বেসামাল প্রেম পর্ব ৩

0
3072

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩
” ছ’বছর আগে মাহেরের প্রেমিকা রশ্নি’কে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ খবর শোনার পর ঢাকা থেকে সরাসরি হসপিটালে এসেছিল মাহের৷ বেডে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা রশ্নির একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেছিল,

– ” উইল ইউ ম্যারি মি রশ্নি? ”

রশ্নি উত্তর দেয়নি। তার গাল বেয়ে শুধু দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। মাহের নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়িয়ে রশ্নির মা, বোন’কে বলেছিল,

– ” আগামীকাল আমার অভিভাবক পাঠাব আন্টি। এনগেজমেন্ট হসপিটালেই হবে। ”

কেবিন থেকে বেরোনোর পথে ওর জলপূর্ণ দু’টো চোখ স্পষ্ট দেখেছিলাম আমরা। পরেরদিন সকালেই রশ্নিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়৷ মাহের’কে রশ্নির মা জানায়, এনগেজমেন্ট তাদের বাড়িতেই হবে। কথামতো, ঠিক দুপুর তিনটায় মা, বোনকে পাঠায় মাহের। কিন্তু এনগেজমেন্ট হয়নি। ”

ফোনের স্ক্রিনে ইংরেজি বার্তায় এ পর্যন্ত দেখেই বুক ধড়ফড় শুরু হলো সূচনার। কপাল ঘামছে তার, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, এক ঢোক গিলে দ্রুত টাইপ করল,

– ” হলো না কেন? তাড়াতাড়ি বলুন। ”

মিনিট পাঁচেক পর উত্তর এলো,

– ” রশ্নি সুইসাইড করেছিল! ”

যে ছেলেটা ম্যাসেজ করেছে তার নাম নিলয়। মাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহেরের মা হামিদা বেগম মাহেরের বিষয়ে সমস্তটা জানাতে বলেছেন নিলয়কে। মাহের সূচনার ফেসবুক একাউন্টে এড হয়েছে গতকাল রাতে। নিলয় মাহেরের থেকে সূচনার আইডি নিয়ে সকাল বেলা নক দিয়েছে। সূচনা ব্যস্ত থাকায় সারাবেলা কথা হয়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণ আগে সীমিত পরিচয়ের পাশাপাশি মাহেরের অতীত জানাল। অতীত নিয়ে কথা বলতে পারে না মাহের। রশ্নি’কে নিয়ে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করতে পারে না৷ ছ’বছর ধরে মাহেরকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি। রশ্নিকে নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। উচ্চ মানসিকতার মানুষদের অনুভূতিও উচ্চমানের হয়। মাহেরের জায়গায় অন্য ছেলে হলে নিশ্চয়ই প্রেমিকার মৃত্যু শোকে পড়াশোনা, পরিবার ভুলে নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবনটা ধ্বংস করে দিত। কিন্তু মাহের তা করেনি। সে প্রেমিকাকে ভুলে গেছে কিনা বোঝা যায় না। তার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে কিনা তাও স্পষ্ট নয়। তাকে কতটুকু ভালোবেসেছিল সেটা যেমন স্পষ্ট নয় তার জন্য ঠিক কতটা কষ্টে জর্জরিত সেটাও অজানা। সাদাসিধে মানুষদের অনুভূতি হয় রহস্যেঘেরা। মাহের সাদাসিধে মানুষ। নিজের অমায়িক আচরণের জন্য সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠেছে ঠিকি তবে ব্যক্তিত্ব কঠিন খোলসে মোড়ানো। তার ব্যক্তিত্বের একাংশ সম্পর্ক সকলেই অবগত। প্রফেশনালি সে একজন লেকচারার। সকলের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, দায়িত্ব বোধে সদাসর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাবাহীন পরিবারে মা, বোনের একমাত্র অবলম্বন, বটবৃক্ষ সে।

ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বিচলিত ভঙ্গিতে বসে আছে সূচনা৷ তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নিঃশ্বাসে অস্থিরতা। পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে রুদ্র। একমনে ড্রাইভ করছে সে। হঠাৎ সূচনার দিকে নজর যেতেই রাশভারী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” এসি চলছে তবুও ঘামছিস সমস্যা কী? ”

কিঞ্চিৎ চমকে সূচনা বলল,
-” কিছু না কিছু না। ”

-” নার্ভাস লাগলে আমি তোর সঙ্গে থাকব। ”

চোখ বড়ো বড়ো করে রুদ্রর দিকে তাকাল সূচনা৷ রুদ্রর দৃষ্টি সম্মুখে স্থির, মুখে গম্ভীর্যতা অবিচল। ড্রাইভ করছে বিরতিহীন। এক ঢোক গিলে বারকয়েক চোখের পলক ফেলল সূচনা। কী বলছে তার ভাই! যার সঙ্গে ছোটো বোনের বিয়ের কথা চলছে, তার সঙ্গে প্রাইভেট কথা বলা কালীন সে সঙ্গে থাকবে! তার ভাইটা অমিশুক, নীরস, আবেগহীন জানতো। কিন্তু সম্পর্কের বিষয়গুলোতে এত অজ্ঞ তা তো জানতো না। জোরপূর্বক মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল সূচনা। বলল,
-” না না তোমার থাকতে হবে না। আসলে উনি আমার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। ”

ভ্রুকুটি করে তাকাল রুদ্র। বলল,
-” তোরা পরিচিত নস, একান্তে কথা আবার কী? আমি আশপাশেই থাকব। ”

ঢোক গিলল সূচনা। বলল,
-” উনি হয়তো উনার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাতে চান। তুমি পাশে থাকলে আনইজি ফিল করতে পারে। ”

কুঁচকানো ভ্রুজোড়া আর সোজা হলো না রুদ্রর। লম্বা করে শ্বাস টানল শুধু। ঠোঁট টিপে হাসল সূচনা। সে হাসি রুদ্রর থেকে আড়াল করার জন্য জানালার দিকে মুখ ফেরাল।

গাড়ি থামল লেকের পাশের রাস্তাটায়। লেকের ধারে সারি সারি কফিশপ এবং ফুচকার দোকান। এখানে পরিচিত এক কফিশপ রয়েছে সূচনার৷ তার বান্ধবীর ভাইয়ের কফিশপ এটা। মাঝে মাঝেই বান্ধবী নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে আসে এবং এই কফি-শপেই বসে। গাড়ি থেকে ভাই বোন নেমে দাঁড়াতেই ঝিনুক, পনির সহ আরো অনেকেই এগিয়ে এলো। ঝিনুকের মুখে হাসি যেন উথলে পড়ছে। পান খাওয়া লাল টকটকে ঠোঁটের ফাঁকে আঁধ সাদা দাঁতগুলো দেখে গা জ্বলে ওঠল সূচনার। ক্রোধনে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাইয়ের দিকে তাকাল। ঝিনুকরা ততক্ষণে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রুদ্র সূচনার ক্রোধের মাত্রা টের পেলো, ঝিনুক’কে কঠিন একটি ধমক দিয়ে বলল,
-” সামনে এসে দাঁত ক্যালাতে বলেছি? দূরে যা। ”

ঝিনুকের মুখের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। সূচনার দিকে এক পলক তাকিয়ে পনিরের ঘাড়ে থাবা মেরে বলল,
-” তোরে বললাম সূচনা আপা রাগ করব আমাদের দেখলে। শালা তবুও আমারে জোর করলি। ”

পনির বোকার মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-” হ আফা আমিই বলছিলাম এইখানে আসতে। আপনি ভালো আছেন আপা? ”

এরা কী পরিমাণ ঢপ মারতে পারে খুব ভালো করেই জানে সূচনা৷ তাই অগ্নি দৃষ্ট ছুঁড়ে তাকাল পনিরের দিকে। সে দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়েই ঝিনুক পনির সহ আরো তিনজন ক্ষিপ্র গতিতে পালিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সূচনা৷ পাছে লোকে তার ভাইকে গুন্ডা, মস্তান বলে। সন্ত্রাস হিসেবে খ্যাতি কম নেই। এসবে এখন আর লজ্জা লাগে না অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার হবু বর এবং হবু বরের পরিবার এসবে অবগত। তাই বলে ভাইয়ের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হবু বরের সঙ্গে মিট করতে আসা সমীচীন নয়৷ এরা এসেছে দেখলে বা জানলে মাহের খানও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে৷ সে নম্র, ভদ্র স্বভাবের মানুষ। একজন সম্মানিত ব্যক্তি। শহরে তার মোটামুটি সম্মানীয় একটা পরিচয় আছে। কলেজের লেকচারার। এমন একজন মানুষ শুধু এক চরিত্রহীন নারীর সন্তান নয় এক সন্ত্রাসের বোনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! এইতো মাথা সমান। এতটুকুতেই মাথা তুলে কথা বলার জো নেই। সেখানে আবার এই চ্যালাফ্যালারা উপস্থিত থাকা নিন্দনীয়ই বটে।

সূচনার বলা নামের কফিশপটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মাহের৷ হঠাৎ দু’টো ছেলে মেয়ে’কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। মেয়েটার পরনে পারপেল কালার কারুকার্যে শোভিত থ্রিপিস। মাথায় পারপেল কালার উড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। পেছনের লম্বা বিনুনির শেষ অংশ হাঁটার তালে তালে কোমড়ের পাশ দিয়ে সম্মুখে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। লম্বাটে ফর্সা মেয়েটার মায়াবী মুখটা দেখতেই চিনে ফেলল মাহের৷ হ্যাঁ এটাই তার হবু বউ! মা’য়ের পছন্দের পাত্রী। মনে মনে তিনবার মাশাআল্লাহ পড়ল সে। ততক্ষণে রুদ্র, সূচনা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সূচনা সালাম দিতেই অমায়িক একটি হাসি উপহার দিয়ে সালাম ফেরাল মাহের। রুদ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য৷ স্বভাবতই গম্ভীর মুখে হাত বাড়াল রুদ্র। প্রথম পরিচিতি শেষে মাহের দু’জন’কেই কফিশপে ঢুকতে বলল। বয়সের দিকে রুদ্র, সূচনা উভয়ই তার ছোটো তাই নাম ধরেই ডাকল। সূচনা ধীরপায়ে কফিশপের দিকে এগোলেও রুদ্র রাশভারী কণ্ঠে বলল,
-” আপনারা কথা বলুন আমার কিছু কাজ আছে এদিকে। ”

মাহেরকে কথাটা বলে সূচনার দিকে তাকাল। বলল,
-” আমি এদিকটায়ই আছি৷ ফোন করিস। ”

সূচনা ঘাড় কাৎ করল। রুদ্রও গম্ভীর চিত্তে মাহেরকে বলল,
-” আসি। ”

মাহের মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-” জি। নাইস টু মিট ইউ। ”

বাঁকানো হাসি হেসে বিদায় নিলো রুদ্র। কফিশপের ভেতরে গিয়ে বসল মাহের, সূচনা৷ একে অপরের মুখোমুখি বসেছে তারা৷ মাঝে ব্যবধান শুধু একটি ছোটো টেবিলের। দীর্ঘক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর গলা খাঁকারি দিয়ে মাহের প্রশ্ন করল,
-” সূচনা আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? ”

নিম্নমুখী সূচনা মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। আলতো হেসে মাহের পুনরায় বলল,
-” অস্বস্তি হচ্ছে? ”

এবারেও না করতে উদ্যত হলো সূচনা। তার পূর্বেই মাহের বলল,
-” হবু বরের সামনে প্রথম আলাপে লজ্জা পাচ্ছেন না। এ কথা হজম করেছি কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে না এটা কিন্তু হজম হবে না। ”

বুকের খুব গোপন স্থানে কিঞ্চিৎ শিহরন জাগল সূচনার। সন্তর্পণে মাথা তুলে তাকাল সম্মুখের মানুষটার দিকে। নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ তার সামনে বসে আছে। সুগঠিত দেহের বলিষ্ঠ শরীরটা বসে আছে অসাধারণ ভণিতায়। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। ফর্সা বললেও ভুল বলা হবে না। হেয়ার স্টাইল খুবই সাধারণ। ফ্যানের তীব্র বাতাসে সিল্কি কয়েকটা চুল কপাল দিয়ে উড়ছে। গভীর একজোড়া চোখ। নাকের এক পাশের কালো তিলটা বেশিই চোখে লাগছে। শেভ করার সময় হয়তো কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে৷ ফর্সা ত্বকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো তার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
চোখেমুখে লেপ্টে আছে অমায়িক হসি৷ এমন পুরুষদেরই বোধহয় মি. পারফেক্ট বলা হয়ে থাকে।

-” পাত্র পছন্দ হয়েছে? ”

কেঁপে ওঠল সূচনা। দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই বেসামাল হয়ে ওঠল। মাহের বিচলিত হয়ে বলল,
-” ওহ শীট! লজ্জা দিয়ে ফেললাম। লজ্জা পাবেন না শান্ত হন। যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাবেন তাকে এভাবে দেখেশুনে নেওয়াটাই ব্যাটার। ”

ইতোমধ্যে দুটো কফি দেওয়া হয়েছে ওদের। কফির মগ সূচনার দিকে এগিয়ে মাহের পুনরায় বলল,
-” কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আমরা কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি। ”

সূচনা মাথা নাড়িয়ে কফির মগ হাতে নিলো। মাহেরও কয়েক চুমুক দিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ সূচনা বলল,
-” বিয়ের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত কী? ”

-” মা’য়ের ছেলের বউ প্রয়োজন, বোনের ভাবি প্রয়োজন, আর আমার একজন বন্ধরূপী ব্যক্তিগত মানুষ প্রয়োজন। এটাই সিদ্ধান্ত। ”

কিছুক্ষণ আবারও নীরবতা কাটল। কফির মগে আস্তেধীরে চুমুক দিতে থাকা সূচনার দিকে একমনে তাকিয়ে মাহের বলল,
-” আপনার মতামত? ”

এক পলক তাকিয়ে কফির মগ টেবিলে রেখে স্বাভাবিক হয়ে বসল সূচনা। ধীরেসুস্থে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” আপনার মতো মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া যে কোন মেয়েরই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমায় বউ হিসেবে গ্রহণ করলে নিজেকে সৌভাগ্যবতীই মনে করব। কিন্তু আমার বিষয়ে পুরোপুরি জানার পর আপনার সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারে। ”

নড়েচড়ে বসল মাহের। বলল,
-” ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বদলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ”

-” আমার দীর্ঘদিনের রিলেশন ছিল! ”

অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে মাহের বলল,
-” ছিল, নেই তো। ”

বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকাল সূচনা। ঢোক গিলে বলল,
-” না। ”

-” আমার আপত্তি নেই। আর কিছু? ”

-” আমি তাকে ভালোবাসতাম। ”

-” স্বাভাবিক। ”

-” বিয়েতে রাজি হলেও আমার সময় লাগবে। ”

-” কীসে? ”

-” আপনাকে স্বামীর স্থান দিতে। ”

-” বন্ধুর জায়গাটা দিলেই হবে। ”

চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ল সূচনা। বলল,
-” আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যাই নেই? ”

-” সমস্যা থাকবে কেন? আপনার চোখ তো টেরা নয়, নাকও বোচা নয়। আপনার আমাকে নিয়ে সমস্যা আছে কিনা বলুন৷ বুড়ো বর পেতে আপত্তি নেই তো?”

আশ্চর্য হয়ে সূচনা বলল,
-” কে বুড়ো আপনি! ”

-” গুণে গুণে ছ’বছরের বড়ো। আটাশ বছর বয়সী বুড়ো। ”

মৃদু মৃদু হাসতে লাগল মাহের। সূচনা আহত সুরে বলল,
-” আপনার বয়সে অনেকে চৌদ্দ, পনেরোর মেয়ে বিয়ে করে। আমার তো বাইশ চলছে। ”

-” তাহলে পারফেক্ট ম্যাচ কী বলেন? ”

সূচনা পুনরায় মাথা নিচু করল। বলল,
-” একটি প্রশ্ন করি? রাগ করবেন না তো? ”

-” ওহ ম্যাডাম প্রথম পরিচয়ে রাগ দেখালে আপনি তো পালিয়ে যাবেন। নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করুন। ”

-” কখনো পারবেন রশ্নির জায়গাটা আমাকে দিতে? ”

নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেল মাহের৷ সে জানতো নিলয় সূচনাকে সবটা জানিয়েছে। যা নিজ মুখে জানানোর সাধ্য তার নেই। তারপরও বুকের ভিতর ভীষণ রকম মুচড়ে ওঠল৷ সত্যিই কি পারবে রশ্নির জায়গা সূচনাকে দিতে। সূচনা তাকিয়ে আছে মাহেরের দিকে। সত্যি বলতে নিলয়ের ম্যাসেজ পাওয়ার পর থেকেই মাহেরের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী হয়েছে সূচনা। যে পুরুষ ধর্ষিত হওয়া নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে ঐ পুরুষের মানসিকতা নিয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহও রাখা উচিৎ নয়। সূচনাও রাখেনি। বিয়েতে দ্বিধাহীন হয়েছে মাহেরের সত্যিটা জানার পরই। সূচনা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘসময় পর মাহের বলল,

-” আমি কখনো আপনাকে রশ্নির জায়গা দিতে পারব না৷ কারণ রশ্নি আমার ভালোবাসার মানুষ। সূচনা, আপনি সত্যি ভাগ্যবতী কারণ রশ্নি যে জায়গাটা পায়নি সে জায়গাটা আপনি পাবেন। কারণ আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবেন। শুধু প্রেমিকা হওয়াটাকে তো প্রাপ্তি বলে না। ওর জায়গাটা না হয় আপনি নাই নিলেন। আপনার স্থান আমার এখানে থাকবে। ”

বুকের বা’পাশ দেখিয়ে বলল মাহের। ভাষাহীন হয়ে পড়ল সূচনা। অদ্ভুতভাবেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। বিরবির করে শুধু একটা কথাই বলল,
-” আপনি অনন্য মাহের। আপনি অনন্য। ”
_____
পরেরদিন ভোর ছ’টায় সূচনার ফোনে কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহের বলল,
-” শুভ সকাল ম্যাডাম। বিরক্ত হলেন? ”

ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল সূচনা। স্ক্রিনে ভালোভাবে নাম্বারটা দেখে জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-” না না বিরক্ত হইনি। বলুন আপনি বলুন। ”

-” পাশে পানি থাকলে পানি খেয়ে নিন। তারপর বলছি। ”

গলা শুঁকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। সত্যি ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। তাই দেরি না করে ফোন রেখে সত্যি সত্যি ওয়াটার বোতল থেকে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলো সূচনা। তারপর বিছানায় এসে ধীরেসুস্থে ফোন কানে ধরে বলল,
-” জি বলুন। ”

-” আমার বোন হৈমী। আপনাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। বায়না ধরেছে আজ কলেজ শেষ করে আপনার ওখানে যাবে। ”

মৃদু হেসে সূচনা বলল,
-” তাই আসুক না আজ আমি বাসায়ই থাকব ভার্সিটি নেই। ”

-” আচ্ছা আমি দিয়ে আসব। হবু ননদ সম্পর্কে জানেন তো? ”

-” জি অল্পস্বল্প। ”

মুচকি হেসে মাহের বলল,
-” পুরোটা জেনে যাবেন আজ। খুব বেশি বিরক্ত করলে আমায় ফোন করবেন। ”

-” একদম না৷ আমি মানিয়ে নেবো। ”

-” এই সেরেছে মানিয়ে নেওয়ার আপনি কী বুঝেন? বাচ্চা একটা মেয়ে ওসবে জড়াবেন না। বিয়ের সময় মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ জ্ঞান দেওয়া হয়। অথচ মানিয়ে নেওয়া উচিৎ আমাদের অর্থাৎ ছেলে সহ ছেলের পরিবারদের। আপনি একা মানুষ সবার সাথে কি করে মানিয়ে নেবেন? আমি বোনকে বুঝিয়ে পাঠাব যেন বিরক্ত না করে চিন্তা করবেন না। ”

গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহের, হৈমী। সূচনাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখছে হৈমী। হঠাৎ মৃদু চিৎকার করে বলল,
-” ভাইয়া তোমার শশুর তো হেব্বি বড়োলোক!”

মাহের চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” ভাষা ঠিক করো। ”

জিব কেটে হৈমী বলল,
-” সরি সরি তোমার শশুর তো ভীষণ বড়োলোক! কতবড়ো বাড়ি। ”

বলেই কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-” আচ্ছা ভাইয়া ভাবির কোন ভাইটাই নেই? ”

-” চুপপ হৈমী… সূচনা আসছে কন্ট্রোল করো নিজেকে। নয়তো কানে ধরে বাড়ি নিয়ে যাব। ”

হৈমী দমে গেল। বিরবির করে বলল,
-” বয়েই গেছে ভাবির ভাইদের সঙ্গে লাইন মারতে। মরেছি গুন্ডা দেখে বেয়াই টেয়াইয়ের ভাত আছে নাকি হুহ! ”

সূচনা এসে গেটের তালা খুলতেই হৈমী হৈহৈ করে ওঠল। দৌড়ে এসে সূচনাকে জড়িয়ে ধরল। সূচনা ভয় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হৈমী তাকে জাপ্টে ধরায় পড়ে যায়নি। হৈমী খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
-” উফফ ভাবি তুমি কী সুন্দরী গো! তোমার ননদিনীও কিন্তু কম সুন্দরী না… আগে আমাকে দেখোতো দেখে বলোতো পছন্দ হয়েছে কিনা? ”

মাহের দ্রুত এসে হৈমীকে ধমক দিলো। সূচনা বলল,
-” ইস ধমকাচ্ছেন কেন? আমার তো ভালোই লাগছে। ভেতরে আসুন। হৈমী ভেতরে গিয়ে কথা বলি আমরা।”

এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। মুহূর্তেই ডোর খুলে বেরিয়ে এলো রুদ্র! সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল হৈমী। সূচনার এক বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
-” সর্বনাশ! গুন্ডাটা আমার প্রপোজাল পাওয়ার পর থেকে নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছে। নয়তো তোমার বাড়ি চিনল কীভাবে? ভাবি, এটা আমার ক্রাশ তাই বোধহয় বাঁশ দিতে এসেছে প্লিজ বাঁচাও আমায়। ”

চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা
( অনুমতি ছাড়া কপি নিষেধ। বেশি বেশি শেয়ার করে পাঠকদের মাঝে পৌঁছে দিন গল্পটা )
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here