বিষাদময় প্রহর পর্ব ০৫

0
1025

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৫ ||

কার্টুনবক্স গুলো ভাঁজ করছি আমি আর নিবিড় ভাইয়া।
নিবিড় ভাইয়া বারবার মাথা চুলকাচ্ছে তা আমি ভালোভাবেই লক্ষ্য করছি।
আমি মুখ টিপে হেসে চলেছি।
একসময় কার্টুন ভাঁজ করতে করতে আমার হাসিএ বেগ বেড়ে গেলো।
মা আর জিনিয়া অন্যরুমে কাজ করছে বিধায় তারা আমার হাসি শুনতে পেলো না।
নিবিড় ভাই আমার মাথায় এক চাপড় মেরে বলে,
—“হাসি থামা, ফাজিল মেয়ে। তোরে কে বলসিলো বারান্দায় যেতে?”

—“ভাগ্যিস গিয়েছিলাম, না গেলে তো তোমার কান ধরে উঠবস করাটা দেখতে পারতাম না।” বলেই আমার কিটকিটিয়ে হেসে দিলাম।

—“যাক ভালো হলো হবু ভাবী তোমাকে সেইরকম টাইট দিয়েছে।” আবারও হেসে বললাম।

—“তুই জানসিস ভালো কথা, জিনিয়া যেন না জানে। এই মেয়ের মুখ পাতলা, একসময় দেখা যাবে রাস্তায় রাস্তায় আমার ইজ্জতহরণ করে বেড়াবে।” মলিন সুরে বলে উঠে নিবিড় ভাই। আমি অনেক কষ্টে হাসি থামালাম নিবিড় ভাইয়ের রিকুয়েষ্টে।
তারপর আর কি, হাসি থামিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলাম।
নিহান ভাইয়া আমাকে সেই সকালে দিয়ে গিয়েছে ফ্লাটে এখন বিকাল।
ফ্লাটটা ৪তলায়।
দুইটা বেডরুম। একটা লিভিংরুম, একটা ডাইনিং রুম, একটা কিচেন, দুইটা বাথরুম। এক রুমের সাথে এটার্স্ট বাথরুম আর দুইরুমেই বেলকনি আছে।
তবে আমার চয়েস করা রুমের বারান্দাটা একটু বেশি বড়।
২রুম হওয়ার কারণে আমি আর জিনিয়া একরুমে থাকবো।
আমাদের ফার্নিচার আগেই এই বাসায় থাকায় পুরো সকাল ফার্নিচারের ধুলোবালি সহ পুরো ফ্লাট ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে মুছামুছি সব করেছি।
দুপুরের খাবার খেয়ে ২০ মিনিটের মতো রেস্ট নিয়ে আবার কাজে গিয়েছিলাম। এখন শেষ বিকেল, কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দিবে।
জিনিয়া আমাদের রুমে কাপড় গুছাচ্ছে আর মাও নিজের ঘরে তার জামা-কাপড় আলমারিতে রাখছে।
আর এদিকে আমি আর নিবিড় ভাইয়া জিনিসপত্র আনার কার্টুনগুলো বটে রাখছি।
সব গুছানো কাজ শেষ হলো রাত ৮টায়।
কাজ শেষে নিবিড় ভাইয়া চলে যায়।
মা অনেকবার তাকে খেয়ে যেতে বলেছিলো কিন্তু ভাইয়া না খেয়েই চলে যায়।
আজ ক্লান্তি ভালোভাবেই আমাকে ঝেঁকে ধরেছে।
কোনোরকমে খাবার খেয়ে রুমে এসে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলাম।
জিনিয়াও কিছুক্ষণ পর এসে আমার পাশে শুয়ে পরলো।
এখন থেকে দুইবোন একই ঘরে থাকবো।
যখনই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবো তখনই জিনিয়ার কথা কানে এলো।

—“আপু আক কি ওই প্রহর কোনো চিঠি পাঠায়নি?”

আমি চোখ না খুলেই ঘুমের ঘোরে জবাব দিলাম,
—“উনি মরে গেলেও মিস করবে বলে মনে হয়না আর আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখন থেকে চিন্তা নেই, ওই প্রহর আমার ঠিকানা জানবে না।”

বলেই ঘুমিয়ে পরলাম।
আর না ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না আমার জন্য।

পরেরদিন ৭ঃ৫০ এ আমার ঘুম ভাঙলো।
কিছুক্ষণ আলসামি করে শুয়ে থাকতেই আমার মাথায় এলো ৮টার টিউশনির কথা।
লাফ দিয়ে দৌড় লাগালাম ওয়াশরুমের দিকে ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে জামা পরে ওড়না কোনোরকমে গলায় পেঁচিয়ে দৌড় লাগালাম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে।
ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে যেতেই মা খাবারের জন্যে ডাকলেও আমি বাইরে থেকে খেয়ে নিবো বলে বেরিয়ে পরলাম। কিন্তু অবাক করার কান্ড হলো দরজার বাইরে সেই একই চিঠি।
চোখদুটো রসোগোল্লার মতো করে চিঠিটার দিকে তাকালাম।
হুট করে টিউশনির কথা মনে আসতেই চিঠিটা হাতে নিয়েই দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম।

বাসার সামনে একটা রিক্সা থাকাতে আমাকে আর হাঁটতে হলো না।
রিক্সাতে উঠে প্রায় ১০ মিনিট পর তাহিরাদের(স্টুডেন্ট) বাসায় পৌঁছালাম।
প্রায় ১৫ মিনিট লেট করে ফেলেছি।
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কলিংবেল চাপলাম।
কয়েক সেকেন্ড পরে তাহিরার মা দরজা খুললেন হাসিমুখে।

আমিও উত্তরে একটা হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
দেরি করার জন্য কেমন যেন অপরাধবোধ লাগছে আমার মাঝে।
লিভিংরুমে বসতেই দেখলাম তাহিরা তার নাইটড্রেস পরে চোখ কচলাতে কচলাতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে।
সে এখনো খেয়াল করেনি আমাকে।
তাহিরার মা ট্রেতে করে নাস্তা আনতে আনতে বলে,

—“ভালো করেছো আজ কিছুটা দেরী করে এসেছো। তাহিরাকে সেই কখন থেকে ডেকে চলেছি, মেয়ে আমার মাত্র উঠলো।”

আমি উত্তরে কি বলবো বুঝলাম না, তবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো।
তাহিরা এবার ক্লাস ৩ তে পড়ে।
তাহিরার মা খুবই ভালো একজন মানুষ, অন্যান্যদের মতো খিটখিটে টাইপ না।
উনি খুব অল্প সময়েই মানুষদের সাথে মিশে যান।

কিছুক্ষণ পর তাহিরা আসলে তাকে পড়াতে শুরু করি।
তাহিরাকে পড়ানো শেষে আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম।
রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছি হঠাৎ দূরে খেয়াল গেলো নিহান ভাইয়ার দিকে।
উনি আমার থেকে অনেকটা দূরে রাস্তার ওপর পাশে রাস্তার গরিব মানুষদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর দান করছে।
ওনার পিছনে ওনার বডিগার্ডসহ আরও অনেককে দেখা যাচ্ছে।
তাকে দূর থেকে অনেকে দেখছে। আবার তার এইসব মুহূর্তকে দূর থেকেই অনেকে ক্যামেরাবন্দী করছে।
নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব ছবি আপলোড করবে আর ওনার মহত্ব নিয়ে প্রশংসায় পা পিছলে পরবে।
হাহ! ঢং দেখলে বাঁচি না ভাই!
ইনি যে কি জিনিস সেটা আমি আর ওনার পরিবার ছাড়া কেউ ভালো জানে না।
ওনার বাবা-মা স্বয়ং ওনার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে না।
এর নানা রেকর্ড আমি জানি হু।
তবে উনি ঘরে-বাইরে সমানভাবে রাগি।
উনি মিনিটে মিনিটে গিরগিটির মতো নিজের রূপ বদলান।
এর মনে কখন কি চলে বোঝা দায়।
আমি বেশি কিছু না ভেবে একটা রিক্সা করে বাসায় চলে আসলাম।
বাসায় এসে আরও খেয়ে নিলাম কারণ, তাহিরার মায়ের দেয়া নাস্তায় আমার পেট পুরোপুরি ভরেনি।
খেয়ে কিছুক্ষণ নিজের রুমে রেস্ট করলাম।
জিনিয়া গেছে তার বান্ধুবীর বাসায় কিছু নোট কালেকাত করতে।
আমি হিদকে কল দিলাম আজকের ক্লাসের সময় জানার জন্য।
এই ভার্সিটিও অদ্ভুত।
এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই ক্লাসের তাই আগে থেকেই জেনে নিলাম।
ক্লাসের সময় জানার সময় এও জানলাম হিদ আমাকে পিক করে নিয়ে যাবে।
এটা নাকি নিহান ভাইয়ের আদেশ।
আমি বুঝি না এই নিহান ভাই নিজের বোনের সাথে আমাকে সবসময় টানবে কেন? কিসের এতো অধিকার তার আশ্চর্য!
না করতে যেয়েও পারলাম না ওই হিটলারের কারণে।
হিদকে দিয়ে আমাকে থ্রেড দেওয়াইসে এই হিটলারে।
এই থ্রেড অনুযায়ী না চললে নিশ্চিত আমার ইজ্জত সব যাবে।
একটা শুকনো ঢোক গিলে টেবিলের সামনে গিয়ে আজকের ক্লাস রুটিন অনুযায়ী বই ব্যাগে ভরতে শুরু করলাম।
ব্যাগ ঘাটতেই ওই প্রহরের আজকের এবং কালকের চিঠিগুলো নজরে পরলো।
চিঠিগুলোর কথা উঠতেই মনে পরে গেলো আজকের চিঠির কথা।
এই প্রহর জানলো কি করে আমার বর্তমান ঠিকানা?
এই প্রহর কি আমাকে চিনে নাকি আমার উপর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে।
মুহূর্তেই মেজাজ চরম লেভেলে খারাপ হয়ে গেলো।
এই অচেনা ছেলেটার সাহস কি করে হয় আমার উপর নজর রাখার।
আচ্ছা এই চিঠিগুলা এবং এই প্রহরের কথা কি নিহান ভাইয়াকে জানাবো?
নিহান ভাইয়া একজন বড় পলিটিশিয়ান, সে নিশ্চয়ই এই প্রহরকে গলির চিপা থেকে হলেও বের করতে পারবে।
ওনাকে কি একবার এর বিষয়ে বলবো?
হঠাৎ মনে পরে গেলো সেই বীভৎস খুনের কথা।
মুহুর্তেই কেঁপে উঠলাম।
আমার জন্য যদি নিহান ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করে ফেলে এই প্রহর?
ধুর আমিই বা কি ভাবছি, এই প্রহর তো নিহান ভাইয়ার ধারে কাছেও যান না।
নিহান ভাইয়া অত্যন্ত মেধাবী এবং শক্তিশালী।
নিহান ভাইয়ার কাছে তো এই প্রহর হাতের মোয়া।
আর আমি কিনা ভাবছি ওই প্রহর দ্বারা নিহান ভাইয়ার ক্ষতি হবে!
আমি আসলেই মাথামোটা।
এখন তাহলে অবশ্যই বলবো নিহান ভাইয়াকে আমিও দেখে ছাড়বো এই প্রহরের খেল কারে কয়।
ভেবেই আনন্দের সাথে বই গুছাতে লাগলাম।
হুট করে মুখটা পেঁচার মতো করে ফেললাম।
এই নিহান ভাইয়া তো এগুলা দেখলে বা শুনলে আমাকে উঠতে বসতে কথা শুনাবে, এই এক টপিক নিয়ে নানানভাবে খোঁচাবে।
সব সহ্য করতে পারি কিন্তু এই নিহান ভাইয়ার কথাবার্তা আমার গায়ে বিষের মতো লাগে।
বুঝলাম নিহান ভাইয়াকে চাইলেও জানাতে পারবো না।
বিপদ আমার সবদিক দিয়েই।

অবশেষে সময়মতো হিদ আমায় পিক করে নিয়ে গেলো ভার্সিটিতে।
ক্লাসে বসে একটা চ্যাপ্টার মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম হুট করে কিছু মেয়ের কথপোকথন কানে ভেসে এলো,

—“উফফফ দেখেছিস ফেসবুকে! আজও নিহানের ছবি আপলোড করা হয়েছে। উফফ কি মনোমুগ্ধকর হাসি! দেখলে যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, এতো সুন্দর কেন এই নিহান। সে কি জানে সে আমাদের স্বপ্নের রাজকুমার!”

—“ঠিক বলেছিস। কিন্তু ওনার বোন আমাদের ক্লাসে থাকা সত্যেও আমাদের লাইন করিয়ে দেয়না।” মুখ গোমড়া করে বললো অপর মেয়েটি।
মেয়েগুলোর কথাগুলোতে আমার কেন যেন বেশ রাগ হলো।
হাতের কাগজটা শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে ফেললাম।
হিদ আসতেউ হিদকে নিয়ে ক্লাসের বাহিরে চলে আসলাম।
কেন জানিনা ক্লাসে একদম অসহ্য লাগছে আমার।

বাইরে আমি আর হিদ কথা বলছি এমন সময়ই দূর থেকে এক সিনিয়র ভাই বলে উঠলো,

—“এইযে লম্বা চুলওয়ালি সুন্দরি এদিকে আসো।”

আমি ঘুরেও তাকালাম না ছেলেটির দিকে।
মেজাজ যা গরম হয়ে আছে এতে আমার অন্যকোথাও খেয়াল নেই।
ক্লাসের বেল বাজতেই আমরা আবার ক্লাসে চলে আসলাম।

পরেরদিন,

প্রতিদিনের মতো আজও একটা চিঠি পেলাম ওই বিষাদের। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে না চাইতেও আজ চিঠিটা খুললাম।
চিঠিতে লেখা,

“ভালোবেসে সখি
নিভৃতে যতনে আমার
নামটি লিখো তোমার,,
মনেরো মন্দিরে…”

নাফি, ভালো আছো তুমি? উপরের গানটি তোমার জন্য গেয়েছি আমি, জানো নিশ্চয়ই এটা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। জানো মাঝেমধ্যে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ কবি তার এই ভালোবাসার গানগুলো তোমাকে এবং আমাকে উৎসর্গ করে লিখতো! বুঝো আমার অনুভূতির সাথে তার লেখা এই গানগুলো কতোটা মিলে? আচ্ছা নাফি জান আদৌ কি তাই?

আর হ্যাঁ এলোকেশী, তোমার সেই দীর্ঘ কেশ ছেড়ে ভুলেও বাড়ির বাইরে পা রাখবে না। তোমার এই দীর্ঘ স্নীগ্ধময়ী কেশের মাঝে শুধু আমি হারাতে চাই। তোমার এই কেশ দেখার অধিকারও শুধুমাত্র আমার, মনে রেখো। কথা শুনবে বুঝলে নাহলে সেদিনের মতো আবারও কারো না কারো মৃত্যু ঘটবে। তুমি তো জানোই তোমার এই “বিষাদময় প্রহর” তোমাকে কতোটা চায়। যাইহোক আজ অনেককিছু বলে ফেলেছি। আজ এই অব্দি-ই আমার কলম থামলো। সাবধানে থাকবে আমার নাফি জান!

ইতি তোমার
“বিষাদময় প্রহর”

চিঠিটা পড়ে প্রথমে বিরক্ত হলেও শেষের দিকে ভয়ে চোখমুখ কুচকে ফেললাম আমি।।
সেদিনের কথা বেশ মনে আছে আমার।
হঠাৎ মনে পরে গেলো গতকালের ছেলেগুলার লম্বা চুলওয়ালী সুন্দরী বলা কথাটা।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ আজ রিচেক করার সময় পাইনি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রই√{লাম। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here