#বোবা_টানেল (০৫)
হঠাৎ প্রচন্ড রা’গ এসে ভর করে অসিফার ভেতরে। শিখনকে হেটে সামনে চলে যেতে দেখেই ছুটে গিয়ে তাকে পেছন থেকে ধা’ক্কা দেয় অসিফা। টাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে কিছুটা নুয়ে পড়ে শিখন। পেছনে ফিরে তাকাতেই চোখ ক’পা’লে উঠে যায় তার।
“ধা’ক্কা দিলে কেন?”
“নিজেকে কি ভাবেন আপনি? আর আমাকেই বা কি পেয়েছেন? এই অসিফাকে পছন্দ না, আবার এই অসিফাই আপনার! মানে সমস্যাটা কি আপনার? হাতের পুতুল পেয়েছেন নাকি আমাকে? সাবধান করে দিচ্ছি আপনাকে, লজ্জা থাকলে আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না।”
অসিফাকে অবাক করে দিয়ে শিখন হোহো করে হেসে ওঠে।
“তা মন থেকে বলেছ তো শেষ কথাটা?”
“আপনার বোধ হয় মনে হচ্ছে যে, আমি আপনার সাথে ইয়ার্কি করছি।” (অসিফা)
অসিফাকে রা’গে ফোস ফোস করতে দেখে শিখন হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,
“তোমার কি ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে না অসিফা?”
শিখনের প্রশ্নটি কানে পৌছাতেই অসিফা দ্রুত হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়।
“শি’ট! আপনার জন্য আমার দেরি হয়ে গেছে।” বলেই দ্রুত পা চালিয়ে ভার্সিটির দিকে হাটা শুরু করে অসিফা। কি একটা ভেবে যেন আবার পেছনে ঘুরে শিখনের কাছে এসে বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠে,
“ভালো করে শুনে রাখুন, আমি আর আপনার মুখ দেখতে চাইনা। আগে ছোট ছিলাম তাই অনেক ভুলভাল কাজ করেছি। সেসব ভুলের একটা অংশ হলেন আপনি। নিজেকে আমি শুধরে নিয়েছি। প্লিজ আপনি আর আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। আপনার জন্য আমার মনে আর কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই মি. শিখন খান।”
আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে অসিফা রাস্তা পার হয়ে ওপারে ভার্সিটির দিকে চলে যায়। শিখন সেদিকে তাকিয়েই হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“এত অভিমান,এত তে’জ এই শিখন খানকে কেউ দেখানোর সাহস টুকু পায়না। তবে এই শিখনের পাথরের তৈরি মনকে যে মেয়ে গলাতে পেরেছে, তার এতটুকু অভিমান আর তে’জ দেখানোর অধিকার তো আলবাত আছে। তোমাকে যখন একবার খুজে পেয়েছিই আর তো তোমার পিছু এই শিখন ছাড়ছেনা প্রিয় তন্দ্রাহরণী। হঠাৎ কোনো একদিন এক চরম সত্য নিয়ে তোমার সামনে হাজির হয়ে যাব আমি। দেখি সেদিন এই অভিমান কোথায় থাকে তোমার!”
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেলে-দুলে হাটতে হাটতে শিখন গুন-গুন করতে থাকে,
“লোকে পা’গ’ল বলুক, মাতাল বলুক, আমি
তোমার পিছু ছাড়ব না।”
—-
“বাবা শিখন ভাইয়া কি আসবেনা? ভাইয়া তো প্রমিস করেছিল আসবে। তবে এখনো কেন আসছেনা?”
“তার আসার ইচ্ছা থাকলে সে আসবে অবশ্যই আসবে। তুমি কেকটা কাটো আহনাফ।” আহনাফের দিকে ছু’রি এগিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে ওঠে সাকলাইন খান।
“না না। আমার শিখন ভাইয়া না আসলে আমি কিছুতেই কেক কাটব না।”
“আহনাফ জে’দ করবেনা একদম। তোমার শিখন ভাইয়া আসবেনা। তুমি চুপচাপ কেকটা কাটো। দেখছ না তোমার ফ্রেন্ডসরা অপেক্ষা করে আছে!” (সিতারা বেগম)
“আমার ভাইয়া আসবে আম্মু। একটু অপেক্ষা করো। এই বড় আপু তুমি শিখন ভাইয়াকে একটা কল দাও তো। কেন সে দেরি করছে জিজ্ঞাসা করো তো।”
“কল দিতে হবেনা, তোর শিখন ভাইয়া চলে এসেছে আহনাফ।” বলেই শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে শিখন। আহনাফ দৌড়ে গিয়ে শিখনকে জড়িয়ে ধরে। হোক আহনাফ তার সৎ ভাই। হোক তার বাবা-মা তার চোখের বি’ষ। তবে এতটুকু বাচ্চার ওপর রা’গ সে কোনোদিনই দেখাতে পারেনি। সবসময় নিজের আপন ছোট ভাইয়ের মতোই তাকে দেখে এসেছে। এই তিন বছরে এই বাড়িতে না এলেও শুধুমাত্র আহনাফের জন্মদিনে সে আসতে বাধ্য হয়। প্রতিবার এইদিনে সে আগামী বছরেও শিখন আসবে তা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়।
“আমার জন্য গিফট আনো নি?”
“এনেছি তো। এটা কি আমি ভুলতে পারি কখনো? সিড়ির ঘরে রাখা আছে। অনুষ্ঠান শেষে দেখে নিস। এখন চল কেক কাটবি।”
কেক কাটার কিছুক্ষণ পরে আহনাফের এক বন্ধুর বাবা সাকলাইন খানকে জিজ্ঞাসা করে বসে,
“এই শিখন ছেলেটা আপনাদের কি হয় সাকলাইন ভাই?”
“ও আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছেলে। ওর মা মা’রা যাওয়ার পর ওকে আমরা নিয়ে এসে লালন-পালন করে বড় করেছি।”
সাকলাইনের দেয়া জবাবখানা পাশ থেকে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শোনে শিখন। পুরনো ক্ষ’তগুলো আবার জেগে ওঠে তার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আহনাফ ধারে কাছে আছে কিনা। আহনাফ তার রুমে বসে বন্ধুদের সাথে খেলছে দেখে ক্ষানিকটা নিশ্চিন্ত হয় শিখন। হঠাৎ টেবিল হতে একটা কাচের গ্লাস নিয়ে মেঝেতে ছু’ড়ে মারে শিখন। উপস্থিত সকলে হুড়মুড় করে লাফিয়ে ওঠে। সাকলাইম খান চে’চি’য়ে বলে ওঠে,
“কি করলে এটা তুমি?”
“যা করেছি বেশ করেছি। আপনাকে কেন ‘বাবা’ বলে ডাকি না তা শুনতে ইচ্ছা করেনা বড্ড? তাহলে শুনুন, যে বাবা নিজের প্রথম পক্ষের সন্তানকে লোকসমাজে সন্তান বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়, সে আবার কেমন ধরনের বাবা হয় তাহলে? সে আশাও বা কিভাবে করে যে, তাকে তার সেই সন্তান ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করবে পরে? আপনারা ভালো করে শুনুন, আমি শিখন খান। এই মি. সাকলাইন খানের প্রথম পক্ষের ছেলে। যাকে তিনি লোকসমাজে দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে এবং নিজের এ্যাডপ্টেড ছেলে বলে দাবি করেন। এই সত্যটি একটু আগ পর্যন্ত এই মি. সাকলাইন খান, সিতারা বেগম, তাদের বড় মেয়ে, এই বাসার কাজের মেয়েটা এবং আমি ছাড়া কেউ জানতো না। এমনকি এই ছোট্ট আহনাফও জানেনা যে, আমি তার সৎ ভাই হই। আমি এই পারিবারিক ব্যাপারটি কখনোই বাইরের মানুষদের সামনে বলতে চাইনি। কিন্তু আজ যখন উপলব্ধি করলাম যে, আমি কখনোই মি. সাকলাইন খানের পরিবারের অংশ ছিলাম না তখন খুব জে’দ চেপে বসল যে আজ আসল সত্যিটা বলেই দেই। তাতে মানুষ যা ভাবার ভাবুক। তবে এটাও দেখুক, পৃথিবীতে এই শিখনেরা কত অবহেলিত। ”
একটু দম নিয়ে শিখন পুনরায় বলে ওঠে,
“আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ। এসব কথা যেন আহনাফের কানে না যায়। প্লিজ আপনারা হাসিমুখে অনুষ্ঠানটিতে শেষ পর্যন্ত থাকুন। অহনা (সাকলাইন খানের দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে) তুই আহনাফকে একটু সামলে নিস। আর বলিস আমি ওর সাথে কাল ওর স্কুল ছুটি হওয়ার পরে দেখা করব। আসছি।”
চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে বাসা হতে বেরিয়ে যায় শিখন। তার চোখের পানি হয়তো এই আসর ভরা মেহমানেরা কেউ লক্ষ্য করেনি। তারা শুধু দেখেছে অবহেলিত এক ছেলের বছর বছর জমিয়ে রাখা ক’ষ্ট ও আক্ষেপের প্রকাশ।
সকলে হা হয়ে শিখনের যাওয়ার দৃশ্য দেখছে। সাকলাইন খান অ’প’মানবোধে মাথা নুয়ে রেখেছেন। সিতারা বেগম মুখ ঝা’ম’টি মেরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।
শিখন বাড়ির সীমানা পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে রাস্তার ফুটপাতের ওপর বসে পড়ে। রাস্তার পাশের সোডিয়াম বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে ওঠে,
“তোমরাও তো যার যার মতো একা। ভীষণ একা। রাস্তা দিয়ে যাওয়া শত শত মানুষের সুখ-দুঃখ দেখে দিন-রাত্রি পার করো। তবুও তো নিজেদের আলো দিয়ে এইযে আনন্দে চারপাশ আলোকিত করছ। তোমাদের মনে এত সুখ কেন? কেন তোমাদের একটু দুঃখ নেই?”
——
আজ ক্লাস শেষে ভার্সিটি হতে বের হতেই অসিফার পেছন পেছন তারই ডিপার্টমেন্টের দুটো ছেলে দৌড়ে আসে। তাদের মধ্যেই একজন গলা উচু করে বলে ওঠে,
“এই অসিফা একটু দাড়াও। তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে।”
দাঁড়িয়ে যায় অসিফা। পেছনে ঘুরে বলে ওঠে,
“আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা তামিম। আগেও বলেছি আমার পিছু ছেড়ে দাও।”
“প্লিজ একটা বার বোঝার চেষ্টা করো অসিফা।” (তামিম)
“কি বোঝার চেষ্টা করবে ভাইয়া?” বলতে বলতে এগিয়ে আসে জয়।
জয়কে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে অসিফা। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“শি’ট! একেও এখন এখানে আসতে হলো?”
হঠাৎ তামিমের হাত মু’চ’ড়ে ধরে জয়। ব্য’থা’য় চিৎকার করে ওঠে তামিম।
“কে আপনি? আমার হাত ছাড়ুন প্লিজ।” (তামিম)
“আমি কে তা জানিস না বলেই তো বললি ‘কে আপনি’। আমি কে তা তোকে আমার লোকেরা বুঝিয়ে বলবে। তবে সাবধান! ফের আমার প্রোপার্টির দিকে চোখ দিলে কিন্তু ওই চোখ আর তোর অক্ষি কোটরে থাকবেনা। এই তোরা একে একটু বুঝিয়ে বল,আমি কে? তারপর ওকে ওর বাড়ি পৌছে দিস ঠিক মতো।”
কথাগুলো বলেই তামিমের হাত ছেড়ে দেয় জয়। জয়ের লোকেরা এসে তামিমকে টেনে নিয়ে চলে যায়।
ভ’য়া’র্ত চোখে অসিফা জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ওরা তামিমকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কি করবে ওর সাথে?”
“আরে ভয় নেই। কিছু করবে না ওকে। শুধু বোঝাবে যে ‘আমি কে’।
“আপনি কে বলুন তো? আর আমার আসেপাশে ঘুরছেন কেন আপনি? আপনার ইন্টেনশন কি? আর আমি আপনার প্রোপার্টি কিভাবে হলাম?”
“তুমি বেশ বুদ্ধিমতী বোঝাই যাচ্ছে। আপাতত কিছুই জানতে হবেনা তোমাকে। বাসায় যাও দ্রুত।”
অসিফা ভয়ে ভয়ে পা ফেলে বাসার দিকে অগ্রসর হয়। জয় সেদিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“তুমিই তো আমার আসল হাতিয়ার মিস. বিউটিফুল।”
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা
[আমার দাদা ভিষণ অসুস্থ। এটা শোনার পর থেকে টেনশনে আর লিখতে বসতেই পারছিলাম না। তবুও যেটুকু পেরেছি লিখেছি। কেমন হয়েছে জানিনা। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।
সকলে আমার দাদার জন্য দোয়া করবেন।]