বিষাদময়_প্রহর পর্ব ১১

0
838

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১১ ||

—“এই তুই আলমিরার উপরে কি ঘাটাঘাটি করছিস?”
.
প্রহরের চিঠিগুলা আমি সব আলমারির উপরেই রাখতাম।
রুমে ঢুকে আলমিরার দিকে চোখ যেতেই দেখলাম একটা কাগজ আলমারির একপাশে ঝুলে আছে।
তা দেখে জলদি রুমে থাকা চেয়ারটা আলমারির সামনে রেখে সেটায় উঠে আলমারির উপরে তাকালাম।
যা ভেবেছিলাম তাই হলো!
বজ্জাত ইনুটা কীভাবে এই আলমারির উপর উঠে সব চিঠির ১২টা বাজাইসে!
ইনুটায় এই কাগজের সন্ধান পায় কোথা থেকে বুঝি না।
যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে মন চাচ্ছে ইনুকে ইচ্ছেমতো বকা দিয়ে দেই।
এই বিড়ালটা আর শুধরালো না।
কাজ করার বদলে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এইসব গোছগাছ করছিলাম আচমকা নিহান ভাইয়ের কন্ঠ শুনতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলাম।
আমার ধড়ফড়িয়ে উঠার জন্যে আরেকটু হলেই চেয়ার নিয়ে পরতাম, নিহান ভাইয়ার জন্য একটুর জন্য বেঁচে গেলাম।
ভয়ে আমার শ্বাস বেড়ে গেছে।
এভাবে কেউ হুট করে কথা বলে?
নিহান ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

—“চোরের মতোন আলমারির উপরে কি দেখছিলি যে ধরা পরার মতো বিহেভ করছিস!”

আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে নিহান ভাইয়াকে ছেড়ে চেয়ার থেকে নেমে গেলাম।
তারপর আমতা আমতা করে বললাম,

—“ইয়ে মানে… ইনুকে খুঁজছিলাম?”

—“তোর ওই ফাজিল বিড়াল আলমারির উপর কি উড়তে উড়তে উঠবে?” রাগি সুরেই কথাটা বললো।

—“দেখেন একদম আজেবাজে বলবেন না। আমার বিড়ালের নাম ইনু ওকে? ডোন্ট কল ফাজিল বিড়াল।”

—“১০০ বার বলবো তোর কী?”

—“ইনুকে নিয়ে আপনার সমস্যা কি বলুন তো? কেন সহ্য করতে পারেন না ওকে?”

—“বিকজ ফাজিল বিড়ালটা তার মালিকের মতোই চরম ফাজিল আর বেয়াদব! এর লোম আমার সহ্য হয় না! গা কেমন ঘিনঘিন করে!”

—“কি বললেন আমি ফাজিল আর বেয়াদব? আপনি নিজে কি? অন্যকে দোষ দেয়ার আগে নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখে নিবেন। আর বিড়াল অতি পবিত্র প্রাণী। এরা নোংরা কিছু পছন্দ করে না। জানেন বিজ্ঞানীরা কি বলে? বলে, “বিড়াল যেখানে ঘুমায় সেই জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাই মানুষ যেন নির্দ্বিধায় সেই স্থানে….”

—“হয়েছে। তোর আজাইরা প্যাঁচাল শোনার জন্য আমি বসে নেই। যেই কথা বলতে আসলাম, বিকালে তৈরি হয়ে থাকবি, ৫-৬টায় নিবিড় এসে তোকে আর জিনিয়াকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। আমাদের বাসা থেকে একেবারে ডিনার সেরে রাত ১০টায় রওনা হবো।”

—“এটা তো আমাকে ফোনেই বলা যেত এখানে এসে বলার কি দরকার? ওহ সরি আপনি তো আবার আমাকে ব্লক করেছেন!”

—“মানেহ! আমি তোকে কোন সুখে ব্লক দিতে যাবো?”

—“ওমা তাই? নিজের ফোন চেক করবেন আর দেখে নিয়েন আদৌ ব্লক করেছেন কি করেন নি। এখন আপনি আসতে পারেন।”

—“তোর কথায় চলবো না আমি।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
যাওয়ার আগে নিহান পিছে ফিরে বলে উঠলো,

—“ভুলেও তোর ওই সাদা বিড়ালটাকে আনবি না। আনলে গাড়ির জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো এরে।” বলেই নিহান ভাই আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চলে গেলো।
আমি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে নিহান ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখছি।
আমি আর না দাঁড়িয়ে আবার চেয়ারের উপরে উঠে আলমারির উপরের কাগজগুলা পরিষ্কার করতে লাগলাম।
পরিষ্কার করে সবে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসেছি এমন সময় ফোনের রিং বেজে উঠলো।
তোয়ালে হাত মুছে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম নিহান ভাইয়ের কল।
আমি রিসিভ করে হ্যালো বললাম।

—“তুই বলেছিলি না আমি তোরে ব্লক দিয়েছি? বিকেলে আয় তুই বাসায় তারপর তোরে মজা দেখাচ্ছি।”

বলেই ফোন কেটে দিলো।
এবারও আমি বোকা বনে গেলাম।
আমি ওনাকে এতদিন ফোনে পাইনাই তাই ভাবতেই পারি উনি আমাকে ব্লক দিসেন। এখন তাকে এই কথা বলাতে যে হিতে-বিপরীত হলো।
ধুর এই হিটলারটাকে কিছু বলাই বেকার।
সারাজীবন ৪পা এগিয়ে থাকে আমার খুঁত ধরার জন্য।
এসব ভেবে ভেবেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আর ভাবতে লাগলাম ইনুকে নিয়ে যাবো নাকি যাবো না।
আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে ৬-৭ দিন হলো।
এক-দেড় মাসের বন্ধ আছে, যেহেতু সামনে ইদ তাই একেবারে ইদের পরেই ভার্সিটি যাবো।
নিহান ভাইয়ার ইলেকশনও শেষ। এবার সে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আরও বড় পদ পেয়েছে।
এতে মায়ের গর্বের শেষ নেই।
আর এখন যেহেতু প্রায় সব ঝামেলা শেষ তাই সেই কথা অনুযায়ী দুই পরিবার আর হিদদের আরও কিছু কাজিন মিলে কক্সবাজারে ঘুরতে যাবো।
কিন্তু আমার মা যাবে না।
মা নানুরবাড়িতে যাবে, নানু নাকি অসুস্থ।
নানু অসুস্থ শুনে মাকে আর জোর করিনি, তাই আমি আর জিনিয়াই যাবো।
তবে ইনুকেও নিতে হবে, কোনোভাবেই ওকে একা ফেলে আমি এই ৫দিনের ট্যুরে যাবো না।
আর ইনু তো বাসাতেই এমন জ্বালায়, বাইরে তো আর নয়।
আমার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই জিনিয়া মনের আনন্দে ঘরে ঢুকে প্যাকিং করতে লাগলো।
আমি গতকাল রাতেই প্যাকিং করে ফেলেছি তাই আপাতত এই ঝামেলা নেই।
জিনিয়া লাগেজে জামাকাপড় ভরছে আর গুনগুন করে গান গেয়ে চলেছে।

—“ট্যুরের কথায় এতো খুশি?”

—“তো খুশি হবো না? কতোগুলো দিন পর এই যানবাহন ছেড়ে সমুদ্রের স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়া পাবো।আর এমনিতেও কক্সবাজারে আমার অনেক যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। জানিস আপু কতো এক্সাইটেড আমি এই ট্যুর নিয়ে উফফফ। কতো জায়গায় ঘুরবো মজা করবো সেইরকম লাগবে।”
বলে জিনিয়া আবারও নিজের প্যাকিং করতে মনীযোগ দেয়।

ফয়সাল স্টাচুর মতো শুয়ে আছে।
সে নড়াচড়া করতে পারছে না, কথাও বলতে বলতে পারছে না।
শুধু তার চোখদুটো নড়ছে। তার পুরো শরীর অবশ হয়ে আছে।
বলা যায় সে একপ্রকার প্যারালাইজড হয়ে আছে।
ফয়সালের সেই রুমটায় কিছুটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কালো লম্বা হুডি পরা লোকটি।
লোকটির চেহারা বোঝা যাচ্ছে না কারণ তার হুডিটা নাক পর্যন্ত টেনে দেয়া।
আর মুখেও কালো মাস্ক।
তার দুইহাতে গ্লাভস পরা আর আরেক হাতে একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ।
সে আর কেউ নয় বিষাদময় প্রহর।
প্রহর অট্টহাসিতে ফেটে পরলো ফয়সালের এই অবস্থা দেখে।
ফয়সালের এই অবস্থা দেখে মনের মাঝে এক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে।
হাসতে হাসতেই বললো,
—“আহারে কি কষ্ট তোমার পুঁচকে! জানিস পুঁচকে তোর জন্য আমার বড্ড মায়া হচ্ছে। কিন্তু কি করার আছে বল? হাঁটুর সমান এক ছেলে হয়ে তুই আমার জানের গায়ে হাত দিয়েছিস, তার সাথে অসভ্যতামি করেছিস, বাজে কথা বলেছিস এমনকি ওকে বেড পার্টনারও বানাতে চাইছিলি। কিন্তু দেখ তোর অবস্থা! আমার জানপাখিকে বেড পার্টনার বানাতে গিয়ে নিজেই প্যারালাইজড হয়ে বিছানার সাথে লেগে গেলি! ইশশ! বেচারা!
কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”

ফয়সাল কিছু বলতে পারলো না।
সে শুধু বিচলিত দৃষ্টিতে চুপচাপ তাকিয়ে আছে।
তার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
প্রহর তা বুঝতে পারে।
প্রহর হেসে দিয়ে বলে,
—“জেলে ছিলি নাফিহার দয়ায় ছাড়া পেয়েছিলি, কিন্তু তুই কি শোধরানোর মানুষ? তুই আবারও নাফিহার ক্ষতি করতে উঠে-পরে লেগেছিলি তাও ভয়ংকরভাবে। কিন্তু তুই তো জানিস না ওর জন্য ওর এই বিষাদময় প্রহর আছে। তু তু তু।(ঠোঁট দিয়ে আওয়াজ করে) এবার আর বাঁচতে পারলি না।”
বলে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পরলো প্রহর।
প্রহরের হাসির ধ্বনিতে ফয়সালের সারা শরীর কম্পন দিয়ে যাচ্ছে।
সে বুঝতে পারছে না কি করে সে এই প্রহরের কবলে পরলো, সে তো তার নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো।
—“খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তোদের বাসা থেকে কি করে তোকে এখানে নিয়ে এলাম? তাহলে শোন, তোর বাড়িরই একজন আমাকে সাহায্য করে আর সে হলো….”
প্রহর কিছু বলতে নিতেই দরজা খট করে খুলে গেলো।

বিকালের দিকে আমরা নিহান ভাইদের বাড়িতে পৌঁছিয়েছি।
এসে তো আমি অবাক!
কারণ, হিদদের অনেক কাজিনরা এসেছে।
হিদ আমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
দুইজন টুকটাক কথা বললাম কিন্তু এই কয়েক মিনিটে একবারও নিহান ভাইকে আশেপাশে দেখলাম না, হয়তো বাড়িতে নেই।
যাক বাঁচলাম, এইবারের মতো তার গপ্প পরিনি।
কিন্তু কথায় আছে না “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।” আমার কপালও তাই।
হিদের সাথে আমরা বাগানের পেছনের দিকে যেতেই দেখি নিহান ভাইয়াসহ তার আরও কাজিনরা নরম ঘাসের উপরে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
নিহান ভাইয়ার পোশাকে আমি অবাক হলাম।
কারণ ভাইয়া হাটু অব্দি একটা প্যান্ট আর ফতুয়া পরে আছে।
ফতুয়া পাতলা হওয়ায় ওনার বডির গঠনযতা আবছা বোঝা যাচ্ছে।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম নিহান ভাইয়ার দিকে। সে আমার দিকে তাকাতেই আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলি।
হিদ আমাদের নিয়ে ওদিকে চলে যায়।
ইনু জিনিয়ার কাছে রয়েছে।
আমি, জিনিয়া আর হিদও বসে পরি।
সকলে গোল হয়ে বসায় আমি একদম নিহান ভাইয়ের সামনাসামনি।
সে এখনো ইনুকে খেয়াল করেনি।
আল্লাহ জানে ইনুকে দেখলে তার রিয়েকশন কেমন হবে।
হিদ সকলের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো।
একটা বিষয় বুঝতে পারলাম ওদের কাজিনের অভাব নাই।
কম করে হলেও প্রায় ১০ জনের মতো ওদের কাজিন।
আগে তো এতো কাজিন দেখলাম না হুট করে এতো কাজিন কই থেকে ডাউনলোড হলো?
এখানে সবার সিনিয়র একমাত্র নিহান ভাই আর আরেকটা ভাইয়া।
আর সব থেকে জুনিয়র হচ্ছে সেভেনে পড়া পুচকি “মারিয়া।”
মারিয়াকে আমার অনেক ভালো লেগেছে, কি কিউট!
আমি এবং জিনিয়াও পরিচিত হলাম ওদের সাথে।
এতোগুলো কাজিন থাকায় নিহান ভাই এমন ভাব ধরছে যেন আমাকে চিনেই না।
হুহ ন্যাকা!
নিহান ভাইয়া কি সুন্দর বোনদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, এখন এই ছেলেটাকে দেখে কেউ বলবে না এই ছেলেটা সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে।
আমি একপলকে তাকিয়ে তার হাসি দেখছি।
জানিনা ওনার হাসিতে কি আছে তবে তার হাসিটা আমার অনেক ভালো লাগে, অনেক।
আমার দেখার মাঝেই ইনু জিনিয়ার কোল থেকে লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকে।
ইনুর এমন চুপ থাকা দেখে ভিষণ হাসি পেলো।
কারণ এতোগুলো মানুষকে দেখে বেচারার অস্বস্তি লাগছে।
যাক এদিক দিয়ে ভালো হলো।

অবশেষে আমরা ডিনার করে রাত ১০ টায় রওনা হলাম।
মোট ২টা হাইস আর ৩টা প্রাইভেট কার নিয়ে কক্সবাজারে যাচ্ছি।
নিহান ভাইয়ের ২-৩ কাজিনের বিয়েও হয়েছে তাই তাদের ফ্যামিলিসহ এতোগুলো মানুষ যেহেতু যাচ্ছে ৫ টা গাড়ি হবেই স্বাভাবিক।
কিন্তু সমস্যা হলো আমি আর হিদ নিহান ভাইয়ার সাথে এক গাড়িতে উঠেছি।
আমি জিনিয়ার সাথে যেতে নিয়েছিলাম কিন্তু নিহান ভাই একপ্রকার জোরে করেই তার গাড়িতে উঠালো।
তাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে হিদ নাকি আনতে বলেছে আমাকে।
যদি হিদ বলে থাকতো তাহলে আমার সাথে ঘেষে বসলো কেন অদ্ভুত!!

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here