#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব২
#নবনী_নীলা
” এটা কেমন ব্যবহার? আপনি ভদ্রতা জানেন না?”, তীব্র বিরক্তি আর রাগ নিয়ে চেঁচিয়ে বললো রুহি।
” তুমি ভদ্রতার ভাষা বুঝলেই হয়।”, আড় চোঁখে তাকিয়ে বললো আহান। তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।
রুহি মুখ গোমড়া করে বিছনায় বসে আহনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এক বালতি পানি এনে একে পুরো ভিজিয়ে দেয়। এমন সময়ে দরজায় টোকা পরে। আহান দ্বিধা না করে দরজা খুলে দেয়। আহানের কাজিন তন্বী এসেছে। এরা দুইজন পিঠাপিঠি। আহান দরজা খোলার সাথে সাথে তন্বী গুড মর্নিং বোলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। তন্বী সোজা রুহির কাছে গেলো। রুহিকে এভাবে ভিজে থাকতে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তন্বী,” একি রুহি তোমার এ অবস্থায় হলো কিভাবে?”
রুহি মুখে পানি শব্দটা বলতেই আহান ব্যাগ্রা দিয়ে বললো,” পানি ফেলে দিয়েছে নিজের উপর।”
কতো বড়ো মিথ্যাবাদী এই লোক। রুহি কিনচিৎ মুখ কালো করে আহানের দিকে তাকালো। আহান চোখের ইশারায় সতর্ক করলো রুহিকে। মানুষের সামনে ভদ্র সাজা হচ্ছে মনে মনে বললো রুহি।
তন্বী আবাক হয়ে বলল,” নিজের উপর পানি ফেললে কিভাবে আর ভিজে গেলেই বা কি করে এতো।”
” আমি নিজেও সেটাই ভাবছি।”, মুখ ফসকে বলে স্বাভাবিক আচরণ করতে চাইলো রুহি।
রুহির কথায় তন্বী হেসে উঠে বললো,” আহানটাকেও একটু ভিজিয়ে দিলেই পারতে।”
রুহি ফিক করে হেসে ফেললো। আহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুহির দিকে। রুহি ভ্রূ কুচকে হাসি থামলো। তন্বী রুহিকে তাড়া দিয়ে বললো,” রুহি ওঠো এবার! চেঞ্জ করে নেও নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। আর এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
রুহি মলিন চোখে উঠে দাঁড়ালো তারপর চেঞ্জ করতে চলে গেলো। তন্বী আহানকে উদ্দেশ্য করে বললো,” তোর বউটা কি মিষ্টি রে! ”
আহান এক সেকেন্ডের জন্য অনিচ্ছাকৃত হাসি দিয়ে আবার নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। তন্বী দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বললো,” সারারাত ঘুমাস নি মনে হয়।”
আহান আড় চোঁখে তাকাতেই তন্বী দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর ফিক করে হেসে উঠে চলে গেলো।
আহান বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কি জানি নাম রুহ… রুহি। সে বের হচ্ছে না কেনো এখনো।
অবশেষে প্যাকেটে থাকা শাড়িটা পরে রুহি বেরিয়ে এলো। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে মুড়িয়ে। চেহারায় সিগ্ধভাব চলে এসেছে তার। রুহি বের হওয়ার সাথে সাথে আহান তাড়া দিয়ে বললো,” নীচে চলো।”
” আরে আরে দাড়ান এক মিনিট। আমার চুলের পানি নিতে হবে। একটু সময় লাগবে।”, বেস্ত হয়ে চুলের পানি নিতে নিতে বললো রুহি।
” হোয়াট দা হেল! ডোন্ট ইউ সি ভিতরে হেয়ার ড্রায়ার ছিলো? তোমার এই চুল এবার শুকাতে কতক্ষণ লাগবে?”, বিরক্তি নিয়ে বললো আহান।
” এইতো হয়ে গেছে” বলে ভেজা চুলগুলো পিছনে ছড়িয়ে দিতেই পানির ছিটকে এসে আহানের মুখে পড়লো। আহান সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের পানি মুছে ভ্রূ কুচকে রুহির দিকে তাকিয়ে রইলো।
” কি হলো? যাবেন যাবেন করে তো মাথা খেয়ে নিয়েছেন এখন খাম্বার মতন দাড়িয়ে আছেন কেনো? আপনি যে কাজটা আজকে সকালে করেছেন না এর প্রতিশোধ তো আমি পরে নিয়েই ছাড়বো নইলে আমার নাম ও রুহি না।”, শাসিয়ে বলল রুহি।
রুহির কথাগুলো সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে আহান বললো,” শেষ হয়েছে তোমার ভাষণ ? চলো এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।”
রুহি মুখ ফুলিয়ে দুপা বাড়তেই আহান রুহির হাত ধরে ফেলল। রুহি ভূত দেখার মতো চমকে পিছনে ফিরলো। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে বললো,” হাত ধরেছেন কেনো আবার? ছাড়ুন। আমার হাত না ভাঙতে পারলে কি আপনার শান্তি হচ্ছে না?”
রুহির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে হাত আরো শক্ত করে ধরে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,” বলেছি না সবার সামনে অভিনয় করতে হবে, সে আমাদের দুজনের ইচ্ছে না থাকলেও।”
সবাইকে যতো তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করানো যাবে ওরা একে অপরকে খুব ভালোবাসে, সুখী আছে দিদা ততো তাড়াতাড়ি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে রাজি হবে।
রুহির খুবই অসস্তি লাগছে বিয়ের পরের দিন এভাবে হাত ধরে সবার সামনে যেতে হবে। লজ্জা নামক একটি জিনিস তো পৃথিবীতে আছে নাকি সেটাও উঠে গেছে। এই লোকের যে কোনো অনুভূতি নেই সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তার তো আছে। আহান রুহির হাত ধরে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। রুহি মাথা নিচু করে পিছনে রয়েছে। হটাৎ কালকে রাতের একটা কথা মনে পড়লো তার। তারপর হালকা কেশে উঠে বললো,” কে জানি বলেছিলো তার নাকি আমার হাত ধরার কোনো ইন্টারেস্ট নেই । কে জানি বলেছিলো আপনি কি চিনেন তাকে?”, আহানকে খানিকটা খোঁচা মেরে রুহি এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
আহান কথাটা শুনতে পেয়ে রুহি হাত টান দিয়ে রুহিকে নিজের পাশে নিয়ে এলো। তারপর রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,” যা বলার এখানে বলে শেষ করো নীচে গিয়ে যদি একটাও আজে বাজে কথা বলেছো না তোমায় আমি….।”, এতটুকু বলেই আহান রুহির হাত ধরে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। রুহিও বাধ্য হয়ে নামছে।
নাস্তার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে। ইয়া বড় ডিনার টেবিলের সোজা মাঝের চেয়ারে আহানের দাদু বসে আছে দাদুর পাশের চেয়ারে দিদা বসে আছে। ওনার নাস্তাটা সাধারণত ঘরে দেওয়া হয় কিন্তু আজ তিনি সবার সাথে নাস্তা করবেন বলে এসেছেন। দিদার পাশের চেয়ারে তন্বী বসে আছে। অপর পাশের চেয়ারে আহানের বড়ো ভাই আবির আর তার ওয়াইফ সুহা বসে আছে। সুহার পাশে তাদের ছোট্ট মেয়ে সুপ্রভা বসে আছে। বেচারি ঘুমে যেনো পড়ে যায় অবস্থা। দাদু বাড়িতে থাকলে নাস্তার টেবিলে সবার একসাথে থাকতে হবেই।
আহানের বাবা মা দেশের বাহিরে আছেন তবে শীঘ্রই দেশে ফিরবেন। আহানের বিয়েতে আহানের মার মত একদমই ছিলো না। তবে দিদাকে আহান খুব ভালোবাসে।
আহানকে রুহির হাত ধরে সাথে নিয়ে আসতে দেখে দিদার চেহারা হাস্যোজ্বল হয়ে গেলো।
সবাই রুহিকে বেশ আদর যত্ন করলো। শুধু আহান আর তার দাদুর মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আহানের দাদু অবশ্য রুহির বাড়ির লোকের কথা জিজ্ঞেস করেছে তারপর থেকে চুপ।
রহিমা খালা নাস্তা শেষে সবাইকে চা দিয়ে গেলেন আর সুপ্রভাকে এক গ্লাস দুধ। বেচারি দুধের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো তার সামনে কেউ বিষ এনে রেখেছে। রুহি চুপ চাপ হয়ে আছে এমনিতে পট পট করলেও এতো মানুষের সামনে তার অসস্তি লাগছে।
আহানের বড়ো ভাই একজন লয়ার। তিনি কাজে বের হচ্ছিল, আহান তাকে থামিয়ে বললো,” ভাই দাড়া আমিও বের হবো।”
” তুই আবার আজ কোথায় যাবি?”, দিদা ব্যাস্ত হয়ে বললো।
” আমার আজ ক্লাইন্টের সাথে একটা মিটিং আছে দিদা।”, চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো।
” নাহ্, তোর কোথাও যেতে হবে না।”, মুখ কালো করে বললো দিদা।
” তাহলে আমি যাচ্ছি, কেমন?”, বলে আবির নিজের ফাইল গুলো নিলো।
” না ভাই দাড়াও, তোমাকেও একবার কোম্পানিতে যেতে হবে। আর দিদা যাই আজকে?”, আহানকে দিদা আর না করলো না। কারণ আহানকেই কোম্পানির সব সামলাতে হয়।
আবির যেতেই সুপ্রভা তার শার্টের হাতা টেনে বললো,” বাবা, বাবা আমার জন্য চকোলেট আনবা কিন্তু।” কি মায়া সেই আবদারে।
আবির ঝুকে এসে বললো,” আচ্ছা আনবো। এখণ আমার সামনে দুধের গ্লাসটা শেষ করে ফেলো দেখি।”সুপ্রভা মুখ কালো করে দুধ নামক অত্যাচার সাদরে গ্রহণ করলো।
” এইতো আমার গুড বাচ্চা।”, বলে আবির সুপ্রভাকে আদর করে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
রুহি আগ্রহ নিয়ে সুপ্রভাকে দেখছে এমন সময় আহান একটু কেশে বললো,” আসছি।”
রুহি আড় চোঁখে একবার আহানের দিকে তাকালো। উনি গেলেই বাঁচি। আহান আর আবির বেড়িয়ে গেলো, আহান যাবার আগে দিদার সাথে এসে গল্প করবে প্রমিজ করে গেছে।
সবাই যার যার কাজে চলে গেলো।
দিদা রুহির কাছে এসে বললো,” আহানটা একটু এমনই বুঝলে। তোমার নানুর সাথে কথা বলা হয়নি কালকের পর, কথা বলে আসি।”
দিদা চলে গেলেন, রহিমা খালা তাকে ধরে ধরে সিড়ি দিয়ে দোতলায় তুললেন।
সুপ্রভা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রুহি তার পাশে গিয়ে বসে বললো,” তোমার কি ঘুম পায় না এতো সকালে উঠলে?”
সুপ্রভার চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন তবুও সে না সূচক মাথা নাড়ল।
রুহি হেসে ফেললো তারপর বললো,” বাহ্ তুমি তো অনেক স্ট্রং।”
” হ্যা আমি বড়ো হয়ে গেছি। আমি পড়েছি এ্যারলি টু বেড অ্যান্ড এ্যারলি রাইজ মেকস এ ম্যান হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।”, মাথা নাড়তে নাড়তে বললো সুপ্রভা।
এরা সবাই দেখি এ্যারলি টু বেড অ্যান্ড এ্যারলি রাইজ কবিতাটাকে বেশী সিরিয়াসলী নিয়ে ফেলেছে। মনে মনে বলতেই সুহা মানে সুপ্রভার মা হেসে উঠে বললো,” বাহ্ তোমাদের দেখি ভাব হয়ে গেছে।”
” হ্যা মামনি।”, বলে মুখে হাত দিয়ে হাসছে সুপ্রভা।
” হয়েছে কাজ এবার সারাদিন তোমায় জ্বালাবে।”, রুহির দিকে তাঁকিয়ে বললো সুহা। রুহি সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
????
রাতের বেলা রুহি তাড়াহুরো করে রুম থেকে বের হতে গিয়ে আহানের সাথে ধাক্কা লেগে রুহি নিচে পড়ে যায়। আহান অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমে যাচ্ছিলো রুহি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধাক্কা লাগলো। রুহি পড়ে যাবার সময় আহান ধরতে গিয়েও কেনো জানি ধরলো না। রুহি তেমন কোনো বেশী ব্যাথা পায় নি হাতে একটু লেগেছে মাত্র।
বাড়িতে আসতে না আসতেই শুরু হলো এ মেয়ের উপদ্রপ, একটু শান্ত হয়ে থাকতে পারে না।
রুহি ফ্লোরে বসে মুখ ফুলিয়ে হাত ডলছে। আগে তো ভেবেছিলাম বয়রা এখন তো দেখি কানাও বটে। ফ্লোরে বসে মনে মনে বললো রুহি।
আহান ঘরে ঢুকে বিছানার উপর ব্লেজাটা রেখে বললো,” ফ্লোরে কি আঠা লাগানো আছে?” বলে হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রয়ারে রাখলো আহান
” মানে?”, উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো রুহি।
” মানে বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”, গলার টাই ঢিলে করে বললো আহান।
” একে তো আপনি আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছেন। আমি পরে যাবার পর একবার সাহায্য করতেও এলেন না। এর আগে সকালে আমার মুখে পানি ঢেলে দিয়েছেন। এসবের পর আপনাকে কি করা উচিত জানেন।”, গর গর করে বলতে শুরু করলো রুহি।
আহান হাত দেখিয়ে রুহিকে থামতে বললো। কিন্তু রুহি! সে কি শোনার পাত্র?
” আপনার মধ্যে মনুষ্যত্ব, বিবেক বলতে কিছু নেই। একটা মেয়ে পড়ে গেছে, পড়ে যেতেই পারে হয়তো খেয়াল করেনি। আপনি কোথায় সাহায্য করবেন তা না আপনি খোঁচা মেরে কথা বলেছেন? আর ফ্লোরে আঠা লাগানো আছে কিনা এটা কেমন প্রশ্ন।”
আহান নিজের কাজ করতে ব্যস্ত তবুও রুহি একেবারে তার মুখের সামনে এসে কথা গুলা আহানের কানের ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আহান থামাতে যাবার জন্যে কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কিছু বললে এ মেয়ে হয়তো আজ আর থামবে না। সব রাগ এক্ষুনি ঝাড়বে। শেষে কথাটা বলা মস্ত বড় ভুল হয়েছে। ফ্লোরে বসে ছিলো ভালোই ছিলো চুপ চাপ বসে থাকতো।
রুহির ইচ্ছে করছে এক বালতি ঠান্ডা পানি আহানের মাথায় ঢেলে দেয়। তবে তার মনে শান্তি হবে।
” কি হলো এখন কথা বলেছেন না কেনো?”, আহানের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করতেই আহান রুহির মুখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। রুহি চোখ বড় বড় করে আহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহান রুহির চোঁখে চোঁখ রেখে বলে,” চুপ। এতো রাগ কিসের? “বোলেই রুহির গালের পাশে ঝুলে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিলো আহান।
রুহি পুরো হা করে তাকিয়ে আছে। কি হলো এইটা?
[ চলবে ]