বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)পর্ব ২

0
250

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ২

বিরাট মন খারাপের এক পাহাড় নিয়ে পত্র তৈরী হয়ে নিলো স্কুল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তার স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর চা বাগানের এমন মুমূর্ষু অবস্থা সে মানতে পারছে না। গত এক মাসেই যেন রূপ বদলে গেছে এই চা বাগানের। হাসি খুশি কিশোরীর ন্যায় চা বাগানে আজকাল নিরেট নিশ্চুপতা। পত্র ছোটো একটা শ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পত্রের মা ছায়া তখন উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। ঠাকুর বাড়ির জেঠিমার অবস্থা সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে রীতিমতো। পত্র বেরিয়ে আসতেই ছায়ার মুখোমুখি হলো। মেয়েকে দেখেই ছায়া কেমন তেড়ে তেড়ে এলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,
“আজকাল তো দেখছি এখানের কুটো ওখানে রাখিস না। ব্যাপার কী তোর? তোর পিসি মারা যাওয়ার সময় কী তোরে বলে গিয়েছিল কাজ না করতে?”

পত্র জবাব দিলো না। মায়ের কথা একবারেই অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছিলো দরজার দিকে। তার মাঝেই ছায়া কণ্ঠ আরেকটু উঁচিয়ে বললো,
“পিসির মতন ঘাড়ের বোঝা হবি নাকি?”

পত্র থেমে গেলো। মুখ ফিরিয়ে তাকালো তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তার বড়দির দিকে। মেয়েটার মুখ-চোখও শুকিয়ে আছে। সেখানে একবার দৃষ্টি দিয়ে অতঃপর ধীর কণ্ঠে বললো,
“ঘাড়ের বোঝা-ই যেহেতু ভাবো তবে জন্ম দিয়ে ছিলে কেন?”

ছায়া রেগে গেলেন। তেড়ে এলেন পত্রের দিকে। পত্রের গাল দুটো চেপে ধরে হিংস্র কণ্ঠে বললেন,
“বড়ো কথা ফুটেছে যে! গাল টেনে ছিঁড়ে দিবো।”

“আমার পিসিকে যে একটা খারাপ কথা বলবে, আমিও তাকে কিছু বলার সময় একবার ভাববো না।”

বেশ তেজের সাথে কথাটা বলেই মায়ের হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয় নিজের গাল থেকে পত্র। তারপর গটগট করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

চা বাগানের পূর্ব দিকের সরু পথটা দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটার পর থেমে যায় পত্র। পরিচিত জিপ গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে বড় জারুল গাছের সাথে। পরিচিত সেই সুদর্শন পুরুষ ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে পত্রের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য পত্র ভুলেই গিয়েছিল আজ তার সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। নিজের ভুলো মনকে তার জন্য কতক্ষণ ইচ্ছে মতন বকাঝকা করলো সে। কীভাবে ভুলে গেলো এত বিশেষ কথাটা!

জিপ গাড়ি থেকে নেমে এলো আতস। মায়া মায়া মুখে আকর্ষণীয় এক হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো পত্রের দিকে। পত্রও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে। দু’জনে মুখোমুখি এসে দাঁড়াতেই আলতো হাতে পত্রের গাল ছুঁয়ে দিলো আতস। মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
“তোমার মাঝে তাকালে এতো শান্তি শান্তি লাগে কেন বলো তো পত্রলেখা?”

পত্র লজ্জায় মিইয়ে এলো। ঘাড় কাঁত করে লজ্জায় রাঙা হয়ে থাকা চোখ-মুখ সে নিবদ্ধ করলো মাটিতে। আহ্লাদী কণ্ঠে বললো,
“জানিনা।”

আতস পত্রের এমন লজ্জা রাঙা মুখ দেখে হো হো করে হেসে উঠলো। আদুরে হাতে গাল টেনে দিয়ে বললো,
“অনেক হয়েছে লজ্জা পাওয়া, এবার চলো।”

পত্রও মাথা দুলিয়ে উঠে গেলো জিপ গাড়িটায়। সশব্দে গাড়ি চলতে শুরু করলো আপন গতিতে। সাথে পত্রলেখার মনে হরেক রকমের অনুভূতি। কিছুটা সংশয়,অস্বস্তি এবং ভয়ও মাখো মাখো হয়ে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি। আতস গাড়ি চালাতে চালাতে গুনগুনিয়ে উঠলো কিছু পরিচিত-অপরিচিত গানের সুর। পত্র মনযোগ দিয়ে শুনলো সেই সুর। ভীষণ মোহনীতায় আবিষ্ট সেই কণ্ঠ। মানুষটা সর্বগুণে গুণান্বিত। এমন একটা মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে পারাটাও যে গৌরবের। বেশ অনেকটা সময় নিরব থাকার পর পত্র কথা শুরু করলো। উৎসুক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা, আপনার সাথে আপনার বন্ধুরা কোথায়!”

“ওরা তো কিছু কাজে তোমাদের সদরে গিয়েছে। চা বাগানটাকে নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে তো তাই।”

“আপনি যান নি যে!”

“এতদিন তো সেখানেই ছিলাম কিন্তু হুট করে শুনলাম নভ নাকি বাড়ি ফিরে গিয়েছে তাই আমাকে এখানে আসতে হলো। এখানের টুকটাক তথ্য আমি পাঠাই সদরে। একজনের তো থাকা উচিৎ।”

“আপনার ঐ বন্ধুটাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়।”

“পছন্দ না হওয়ারই কথা। ওর কথার ভাব ভঙ্গি ভালো না।”

নিজের বন্ধুদের দোষটা সাবলীল ভাবে আতসকে স্বীকার করতে দেখে ভালো লাগলো পত্রলেখার। সে মুচকি হেসে বললো,
“আপনার কথার ভাব ভঙ্গি তো ভালো। আপনার সাথে থেকেও সে ভালো হতে পারলো না কেন?”

পত্রের বাক্যে যে রসিকতার উপস্থিতি তা বুঝতে বাকি রইলো না আতসের। কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঠিক ঠাট্টা করে ফেললো মেয়েটা! আতস প্রশংসা করে বললো,
“বাহ্, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী!”

পত্র জবাব দিলো না। লজ্জায় আরেকটু নুইয়ে গেলো সে। কী যেন একটা আকর্ষণ জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কেমন যেন মুগ্ধতা ভরপুর চারপাশে।

_

ছায়ার শরীরটা হুট করেই অসুস্থ বোধ হচ্ছে তাই দুপুরের খাবার খেয়েই শুয়ে পড়লো বিছানায়। পদ্ম গিয়েছে কোথাও একটা, বলে যায় নি যদিও। বাকি রইলো পুষ্প। সে স্কুলও যায় নি আর না গেছে পাড়া বেড়াতে তাই আজকে দুপুরের এঁটো থালাবাসন ধোয়ার কাজটা তার ঘাড়ে এসেই পড়েছে। তাই না চাইতেও সে অলস ভঙ্গিতে থালাবাসন নিয়ে পুকুর পাড়ে গেলো।

দুপুর আড়াইটা কিংবা বড়োজোর তিনটে বাজে। সূর্যের তেমন তেজ নেই। আষাঢ়ে মেঘে আঁধার হয়ে আছে চারপাশ। পুষ্প পুকুরের শেষ সিঁড়িটাতে বসে একমনে থালাবাসন ধুতে ব্যস্ত। তখনই পুকুরের পাশের ঝোঁপ থেকে শুকনো পাতা পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার মতন শব্দ হলো। হঠাৎ করেই পরিবেশটা কেমন গা ছমছমে ঠেকলো পুষ্পের কাছে। হুট করেই মনে পড়ে গেলো চা বাগানে প্রচলিত কলরবের কথা। কোনোরকমে থালাবাসন গুলো ধুয়ে উঠে দাঁড়ালো পুষ্প। শ্বাস বন্ধ করে মুহূর্তেই সিঁড়ি গুলো পিছে ফেলে উপরে এসে দাঁড়ালো। এতটুকু সময়েই হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। কেমন যেন ভয় ভয় জেঁকে ধরেছে তাকে। মনে হচ্ছে চারপাশে কারো নিরব উপস্থিতি। পুষ্প বাড়ির পথে যাওয়া সরু রাস্তাটাতে পা বাড়ানোর আগেই জঙ্গলটা থেকে ফিসফিস শব্দ শোনা গেলো। পুষ্প পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালো না। বরাবরই তার কৌতূহল সবচেয়ে বেশি। সেই কৌতূহল মেটানোর জন্যই পুষ্প একটু একটু করে এগিয়ে গেলো জঙ্গলের দিকে। তার পায়ের গতি ধীর। আকাশে তখন গুড়ুম গুড়ুম ডাক ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশে কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব মনে হচ্ছে। মুহূর্তেই আকাশ রূপ বদল করে ফেললো যেন।

পুষ্প আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো, বটগাছটার ঠিক সামনে দাঁড়ালো। আশেপাশে দু একবার ভীত, কৌতূহলি দৃষ্টি দিয়ে পরোখ করে নিলো। কিছুই তেমন সন্দেহজনক পেলো না তবে পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো চারদিকে। মনে হচ্ছে কে যেন ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একে তো প্রকৃতিতে আলো ঝিমিয়ে এসেছে তার উপর বড়ো বড়ো কাছের ছায়ার জন্য জঙ্গলটাকে কেমন আঁধারে আচ্ছাদিত মনে হচ্ছে। পুষ্প এগিয়ে গেলো গাছের বরাবর। বহু পুরানো গাছটাকে শক্ত, সামর্থ্যবান এক দা ন ব মনে হচ্ছিলো। পুষ্প আশপাশ তাকালো, কেউ নেই সেখানে। তবে কী সে ভুল দেখেছে! নিজের মনেই সংশয়ের উপস্থিতি টের পেলো ৷ মনে মনে ভাবলো সে হয়তো খারাপ কিছু ভেবেছিল যার জন্য শুধু শুধু মন ভীত হয়েছে। আশেপাশে কিছু না পেয়ে যেই না সে ঘুরে দু’কদম এগিয়ে গেলো কিছু একটা অস্পষ্ট চোখে পড়তেই সে ভ্রু যুগল কুঁচকে থেমে গেলো। তার মনে হলো বটগাছটার সাথে হেলান দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আবার ভীত ভীত দৃষ্টিতে পেছনে তাকালো। সত্যিই সেখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে অথচ প্রকৃতির আঁধারময় রূপটার জন্য ঠিক ঠাহর করতে পাচ্ছিলো না মানুষটা কে। পুষ্প এক’পা আগালো, অস্ফুটস্বরে শুধালো,
“কে ওখানে?”

পুষ্পের কথায় সামনের মানবটার কোনো ভাবান্তর দেখা দিলো না, সে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। পুষ্প আরেক পা এগুলো, আবার ঠোঁট নাড়ালো প্রশ্ন করার জন্য কিন্তু তার আগেই তুমুল শব্দে চারপাশে ব/জ্র/পা/ত হলো, এবং আলোকিত হলো ভুবন। সে আলোতে পুষ্পের সামনে ভেসে উঠলো এক ভ°য়ঙ্কর পুরুষ অবয়ব। পুষ্প মুহূর্তেই গগন ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার কণ্ঠধ্বনি থেকে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ,
“অভ্রদা!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here