বোবা টানেল পর্ব ৪

0
95

#বোবা_টানেল (০৪)
উনাকে এখান থেকে চলে যেতে বলো মা।”
শিখন কিছু একটা বলতে নিতে অসিফা চোখ বুজে নিয়ে বেশ কঠোরভাবে নিলুফা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“মা আমি শেষবার বলছি উনাকে চলে যেতে বলো। আমিতো উনাকে আর জ্বা’লা’চ্ছি না। আর না আমি তার প্রেমের মাঝে বাধা দিয়েছি। আমিতো আর উনার সামনেও যাইনি। তাহলে উনি এখানে কেন এসেছেন? আমিতো মুভ অন করেছি তবে আবার কেন উনি বারবার আমার সামনে আসছেন?”
উত্তেজিত হয়ে বলা কথার চেয়েও শীতল ভংগিতে বলা কথা মানুষকে ঘা’য়ে’ল করে বেশি। শিখন কোমল কন্ঠে বলে ওঠে,
“আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। তাও তুমি একটু রিল্যাক্স হও। আন্টি ওর খেয়াল রাখবেন। কোনো দরকার পড়লে জানাবেন আমাকে,আমি সাথে আছি। আসি তবে।”
দ্রুত পায়ে কেবিন হতে বেরিয়ে যায় শিখন।
“এমনটা করা কি ঠিক হচ্ছে অসিফা?” (নিলুফা বেগম)
মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে অসিফা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
—–
পরদিন সকালে একটি জরুরি সভা বসে গতকালের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে। সভায় ভার্সিটির ছাত্রদলের সদস্যবৃন্দদের জরুরি তলব করা হয় এবং গতকালের ঝামেলার সাথে জড়িত সকল ছাত্রদেরকেও উপস্থিত করা হয়।

“জয় তোমাকে এখানে দো’ষী’দের সাথে একত্রিত হয়ে দাড়াতে দেখে আমার নিজেরই লজ্জা বোধ হচ্ছে। তোমার সাথে যে ছেলেরা ঘোরে তারাই গতকাল মেইন ঝা’মে’লা’টি পাকিয়েছে। ‘ল’ ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের সাথে তোমার লোকেরা ইচ্ছাপূর্বক কথা কা’টা’কা’টি করে মা’র’পি’টের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ছেলেগুলোকে তো আজ বহিষ্কার করা হবে। তোমার নাম তো এতে অটোমেটিকলি জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন একটু বাদে যখন সকলের প্যারেন্টসকে ডাকা হবে তখন তো তোমার প্যারেন্টসকেও হাজির হতে হবে। তোমার বাবা একজন সম্মানিত মানুষ। তাকে এখন এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে! কি একটা লজ্জার ব্যাপার।” (প্রফেসর ড. আরিফুল ইসলাম)
“প্রথমেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। স্যার ক্যাম্পাসে যখন ওই ঘটনা ঘটে তখন আমি টোটালি ভার্সিটির আসেপাশেও উপস্থিত ছিলাম না। আর সকলে জানে যে এরা আমার লোকজন, একসাথে ঘুরিফিরি। কিন্তু এসবে আমি কখনোই ছিলাম না। আমাকে প্লিজ এসবে জড়াবেন না।” (জয়)

জয়ের কথা শেষ হতেই আচমকা শিখন গলার স্বর উচু করে বলে ওঠে,
“এই ধরনের আ’ক্র’ম’না’ত্ম’ক কাজবাজে নির্দিষ্ট কারো উস্কানিই মুখ্য ভূমিকা রাখে।”
সকলে অবাক দৃষ্টিতে শিখনের দিকে চেয়ে পড়ে। আসলে সে বলতে চাইছেটা কি? ‘নির্দিষ্ট কেউ’ বলতে সে কাকে বুঝিয়েছে? ভেবে না পেয়ে যেন সকলে যে যার মাথার চুল পারলে টেনে ছে’ড়ে।

“তুমি কার কথা বলছ শিখন?” (প্রফেসর ড. আরিফুল ইসলাম)
“স্যার আমি বলেছি ‘এ ধরনের কাজবাজ’। গতকালের ঘটনার সাথেই যে আমার জানা নির্দিষ্ট কেউ জড়িত আছে তা বলিনি। তবে থাকতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সব সামনে চলে আসবে। অ’প’রা’ধ কখনোই দীর্ঘকাল যাবত চাপা থাকে না স্যার।”
শেষের কথাটুকু শিখন জয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষানিকটা হেসেই বলে ওঠে।

সভা শেষে হল রুম হতে বের হওয়ার সময় শিখনকে ইচ্ছাপূর্বক ধা’ক্কা দিয়ে চলে যায় জয়। টাল সামলাতে না পেরে শিখন পাশের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভ্যা’বা’চ্যা’কা খেয়ে সামনে তাকায় সে। জয় আ’গু’ন ঝরা চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে আংগুল নাচিয়ে কিছু একটা ইশারা করে পুনরায় সামনে ফিরে হাটতে আরম্ভ করে। শিখন মুচকি হেসে উঠে ভাবতে থাকে, “তীর তবে মেইন পয়েন্টে গিয়েই লেগেছে!”
——
তিনদিন পর হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয় অসিফাকে। এই তিনদিনে একবারও অসিফার সামনে আসেনি শিখন। তবে সে রোজ এসে অসিফার খোজ নিয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় ঔষধ ও ফলমূল পৌছে দিয়ে গেছে। নিলুফা বেগমের মনে থেকে থেকে প্রশ্ন জাগে, “ছেলেটার যদি সত্যিই অন্য কারো সাথে সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে সে কিসের টানে বারবার হসপিটালে ছুটে এসে অসিফার খোজ নিচ্ছে?”

“আচ্ছা নিলুফা একটা কথা বলো তো?” (আসিফ খন্দকার)
“কি কথা?” (নিলুফা বেগম)
“এই শিখন ছেলেটা কিসের গরজে বারবার এখানে ছুটে আসছে? আমরা কুমিল্লাহ শিফট হয়েছি তিন বছরেরও বেশি হবে। এতদিনে তো আমাদের ভুলে যাবার কথা। কোনো কারণ আছে কি?”
“কোনো কারণ আছে কিনা আমি নিজেও জানিনা। তবে তোমায় আজ একটা কথা জানাতে চাই। তোমার মেয়েটা এই ছেলেকে একটা সময়ে উ’ন্মা’দের মতো ভালোবাসতো। হয়তো এখনো বাসে কেননা আজও আমি ওর চোখে এর রেশ দেখতে পাই। অসিফার এত চুপচাপ হয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণই এই ছেলেটা।”
অসিফার সাথে আসলে কি ঘটেছিল তা আর জানতে চাননা আসিফ খন্দকার। চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে বারন্দায় চলে যান তিনি।

অসিফা সুস্থ হওয়ার পর তাকে আর হলে যেতে দেননি আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম। আসিফার ভার্সিটির কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে তাকে নিয়ে থাকতে শুরু করেছেন নিলুফা বেগম। আসিফ খন্দকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ঢাকায় পোস্টিং করানোর জন্য।
অসিফাও ইতোমধ্যে পূর্বের মতোই ব্যস্ত জীবন পার করতে শুরু করেছে। এমনই একদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য লোকাল বাসে চড়ে বসে অসিফা। কিছুক্ষণ বাদেই তার পাশের সিট দখল করে বসে এক অচেনা যুবক। অসিফা অ’স্ব’স্তিতে কাচুমাচু হয়ে কিছুটা চেপে বসে। তবে সে এটাও খেয়াল করে তার কান্ড দেখে ছেলেটা মুচকি মুচকি হাসছে। এতে যেন তার অ’স্ব’স্তি’বোধ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
“হ্যালো! আমি জয়।”
বি’স্ফো’রিত নয়নে জয় ছেলেটার দিকে চেয়ে পড়ে অসিফা। অসিফাকে অবাক করে দিয়ে পুনরায় ছেলেটা বলে ওঠে,
“আরে আপনি স্বাভাবিক হন। আপনার সমস্যা হলে আমি সিট ছেড়ে দিচ্ছি।”
অসিফা কাপা কাপা কন্ঠে বলে ওঠে,
“না না আপনি বসুন। আসলে আমার লোকাল বাসে ওঠার অভ্যাস নেই তো তাই মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।”
“ওহ আচ্ছা এবার বুঝেছি। আমারও একই অবস্থা। আমার আজ গাড়িটা হঠাৎ ন’ষ্ট হয়ে যাওয়ায় লোকাল বাসেই উঠতে হলো। আচ্ছা তবে এরপর হতে আমি আপনাকে আমার গাড়িতে করে ভার্সিটিতে যদি ড্রপ করে দেই আপনার কোনো সমস্যা হবে?”
“না না একদম লাগবেনা। তবে বলার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।” বলেই অসিফা পাশের ফাইলের সিটের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। শিখন তার দিকে তাকিয়ে রা’গে ক’ট’ম’ট করছে। এখনই যেন সে অসিফাকে গি’লে ফেলবে একদম। ভয়ে অসিফা একটা ঢোক গি’লে নেয়।
বাস ভার্সিটির কাছে এসে থামতেই অসিফা নেমে নামার জন্য উঠে সামনে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে জয় বলে ওঠে,
“আপনার নামটা তো বললেন না?”
অসিফা আর কোনো কথা কানে নেয় না। চুপচাপ দ্রুত পায়ে বাস হতে নেমে ভার্সিটির দিকে হাটতে আরম্ভ করে। সে বেশ বুঝতে পারে তার পেছনে পেছনে শিখনও আসছে। আচমকা পেছন হতে কেউ হাত টেনে ধরতেই অসিফা বুঝে যায় কার কাজ এটা। অসিফা পেছন ফিরে তাকাতেই শিখন বেশ জোরেই তার হাতের কব্জি চেপে ধরে বলে ওঠে,
“অচেনা-অজানা ছেলেদের সাথে এত কিসের কথা তোর?”
শিখনের মুখে ‘তুই’ সম্বোধন শুনে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় অসিফা। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে রা’গে নাক-মুখ কুচকে নিয়ে তার হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিখন পুনরায় বলে ওঠে,
“কিরে আমি কি বলছি কানে যাচ্ছে না?”
“হাত ছাড়ুন ব্য’থা পাচ্ছি আমি। আর আপনি নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিহীন নন যে, অন্যের দোষটা আপনি আমার ওপর চাপিয়ে আমাকেই রাগ দেখাবেন! ওই ভদ্রলোকটা নিজে যেচেই আমার সাথে কথা বলেছে। আমি যে ফরমালিটি মেইনটেইন করেই ওই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছি তা আপনি নিজের চোখেই দেখেছেন। এখন প্লিজ হাত ছাড়ুন।”
শিখন আস্তে করে অসিফার হাত ছেড়ে দেয়। আঙুল উচু করে অসিফার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ওই ছেলেটা আর কোনোদিন সামনে পড়লে যেন তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। একটা কথা মাথায় রাখবে, তুমি শুধুই শিখনের।”
কথা শেষ করে এক মুহূর্ত আর সেখানে দাঁড়ায় না শিখন। অসিফা অবাকের শীর্ষে পৌছে হা হয়ে সেই একই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।

চলবে….

#আফিয়া_অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here