বেসামাল প্রেম পর্ব ২

1
3810

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২
-” আমাকে ভালোবেসে ফুল দেওয়ার জন্য থ্যাংকিউ। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রেমটেমও চলবে না আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”

এমন একটি উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল পালন। কারণ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া এই মেয়েটি মাত্র তিন মাসেই কলেজে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রথমত, বাংলা বিভাগের নতুন লেকচারার মাহের খানের একমাত্র ছোটো বোন সে। দ্বিতীয়ত এই মেয়েটি ভয়াবহ রকমের বিচ্ছু। সর্বক্ষণ তার মাঝে একটা ছটফটে ভাব বিরাজমান। সিনিয়র আপু, ভাইয়াদের অনেকেই তাকে ভীষণ ভয় করে চলে, অনেকে আবার খুব ভালোওবাসে। সবচেয়ে বড়ো কথা সিনিয়র আপুরাই তাকে বেশি স্নেহ করে। এর পেছনে অনেক বড়ো একটি কারণ তার সুদর্শন লেকচারার ভাইটি৷ আটাশ বছর বয়সী অবিবাহিত সুদর্শন লেকচারার পেলে অনার্স পড়ুয়া অবিবাহিত মেয়েরা বেসামাল অনুভূতিতে লুটোপুটি খাবেই। বয়স সবে সতেরো হলেও ভাইয়ের মতো বোনটিও কম নয়। ভাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বল গায়ের রঙ তার৷ গায়েপায়ে খুব একটা বড়ো না হলেও ধবধবে ফর্সা ত্বক, গোলগাল শুভ্র মুখশ্রীর ঘন-কালো বড়ো বড়ো পাপড়িতে বেষ্টিত চোখজোড়া দেখেই সমবয়সী, সিনিয়র ভাইরা কপোকাত। তিন মাসে কম প্রপোজ পায়নি সে। বরাবরই পালনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়েও তার খ্যাতির শেষ নেই৷ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হওয়ার দরুন ইন্টার, অনার্স, ডিগ্রি, মাস্টার্স সকল পর্যায়ের স্টুডেন্ট’স রয়েছে এখানে। পালন অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। পালন’কে দিয়ে মোট তেরোটা প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল হৈমী। এই তেরো বারে বারোটা গোলাপ ঠিক গ্রহণ করেছে৷ বাকি একটা গোলাপ প্রপোজকারী প্রপোজ একসেপ্ট না করাতে দেয়নি। এ নিয়ে অবশ্য এক চোট ঝগরা করেছিল ছেলেটার সঙ্গে। ছেলেটার বাইকের সিটে চুইংগাম লাগিয়ে প্রতিশোধ নিতেও ভুলেনি! বর্তমানে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই ইঁচড়ে পাকা। কিন্তু হৈমীর বেলায় শুধু ইঁচড়ে পাকা নয়৷ মেয়েটি যেমন বাচাল, তেমনি দুরন্ত। শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মিষ্টিভাষী একজন গুণী শিক্ষকের বোন এমন অশান্ত কী করে হলো ভাবতে গেলেই মাথা ঘুরে যায়।

রুদ্র সহ তার সাঙ্গোপাঙ্গ’রা মোটেই হৈমীর এইরূপ আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। রুদ্র চোখ, মুখ কুঁচকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। আগ্রহ নেই অথচ বিরক্তি আকাশ ছোঁয়া। ঝিনুক আবির সহ বাকি সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এরা একে অপরের দিকে বিস্মিত চোখে চাওয়া চাওয়ি করছে! গোলাপ ফুল নিয়ে চঞ্চল পায়ে ঝিনুকের সামনে এসে দাঁড়াল হৈমী। পালন ক্লান্ত মুখে সেই তখনি ভার্সিটিতে ঢুকে পড়েছে। তার ইনকোর্স পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার সময় হয়ে যাওয়াতে আর দেরি করেনি।

-” তো ভাইয়া কী বলছিলেন? মাহের ভাইয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক তাই তো? ”

হৈমী এসে একদমে কথাটা বলতেই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়াল ঝিনুক। আবির ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। তার দৃষ্টি একবার হৈমীর মুখের দিকে তো আরেকবার হাতে থাকা লাল গোলাপটির দিকে ছুটোছুটি করছে। হৈমীর উত্তর দেওয়ার তেমন তাড়া নেই। সে এক এক করে সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ যখন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী রুদ্রর দিকে পাকাপোক্ত নজর পড়ল কিঞ্চিৎ চমকাল। ঘন ঘন চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে আপাদমস্তক রুদ্র’কে দেখতে শুরু করল। চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল ভীষণভাবে। চোখের পাতা এলোমেলো নড়চড় করতে করতেই গোলাপটা নয়নের হাতে দিলো। নিজের দু-হাত কোমড়ে রেখে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো সুক্ষ্মভাবে তাকিয়ে রইল। আবির রুদ্রর পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
-” দোস্ত দেখ তোকে কেমনে দেখতাছে। রোহিঙ্গাদের যেমনে দেখি অমনে তোরে দেখতাছে। এইটা কোন কথা হইল! তুই কিছু বল আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ লাগতাছে। ”

আবিরের কথা শুনে রুদ্র ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে এক পলক তাকাল হৈমীর দিকে৷ সত্যি সত্যি মেয়েটা ভুত দেখার মতো দেখছে তাকে। গোলগাল মুখের গোল গোল চোখ যেন গিলে খাচ্ছে। পা থেকে মাথা অবধি বিরক্তি ভঙ্গিতে অতি সুক্ষ্মভাবেই দেখল রুদ্র। বডি ফিগার দেখেই চট করে বুঝে নিলো নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। এর সঙ্গে মাহেরের কোনকিছু থাকতে পারে বলে মনে হলো না। আবার সন্দেহও হলো, যতটুক বুঝল মেয়েটার চরিত্রে ঘাপলা আছে। ভালো মেয়েরা নিশ্চয়ই এত কথা বলে না, এভাবে একটা ছেলের থেকে গোলাপ ফুল নেয় না। তাছাড়া আজকাল পুরুষদের এমন কচি মেয়েদের প্রতিই ঝোঁক বেশি। যত শিক্ষিতই হোক অল্পবয়সী মেয়েদের প্রতি লোভ বেশিরভাগ পুরুষেরই রয়েছে। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভরে গেল। ত্বরিতবেগে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ক্ষণকাল সময় পেরোতেই হৈমীর দিকে আঙুলে তুরি বাজিয়ে গম্ভীর, রূঢ় কণ্ঠে বলল,
-” এই, মাহেরের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? যা প্রশ্ন করেছি জাস্ট সেটার উত্তর দিয়ে বিদায় হও। নয়তো এমন হাল করব, মানুষ’কে মুখ দেখাতে পারবে না। ”

আঁতকে উঠল হৈমী। সম্বিত ফিরে পেয়ে কোমড় থেকে দু’হাত সরিয়ে এক ঢোক গিলল। পিটপিট করে কতক্ষণ তাকিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে অমনি পেছন থেকে নয়ন ওর মুখ চেপে ধরল। শঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
-” মাহের স্যার ওর আপন বড়ো ভাই। ”

ব্যস আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না নয়ন। প্রাণের বান্ধবীটিকে নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে একটি রিকশা ডেকে ওঠে পালিয়ে গেল। রিকশা চলছে হৈমীর বাড়ির দিকের রাস্তায়। একমিনিট সময় ধরে নয়ন ভয়াতুর কণ্ঠে অনেক কথাই বলেছে হৈমীকে। তার ধারণা রুদ্র সহ ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা সন্ত্রাস হবে। আর তাদের লিডার হচ্ছে রুদ্র। ঐতো লম্বা লম্বা চুল, মুখ ভর্তি বড়ো বড়ো দাঁড়ি। চোখ, মুখের ভাব, কণ্ঠস্বর সবটাতেই পাক্কা সন্ত্রাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। কী বিশ্রী ভাবে সিগারেট খায়। নাক কুঁচকে রইল নয়ন। বাড়ির সামনে রিকশা আসতেই হঠাৎ হৈমী চিৎকার করে ওঠল। নয়নকে আকস্মিক জড়িয়ে ধরে বলল,
-” দোস্ত ফাটাফাটি। ”

-” কী! ”

-” ফাটাফাটি রকমের ক্রাশ খেয়েছি। ”

ভয়কাতুরে কণ্ঠে নয়ন বলল,

-” প্লিজ এটা বলিস না তুই ঐ সন্ত্রাসটাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিস। ”

-” দোস্ত এ জীবনে আমি কাউকে দেখে ভয় পাইনি। কারো কথায় আমার গলা শুকিয়ে যায়নি। বুকের ভিতর ধড়াস করেও ওঠেনি। কিন্তু আজকে! হায়! আমি ভাবতে পারছি না। তাড়াতাড়ি নাম একটা সেলিব্রেশন হওয়া উচিৎ। ”

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নয়নকে নিয়ে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল হৈমী। নয়নের হাত পা এখনো কাঁপছে তখনকার পরিস্থিতি মনে করে৷ কী চেহেরা! কী কণ্ঠস্বর! কী ভয়াবহ হুমকি! পুনরায় গা শিউরে ওঠল তার। অথচ হৈমী কিনা ক্রাশ খেলো! মেয়েটা কি সত্যি পাগল?
_
যুব উন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি রাদিফ শেখ। রুদ্রর বড়ো চাচার বড়ো ছেলে। তার ফোন পেয়েই ক্লাবে ছুটে গেছে রুদ্র। সেখানে যাওয়ার পর দেখল, ছোটোখাটো একটি জটলা বেঁধে আছে। রুদ্র’কে দেখে অনেকে জড়োসড়ো হয়ে গেল। রাদিফ জটলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রুদ্রর কাছে গেল। রুদ্রকে দেখে জটলার ভিতরে থাকা প্রতিটি মানুষের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ ক্লাবের পেছনের জঙ্গলে দু’টো ছেলেমেয়ে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়েছিল। তখনই ক্লাবের কয়েকজন সদস্য ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। এখন তারা জটলার মাঝখানে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। সমস্ত ঘটনা শুনতেই রুদ্রর চোখ, কান উভয়ই রক্তিম হয়ে ওঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারল না৷ তড়াক করে এসে জটলার ভেতর ঢুকে ছেলেটাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করল। মেয়েটার গালেও কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছে। রাদিফ ওকে টেনেটুনে সরিয়ে এনে থমথমে কণ্ঠে বলল,
-” রুদ্র মাথা ঠান্ডা কর একটা সমাধান দে। ছেলেটা আমার বন্ধুর ছোটো ভাই৷ ”

বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নীরস কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” মেয়ের পরিচয় কী? ”

রাদিফ মেয়ের পরিচয় দিতেই রুদ্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেডি করে কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলল। ছোটো ভাইয়ের পরামর্শে রাদিফ তার ছেলেপুলেদের দিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। বিকাল গড়াতে গড়াতে ছেলে, মেয়ে উভয়ের পরিবারের সম্মুখেই বিয়ে পড়ানো হলো। পাত্রপাত্রী বিদায় করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ পনির নামের রুদ্রর একজন চ্যালা বলল,
-” বস আপনার নামে একটা চিঠি আছে। ”

বাইকে বসতে বসতে ভ্রু কুঁচকে রুদ্র বলল,
-” ঝেড়ে কাশ। ”

-” ইয়ে মানে লাভ লেটার পাঠিয়েছে এক মেয়ে। ”

আশ্চর্য হয়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল রুদ্র। বাইকের পেছনে ঝিনুক বসতে নিয়ে আবার নেমে দাঁড়িয়েছে। সেও অবাক চোখে পনিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– “আমি একজন সন্ত্রাস। একজন সন্ত্রাস’কে যে মেয়ে লাভ লেটার পাঠায়, সে মেয়ে আরো বড়ো সন্ত্রাস। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম, চব্বিশ ঘন্টা। এরমধ্যে ঐ মেয়ে’কে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। প্রয়োজনে ঘরে ঘরে তল্লাশি করবি। ”

পনির বলল,

– “ভদ্র ঘরের মেয়ে বস। বড়ো একটা ভাই আছে কলেজে লেকচার দেয়। ”

– ” নাম কী? ”

– ” মাহের খান। ”

-” বোনের নাম? ”

– ” হৈমন্তীকা জাহান হৈমী। ”

ঝিনুক আতঙ্কিত হয়ে মুখে হাত দিলো। রুদ্র কপাল কুঁচকে ঝিনুকের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” বোনের তো লুস ক্যারেক্টার দেখছি! ভাইয়ের বিষয়ে আরেকটু খবর নে ঝিনুক। আমার বোনের গোটা জীবনের বিষয় এটা। ”

ঝিনুককে কথা গুলো বলেই পনিরকে বলল,

-” লাভ লেটার কার কাছে। ”

– ” বাবু ভাইয়ের কাছে। ”

সিগারেট ধরাতে ধরাতে রুদ্র গর্জন ছাড়ল,

– ” এই বাবু, কী লিখছে পড়তো। ”

পনিরের পেছন থেকে এগিয়ে এলো বাবু। মৃদু কাঁপছে তার হাতদুটো। কম্পিত হাতেই দু’ভাঁজ করা সাদা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করল,

– ” এই যে মি. গুণ্ডা, থুরি গুণ্ডাদলের হেড। আপনাকে
আই লাভ ইউ। অর্থ হচ্ছে, আপনাকে আমার মতো এই দুষ্টু, মিষ্টি, সুন্দরী রমণীটি ভালোবাসে। আপনাকে আমি আমার প্যারাসিটামল হিসেবে চাই, আপনাকে আমি আমার এন্টাসিড হিসেবে চাই। আপনাকে চাই, আপনাকে চাই ও গুণ্ডা আপনাকে কিন্তু চাই’ই। আসসালামু আলাইকুম গুণ্ডা। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব, আশা করি, দু’দিনের ভেতরে জবাব পাবো। ”

চিঠিতে লেখা ভাষাগুলো কর্ণগোচর হতেই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধতার সঙ্গে তেড়ে এলো রুদ্র। খপ করে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলিষ্ঠ হাতে মুচড়ে মাটিতে ফেলল। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” বেয়াদব মেয়েটার আজ এমন অবস্থা করব যে পরবর্তীতে আমাকে লাভ লেটার তো দূরের কথা আমাকে কল্পনা করতেও ওর রূহ কেঁপে উঠবে! ”

ত্বরিতগতিতে বাইকে ওঠে ঝিনুক’কে পেছনে বসতে বলল৷ ঝিনুক বসতেই বলল,
-” মাহের খানের বাড়ির পথ বল। ”

ঝিনুক মাহেরের বাড়ির ঠিকানা বলতেই রুদ্র সেদিকে বাইক ঘোরাল। পনেরো মিনিটের পথ মাত্র পাঁচ মিনিট গিয়েছে। এমন সময় কল পেলো বড়ো চাচি জেরিনের৷ সে জানাল, সূচনা’কে দেখতে এসেছে তার বান্ধবী। তাই রুদ্রকে যত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে৷ ফোনে কথা শেষ করে রুদ্র বাইক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
-” মেয়েটার কপাল ভালো। ”

বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলো বোরখা পরিহিত একজন মহিলা সূচনার পাশে বসে আছে। নিকাব খোলা থাকায় মহিলাটির বয়স আন্দাজ করল পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। রুদ্রকে দেখতেই চাচি জেরিন বলল,
-” এইতো আমাদের রুদ্র এসে গেছে। হামিদা এটাই আমার ভাতিজা। সূচনার বড়ো ভাই। ”

মহিলাটি সৌজন্যপূর্ণ হেসে রুদ্রকে বলল,
-” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো বাবা। ”

আমতা আমতা করে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে রুদ্র বলল,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”

বাকিটুকু জবাব দিলো না সে। দোনোমোনো করে দাদিনের পাশে গিয়ে বসল। হামিদা রাগ করলেন না। জেরিনের বান্ধবী হওয়ার সুবাদে রুদ্র, সূচনা সম্পর্কে পুরোপুরিই অবগত তিনি। মা হারা ছেলেমেয়ে দু’টোর প্রতি মায়ার অন্ত নেই। সে মায়া থেকেই একমাত্র ছেলে মাহেরের জন্য সূচনাকেই নির্বাচন করেছেন।ছেলে সম্পর্কে মোটামুটি যতটুক ধারণা পেয়েছে সূচনার প্রবাসী বাবা, বড়ো চাচি, চাচাতো ভাইরা এবং দাদিন কারো কোন আপত্তি নেই৷ ছেলের মায়ের স্নেহপূর্ণ আচরণ দেখে সূচনার মন অনেকটাই নরম হয়েছে। মা হারা মেয়ে সে। ছোটোবেলা থেকে মাকে ছাড়া বড়ো হয়েছে। মা, মা গন্ধটা কখনো নাকে আসেনি। বড়ো চাচি অনেকগুলো বছর অভিমানে বাপের বাড়ি কাটিয়েছেন। এখন পর্যন্তও ছেলে, ছেলে বউয়ের সঙ্গে শশুর ঘর থেকে দূরেই আছেন। বছরখানেক হলো রুদ্র আর সূচনার সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ বয়স বেড়েছে বুদ্ধিও খুলেছে। এক সময় অতি সরলা ছিল বলেই স্বামী ছোটো ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে তাকে ত্যাগ করেছেন। সেদিনের জেরিনের সাথে আজকের জেরিনের মধ্যে রাত দিন তফাৎ। নিজের বাচ্চাদের বুকে টেনে রুদ্র, সূচনার থেকে এতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকলেও এখন তিনি বুঝতে পরেছেন এই সন্তান দুটোর কোন দোষ নেই। মায়ের পাপের অংশীদার তারা কোনভাবেই নয়। ঠিক যেমন তার ছেলেরা বাবার পাপের অংশীদার নয় তেমনি রুদ্র, সূচনাও। তাই তো সূচনার এমন খারাপ পরিস্থিতিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে বান্ধবী হামিদার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা এগিয়েছেন। এ নিয়ে চাচির প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই রুদ্রর। সূচনাও ভাই আর চাচিকে ভরসা করে একজন মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বিয়েতে মত দিয়ে দিলো৷ কথাবার্তা শেষে সকলেই মিষ্টি মুখ করল। দাদিন জানে মাহেরের বাবা নেই। বছর চারেক আগে পরলোকগমন করেছেন। মা, বোন নিয়েই তার সংসার৷ তাই বললেন,
-” হামিদা, তোমার মেয়েটাকে নিয়ে আসলে না তো?”

শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে ঠোঁট টিপে হাসল জেরিন৷ হামিদাকে কিছু বলতে না দিয়ে সেই বলল,
-” আসলে মা ওর মেয়েটা বড্ড ছেলেমানুষ। অতিরিক্ত সহজসরল। হাতেপায়ে বড়ো হলেও বুদ্ধি তেমন নেই। হৈহৈ রৈরৈ করতে পছন্দ করে। প্রথম দিন এসেই যদি অমন হৈহৈ শুরু করে আপনারা ভুল বুঝতে পারেন। তাই নিয়ে আসেনি। ”

লজ্জিত হয়ে হামিদা বলল,
-” আসলে মেয়েটা সহজেই সবার সাথে এমনভাবে মিশে যায় এরজন্য অনেক সময় লজ্জায় পড়তে হয়। বাচালও বলতে পারেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ওকে কোথাও নিয়ে যাই না। সব ঠিকঠাক হোক নিশ্চয়ই আসবে। আপনাদের পাগল করেও ফেলবে একদম।”

এমন সময় রুদ্র দাদিনের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-” দাদিন আমার কথা আছে। ”

-” কী বল তোর কি আপত্তি আছে? ”

ইতস্ততভাবে রুদ্র বলল,
-” ছেলেকে নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের বোনকে নিয়ে বিরাট সমস্যা। ”

দাদি চোখমুখ ছোটো করে বলল,
-” সেকি! বিয়ে দেবো আমার নাতনিকে ঐ ছেলের কাছে। আমার নাতিকে দিয়েতো আর ঐ ছেলের বোন আনব না। তাহলে তাকে নিয়ে কেন সমস্যা থাকবে? ”

হকচকিয়ে রুদ্র বলল,
-” ছেলের বোনের চরিত্র খারাপ দাদিন! ”

-” কী বলিস আমি জীবনেও বিশ্বাস করব না এটা। হামিদার মেয়ে খারাপ হতেই পারেনা। আর যদি হয়ও তাতে আমাদের কী? তাকে তো আর তোর বউ করে আনছি না। ”
_
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। হৈমীকে তার বেয়াদবির শাস্তি দিতে চেয়েছিল রুদ্র। কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়াতে এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাল না। শতহোক, বোনের শশুর বাড়ির লোক। এদিকে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই মাহেরের। শুধু এনগেজমেন্টের আগে মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলতে চায়৷ মাহেরের এমন ইচ্ছে শুনে সূচনাও স্বস্তি পেলো৷ একজনকে ভালোবেসে আরেকজন’কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাই বলে কাউকে ঠকানোর মানসিকতা নেই। আগামীকাল বিকেল চারটায় মি.মাহের খানের সঙ্গে মিট করতে যাবে সে।

চলবে…
( অনুমতি ছাড়া কপি নিষেধ )
[ ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এই গল্পটি রোমান্টিক জনরার আশা করি ধীরে ধীরে ভালো লাগবে। ]

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here