ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব ১৭

0
1047

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_১৭

চাচাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম আব্বার কী হয়েছে। চাচা ঠিকঠাক উত্তর দিলো না। শুধু জানালো ভোরবেলা আমাকে নিয়ে গ্রামে রওনা দিবে। ট্রেনে করে! আমি যেন তৈরি থাকি।

প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ছোট্ট এক ব্যাগে ভরে রাখলাম। বড় মায়ের থেকে অনুমতি নিলাম। বড় মা এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। বরঞ্চ তাকে একটু বেশি খুশি মনে হলো। খুশি হওয়ার কথা! বছর দুইয়ের অধিক হলো এ বাড়িতে আছি। একটা রাতের জন্যও তাদের চোখের আড়াল হইনি। আমার এই পরিচিত মুখটা দেখতে দেখতে হয়তো বিরক্ত হয়ে গেছে!

সে রাতে ঘুম হলো না আমার। চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ভোরের আলো ফোটার আগে আগে রওনা করলাম। বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে। আমি যে গ্রামে যাচ্ছি কেউ জানলো না। দুঃখ পেল না। লোক দেখানো মন খারাপ করলো না! শুধু মন খারাপ করলো সালেহা খালা। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল সে। মঈন চাচাকে বার বার করে সাবধান করলো। আমায় যেন দেখেশুনে নিয়ে যায়!

কাছে ফোন নেই আমার। প্রয়োজন পড়ে না বলে কেনা হয়নি। খালা তার ফোনটা নেওয়ার জন্য জোর করলো। রাজি হলাম না। তাকে ফেরার প্রত্যাশা দিয়ে পথে নেমে পড়লাম। স্টেশনে আসার পথে মঈন চাচা বলল,

‘আমি কিন্তু থাকতে পারবো না মা। তোমারে রাইখা চলে আসবো। আজকের ছুটি নিছি। বড় স্যারের গাড়ির প্রয়োজন পড়ে সবসময়। আজ অন্যজন ডিউটি করবো।’

‘আচ্ছা! কিন্তু আব্বার কী অসুখ হয়েছে চাচা?’

‘গেলে দেখতে পারবা। আমি ভালো মতো জানি না। ফোনে শুনছি।’

আমি কথা বাড়ালাম না। স্টেশনে পৌঁছাতে চাচা কিছু খেতে বললো। আমার রুচি নেই। না করে দিলাম। প্ল্যাটফর্মে ভিড়। অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের একেকজনের জীবনে একেক রকম গল্প। সবাই ভিন্ন ভিন্ন গল্পের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। তবুও আমার মনে হলো প্রতিটা গল্পে কিছু একটা মিল রয়েছে। দুঃখ বোধের একটা ব্যাপার রয়েছে। এই মিল টুকুর জন্যই দিনশেষে প্রতিটা মানুষ এক!

হুইসেল বাজিয়ে অতঃপর ট্রেন এলো। সেই ভোরের ট্রেনে উঠে পড়লাম আমরা। মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন ছাড়লো। পেছনে এক শহুরে জীবন ফেলে রেখে ট্রেন ছুটে চললো। দুরন্ত গতিতে!

________

মাটির বিছানায় শয্যাশায়িত ব্যক্তিটিকে দেখে চেনার উপায় নেই যে এটা আমার আব্বা। আব্বা অসুস্থ। ভয়ানক অসুস্থ। সেই সুঠাম দেহ আর নেই। দুই-আড়াই বছরের ব্যবধানে বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আব্বার এহেন অবস্থা দেখে বুকে তীব্র জ্বলুনি অনুভূত হলো। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে রইলো। এই মানুষটার উপর যে আমার পাহাড়সম রাগ ছিল তা এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

যখন মা বোনকে হারিয়েছিলাম তখন আব্বার উপর অভিমান হয়েছিল। রাগ হয়েছিল। একটু একটু করে ঘৃণা জমতে জমতে আকাশ চুম্বি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটু বড় হওয়ার পর বুঝলাম এসব কিছু ভাগ্যের লিখন। একটা জীবন খেলার অংশ। নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিশাপ। কিছু জিনিস জীবনে আপনা-আপনি ঘটে যায়। ইচ্ছে করে ঘটাতে হয় না। চেইন বিক্রিয়ার মতো একের পর এক ঘটতে থাকে। আমার জীবনের ঘটনা গুলো তেমনি ভাবে ঘটে গেছে।

আমি হালকা পায়ে আব্বার দিকে এগিয়ে গেলাম। দু-চোখে তখন উপচে পড়া অশ্রু। শিয়রের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লাম। কতগুলো দিন পর তাকে ডাক দিলাম।

‘আব্বা!’

আব্বা চোখ তুলে তাকালেন। চিনতে পেরে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলেন! উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আব্বার মুখ ডানদিকে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকানো মুখ থেকে অস্পষ্ট সুরে শুধু আ আ শব্দ বের হলো। কথা বলতে না পেরে তার চোখ ভিজে উঠলো। কি যে কষ্ট হলো আমার। আমি হাত চেপে ধরে ভরসা দিলাম। আব্বার শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ শরীর অচল প্রায়। মুখ একপাশে বেঁকে গেছে। হাঁটাচলা, কথা বলার শক্তি সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলেছে। এতো করুণ অবস্থা!

ছোট মা মুখ গোমড়া করে দূরে বসে ছিল। আকস্মিক ধাক্কা সামলে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো আমার। উঠে ছোট মায়ের কাছে এলাম। থমথমে সুরে জানতে চাইলাম,

‘কদিন হলো এই অবস্থা?’

ছোট মা উত্তর দিল,

‘তিন দিন!’

‘হঠাৎ এমন হলো কি করে?’

‘আমি কেমনে বলবো? দুপুর বেলা বাজার থেইকা ফেরার পথে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পইড়া ছিল। গ্রামের লোকজন ধরাধরি কইরা বাড়ি আনছে। তারপর থেইকা কত চিকিৎসা হইতাছে। কিচ্ছু ঠিক হইতাছে না।’

ছোট মায়ের চিকিৎসা মানে কবিরাজি চিকিৎসা। সারা দেহে গাছ, লতাপাতা আর গোবর মিশিয়ে চিকিৎসা! এতে আব্বার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আব্বাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। যত দ্রুত সম্ভব তাকে সদরে নিতে হবে। নিজেকে সামলে নিলাম। আব্বাকে হারাতে চাই না আমি। আব্বাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।

মঈন চাচা বাহিরে বসে ছিল। আব্বার অবস্থা দেখে তারও তীব্র মন খারাপ। আমাকে রেখে আজই ঢাকা ফেরার কথা বলেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

‘ঘরে গিয়ে বসেন চাচা। ছোট মা ভাত রান্না করেছে।’

‘তুমিও খাইয়া নেও। আসো।’

‘আসতেছি। আপনি যান।’

কলপাড়ে বসে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। চারপাশে তাকালাম। রাস্তার ধারে ছোট্ট এক ভিটে। গ্রামের করিম হাজীর। ভাড়া খুব কম! নেই বললেই চলে। সেখানে আব্বা ছোট মাকে নিয়ে সংসার পেতেছে। শুনলাম বেশিদিন হয়নি। মাস ছয়েকের মতো। তার মানে ছোট মা যাত্রাপালা ছেড়ে দিয়েছে। মনে মনে কিছুটা প্রসন্ন হলাম।

ছোট্ট এক টিনের খুপড়ি। চালার টিন ঝকঝকে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এর বয়স বেশিদিন হয়নি। সেখান থেকে উত্তর দিকে তাকালাম আমি। উত্তরে বিস্তীর্ণ মাঠ। এই মাঠ পেরিয়ে মিনিট বিশেক হাঁটলে আমাদের আগের বাড়ি পাওয়া যাবে। যেখানে আমার কতশত ভঙ্গুর স্বপ্ন ফেলে রেখে এসেছি। আস্ত এক সংসার ফেলে রেখে এসেছি। ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কলপাড় থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে সরে আসলাম।

খাওয়ার সময় ছোট মাকে বললাম,

‘আব্বাকে সদরে নিয়ে যেতে হবে। ডাক্তার দেখাতে হবে।’

ছোট মা মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল,

‘ডাক্তার কী মাগনা দেখবো? টাকা পয়সা কিছু লাগবো না?’

‘টাকা কি আব্বার নাই? আব্বা এতগুলো দিনে কি এক পয়সা জমায়নি? সে টাকা কই?’

‘আমারে জানায় তো জমায় নাই। তোমার বাপ রে গিয়া জিগাও।’

আমি অবাক হয়ে ছোট মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মহিলার জন্য আমাদের সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দুঃখে ভরা সংসার ছিল। তবুও সবাই জীবিত হয়ে একত্রে তো ছিলাম। খাবার আর গলা দিয়ে নিচে নামলো না। প্লেট সরিয়ে আমি বাইরে বের হয়ে এলাম। সামনের দেড় দুই হাত ফাঁকা জায়গায় কয়েক জন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতিবেশী। আমাকে দেখে তারা ফিসফিস করলো। আমি সরে ঘরের পেছন দিকটাতে গিয়ে বসলাম।

___________

সেদিন বিকেলে আব্বাকে ডাক্তার দেখানো হলো। লাভ হলো না কোনো। অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে আমার। আব্বার এতো কষ্ট মানতে পারছিলাম না। বার বার ভয় হচ্ছিল। যদি তাকে হারিয়ে ফেলি? আব্বা আমার খোঁজ নিক বা না নিক, তিনি যে এই পৃথিবীতে কোথাও বেঁচে আছেন তাতেই শান্তি পাই আমি। ভরসা পাই। শক্তি পাই! আব্বার কিছু হলে সেই শক্তি কোথায় পাব!

মঈন চাচার সেদিন ঢাকা ফেরা হলো না। আব্বার অসুস্থতার জন্য দুদিন আটকে পড়লো। আজাদ আঙ্কেল কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল বিষয়টা। এই দুদিন আব্বাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে ছুটোছুটি করলাম। তেমন উন্নতি না হলেও আব্বা জড়ানো গলায় কিছু বলতে সক্ষম হলো।

চাচা পরদিন ভোরে রওনা দিল। তার সাথে বড় সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। চাচা বড় সড়ক থেকে রিকশা নিল। আমি রাস্তার ধারে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তা পুবদিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে হাঁটলে রাফি ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছানো যাবে। খুব করে যেতে ইচ্ছে করছে। কতগুলো দিন, কতগুলা বছর হলো তাকে দেখি না! দোমনা করতে করতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেখান থেকে আর বাড়ি না ফিরে পুবদিকে পা বাড়ালাম।

বড় সড়ক থেকে কিছুদূর এসে বাম দিকে বাঁক নিতে হলো। এদিকে মাটির কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। সেখান দিয়ে হাঁটছিলাম। মাথা যথাসম্ভব নিচু করে। পরিচিত কারো নজরে না পড়ি যেন! তবুও গ্রামের কৌতূহলী লোকজন গভীর দৃষ্টিতে দেখছিল আমায়। তারা কি চিনতে পারছে আমায়? অস্বস্তি হলো ভীষণ। তবে চেনার কথা না! আড়াই বছর হলো গ্রাম ছেড়েছি। এরমধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে আমার। আগের থেকে হাতে-পায়ে লম্বা হয়েছি, মাথার চুল বড় হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আরো কত পরিবর্তন! এতো পরিবর্তনশীল একজনকে চেনার কথা না!

আমাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। প্রথম দিকে বুঝতে কষ্ট হলো যে এটা সেই আমাদের বাড়ি। আব্বা যার কাছে বাড়ি বিক্রি করেছে সে এলাকার নামী দামী ব্যক্তি। সরোয়ার মেম্বার! তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর জন্য জায়গা কিনে নিয়েছে। প্রচুর টাকা পয়সা মানুষটার। অল্পদিনে বাড়ির চেহারা ঘুরিয়ে এনেছে। ছবির মতো সুন্দর করে ফেলেছে। চারপাশে ইটের প্রাচীর। তার ভেতর টিনশেড বিল্ডিং। সুন্দর ডিজাইন করা। আমি থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

ভেতরে ঢুকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাহস হলো না। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। গ্রামের মানুষজন উঠে পড়েছে। আমি হেঁটে রাফি ভাইয়ের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।

বুকের ভেতর দুরুদুরু করে কাঁপছিল। এই বুঝি রাফি ভাই সামনে এসে পড়বে। এতগুলো বছর পর তাকে মুখ দেখাবো কি করে! অস্থিরতায় গলা শুকিয়ে এলো। আমি গিয়ে বারান্দার সামনে দাঁড়ালাম। রাফি ভাইয়ের মা ভাতের পাতিল হাতে ঘর থেকে বের হলেন। আমাকে দেখে চমকে উঠকেন। আমি হালকা স্বরে বললাম,

‘চাচী কেমন আছেন? আমি জুঁই।’

চাচী ভীষণ অবাক হলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। পরক্ষণে চিনতে পেরে দৌঁড়ে এগিয়ে এলেন। কাছে এসে গায়ে হাত ছুঁইয়ে বললেন,

‘আল্লাহ্! জুঁই তুই? কতগুলো দিন পর দেখছি। কেমন আছিস রে? একবার গ্রামে আসবি না? না আসলে অন্তত যোগাযোগ করতি। কত মনে পড়তো তোর কথা। ভালো আছিস?’

‘হ্যাঁ চাচী। ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?’

‘আছি ভালো। তোর কাকা প্রায়ই তোর কথা বলে। মাঝে মধ্যে তোর আব্বার থেকে খবর নিয়ে বাড়ি এসে বলতো, মেয়েটা ভালো আছে। ঢাকায় বড় কোনো বাড়িতে আছে। একটু স্বস্তি পেতাম।’

চাচী আমায় হাত ধরে নিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। আমি সংকুচিত হয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

‘কাকা কই?’

‘তোর কাকার ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে। এজন্য রোজ হাঁটতে বের হয়। হাঁটা শেষ করে বাজারে গেছে হয়তো। আসবে এক্ষুণি! জানিস কি হয়েছে? গ্রামে একবার…..’

চাচী হড়বড় করে বলা শুরু করেছে। বিগত বছরে গ্রামে কোথায় কী হয়েছে, কে মারা গেছে, কার বিয়ে হয়েছে সব বলছে। আমি উৎসুক হয়ে শুনছি তার কথা। মনে মনে ভাবলাম হয়তো এই প্রসঙ্গে রাফি ভাইয়ের কথা আসবে। কিন্তু চাচী রাফি ভাইয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু বললো না। রাফি নামে তার যে একটা ছেলে আছে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে যেন! আমি আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারলাম না। চোখজোড়া বার বার ঘুরেফিরে রাফি ভাইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছিল। কর্ণারের রুমটা রাফি ভাইয়ের। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা। রাফি ভাই কি বাড়িতে আছে?

চাচী কথা বলতে বলতে একসময় হাঁপিয়ে উঠলেন। দুঃখ নিয়ে বললেন,

‘তোর আব্বার অসুস্থতার কথা শুনে রাতের বেলা দেখতে গেলাম। কি করুণ অবস্থা! যা পাপ করছে দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি ভালোই শাস্তি পেয়েছে। আল্লাহ এখন সুস্থ করে দিক।’

আমি প্রতিত্তর করলাম না। চাচী নিজে থেকে বললেন,

‘কত বড় হয়ে গেছিস। কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস! ওহ্! তুই নাকি পড়াশুনা করিস জুঁই? তোর আব্বা বলছিলো।’

‘হ্যাঁ চাচী। কলেজে ভর্তি হয়েছি।’

‘ভালো। পড়াশুনা কর। বেঁচে থাকলে কত ধরনের দুর্যোগ আসবে! সেগুলো মোকাবেলা করতে হবে না? প্রত্যেকটা মেয়ের একটা নিজস্ব অবস্থান তৈরি করা খুবই জরুরি। একেবারে পাকাপোক্ত অবস্থান। যে অবস্থান সকল ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকূলতায় ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়াবে।’

‘হুঁ!’

চাচীকে বলতে ইচ্ছে হলো। চাচী আমার ভীষণ ভয় হয়। এই বয়সে এতকিছুর সম্মুখীন হয়েছি যে আর নিতে পারছি না! কিছু বলা হলো না। নিশ্চুপ রইলাম। চাচী উঠে একবার ঘরে গেলেন। প্লেটে করে মুড়ি আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘সকালে তো নাস্তা করিসনি। খেয়ে নে। আমি রান্না করি। ভাত খেয়ে যাবি।’

‘চাচী বাড়িতে আর কেউ নাই?’

‘নাহ্ রে! আমি আর তোর চাচা থাকি। ও ভালো কথা! রাফি অনেকদিন হলো ঢাকাতে আছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ইংলিশে কোর্স করেছে। ওর বিদেশে যাওয়ার কার্যক্রম চলছে। সব কাজ শেষের দিকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবে।’

মুড়ির প্লেটে হাত থেমে গেল আমার। বুক কেঁপে উঠলো অজানা আতঙ্কে। চাচী কী বললো এসব? রাফি ভাই বিদেশ চলে যাবে? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। চাচীর সেদিকে খেয়াল নেই। আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। বললেন,

‘ছেলেটাকে এতো বারণ করলাম। কিন্তু কিছুই শুনলো না। তার নাকি স্বপ্ন বিদেশ যাওয়া। এতো জিদ করলো! পরে আর বাঁধা দিলাম না। যাচ্ছে যাক। ওদের স্বপ্ন পূরণ করুক।’

চাচী থেমে গেল। আমি কথা বলার অবস্থায় নেই। রাফি ভাই গ্রামে আছে। একই দেশে আছে। বেঁচে থাকলে অন্তত দেখা হবে। এই আশায় ছিলাম এতদিন। কিন্তু মানুষটা বিদেশ চলে যাবে। এটা মানতে ভীষণ কষ্ট হলো। বুক ফেটে কান্না এলো। আমার আর খাওয়া হলো না। হাত ধুয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাড়া দিয়ে বললাম,

‘চাচী আমায় যেতে হবে। আব্বাকে দেখার কেউ নাই। একা রেখে আসছি।’

চাচী বাঁধা দিলো। ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলো। আমি থাকলাম না। প্রায় ছুটে চলে এলাম। রাস্তায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। দু চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ওড়নার ঝুলন্ত অংশ দিয়ে চোখ মুছে এগিয়ে চললাম। মস্তিষ্ক জুড়ে এলোমেলো চিন্তার বহর। সেই চিন্তার মাঝে একটা বড়সড় সত্যি ধরা দিল। বুঝতে পারলাম, রাফি নামক ছেলেটার উপর আমি ভয়ানক দূর্বল ছিলাম। ঠিক কতটা দূর্বল তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বুঝতে সক্ষম হলাম যে এই মানুষটাকে আমি সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে ফেলেছিলাম এবং এখনো ভালোবাসি।

সূর্য উঠে গেছে অনেক আগে। গ্রাম্য প্রকৃতি আলোয় ঝলমল করছে। গ্রাম জীবন্ত হয়ে উঠছে। সেই সাথে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে। আমি মাথার ঘোমটা বড় করে দিয়ে এগিয়ে চললাম। পরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় আমি নেই।

বাড়ি ফিরে কল পাড়ে বসে রইলাম। খুপড়ির দরজা বাহির থেকে আটকানো। আব্বা কাল সারারাত ঘুমায়নি। অনেক জ্বালাতন করেছে। চিৎকার, কান্নাকাটি করেছে। শেষরাতের দিকে একটু ঘুমিয়েছে। এখন খাবার খাইয়ে ওষুধ দিতে হবে। ছোট মাকে দেখা যাচ্ছে না। ঘরে অসুস্থ মানুষ রেখে কোথায় গেল!

ঘর থেকে হঠাৎ আব্বার গোঙানির শব্দ এলো। আমি দৌঁড়ে গেলাম। কাছে যেতে আব্বা অস্পষ্ট সুরে পানি চাইলো। গ্লাসে করে পানি খেতে পারে না সে। বাটিতে ঢেলে চামচ দিয়ে খাওয়ালাম। নত মুখে বললাম,

‘ছোট মা কই?’

আব্বা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি আশপাশে তাকাতে চমকে গেলাম। বিছানায় কাপড় ছড়ানো ছিটানো। জিনিসপত্র অগোছালো। কিন্তু মাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। ছোট মা কোথায়? উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে খুঁজলাম। চারপাশ খুঁজলাম। ফের ঘরে এসে আব্বাকে বললাম,

‘সে কোথায়? বাড়িতে দেখছি না তো।’

আব্বা কিছু বলতে চাইছে। আমি বুঝার চেষ্টা করে বললাম,

‘হ্যাঁ বলো।’

আব্বার কণ্ঠ অপরিষ্কার। জিহ্বা ভারী হয়ে গেছে। কথা বোঝা যায় না। তবুও কিছুদিন হলো শুনতে শুনতে একটু বোধ গম্য হয়ে এসেছে। সেখান থেকে বুঝতে পারলাম আব্বা ছোট মায়ের ব্যাপারে বলছে। ছোট মা নাকি পালিয়ে গেছে। তার জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা নিয়ে একেবারে চলে গেছে। বলে গেছে আর ফিরবে না কখনো।

_______

কয়েকদিন কেটে গেল। কি যে দুর্বিষহ দিন! ঘুম নেই। ঠিকমতো খাওয়া নেই, গোসল নেই। সারাক্ষণ আব্বার সেবা-যত্ন করা। একা একা সব দিক সামলাতে গিয়ে নাজেহাল দশা। ছোট মা আর ফিরলো না। আমি তবুও আশায় বুক বেঁধে রইলাম। সে হয়তো ফিরবে! সে ফিরলে একটু সাহস পাই। কিন্তু সে সত্যি সত্যি ফিরলো না। আশপাশের মানুষ কানাঘুষা করতে লাগলো তাকে নিয়ে। কেউ কেউ ছি ছি করলো। অসুস্থ স্বামী ফেলে রেখে চলে যাওয়ায় ধিক্কার জানালো। সেসবের কিছুই ছোট মা অবধি পৌঁছালো না।

প্রতিদিন দলে দলে লোক আসে। আব্বার কষ্ট দেখে হা হুতাশ করে। দুদণ্ড অপেক্ষা করে চলে যায়। কেউ কেউ কৃতকর্মের ফল বলে আফসোস করে। আমি নির্বাক হয়ে রই। আব্বার চিকিৎসা বাবদ জলের মতো টাকা খরচ করছি। গত দিনগুলোতে জমানো সব টাকা প্রায় শেষ। মঈন চাচা কিছু কিছু পাঠায়। এতো খরচ করার পরও স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে না।

একদিন দুপুর বেলা আব্বাকে দেখতে এলো তার দূর সম্পর্কের এক বোন। মোমেনা ফুফু।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here