। বড় বড় বিল্ডিং এর কোনটা কি সব বুঝিয়ে দিল। একবার বলেই ফেললো,
‘হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’
ছোট্ট একটা প্রশ্ন। অথচ তাতে আমার কি যে ভালো লাগলো! ঘন ঘন মাথা ডানে বায়ে নেড়ে বললাম,
‘না! একটুও কষ্ট হচ্ছে না।’
সত্যি কষ্ট হচ্ছে না আমার। ছোটবেলা থেকে হেঁটে অভ্যাস আছে। গ্রামে যে স্কুলে পড়তাম সেটা বেশ দূরে ছিল। নিয়মিত হেঁটে যেতাম সেখানে। যার দরুন হাঁটাহাঁটি তে বেশ পাকা আমি। কিন্তু ফাইজান ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে টা বুঝতে পারছি। উনারা বড়লোক মানুষ। গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে সবসময়। আজ আমাকে রাস্তা চিনিয়ে দেওয়ার কারণবশত হাঁটতে হচ্ছে।
‘এইতো পৌঁছে গেছি। এটাই স্কুল।’
খানিক দূরের স্কুলটা ইঙ্গিত করে বললো ফাইজান ভাই। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতবড় স্কুলে পড়বো আমি? বাহির থেকে কি যে সুন্দর লাগছে। স্কুলের ভেতরে ঢুকে আরো অবাক হয়ে গেলাম। চারপাশ পরিপাটি, ছিমছাম। কোনো ছেলে নেই। চারিদিকে মেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে ছুটোছুটি করছে। বেশিক্ষণ সে দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো না। উনার সাথে স্কুলের অফিস রুমে যেতে হলো।
স্কুলের প্রায় শিক্ষকেরা ফাইজান ভাইকে চিনে। চলমানরত সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করলো। বুঝলাম উনি পরিচিত সবার। পরিচিত হবে নাই বা কেন? উনার বাবা নামকরা লোক। রাজনীতি করে। উনার চাচাও কম না! আবার ফাইজান ভাই নিজে কম কিসে! খুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। পড়াশুনা শেষ দিকে প্রায়।
অফিস রুমের স্যার দ্রুত ভর্তির সব কাজ শুরু করে দিল। কাগজ পত্র দেখে বুঝলাম আব্বা গতকাল ভর্তির প্রয়োজনীয় কাগজ দেওয়ার জন্য ঢাকা এসেছিল। আব্বাকে জানালো কে? পাশের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে গেলাম।
ভর্তির কাজ শেষ হলো দ্রুত। অবশেষে আমিও এতোবড় এক স্কুলের ছাত্রী হয়ে গেলাম। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এখানে টিকতে পারবো তো? বাড়ির কাজ সামলিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতে পারবো তো? প্রশ্ন জাগলো মনের কোণে। জানিনা এই ভাগ্যে বিধাতা আর কি কি লিখে রেখেছে। তবে আমাকে পারতে হবে। যে মানুষগুলো এতো আগ্রহ নিয়ে আমায় ভর্তি করালো তাদের অসন্তুষ্ট করা যাবে না। কাজ শেষ হতে বের হয়ে আসছিলাম। হঠাৎ অফিস রুমের স্যারটা ফাইজান ভাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘স্টুডেন্ট কে হয় আপনার?’
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ফাইজান ভাই এখন কি উত্তর দিবে? বাড়ির কাজের লোক বলে পরিচয় দিবে? সে সময় নিলো না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘ছোট বোন আমার। দেখেশুনে রাখবেন প্লিজ।’
ফাইজান ভাইয়ের নির্মল, স্নেহাশিস কণ্ঠ। এতটুকু মিথ্যে নেই। কিন্তু তার এই অকপটে বলা সত্যটা বুকে তীব্র আঘাত হানলো। তার মুখের ‘বোন’ সম্বোধন শুনে অন্তরে ব্যথা অনুভূত হলো। কোথায় যেন তীব্র অভিমান জমলো। তবে কি আমার অবচেতন মন তার কাছে অন্যকিছু আশা করেছিল?
(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ০৯
তবে কি আমার অবচেতন মন তাকে নিয়ে অন্য কিছু ভেবেছিল? জানি না! এসব তো কখনো ভাবিনি। শুধু জানি তার ভালো ব্যবহার গুলো মনে জোর এনে দিত।
ফাইজান ভাই হাঁটছে। তার হাতে আর্টসের একগাদা বই। বিভাগ বদলে আর্টসে ভর্তি হয়েছি। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই। পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারলেই হলো।
‘ভর্তি তো করে দিলাম। পড়াশুনা ঠিকমতো করবে তো?’
‘করবো।’
ক্ষীণ স্বরে প্রতিত্তর করলাম আমি। নিশ্চুপ তার পিছু পিছু হেঁটে চলেছি। কোনো দিকে নজর নেই আর। যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে স্কুলে পা রেখেছিলাম তা ছিটেফোঁটা বিষাদের নিচে চাপা পড়েছে। বিষাদের এতো শক্তি!
স্কুলের সামনে অসংখ্য খাবারের দোকান। ফাইজান ভাই দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
‘কিছু খাবে ফুলি?’
চমকে উঠলাম আমি। ফুলি ডাক শুনে। এই নামে আমায় কখনো কেউ ডাকেনি। আমার স্তব্ধ ভাবকে সম্মতি ধরে নিল সে।
‘আসো। ফুচকা খাই।’
ফুটপাতে সারি সারি ফুচকার দোকান বসেছে। সিমেন্টের বাঁধানো এক বসার জায়গাতে বসে আমি। দুই বাটি ফুচকা নিয়ে এলো ফাইজান ভাই। একটা হাতে ধরিয়ে দিল। ফুচকার দিকে তাকিয়ে সেজো আপার কথা মনে পড়লো আমার। আপার ফুচকা ভীষণ পছন্দের ছিল। কি যে মন খারাপ হয়ে গেল!
‘তোমার বয়সী আমার একটা বোন ছিল জুই। মা নাম রেখেছিল ফাহমিদা। কিন্তু আমি ফুলি বলে ডাকতাম সবসময়। ফুলের মতো দেখতে ছিল তো! বাচ্চা বয়সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লো ফুলি। তিন কি চার বছর বয়স তখন। আহামরি অসুখ না। সামান্য ডায়রিয়া! অথচ সেই দুই দিনের ডায়রিয়াতে ফুলি আমাদের ছেড়ে চলে গেল। গ্রামের পরিবেশ তখন অস্বাস্থ্যকর ছিল। উন্নত চিকিৎসা ছিল না। মাও দরিদ্র ছিল! সবকিছু মিলিয়ে ফুলিকে হারালাম। ফুলি থাকলে এতদিনে তোমার মত বড় হয়ে যেত। খুব মিস করি ওকে।’
ফাইজান ভাই ফুচকা মুখে পুড়ল। মুখ লুকালো আমার থেকে। কিন্তু তার কন্ঠের গভীর দুঃখবোধ ছুঁয়ে গেলো আমায়। এই মানুষটা কখনো হাসে না। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে থাকে। ভেতরে না জানি কত কষ্ট চাপা দিয়ে রেখেছে।
‘আপনি ছোটবেলায় গ্রামে ছিলেন?’
‘গ্রামে জন্ম আমার। গ্রামে বেড়ে উঠা!’
‘কিন্তু……’
হিসাব মিলাতে পারলাম না। ফাইজান ভাইয়ের দাদু, বাবা সবাই তো ঢাকার স্থানীয়। বহু বছর ধরে এখানে বসবাস। তাহলে তার জন্ম, বেড়ে উঠা গ্রামে কেন? প্রশ্ন করলাম না। ফাইজান ভাই খাওয়ার ফাঁকে বললো,
‘পড়াশুনা করবে ভালো করে। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নিজের শক্তি বাড়াতে হয়। সে শক্তি শিক্ষা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না তোমাকে।’
‘হুঁ।’
সে আর কিছু বললো না। তীব্র মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, পৃথিবীর কেউ ভালো নেই। সবার কিছু না কিছু গোপন দুঃখ রয়েছে। হারানোর কষ্ট রয়েছে। এ পৃথিবীর দেয়াল জুড়ে যেন শুধু অপূর্ণতার গল্প!
__________
শনিবার থেকে আমার স্কুল। ফাইজান ভাই বৃহস্পতিবার রাতে সব গোছগাছ শুরু করে দিলো। বড় মার থেকে জানতে পারলাম তার ছুটি শেষ হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য এতদিন ছিল। মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করলো! ভেতরে ভেতরে পুলকিত অনুভব করলাম। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল।
পরদিন ভোরবেলা সে রওনা করলো। এই প্রথম বাড়ির বাইরে গেট পর্যন্ত এলাম। তাকে বিদায় দিতে। বড় মায়ের চোখ ভেজা। বাকি সবার মন খারাপ। আমি এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেবেছিলাম ফাইজান ভাই আমাকে খেয়াল করবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কাছে এলো। মাথায় টোকা মেরে বললো,
‘ভালো মতো পড়াশুনা করিস। অনেক পিছিয়ে পড়েছিস কিন্তু।’
আমি মাথা নাড়লাম। ক্ষীণ সুরে বললাম,
‘আপনি সাবধানে থাকবেন ভাই।’
‘থাকবো।’
এই প্রথম তার মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখতে পেলাম। সে চলে গেল। তার দুঃখ ভরা, আপনজন হারানো বিষণ্ণ দৃষ্টি কেউ দেখতে পেল না।
সেই রাতে আমি ডায়েরি লিখতে বসলাম। ফাইজান ভাই আমার নতুন জীবনের উপহারস্বরূপ একটা ডায়েরি আর কলম দিয়েছে। সেই কলম দিয়ে ডায়েরি লিখতে বসলাম। লিখতে বসলাম আমার জীবনের গল্প। আমার অল্প বয়সের অনুভুতির গল্প। কিভাবে পরিবার হারিয়ে এই অচেনা শহরে আশ্রয় নিলাম তার গল্প।
রাত শেষের দিকে প্রায়। লিখতে লিখতে ভোর হয়ে গেল। ঠিক গুছিয়ে লিখতে পেরেছি কি না জানি না। আমার লেখা পড়ে কেউ কি অনুভব করতে পারবে আমার দুঃখ? আমার হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোর বেদনা? হয়তো পারবে, হয়তো পারবে না! ডায়েরিতে শেষ টান দিলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি সালেহা খালা নড়চড় করছে। ঘুম জড়ানো গলায় খালা বললো,
‘ঘুমাইবি না মাইয়া? ভোর হইয়া আইলো যে।’
‘ঘুমাবো না খালা। আমার জীবনের এক নতুন ভোর আসছে। তাকে আমন্ত্রণের অপেক্ষায়।’
_________
‘এই জুঁই! বই-খাতা নিয়ে দ্রুত রুমে চলে আয়।’
দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে মুখ বের করলাম। সামান্তা আপু সিঁড়ির উপর থেকে ডাক দিয়েছে। আমি ঝলমলে সুরে উত্তর দিলাম,
‘আসছি আপু। একটু অপেক্ষা করুন।’
একহাতে বই খাতা আরেক হাতে ট্রে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সামান্তা আপুর জন্য চা বানিয়েছি। কয়েক সিঁড়ি উঠতে উপর থেকে হুড়মুড় করে জাবির নামলো। ছো মেরে আমার হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিল। কণ্ঠে অধিকার ফুটিয়ে বললো,
‘তোর কাল পরীক্ষা না? রান্নাঘরে যেতে বলেছে কে?’
‘শুধু তো চা বানিয়েছি। কত সময় আর লেগেছে!’
জাবিরের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলাম। কিন্তু তাতে ছেলেটার মুখের কাঠিন্য দূর হলো না। সে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে গটগট করে উপরে চলে গেল। হাসলাম আমি। এই ছেলেটা এমন পাগল! শুধু চা বানিয়েছি? আরো কত কাজ করে এলাম। কাজ না করে অন্যের বাড়ি থাকা যায়? কেউ থাকতে দেয়!
ইতোমধ্যে মাস ছয়েকের বেশি কেটে গেছে। বিগত কয়েক মাসে কতকিছু ঘটে গেলো। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষা এলো। তারপর এলো প্রিয় শরৎ! সেই শরৎ ও চলে যাওয়ার পথে। এই দিনগুলোতে আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক কতশত ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো।
তবে সময়ের ব্যবধানে এ বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছি আমি। ঘরের কাজ সামলে রীতিমত স্কুল ও সামলাচ্ছি। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না। যেদিন কাজের চাপ বেশি থাকে সেদিন যাই না। না গেলেও রাত জেগে পড়া শেষ করি। বিগত দিনগুলোতে সবার সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। জাবির অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। তার এসএসসি পরীক্ষা শেষ। ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন কলেজে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আর সামান্তা আপু? রাত-দিন এক করে ভর্তি পরীক্ষার পড়াশুনা করছে। আপুর কয়েক মাস পর ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। তাদের সাথে সাথে আমিও পড়ছি। সমান তালে না হলেও অনেক পড়াশুনা করছি।
সামান্তা আপুর ঘরে ঢুকে দেখলাম জাবিরও উপস্থিত। দুই কাপ চায়ের একটা নিয়ে নিয়েছে। আমি বইখাতা ছড়িয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। আপু জাবির কে বললো,
‘তুই চা খেলি কেন? ওইটা তো ওর নিজের জন্য ছিল।’
কয়েক চুমুক খাওয়া চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলো জাবির।
‘ওর নিজের জন্য ছিল তাহলে রেখে দেই।’
‘আমি চা খাবো না এখন। আপনি খেয়ে নেন।’
‘রাত জেগে পড়বি। চা টা তুই খা।’
‘তোর খাওয়া চা ও খাবে এখন? এক চড় দিবো।’
সামান্তা আপু ধমকে উঠল। অগত্যা জাবির চায়ের কাপটা ফের হাতে উঠালো। সামান্তা আপু আমাকে পড়ানো শুরু করতে সে বের হয়ে গেলো।
বার্ষিক পরীক্ষা চলছে আমার। কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা। আপু গুরুত্বপূর্ন কিছু টপিক পড়তে দিয়ে চলে গেল। আপুর ফোন বাজছে। মোবাইলে নাম্বার দেখেই তার সমস্ত মুখ জুড়ে রক্তিম এক আভা ছড়িয়ে পড়লো। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। আপু কি কারো প্রেমে পড়েছে?
‘তুই মন দিয়ে পড়। সব মুখস্ত করে ফেল। সব।’
‘হুঁ!’
আপু ফোন হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের পাশের বেলকুনিতে চলে গেল। বাহির থেকে কাচ টেনে পর্দা দিলো। আমি বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিলাম।
কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই। জাবির এলো চা, বিস্কুট আর কেক নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো,
‘বুবু কই?’
‘বেলকনিতে।’
‘তোর পড়া কতদূর? ক্ষুধা লাগেনি? খেয়ে নে কিছু।’
আমি উত্তর দিলাম না। জাবির আমার সাথে অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার করে। এই পরিবারের কিছু মানুষের তা সহ্য হয় না। হওয়ার কথা না! বাড়ির কাজের মেয়ে আমি। তার সাথে এতো সুন্দর ব্যবহার কিসের?
খাবারের প্রতি আমার অনীহা দেখে জাবির জোর করে হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। সম্মুখের বইটা হাতে নিয়ে বলল,
‘বল কতদূর পড়েছিস।’
‘পড়া শেষ। আপনি প্রশ্ন ধরুন।’
জাবির প্রশ্ন করছে। আমি তার উত্তর দিচ্ছি। হঠাৎ সে টপিক পাল্টে জিজ্ঞেস করলো,
‘সামনে আমার জন্মদিন। কি গিফট দিবি বলতো।’
‘আপনার গিফট দেওয়ার অনেক মানুষ আছে। আমি দিতে যাবো কেন!’
‘আমি তোর বন্ধু মানুষ না? তুই তো আমার কাছের মানুষ। বুবুর পড়ে আমার জীবনে দ্বিতীয় মেয়ে তুই। তোদের বাইরে আর কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় নেই।’
আমি কিছু বললাম না। জাবির আমার ব্যাপারে অতিরিক্ত যত্নশীল। যার বেশিরভাগ অন্যদের আড়ালে। তবুও মাঝে মধ্যে কারো নজরে পড়ে যায়। আমার ভালো লাগে না। কয়েক বার বারণ করেছি। তারপরও পিছু হটে না। জাবির আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তোর জন্মদিন কবে রে?’
‘জন্মতারিখ, জন্মসাল কিছুই জানি না। অনেকগুলো বোন ছিলাম আমরা। আব্বা মা মনে রাখে নাই। পরে আন্দাজ থেকে নিবন্ধন করেছে। তবে বয়সে আমি আপনার বড় হতে পারি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর স্কুলে যায়। আমার তো এখনো মনে আছে। সেদিন মাত্র আব্বা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসলো। আমি ……’
হঠাৎ থামিয়ে দিল জাবির। বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘অনেকগুলো বোন মানে? তোর আরো বোন আছে?’
চমকে গেলাম আমি। আমার মা বোনদের পরিণতি সম্পর্কে এখনো এ বাড়ির কেউ জানে না। জানলে বোধহয় আর রাখবে না। জাবিরের দাদী আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। কারণ জানা নেই। তিনি সুযোগ খুঁজছে শুধু। আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে দেওয়ার। একবার জেনে গেলে আর রক্ষে নেই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
‘ফাইজান ভাই বাড়ি আসছে না কেন? কত মাস হয়ে গেল।’
‘ভাইয়া আসবে না। বড় আব্বু বাড়ি থাকলে ভাইয়া আসে না। এর আগেরবার বড় আব্বু বিদেশ ছিল কাজে। এইজন্য ভাইয়া অনেকদিন ছিল।’
‘কেন?’
সেজন্যই কি ফাইজান ভাই খুলনা গিয়ে ভর্তি হয়েছে? হয়তো। তা না হলে ঢাকায় এতো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থাকতে সে খুলনা গিয়ে কেন ভর্তি হবে!
তবে জাবির উত্তর দিল না। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করার পর বুঝলাম ভুল হয়েছে। আমি এ বাড়ির কাজের লোক। এতকিছু জানার অধিকার নেই। বই টেনে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
জাবিরের ফোন বাজছে। সে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখে বললো,
‘রাজ ভাইয়া ফোন দিয়েছে।’
ফোন রিসিভ করে কানে নিল জাবির। রাজ ভাইয়া এ বাড়ির বড় ছেলে। বড় মায়ের প্রথম সন্তান। যে বহুদিন হলো বিদেশে। সালেহা খালা বলেছিল বাবার সাথে ঝামেলা করে বিদেশ চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। এ বাড়ির সব ছেলেই কি বাবার সাথে ঝামেলা করে? অদ্ভুত তো! তাদের বাবা মানুষটাকে তো ভালো মনে হয়। যদিও আমার সাথে কখনো তেমন করে কথা হয়নি। সারাদিন বাহিরে বাহিরে থাকেন। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।
________
আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। শেষ হতে দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির কাজ করে স্কুল আসা, আবার ছুটে গিয়ে কাজ শুরু করা। অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। ভোরবেলা নামাজ পড়ার পর আর ঘুমানো হয় না। আমি আর সালেহা খালা নাস্তা বানানো শুরু করে দেই। তারপর সারাটা দিন দৌঁড়ের উপর থাকতে হয়। তবুও খালার জন্য বেচেঁ আছি। সে যদি সাহায্য না করতো এতদিনে মরে যেতাম। অনেক আগে জীবন যুদ্ধে হেরে যেতাম।
এখন যেকোনো পরিস্থিতিতে বেচেঁ থাকতে শিখে গেছি। ভালো থাকতে শিখে গেছি। আমার সাথের মেয়েগুলো কত খেলাধুলা করে। সারাক্ষণ দৌঁড়-ঝাঁপ পারে। হাসা-তামাশা করে। শুধু আমি চুপচাপ থাকি। গম্ভীর হয়ে থাকি। তাদের এসব ছেলেমানুষী মনে হয়। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বড় হয়েছি। খুব কাছ থেকে কঠিন এক জীবন উপলব্ধি করেছি। এসব আমাকে বয়সের তুলনায় অনেক বড় করে দিয়েছে যেন! চিন্তা ভাবনা পূর্ণবয়স্কদের মত হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত দুঃখ কষ্ট অন্য এক আমিতে পরিণত করেছে! এখন ওদের বাচ্ছাসুলভ আচরণ স্পর্শ করে না আমাকে। সেজন্য স্কুলের কারও সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠেনি।
‘জুঁই!’
স্কুল গেট অতিক্রম করতে দূর থেকে কেউ ডাক দিল।
(চলবে)