বৃষ্টি ভেজা সেই রাত,পর্বঃ ০১

0
1829

বৃষ্টি ভেজা সেই রাত,পর্বঃ ০১
লেখকঃ আবির খান

আমার ঠিক দু’চোখের সামনে দিয়ে নাদিয়া আরেকটা ছেলের সাথে একটা হোটেলে ঢুকে পড়লো৷ সময়টা যদি এখন দিন হতো তাও আমি বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করতে পারতাম। কিন্তু এখন রাত ৮ টা। এই রাতের বেলায় এরকম একটা হোটেলে নিশ্চয়ই কেউ ভালো উদ্দেশ্যে যায় না৷ আমি না হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে এটুকু বুঝ দিতে পারলাম না, যে আমার নাদিয়া হয়তো নিষ্পাপ। ও আমার সাথে চিট করতে পারে না৷ কখনো না৷ কিন্তু নিজের চোখ যে তা মানে না। কত সুন্দর আরেকটা ছেলের সাথে হাসতে হাসতে আমার সামনেই ওরা ভিতরে চলে গেল। একটা কথা কি, হাজার মানুষের মাঝে সত্যিকারের প্রেমিকটা তার প্রেমিকাকে ঠিকই চিনতে পারে। কারণ তার নয়নজোড়া শুধু দিন রাত তাকেই খুঁজে। আজ যদি ওকে সত্যিকারের ভালো না বাসতাম তাহলে বোধহয় ও আমার চোখে পড়তো না। বেশি সময় নিলাম না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নাদিয়াকে কল দিলাম। তিনবার রিং হওয়ার পর ও ফোন রিসিভ করলো। আমি বলছি,

– কি করো? (শান্ত গলায়)

ও আস্তে সাবধানতার স্বরে বলছে,

~ বাবু আমি আম্মুর কাছে। ফ্রী হলে কল দিব নি৷ তুমি কিন্তু ভুলেও আমাকে কল দিবে না। নাহলে আম্মু বুঝে যাবে৷
– এক কাজ করো, তোমার আম্মুকে বলে দিও, তুমি এখন একটা হোটেলে একটা ছেলের সাথে প্রাইভেট সময় পাড় করছো। নাহলে উনি আবার চিন্তা করবেন৷ রাখি নাদিয়া। ভালো থেকো। আর হ্যাঁ, সবকিছুর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ফোনটা আবার রেখে দিলাম পকেটে। অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য হাঁটছিলাম। সারাদিন বসে বসে কাজ করতে করতে কোমরটার বারোটা বেজে গিয়েছিল। তাই ভেবেছি হেঁটে হাতিরঝিল এসে বাসে উঠবো৷ কিন্তু আসার পথে এমন কিছু আমার সাথে যে হবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি। এই নাদিয়ার সাথে আমার পরিচয় সেই ভার্সিটি লাইফে। আমি যখন এমবিএ তে পড়ি তখন ও ফাস্ট ইয়ারে ছিল। ওর প্রথম সেমিস্টারে পড়া অবস্থায় আমার কাছে অনেকেই পড়তে আসতো। ও এসেছিল। আর তারপর সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়। আর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তারপর ভালবাসা। চার বছরের সম্পর্ক আমাদের। কিন্তু আজ তা সব শেষ। অনেক আগেই ওর উপর আমার সন্দেহ হয়েছিল। আজ থেকে এক বছর আগে একদিন ওকে এই ছেলেটের সাথেই একসাথে হাঁটতে দেখেছিলাম। ও বলেছিল ওর ক্লাস মেইট। বই আনতে গিয়েছিল। আমি ওকে অন্ধের মতো ভালবাসতাম। জীবনের প্রথম ভালবাসা বলে কথা। তাই বিষয়টা নিয়ে আর মাখামাখি করি নি। কিন্তু কে ভেবেছিল ভিতরে ভিতরে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে। আমাদের চার বছরের সম্পর্কে ওর হাতটা ছাড়া আমি আর কোথাও ওকে স্পর্শ করি নি। বরং কখনো খারাপ নজরেও দেখি নি। কিন্তু আমার নাদিয়া যে এরকম আমি তা কল্পনাও করিনি। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। মন চাচ্ছে চিৎকার করে কান্না করি৷ যে মানুষটাকে আপনি আপনার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সারাজীবন এর জন্য৷ সে এখন অন্যের বুকে শান্তি খুঁজছে। চোখ দিয়ে কখন যেন টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে জীবন থেকে সবকিছু নিমিষেই হারিয়ে গিয়েছে। ঠিক করলাম পুরোটা পথ আজ হেঁটেই যাবো। যেতে যেতে চোখের পানি গুলো হয়তো ফুরিয়ে যাবে৷ কেউ আর বুঝতে পারবে না আমার কষ্ট গুলো। কিছু দূর হেঁটে আসতেই আকাশে কঠিন মেঘের গর্জন। সাথে বিদ্যুৎ ঝলকানি। আর বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। একটু পরই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে৷ বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটা গুলো গাল বেয়ে চোখের পানির সাথে মিশে মিশে পড়ছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ব্যাগে রেখে দিলাম। দামী একটা ফোন৷ ভিজে গেলে অনেক ক্ষতি। ব্যাগটা ওয়াটারপ্রুফ তাই সহজে কিছু ভিজবে না। তবে আমি আজ অনেক ভিজতে চাই। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে অঝোরে কাঁদতে চাই। হাঁটতে হাঁটতে হাতিঝিল ব্রিজের উপর এসে বসে পড়ি। গাড়ি তেমন একটা নেই। দু একটা মাঝে মাঝে সো করে চলে যাচ্ছে। আমি ঝুম বৃষ্টিতে আইল্যান্ডের উপর বসে জোরে জোরে কাঁদছি। কেউ বুঝতে পারছে না। কিভাবে বুঝবে, বৃষ্টির শব্দে সবাই বধির। পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। নাদিয়ার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের কথা এখন মনে হচ্ছে। তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে, যে ও এখন চরম সুখে আনন্দ করছে অন্য একটা ছেলের সাথে। এটা ভেবে কান্নায় মাথাটা বুঝে ফেলি দু’হাতের মাঝে। সব শেষ। কোন ভাবেই মানতে পারছি না৷ অনেকে ভাবে ছেলেরা নাকি ভালবাসতে জানে না৷ আরে কেউ একবার যদি বুঝতো, ছেলেরা যাকে একবার সত্যিকারের ভালবাসে তাকে সারাজীবনই ভালবেসে যায়৷ যদি তাকে হারিয়েও ফেলে, তার শূন্যতা তাকে সবসময় কষ্ট দেয়৷ হয়তো কখনো কেউ সেটা বুঝার চেষ্টাই করে নি। আমি এসব ভেবে কাঁদছিলাম। কিন্তু হঠাৎই অনুভব করলাম কে যেন আমার পাশে এসে বসেছে। আর মাথার উপর ছাতাও ধরেছে। যার জন্য বৃষ্টি অতটা গায়ে লাগছে না৷ আমি মাথা তুলে তাকাতেই অবাক। একটা মেয়ে আমার পাশে ছাতা হাতে বসে আমার দিকে চিন্তিত নয়নে তাকিয়ে আছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করে,

~ আপনি তো কান্না করছেন! কিন্তু কেন? কি হয়েছে আপনার?

আমি মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলি। কিছু বলার মতো আমার কাছে নেই। কি বলবো আমি? মেয়েটা আবার জোর দিয়ে প্রশ্ন করে,

~ আমার জীবনে কখনো আমি কোন ছেলেকে সরাসরি কাঁদতে দেখিনি। ভেবেছি তারা খুব পাষাণ প্রকৃতির হয়। কিন্তু আজ আপনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে খুব জানতে ইচ্ছা করছে আপনি কেন কাঁদছেন? প্লিজ বলুন।

আমি আবার মেয়েটার দিকে তাকাই। ওর চোখগুলো খুব আশা নিয়ে বসে আছে। এরকম একটা অপরিচিত ছেলের সাথে কথা বলতে কি মেয়েটার বাঁধছে না? কেন সেধে সেধে কথা বলছে ও? আমি কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বললাম,

– আমি কাঁদছি না। বৃষ্টিতে ভিজছি। আপনি আমার জন্য সময় নষ্ট করবেন না৷ চলে যান।
~ আমি এতটা বোকা না যে কোনটা বৃষ্টির পানি আর কোনটা চোখের জল আলাদা করতে পারবো না। আপনি বৃষ্টির মাঝে কাঁদছিলেন।
– একটা অপরিচিত ছেলেকে একবার দেখেই তার চোখের পানি ধরে ফেললেন?
~ মন থেকে কাউকে দেখলে তার সব কিছুই ভালো ভাবে বুঝা যায়। যেমন আপনি এখন অনেক কষ্টে আছেন। সেটা আপনাকে দেখেই বেশ বুঝা যাচ্ছে। প্লিজ বলুন না কি হয়েছে আপনার?

কেন জানি আমিও চাচ্ছিলাম কেউ একজন আমার কষ্টগুলো শুনুক। তাই আমি এই অপরিচিতাকে সব বলে দিলাম। কখন যে আধা ঘণ্টা চলে গেল টের পাইনি। এখন বৃষ্টিও প্রায় থেমে এসেছে। আমি শেষ কথাটা তাকে বলি,

– মাফ করবেন কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে৷ আমি আর কোন মেয়েকে বিশ্বাস করিনা। মেয়েরা খুব খারাপ। ছেলেদের মন না জীবন নিয়ে খেলে।
~ শুনুন, আমি বলবো না আপনি ভুল। তবে হ্যাঁ, আপনি পুরোপুরি সঠিক না৷ হাতের পাঁচ আঙুল যেমন একই রকম না, ঠিক প্রতিটি মেয়ে ছেলে কিন্তু এক না৷ একজন দুজন খারাপ বলে সবাইকে খারাপ বলা ঠিক না৷ ছেলেরা যেমন মেয়েদের মন ভাঙে তেমনি কিছু কিছু মেয়েও এরকম করে। উভয়পক্ষই দোষী। তবে এটুকু বিশ্বাস রাখেন, ভালোদের সাথে সবসময় ভালো হয়। হয়তো কোন ভালো মেয়ে আপনার হাতটা এসে শক্ত করে ধরবে সারাজীবনের জন্য৷ সে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। একজনের জন্য নিজের বাকি জীবনটা নষ্ট করবেন না। আমি ত একজন মেয়ে। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি প্লিজ উলটা পালটা কিছু করবেন না৷
– সেটা আমি কখনো পারবোও না৷ আমার বাবা মা আছেন। তারা আমার উপর নির্ভরশীল। আমি না থাকলে তারাও মরে যাবে৷ তবে হ্যাঁ আপনি বললেন না আমার হাত এসে আরেকজন ধরবে৷ সে সুযোগ আমি আর কাউকে দিব না৷ আমি সারাজীবন একাই থাকবো। লাগবে না কোন নারীকে আমার।

মেয়েটা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

~ আচ্ছা আসি আমি। বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে।
– জি।.. দাঁড়ান রিকশা করে দিচ্ছি।

মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি একটা খালি রিকশা দেখলে তাকে উঠিয়ে দি। সে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে যায়। সাথে আমাকে অনেকটা হালকা করে দিয়ে যায়। জানি না কিন্তু কেন জানি বুকটা অনেক হালকা লাগছে। হয়তো মেয়েটাকে নিজের কষ্ট আর মনের ক্ষোভগুলো বলেছি তাই। মনটা হালকা হলেও নাদিয়ার শূন্যতা আমাকে তাড়া করছে। তাই আর বেশিক্ষণ ওখানে থাকি না। একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা হই। এখন একটুও বৃষ্টি নেই৷ তবে বৃষ্টির ঘ্রাণটা আছে। সাথে বৃষ্টি ভেজা রাত। আর একরাশ বিষন্নতা। সময়টা এখন খুব উপভোগ করার মতো হলেও আমার ভাঙা মনখানা তা চায় না৷ এত কষ্ট কখনো আগে পাই নি৷

বাসায় আসলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে যাই। আমাকে এরকম কাক ভেজা দেখে মা খুব বকাঝকা করে। আমি চুপচাপ সব শুনি। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বকা বন্ধ করে বলেন,

~ নীল কি হয়েছে বাবা? তোর মুখটা এমন হয়ে আছে কেন? কিছু হয়েছে?

আমি মোটেই চাই না মা এসব শুনে কষ্ট পাক৷ তাই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ঠোঁটের কোণায় হাসি এনে বলি,

– না না মা কিছু হয় নি। বৃষ্টিতে ভিজেছি তো তাই এরকম লাগছে।
~ আচ্ছা যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আস। আমি খাবার দিচ্ছি।
– না মা আজ একদম ক্ষুধা নেই। আমি ঘুমিয়ে পড়বো।
~ তুই কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস? সত্যি করে বল তো বাবা?
– না না মা কিছু লুকাচ্ছি না৷ আমি যাই।

বলেই দ্রুত ওয়াশরুমে চলে আসলাম। কারণ খুব কান্না পাচ্ছিল মায়ের দিকে তাকিয়ে।

এদিকে,

মা তার নিজের রুমে বেশ চিন্তিত হয়ে ঢুকলেন। বাবা তাকে দেখে বলেন,

– কি হয়েছে? কি নিয়ে এত ভাবছো? নীল কিছু বলেছে?

মা বাবার পাশে গিয়ে বসে বলেন,

~ ছেলেটা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মুখে হাসি নেই। মুখখানা কেমন মলিন হয়ে আছে। তার উপর আজ ভিজে এসেছে। কিছুই বুঝতে পারছি না৷
– শোনো আমি বলি কি…

এরপর মা বাবা অনেকক্ষণ কথা বললেন৷ এদিকে আমি বাইরে এসে হাত মুখ মুছে ব্যাগটা শুকাতে দিয়ে রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়ি। আকাশে আবার মেঘের গর্জন। হয়তো আবার বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির কথা ভাবতেই সেই অপরিচিতা মেয়েটার কথা মনে পড়ে৷ আজ মেয়েটাকে মনের কথাগুলো না বলতে পারলে হয়তো আমি বাসায়ই আসতে পারতাম না৷ জানি না মেয়েটার সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা৷ না হলেই ভালো। মেয়েদের আর ভালো লাগে না। সব মেয়েই এক। খুব কষ্ট নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন সকালে,

আজ শুক্রবার। তার উপর ঠান্ডা আবহাওয়া। বেঘোরে ঘুমাচ্ছি আমি। একমাত্র এই একটা দিনই আমার ছুটি। তাই অনেকক্ষণ ঘুমানো যাবে। মাও ডাকবে না৷ কিন্তু আজ হলো উল্টো। হঠাৎ ঘুমের মাঝে শুনতে পাই মা ডাকছে৷

~ নীল এই নীল উঠ। আর কত ঘুমাবি?

আমি চোখ না খুলেই বললাম,

– মা আজ তো শুক্রবার। কেন ডাকছো?
~ কারণ আজকে এক জায়গায় যেতে হবে।
– কোথায়?
~ তোর জন্য তোর বাবা একটা মেয়ে ঠিক করেছে তাকে দেখতে যাবো। উঠ তাড়াতাড়ি। আমি গেলাম।

আমি একলাফে উঠে বসি। নিজের কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না৷ এটা কি বলল মা! আমি তো বিয়ে করবো না৷ কখনো না৷ আমি মেয়েদের ঘৃণা করি। মাকে দ্রুত না বলার জন্য উঠতে নিলেই দেখি বাবা রুমে এসেছেন। আমি তাকে দেখে পুরো অবাক। তিনি সচারাচর আমার রুমে আসে না। তাহলে আজ কেন? তিনি আমাকে দেখে বললেন…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here