#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
৬.
বিছানার মাঝখানে হাঁটু মুড়ে বসে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল সূচনা। অবহেলিত হতে হতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। নিজেকে এখন মানুষ ভাবতেও কষ্ট হয়। দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ পেয়ে দু’হাতে গালে লেপ্টে থাকা চোখের পানি মুছে নেয়। গুটি গুটি পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। বাইরে জারিফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর হাতে মিঠাই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সূচনা। ওর কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাঁজ।
‘কিছু হলেই এত কাঁদিস কেন রে তুই বুবি? এই নে তোর বিড়াল।’ মিঠাইকে সূচনার হাতে তুলে দিয়ে কথাটি বলল জারিফ। সূচনা হা করে তাকিয়ে রয়েছে। এটা সে কোন জারিফকে দেখছে? এত ভালো ব্যবহার? তাও আবার সূচনার সাথে! এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব? জারিফ বোধ হয় সূচনার মুখাবয়ব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বলল,’এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকে আমি ভীষণ খুশি, এজন্য তোকে বিড়ালের বাচ্চাটি এনে দিলাম।’
একটু চুপ করে থেকে আবার বলল,’কেন খুশি জানিস? আজ আমার ক্রাশ আমার প্রপোজালে রাজি হয়েছে। আমরা রিলেশনশিপে আছি। এখন শোন, এবারই প্রথম এবং এবারই শেষ তোর বিড়ালের বাচ্চাকে এনে দিলাম। এরপর যদি আবার মায়ের হাতে ধরা খাস তাহলে কিন্তু আমি কিছু করতে পারব না।’
সূচনা স্মিত হাসে। জারিফ বলে,’এই ভালো কথা! আমার বাকি টাকা কোথায়?’
মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে যায় সূচনার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছু্ক্ষণ। রুমের ভেতর গিয়ে বিড়ালের বাচ্চাটি রেখে একটা কলম নিয়ে আসে। হাতে লিখে,’আসার সময়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন টাকাগুলো ড্রেনে পড়ে গেছে।’
জারিফ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে লেখাগুলো পড়ল। রেগে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’হায়রে বুবির বাচ্চা! টাকাগুলোই ড্রেনে পড়ল? তুই পড়লি না কেন? টাকা ড্রেনে পড়েছে নাকি চুরি করেছিস জানিনা, তবে আজকেও তোকে মাফ করে দিলাম যা।’
এরপর জারিফ চলে গেল নিজের রুমে। সূচনা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।
রাতে খাওয়ার সময়ে চাচির সাথে খাবারগুলো টেবিলে এনে রাখছিল সূচনা। চাচি আদেশ দিয়ে বললেন,’এগুলো আমি গুছিয়ে নিচ্ছি। তুই জারিফ আর তোর চাচাকে ডেকে আন।’
সূচনা মাথা ঝাঁকিয়ে আগে চাচাকে ডাকতে যায়। বড়ো চাচা তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে উপন্যাসের বই পড়ছিলেন। সূচনা ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছে চাচার বই পড়ার শখ রয়েছে। ওর ইশারাসূচক কথা চাচা বুঝতে পারেন। চাচার সামনে গিয়ে সূচনা হাত নাড়িয়ে বলল,’খেতে চলেন।’
চাচা শোয়া থেকে উঠে বসলেন। বইটা বন্ধ করে সূচনাকে হাত টেনে পাশে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’কলেজ ভালো লাগছে তো?’
সূচনা ঈষৎ হেসে মাথা নাড়ায়।
‘তোর কোনও কিছু লাগলে আমায় বলবি। মনে থাকবে?’
পূণরায় মাথা নাড়াল সূচনা। এবার তাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি ডাইনিং-এ যেতে বলল। জারিফের ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। দরজায় টোকা দিলে জারিফ ভেতর থেকেই উত্তর দিল,’দরজা খোলাই আছে।’
সূচনা ভেতরে গেল না। দরজায় দাঁড়িয়েই বলল,’খেতে ডাকে।’
সূচনার এই ইশারাটা বুঝতে পারে জারিফ। হাত নাড়িয়ে ভেতরে যেতে বলে। সূচনা গিয়ে পাশে দাঁড়ানোর পর দেখতে পায় ভিডিও কলে একটা মেয়ে রয়েছে। জারিফ মেয়েটাকে বলল,’তোমায় বলেছিলাম না বুবির কথা? এইযে ওর কথাই বলেছিলাম।’
এরপর সূচনার দিকে তাকিয়ে বলল,’ও হচ্ছে আমার গার্লফ্রেন্ড প্রীতি।’
সূচনা নার্ভাস ফিল করছিল। প্রীতি হাত নাড়িয়ে হাই দেয়। সূচনাও হাত নাড়িয়ে হাই দিল। জারিফ সূচনাকে বলল,’তুই যা। আমি আসছি।’
সূচনা চলে যাওয়ার পর মৃদু রাগ দেখিয়ে প্রীতি বলল,’বুবি কি হ্যাঁ? একজন মানুষকে কেউ মুখের ওপর এভাবে বুবি বলে?’
‘আরে আজব! ও যেটা আমি তো সেটাই বলি।’
‘মানুষটা কষ্ট পেতে পারে এটা ভাবো না?’
‘ও কষ্ট পায় না।’
‘তোমায় বলেছে? কথা বলতে পারে না মানে তো এই নয় যে, কষ্ট পায় না। সব মানুষের মাঝেই কষ্ট আছে। সূচনার কষ্টটা আরও বেশি। কারণ ও কথা বলতে পারে না। তাছাড়া ও পরিবার ছেড়ে তোমাদের বাসায় থাকছে। ওর সাথে এমন ব্যবহার করা একদম উচিত না তোমার।’
‘আচ্ছা বাবা সরি! আর বলব না। হয়েছে?’
‘না বললেই খুশি হব।’
তারপর একটু চুপ থেকে বলে,’তবে যাই বলো, দেখতে কিন্তু মাশ-আল্লাহ্।’
‘হ্যাঁ, তোমায় তো বলেছিলাম সূচনা দেখতে অনেক সুন্দর।’
প্রীতি মুখটিপে হেসে বলল,’আচ্ছা জারিফ একটা কথা বলো তো। সূচনা যদি কথা বলতে পারত তাহলে তুমি ওর প্রেমে পড়তে না?’
‘ধুর! ওকে কখনও আমি ঐ চোখে দেখিনি।’
‘কথা বলতে পারে না বলেই দেখোনি।’
‘তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছ এখন!’
প্রীতি শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে,’আচ্ছা যাও, খেয়ে নাও আগে।’
‘ওকে। আমি খেয়ে এসে ফোন দিচ্ছি।’
ফোন রেখে ডাইনিং-এ বসে জারিফ। ওর মুখোমুখি বসে মাথা নত করে ভাত খাচ্ছে সূচনা। রাজ্যের সকল সংশয় যেন ওর মাঝে। সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার ব্যস্ততা। প্রীতির বলা কথাটা ভাবতে থাকে সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণেই মাথা থেকে এসব উদ্ভট চিন্তা বের করে ফেলে।
৭.
নিরবে কাঁদতে কাঁদতে হালিম রান্না করছিল ভূমিকা। রাসেল একটু আগে রেশমা বেগমকে ফোন করেছিল। ভূমিকার সাথে করা খারাপ আচরণগুলো,বকাঝকা সবই সে শুনেছে। মায়ের সাথে এটা নিয়ে বেশ তর্কাতর্কিও হয়েছে। এক পর্যায়ে রাগ করে রাসেল ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। রাগে, জিদ্দে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিশ্রি ভাষায় ভূমিকাকে গালাগালি করেন। তার ভাষ্যমতে ভূমিকা ফোন করে রাসেলের কাছে বিচার দিয়েছে। অশ্রাব্য ভাষায় তিনি এখনও গালাগালি দিয়ে বলে চলেছেন,’আমার সংসারডারে নষ্ট করতে আইছে এই ডাইনি। আগুন লাগাইতে আইছে। কত্ত বড়ো সাহস! আমার নামেই আমার পোলার কাছে বিচার দেয়। তোর চুলের মুঠি ধইরা যদি বাড়ি থেইকা বাইর করতে পারতাম তাইলে আমার শান্তি হইত বান্দির বাচ্চা!’
ভূমিকার খুব করে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে সে কিছুই বলেনি রাসেলের কাছে। এক তো সত্যি কথা বললেও তিনি বিশ্বাস করবেন না, আর দুই এতে আরও বেশি অশান্তি শুরু হবে। রাসেলের তখনের বলা কথাটাও সে ভোলেনি। সংসার করার মানসিকতা নাকি ভূমিকার মধ্যে নেই। সে রাসেলকে প্রচণ্ড ভালোবাসে এটাই কি তার দুর্বলতা? অন্যদিকে সে কালো, সুশ্রী নয় এজন্যই শ্বাশুরীর এমন বর্বর নিষ্ঠুর আচরণ!
সেই রাতে আর খাবার জোটেনি ভূমিকার ভাগ্যে। যদিও রিদি লুকিয়ে ভূমিকাকে খাবার দিয়েছিল। তবে সে খায়নি। সৌন্দর্য না থাকতে পারে, তবে আত্মসম্মান রয়েছে। যেখানে শ্বাশুরী রাতের খাবার দেবে না বলেছে, সেখানে ননোদের লুকিয়ে আনা খাবার তার গলা দিয়ে নামবে না। এতটাও নিচু মনের মেয়ে সে নয়। না হয়, এক বেলা না খেয়েই রইল!
.
একটি সুন্দর সকালের দেখা মিলেছে আবার। দুটি অবহেলিত মানুষের জন্য যদিও এই সুন্দর সকাল প্রতিদিনকার মতোই বিভীষিকাময়! রাসেল রাতে আর ফোন দেয়নি। ভূমিকা বার দুয়েক ফোন দিয়েছিল কিন্তু কল যায়নি। মায়ের ওপর তার রাগ কখন ভাঙবে কে জানে। বাড়িতে শুধু শ্বাশুরী আর সে থাকে। শ্বশুর আর রাসেল একই দেশে কাজ করে। সকালের নাস্তা বানিয়ে শ্বাশুরীকে ডাকতে যাবে তখন কলিংবেল বেজে ওঠে। সকালে সাধারণত কেউ তো আসে না। রিদি আসতে পারে। ওর স্বামী অফিসে চলে গেলে মাঝে মাঝেই এখানে এসে পড়ে। রিদি আসলে ওর ভালোই লাগে। একটু গল্পগুজব করা যায়। কিন্তু দরজা খু্লে অবাক হয়ে যায় ভূমিকা। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পরক্ষণেই অস্ফুটস্বরে ‘বাবা’ বলে সেলিম মিয়ার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। আনন্দে সে কেঁদে ফেলে। বিয়ের পর এই তিন মাসে আর দেখা হয়নি। এতদিন বাদে বাবাকে দেখে আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারে না।
সেলিম মিয়া ব্যাগে করে গ্রাম থেকে অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। ভূমিকা আগে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে। বিস্মিত হয়ে বলে,’কীভাবে এত সকাল সকাল চলে এলে? আর আসলে যখন বলবে না আমায়?’
সেলিম মিয়া স্মিত হাসে। ইশারায় বলেন,’তোকে দেখেই তো আমার শান্তি মা।’
ছোটোবেলা থেকেই বাবাকে ইশারায় কথা বলতে দেখে আসছে ভূমিকা। তাই তার সব কথাই ভূমিকার বোধগম্য। রেশমা বেগম ড্রয়িংরুমে সেলিম মিয়াকে দেখে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেন। রাতের রাগ এখনও তার কমেনি। সেলিম মিয়া ইশারায় জিজ্ঞেস করেন,’কেমন আছেন?’
তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন,’কী যে বলে না বলে! ভূমিকা, আমার ছেলেরে জাদুটোনা করছিলা নাকি সত্যি কইরা বলো তো? না মানে, নইলে কেমনে এই পরিবারের মাইয়া আনে রাসেল? বউ কালী, বইন আর বাপে বোবা। মানে! আমার মাথাতেই ঢুকে না।’
অপমানে জর্জরিত হয়ে মাথা নত করে বসে থাকেন সেলিম মিয়া। চোখ টলমল করছে তার। ভূমিকা কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,’দয়া করে আব্বারে অপমান করবেন না মা! আপনার রাগ থাকলে আমায় বকেন। প্রয়োজন হলে মারেন। তবুও আমার আব্বারে কিছু বইলেন না। আপনার দুইটা পায়ে ধরি আমি।’
‘তোদের মান আছে? অপমান লাগে কেমনে তাইলে? সকালটাই নষ্ট আমার!’
তিনি খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যান। ভূমিকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলে,’আব্বা তুমি কষ্ট পাইয়ো না!’
কাঁদেন সেলিম মিয়াও। আজ তার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে কথা বলতে পারেন না বলে! কারণ বাকশক্তি থাকার পরেও কথা বলতে না পারার কষ্ট অনেক। মেয়ে সুখে নেই এটা জানার পর কোন বাবারই বা কথা বলার ক্ষমতা থাকে? তবে এক বুক আশা নিয়ে সে ঢাকায় এসেছিল।মেয়ে দুটোর সুখ দু’চোখ ভরে দেখে যাবে বলে! যা দেখল এতে সে বাকিটা জীবন শান্তিতে থাকতে পারবে নাকি জানা নেই। তিনি বেশিক্ষণ আর সেই বাড়িতে থাকলেন না। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ভূমিকার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে তো এমন জীবন চায়নি কখনও!
__________
৮.
কোলাহলভর্তি রাস্তায় এসে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সূচনা। অস্বস্তিপূর্ণ ভাবটা পূণরায় ফিরে আসে। বাসে যেতে মন সায় দেয় না। কিছু মানুষরূপী পশুর কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে সুরক্ষা রাখার চিন্তায় সে চিন্তিত। অফিস টাইম আর কলেজ টাইম এক সময়ে হওয়ায় ভিড় বেশি থাকে। চাচা জারিফকে বলে দিয়েছে সূচনাকে কলেজে দিয়ে আসতে। কিন্তু সে আজও গতকালের মতো সূচনাকে বাস স্টপেজে এসে নামিয়ে দিয়েছে। জারিফ যাওয়ার আগে বলে গেল,’আজ তোকে কলেজে আনতে যেতে পারব না। তুই একটা রিকশা করে বাড়ি চলে যাস।’
কথা শেষে সে রিকশা ভাড়ার জন্য একশো টাকা সূচনার হাতে গুঁজে দেয়। জারিফ চলে যাওয়ার পরে সে বাসের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রথম দুটো বাস সে ইচ্ছে করেই ছেড়ে দেয় এই আশায় যে, পরের কোনও বাস হয়তো খালি আসবে। কিন্তু তাকে নিরাশ হতে হয়। এদিকে ক্লাসের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তাই আর সে আর কিচ্ছু না ভেবে বাসে ওঠার জন্য পা বাড়ায়। বাসে পা রাখার সাথে সাথে অজানা ভয়ে সে কুঁকড়ে যেতে শুরু করে। সে বাসে ওঠার পরে আরও মানুষ বাসে উঠেছে। একটা সীট ধরে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত দৃষ্টিতে বাসে চোখ বুলায়। হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় জানালার বাইরে। নীল শার্ট পরা, গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে একটা ছেলে দৌঁড়ে আসছে। সেই ছেলেটি অন্য কেউ নয়, জয়। সূচনা মনে মনে বারবার চাচ্ছে জয় যেন এই বাসেই উঠে। কাকতালীয় হোক বা মীরাক্কেল; এভাবে বারবার জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া, বিপদ থেকে রক্ষা করায় তার অবচেতন মন জয়ের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। অথচ সে জয়কে চেনে না! জানে না তার নামটিও।
সূচনাকে হতাশ হতে হলো। জয় এই বাসে ওঠেনি। সামনের বাস স্টপেজ থেকে আরও কয়েকজন ছেলে-মেয়ে বাসে ওঠে। মেয়েদের উঠতে দেখে অজানা কারণেই ওর কেমন যেন একটু ভালো লাগতে শুরু করে। মনে সাহস সঞ্চয় হয়। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। বাস স্টপেজের একটু সামনে যখন বাস যায় তখন একটা ছেলে হেল্পারের উদ্দেশ্যে বলল,’মামা গাড়িটা থামান। আমার এক ফ্রেন্ড উঠবে।’
হেল্পার বাস থামতে দিতে নারাজ। চোখের পলকে ছেলেটি হেল্পারের গালে থাপ্পড় বসায়। বিশ্রী ভাষায় গালি-গালাজও করে। ছেলেটির পরনে কলেজের সাদা শার্ট। একেই হয়তো বলে স্টুডেন্টস পাওয়ার! কিন্তু সূচনার এই বিষয়টি ভালো লাগেনি। সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলতে হবে? এক পর্যায়ে চলন্ত বাসেই হেল্পারের সাথে ধস্তাধস্তি বেঁধে যায় ছেলেটির। হেল্পার গায়ে হাত তোলেনি, নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ধস্তাধস্তি করতে করতে বাসের একদম ভেতরে চলে আসে। সূচনার সাথে ধাক্কা লেগে পরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সূচনা। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটির। বাসের কয়েকজন মুরুব্বি মিলে অবশেষে ওদের ঝগড়া থামাতে সক্ষম হয়। বাস থেকে নামার পর সূচনা বুঝতে পারে ছেলেটি ওদেরই কলেজের। অজানা কারণেই একটা বিতৃষ্ণা চলে আসে। রাস্তার পার হওয়ার পর ছেলেটি বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে সূচনার দিকে দৃষ্টিপাত করে। সূচনাও তখন তার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হওয়ায় দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সূচনা। ছেলেটি এবার বন্ধুদের আগে যেতে বলে সূচনার কাছে আসে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,’তাকিয়ে ছিলে কেন?’
সূচনার বলতে ইচ্ছে করছিল,’হঠাৎ কারও দিকে দৃষ্টি পড়তেই পারে। তার মনে এই নয় যে তাকিয়ে ছিলাম।’
কিন্তু হায়! কথা বলার মতো বাকশক্তি বিধাতা তাকে দেননি। ছেলেটি একটু ভাবুক হয়ে বলল,’বাসে বোধ হয় তোমার সাথেই ধাক্কা লেগেছিল তাই না? আমি খেয়াল করিনি। এজন্য সরি।’
এতক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও সূচনা এবার আর দাঁড়াল না। অন্যপাশ দিয়ে চলে গেল। ছেলেটি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার ওর বন্ধুই কাছে এলো। জিজ্ঞেস করল,’কীরে ইউসূফ এখনও দাঁড়িয়ে থাকবি? প্রথমদিন ক্লাস করিনি। আজ অন্তত ক্লাস করি চল।’
‘মেয়েটা ইগনোর করল কেন? সরি বললাম, ইট’স ওকে পর্যন্ত বলল না।’
‘সিনিয়র মনে হয়।’
‘সিনিয়র তো কী? এজন্য কি কথা বলা যায় না? সব হলো রূপের অহংকার বুঝেছিস? বেশি সুন্দর হলে যা হয় আরকি! রাখ তো এসব বালের কাহিনী। ক্লাসে চল।’
কলেজের মেইন গেটের সামনে এসে চমকে যায় সূচনা। সেলিম মিয়াকে এখানে দেখে ভাবে নিজের ভ্রম হয়তো। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে কোনও ভ্রমে পায়নি। বরং এটা তার বাবা। সূচনা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। ছলছল দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো বাবা?’
তিনি নিজেও ইশারায় বলেন,’ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
‘ভালো আছি।’
কলেজের পাশে পাম্পে বসে বাবা-মেয়ের ইশারায় গল্প-গুজব চলে কিছুক্ষণ। তিনি কয়েকবার করে বলেছেন,’তোদের দেখতে এসেছিলাম। দেখেছি। এখন শান্তি লাগছে। এখন তুই ক্লাসে যা।’
সূচনা মাথা ঝাঁকিয়ে না করেছে। আজ সে ক্লাসে যাবে না। বাবার সাথে গল্প করবে। কথায় কথায় সূচনা জানতে চায় ভূমিকার বাড়িতে গিয়েছিল কী-না। কান্না তখন সেলিম মিয়ার গলায় দলা পাঁকিয়ে যায়। কিন্তু সূচনাকে বুঝতে দিলেন না। জানতেও দিলেন না আসল কথা। হাসিমুখে বললেন,’গিয়েছিলাম। অনেক আদর-যত্ন করে খাইয়েছে। বেশি সময় নেই আমার। গ্রামে ফিরে যেতে হবে। ভাবলাম তোকে একবার দেখে যাই।’
সূচনা জিজ্ঞেস করল,’চাচার বাসায় যাবে না?’
তিনি বললেন,’না রে মা। অন্যদিন যাব।’
সূচনার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা কিছু লুকাচ্ছে। কিছু বলতে চাচ্ছে না। বাবার ভাসা ভাসা চোখই তার সাক্ষী। কিন্তু সে জোর করেও কিছু জানতে চাচ্ছে না। এদিকে আকাশে মেঘ করেছে। একটু বাদেই হয়তো জোরে বৃষ্টি নামতে শুরু করবে। সেলিম মিয়া তাড়াহুড়া করে উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’বৃষ্টি আসবে রে মা। আমি তবে যাই এখন। তুই আর এখানে বসে থেকে কী করবি? চল রিকশায় উঠিয়ে দেই।’
সূচনা কষ্টের সহিত মৃদু হেসে বলল,’আমায় নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি যেতে পারব। চলো তোমায় বাসে উঠিয়ে দিচ্ছি।’
তিনি চলে যাওয়ার পূর্বে জোরপূর্বক সূচনার হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন। স্নেহময় হাতে সূচনার মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,’সাবধানে থাকবি মা।’
তিনি চলে গেলেন। বাস চোখের আড়াল হওয়ার পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতে শুরু করে। আপু ভালো নেই। ও বাড়িতে কি বাবাকে অপমান করেছে কেউ? ভূমির শ্বাশুরী যে ভূমিকে সহ্য করতে পারে না এটা সূচনা জানে। কষ্ট লাগে ভীষণ। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে বাবা-মা আর বড়ো বোনকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তবে এই মনে চাওয়াটা নিতান্তই বাড়াবাড়ি। প্রথমত ভূমিকার এখন আলাদা একটা জীবন রয়েছে। সংসার রয়েছে। সে এখন অদৃশ্য শেকলে আবদ্ধ। অন্যদিকে সূচনার পক্ষেও এখন সম্ভব নয় বাবা-মাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার। এরজন্য আগে তাকে পড়াশোনা করতে হবে। নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর সেও বাবা-মাকে সাথে নিয়ে ভালো থাকবে। কারও অপমান, লাঞ্ছনা আর সহ্য করতে হবে না। বৃষ্টি এখন বড়ো বড়ো ফোঁটায় পড়ছে। সে বৃষ্টিতে ভিজেই উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে। সাথে টাকা রয়েছে। পথ না চিনলেও টাকা দিলে রিকশাওয়ালা বাড়িতে পৌঁছে দেবে। তাই চিন্তার কোনও কারণ নেই। সে চেষ্টা করে চলেছে অশান্ত মনকে শান্ত করার।
জুতাগুলো হাতে তুলে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা পিচঢালা পথে সে হাঁটতে থাকে। মানুষের চলাচল এখন শুধু গাড়িতে। পাশের একটা ছাউনির নিচে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সে জয়ের দর্শন পেয়ে যায়। বিষন্ন মনে মাথা নত করে বসে রয়েছে। সূচনা দোনামনা করে তাকিয়ে রয়েছে। যাবে কী-না বুঝতে পারছে না। অবশেষে সে গেল। সুন্দর দুটি পা দৃষ্টিতে আসায় জয় মাথা তুলে তাকায়। সূচনাকে দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,’আপনি!’
সূচনা নিরব। জয় হাসার চেষ্টা করে বলল,’সরি। আপনি কথা বলতে পারেন না জেনেও প্রশ্ন করে আপনাকে লজ্জা দিচ্ছি।’
সূচনা দাঁড়িয়েই রইল। বসার মতো জায়গা দিয়ে জয় সরে বসল। সূচনা পাশে বাসে। ব্যাগ থেকে খাতা, কলম বের করে লিখে,’আপনি এখানে কেন?’
‘আছে কারণ। আপনি এখানে কেন? আপনার কলেজ নেই?’
সূচনা লিখল,’ছিল। যাইনি। বাবা এসেছিল দেখা করতে।’
‘ওহ।’
একটু চুপ করে থেকে আবার জিজ্ঞেস করল,’আপনার নাম কী?’
‘সূচনা। আপনার?’
‘জয়। আপনার বাবা কোথায় থাকে?’
‘গ্রামে। আমি চাচার বাড়িতে থাকি।’
‘চাচার বাড়িতে খুব কষ্ট হয় তাই না?’
সূচনা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। অবাক হয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জয় মৃদু হেসে সূচনার বাম হাতটির দিকে তাকিয়ে বলে,’হাত পুড়েছে কি রান্না করতে গিয়ে?’
সূচনা হাতটি লুকিয়ে ফেলে। গতকাল রাতে রান্না করতে গিয়ে গরম কড়াইয়ের সাথে লেগে ফোসকা পড়ে গেছে। বাড়িতে কাউকে জানায়ওনি। কিন্তু জয়ের চিন্তাশক্তি ভীষণ প্রখর বলে অভিভূত হচ্ছে সূচনা। জয় রহস্যজনকভাবে হেসে বলল,’এই শহরের মানুষগুলো ভীষণ একা সূচনা। এখানে বাঁচতে হলে, টিকতে হলে লড়াই করতে জানতে হয়। প্রতিবাদ করতে জানতে হয়। মনে দৃঢ় মনোবল রাখতে হয়। আপনি কথা বলতে পারেন না এটাকে আপনার দুর্বলতা ভাববেন না। এমনকি এটা আপনার কমতিও নয়। এটা উপরওয়ালার ইচ্ছে। উনার চেয়ে বেশি তো কেউ জানে না তাই না? তিনি জানেন কাকে কতটুকু দিতে হবে। যেখানে সে সবকিছু সম্পর্কে অবগত সেখানে মানুষজন আপনাকে নিয়ে জাজ করার কে? জাস্ট ইগনোর দেম। ইউ ক্যান, এন্ড আই নো ওয়ান ডে ইউ উইল উইন।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
মুন্নি আক্তার প্রিয়া