#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________________
৩০.
সূচনার ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টি জারিফের ওপর স্থির হয়ে রয়েছে। তার হাতটি এখনো জারিফের হাতের মুঠোয়। কিছুদূর অগ্রসর হতেই চাচার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সেই সাথে সূচনাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে জারিফও। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চাচা জিজ্ঞেস করেন,’তুই এখানে কেন?’
প্রশ্নটি জারিফের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে উত্তর দিতে প্রস্তুত নয়। সে নিরব-ই রইল। ধরে রাখা হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করে চাচা পূণরায় প্রশ্ন করলেন,’তুই ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? কিরে চুপ করে আছিস কেন?’
এই পর্যায়ে জারিফ মুখ খুলল। বলল,’বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিস মানে? কোন বাড়িতে?’
‘আমাদের বাড়িতে।’
তৎক্ষণাৎ চাচা কোনো জবাব দিতে পারলেন না। রাগে তার চোয়াল ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠেছে। তিনি কর্কশকণ্ঠে বললেন,’তোর সমস্যাটা কি আমি বুঝতে পারছি না। এখন কি তোর জ্বালায় মেয়েটা হোস্টেলেও থাকতে পারবে না?’
‘আমাদের বাড়ি থাকতে, সূচনা হোস্টেলে কেন থাকবে আব্বু?’
‘কেন থাকবে তুই জানিস না? তোর আর তোর মায়ের অত্যাচারেই ওকে আমি দূরে রেখেছি। মেয়েটাকে এবার একটু শান্তিতে থাকতে দে।’
শেষ কথাটা প্রবলভাবে আঘাত করে জারিফকে। সে সূচনার অশান্তিতে থাকার কারণ? সত্যিই কি তাই? সূচনার হাতটি ছেড়ে দিলো জারিফ। এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,’আমি আর ওর অশান্তির কারণ হব না আব্বু। আমি চলে যাচ্ছি।’
উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে জারিফ সেখান থেকে প্রস্থান করে। চাচার রাগ কমে এসেছে। তিনি সূচনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’হোস্টেলে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
সূচনা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝাল। তিনি বললেন,’বেশ! এতক্ষণে শান্তি পেলাম। আজ তাহলে আমি যাই মা। সাবধানে থাকিস।’
প্রত্যুত্তরে সূচনা হাসি প্রদান করল। গুটি গুটি পায়ে হোস্টেলের ভেতর ফেরত আসতে আসতে মাথায় ঘুরছিল জারিফের অদ্ভুত কর্মকাণ্ডগুলো। হুট করেই লোকটার কী হলো?
.
শুভ্র রঙের পাঁচতলা বাড়ির সামনে পায়চারি করছে জারিফ। কিছুক্ষণ পরপর নিঃশ্বাস আটকে সিগারেট টানছে। ইদানীং বড্ড বেশি সিগারেট খাচ্ছে সে। অথচ সেদিকে তার খেয়ালই নেই। রাতের রাস্তায় নারী মূর্তির ছায়া দেখতে পেয়ে পায়চারি বন্ধ করে সে। এতক্ষণ প্রীতির বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সূচনার হোস্টেল থেকে সরাসরি সে প্রীতির বাসার সামনে এসে তাকে ফোন করেছে। অবশ্য জারিফের এমন কাজে সে ভীষণ অবাক। কেননা প্রেম হওয়ার আগ পর্যন্ত জারিফের পাগলামীগুলো দৃষ্টিগোচর হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও কিছুদিন ধরেই দুজনের মাঝে চলছিল মনোমালিন্য।
প্রীতি কাছে এসে বলল,’বলো।’
প্রীতির মুখের ওপর দৃষ্টিপাত করল জারিফ। সোডিয়াম লাইটের আলোয় প্রীতির পুতুল পুতুল চেহারাটা ভারী সুন্দর লাগছে। তখনই তার মন বলে বসল,’হুহ! সূচনার মতো সুন্দর নয়।’ জারিফ অবাক হয়। তার মন সূচনার সাথে প্রীতিকে কেন জাজ করছে? প্রীতি তার গার্লফ্রেন্ড হয়। তার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু সূচনা? সে তো তার কাজিন ব্যতীত কিছু হয় না। এমনকি খুব একটা ভালো সম্পর্কও দুজনের মধ্যে ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে, সূচনার প্রতিবন্ধকতা এবং অস্বচ্ছল আর্থিক অবস্থার জন্য জারিফ তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।
জারিফকে নির্বাক দেখে প্রীতি জিজ্ঞেস করল,’তোমার কি মন খারাপ?’
‘মনের ডাক্তার হলে কবে থেকে?’ হাসার চেষ্টা করে পালটা প্রশ্ন করল জারিফ। প্রীতি ভ্রুকুটি করে বলল,’মনের ডাক্তার হতে যাব কেন? তোমায় দেখে মনে হলো মন খারাপ। তাই জিজ্ঞেস করেছি।’
‘ওহ আচ্ছা। মুখ দেখলেই সব বুঝে ফেলো?’
‘উফ! এত কথা পেচাচ্ছ কেন?’
‘তুমি কি ফ্রি?’
‘হুম। কেন?’
‘চলো কোথাও থেকে হেঁটে আসি।’
‘এখন?’ প্রশ্নটা করার সময়ে প্রীতির চোখে-মুখে বিস্ময় ফুঁটে ওঠে। মনে হচ্ছে এটা একটা অলুক্ষণে সময় এবং জারিফ সেই অলুক্ষণে সময়ে তাকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু সত্যিটা হলো, সে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে। নিরিবিলি রাত্রি, চারদিকে অন্ধকার, অল্পসল্প সোডিয়ামের আলো। প্রিয় মানুষটির হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটার অনুভূতি ব্যাখা করার মতো নয়।
জারিফ বলল,’হুম, এখন। যেতে পারবে নাকি বলো।’
‘পারব।’
‘তাহলে চলো।’
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। প্রীতির গায়ে আকাশী রঙের সালোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা শুধু সাদা রঙের। চুলগুলো পনি-টেইল করে বাঁধা। মুখে কোনো সাজগোজ নেই, তবুও অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। জারিফ হাঁটতে হাঁটতে বলল,’তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
প্রীতি সলজ্জিত মুখখানা নত করে নিল। ঠোঁটের কোণে সুমিষ্ট হাসি ফুঁটিয়ে বলল,’সত্যি?’
‘মিথ্যে বলার তো কোনো কারণ দেখছি না।’
‘তুমি না কেমন জানি! আগে তো এমন ছিলে না।’
‘কেমন?’
‘আগে কত প্রসংশা করতে। কত রোমান্টিক ছিলে। আর এখন একদম নিরামিষ হয়ে গেছ।’
‘ইশরে! এ তো খুব অন্যায়।’
প্রীতি হেসে ফেলল। জারিফের বাম হাত জাপটে ধরে হাঁটতে হাঁটতে আহ্লাদীস্বরে বলল,’অতো ঢং করে দুঃখ প্রকাশ করা লাগবে না। আমি নিরামিষ মানুষটিকেই ভীষণ ভালোবাসি।’
প্রীতির নরম গালটা জারিফের কাঁধের ওপর। দুজনে খুব আস্তে আস্তেই হাঁটছে। আশেপাশে জনমানবের চলাফেরা নেই। কয়েকটা নেড়ি কুকুর এখানে-ওখানে শুয়ে-বসে রয়েছে। জারিফের মনের ভেতর অস্থিরতা। সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রীতির কাছে এসে ভালো লাগছে। কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না। চিন্তা-ভাবনা করতে করতে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। প্রীতির আদুরে আহ্লাদী কথাগুলো তার কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছাতে পারে না।
‘এই কী ভাবো এত?’ জারিফের হাত ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল প্রীতি।
‘সূচনা আর আমাদের বাড়িতে থাকে না জানো?’
‘না, তো। তুমি তো বলোনি। ওর তো এখানে কেউ থাকে না। তাহলে এখন কোথায় আছে?’
‘হোস্টেলে।’
‘তোমাদের বাসায় কী সমস্যা ছিল?’
‘আমি আর মা ওর সাথে খারাপ আচরণ করি বলে আব্বু ওকে হোস্টেলে দিয়ে এসেছে।’ একদম স্বাভাবিক স্বীকারোক্তি। তবে এ কথার প্রেক্ষিতে প্রীতি কিছু বলতে পারল না। জারিফ নিজেই বলল,’সমস্যাটা কি জানো? ওর হোস্টেলে চলে যাওয়াটাই কেন জানি আমি মানতে পারছি না।’
‘মিস করছ হয়তো।’
‘ওকে কেন আমি মিস করব? ও তো আমার কেউ নয়।’ জারিফের বাচনভঙ্গিতে মিশে ছিলে পাহাড়সম অভিমান। হ্যাঁ, আর এই অভিমানগুলো যেন সূচনাকে ঘিরেই। মেয়েদের নাকি তৃতীয় চক্ষু থাকে। এই চক্ষু দ্বারা তারা অনেক কিছুই দেখতে পারে। এই যেমন এখন প্রীতি দেখছে পাচ্ছে জারিফের অভিমানগুলো। তার কাছে এটাও স্পষ্ট সে সূচনার অনুপস্থিতিতেই তার কাছে এসেছে। আস্তে আস্তে তার হাতটা আলগা হয়ে যায়। কোথাও একটা খুব কষ্ট কষ্ট অনুভূতি হচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে? এমন হওয়ার মতো তো কিছু হয়নি। সে কি অযাচিত চিন্তা-ভাবনা করছে? মনের কথাগুলো মনের মধ্যেই আটকে রাখতে পারল না। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,’তুমি সূচনার প্রেমে পড়ে যাওনি তো?’
এ কথায় তেলে-বেগুমে জ্বলে উঠল জারিফ। রাগে হিসহিস করতে করতে বলল,’আমি কেন ওর প্রেমে পড়তে যাব? কীসব আলতু-ফালতু কথা বলো। তোমার কাছে এসেছিলাম একটু শান্তির জন্য, মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য। আর তুমি যা তা বলা শুরু করে দিয়েছ। সূচনাকে নিয়ে তোমার এত কীসের সমস্যা?’
প্রীতি অবাক হয়। সে কখন বলল সূচনাকে নিয়ে তার সমস্যা? সে তো সূচনাকে কখনো বাঁকা চোখে দেখেনি। জারিফ আবার বলল,’তুমি যখন তোমার ছেলে ফ্রেনন্ডসের সঙ্গে মেশো। ওদের সাথে আড্ডা দাও, ঘুরো তখন কি আমি কিছু বলি?’
‘তুমি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছ? আমি কিন্তু একবারের জন্যও বলিনি সূচনাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা আছে।’
‘বলতে হবে কেন? তোমার চোখমুখ-ই তো সব বলে দিচ্ছে।’
‘তুমি কিন্তু এখন বেশি বেশি ভাবছো।’
‘আমি মোটেও বেশি ভাবিনি। তোমার মন এখন এগুলাই ভাবছে।’
রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ে প্রীতি। সে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাগগুলো যেন এখনই কান্নায় রূপ নেবে। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে রয়েছে। আর কিছু না বলেই বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে জারিফ পেছন থেকে অনেকবার ডাকে। হাতের উলটোপিঠে চোখের পানি মুছে হাঁটার গতি বাড়ায় প্রীতি। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ফাঁকা রিকশাও পেয়ে যায়। একবারও পিছে না তাকিয়ে সে রিকশায় উঠে বসে। জারিফ দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রীতিকে আটকানোর আর বৃথা চেষ্টা করে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার মাঝে বসে পড়ে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন জ্বালায়। তার মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ছে। ঘুম প্রয়োজন। সিগারেট শেষ হওয়ার পথে পেছন থেকে রিকশার হর্ণের শব্দ পায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,’এই রিকশা থামো।’
__________
৩১.
সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমা আর সাথী তাদের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ওরা কেউই সকালের খাবার হোস্টেলে খায় না। বাইরে খেয়ে নেয়। ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর সুখী ঘুম থেকে ওঠে। পাশের বিছানায় বেঘোরে ঘুমুচ্ছিল সূচনা। রাতে ঘুম খুব একটা ভালো হয়নি তার। সুখী হাই তুলতে তুলতে সূচনার কাছে এগিয়ে যায়। পিঠে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,’আপু, এই আপু? কলেজে যাবে না?’
কয়েকবার ডাকার পর সূচনার ঘুম হালকা হয়। নিভু নিভু চোখে সুখীর দিকে তাকায়। দু’হাতে চুলগুলো হাত খোঁপা করছিল সে। আরেকবার হাই তুলে বলল,’তাড়াতাড়ি উঠো।’
কথা শেষ করে সে স্কুল ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় গোসল করার জন্য। অন্যদিকে কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে থাকে সূচনা। এরপর উঠে বসে। সুখী বের হলে সে গোসল করতে যায়। দুজনে একসাথে সকালের খাবার খেয়ে হোস্টেল থেকে বের হয়। সুখীর স্কুলও হোস্টেলের কাছেই। তাই কেউই রিকশা নিল না। সুখীকে স্কুলে দিয়ে সূচনা কলেজে আসে। নুসরাত এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে,’এই তোমার সমস্যা কী? ঠিকমতো কলেজে আসো না কেন? জানো কত মিস করি?’
অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে সূচনা। নুসরাত ফিক করে হেসে ফেলে। সূচনার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,’ওরকম ইনোসেন্টের মতো তাকিয়ে থাকলে কি রাগ করা যায়?’
দুজনে গিয়ে ক্লাসে বসে। এ ক’দিন ক্লাসে কী কী পড়িয়েছে সব নোট করে রেখেছিল নুসরাত। ক্লাস শুরু হতে এখনো সময় আছে বিধায় সূচনা ক্লাসে বসেই নোট করতে শুরু করে। পাশে বসে নুসরাত এতদিনের জমিয়ে রাখা গল্পগুলো সব বলছে। ওরা বসেছিল দ্বিতীয় বেঞ্চে। হঠাৎ-ই একজন ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। সূচনা দৃষ্টি সরিয়ে নিলেও ইউসূফ কিন্তু তাকিয়েই ছিল। সে সরাসরি সূচনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,’কী করো?’
সূচনা তাকালো না। নুসরাতই বলল,’দেখো না লিখতেছে?’
‘তোমারে বলতে বলছি?’
নুসরাত এবার দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,’মজা নাও তুমি? জানো না, সূচনা যে কথা বলতে পারে না?’
ইউসূফ দমে যায়। আজ সে সূচনাকে অপমান করার মতলব নিয়ে আসেনি। কিছু না বলেই সেখান থেকে সরে গেল সে।
টিফিন টাইমে ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময়ে সূচনার নাম ধরে ডাক পড়ে। পিছু ফিরে ইউসূফকে দেখতে পায়। সে উচ্ছস্বিত কণ্ঠে বলল,’খেতে যাচ্ছ তো? চলো একসাথে খেতে যাই।’
নুসরাত চুপচাপ দেখছিল, কিছু বলল না। কোনো সাড়া দিল না সূচনাও। তিনজনেই এখন পাশাপাশি হাঁটছে। পাশ থেকে তখন এক বন্ধু বলল,’কিরে মামা আবার নতুনটারে পটাইতেছিস এখন?’
‘ধুর শালা!’ বলে ছেলেটার পিঠে কিল বসায় ইউসূফ। কথাটা সূচনাকে নাড়িয়ে তোলে। এই ছেলের কতগুলো গার্লফ্রেন্ড? ইউসূফ ভাব জমানোর চেষ্টা করে। বিরক্তিকর চাহনীতে কিছুক্ষণ সূচনা ইউসূফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘কী দেখো ওভাবে?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করল ইউসূফ। তার কথার ধরণে মনে হচ্ছে দুজন, দুজনার খুবই পরিচিত। সূচনা হাতের ইশারায় বলল,’চলে যান।’
ইউসূফ বুঝতে না পেরে বলল,’কী বললে? বুঝিনি।’
‘তোমায় চলে যেতে বলছে।’ বলল নুসরাত। ইউসূফ অপরাধীর মতো সূচনাকে বলল,’সেদিনের ব্যবহারের জন্য কি তুমি আমার ওপর রাগ করে আছ?’
সামনে দাঁড়ানো একটা মেয়ের হাতে কলম দেখতে পেয়ে সূচনা গিয়ে কলমটি নিয়ে এলো। ইউসূফের এক হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে লিখল,’আপনার উপস্থিতি, আপনার সঙ্গ আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। দয়া করে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।’ লেখা শেষে কলম মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিলো সূচনা। নুসরাতকে নিয়ে সে তখনই নিচে নামে। ইউসূফের রিয়াকশন কেমন হয়েছিল সেটি তার জানা নেই।
________
৩২.
পাবলিক প্লেসে এক নিরিবিলি জায়গায় বসে রয়েছে জয় এবং সূচনা। গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে পাখিরা বসে তাদের নিজস্ব ভাষায় ডাকাডাকি করছে। জয় একটার পর একটা ফিজিক্সের ম্যাথ বুঝিয়ে দিচ্ছে সূচনাকে। পড়ার দিকে সূচনার মনোযোগ কতটুকু ছিল জানা নেই; তবে জয়ের দিকে তার মনোনিবেশ ছিল শতগুণ। একটা করে ম্যাথ বোঝানো শেষ হলে জয় জিজ্ঞেস করে,’বুঝেছ?’
কখনো বুঝে আবার কখনো বা না বুঝেই সূচনা মাথা ঝাঁকায়। বই বন্ধ করে জয় বলে,’আজ এই পর্যন্তই। আবার কাল পাঁচটা বুঝিয়ে দেবো। তুমি আমার কাছে রেগুলার পড়লে আর প্রাইভেট পড়তে হবে না।’
সূচনা স্মিত হেসে খাতায় কী জানি লিখল। জয় দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিলে সূচনা খাতাসহ অন্যদিকে ঘুরে বসে। লেখা শেষ হলে খাতাটি জয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। লেখা ছিল,’আমি কথা বলতে পারি না, জবাব দিতে পারি না। আপনার বিরক্ত লাগে না?’
লেখাটি পড়ে গম্ভীর হয়ে গেল জয়। শঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সূচনা। তার দৃষ্টি প্রশ্নবিদ্ধ। কয়েক সেকেণ্ডের মতো চুপ করে থেকে জয় বলল,’এইযে তুমি কথা বলতে পারো না, অথচ তোমার সঙ্গে দেখা হলে আমিই সারাক্ষণ কথা বলি। তোমার বিরক্ত লাগে না?’
সূচনার দৃষ্টি স্থির। সে কথার মানে বুঝতে পেরেও বুঝতে পারছে না যেন। চোখে চোখ রাখল জয়। সূচনার ইচ্ছে হলো জয়কে একটু ঘাঁটাতে। সে কি অল্প হলেও ভিন্ন নাকি বাকি সবার মতো সেটি মন জানতে চাচ্ছে। জয়ের হাত থেকে খাতাটি নিয়ে লিখল,’আমি জানিনা আমি কতটা সুন্দর। তবে ছোটোবেলা থেকেই সকলের কাছ থেকে আমার সৌন্দর্যের প্রসংশা শুনে আসছি। এমনকি যেই মানুষটা আমায় পছন্দ করে না সেও আমার সৌন্দর্যের কথা বলে। আপনার পূর্বেও অনেকে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল। আমি জানতাম আমার বাহ্যিক রূপের মোহেই তারা বন্ধুত্ব করতে চাইত। কিন্তু আপনি আমায় চিনতেন না, জানতেন না। তবুও কেন আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছেন?’
এই লেখাটি পড়ার পর জয়ের ভাবভঙ্গি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়া হলে সে চট করে একটা প্রশ্ন করল,’ইনডিরেক্টলি তুমি জানতে চাচ্ছ, তুমি সুন্দর বলে আমি বন্ধুত্ব করেছি নাকি?’
সূচনা খাতায় লিখল,’যদি বলি হ্যাঁ?’
জয় নিরব হয়ে গেল। সূচনার বুক ধুকপুক করছে। কী উত্তর দেবে সে?
মাথা নত করে ছিল জয়। এবার সরাসরি সূচনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার রূপ, সৌন্দর্যকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। তোমার নীরবতাকেই আমি ভালোবেসে এসেছি।’
এক অজানা ভালোলাগার আবেশ যেন মুহূর্তেই সূচনাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। এ ভালোলাগা লিখে প্রকাশ করা যাবে না, বলে প্রকাশ করা যাবে না; শুধু মন দিয়ে অনুভব করতে হবে। জয় স্মিত হেসে বলল,’একটা গান শুনবে?’
সূচনা সম্মতি জানাল। জয় বলল,’আমি গাইব না কিন্তু। ফোন থেকে শোনাব। মানে আমি গানটা তোমায় ডেডিকেটেড করছি।’
সূচনার ইচ্ছে ছিল জয় নিজে তাকে গান শোনাবে। আচ্ছা তা না হোক, ডেডিকেটেড যে করছে এটাই বা কম কী? জয়ের ফোনের প্লে-লিস্ট থেকে গানটি ওপেন করে।
‘ঠিক এমন এভাবে
তুই থেকে যা স্বভাবে,
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই;
আর তুই ছাড়া গতি নেই।
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা
কথা দেয়া থাক,
গেলে যাবি চোখের বাইরে না।
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা
কথা দেয়া থাক,
গেলে যাবি চোখের বাইরে না।’
গান শেষ হওয়ার পূর্বেই জয় দাঁড়িয়ে পড়ে। সূচনাকে অন্যকিছু ভাবার সুযোগ দিলো না। এক হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’উঠো। ক্ষুধা লাগছে। কিছু খেয়ে আসি আগে।’
সূচনা খাতাটি বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো আগে। জয় এখনো হাত বাড়িয়ে রেখেছে। এক হাতে ব্যাগ এবং অন্য হাত দিয়ে সে জয়ের বাড়িয়ে রাখা হাতটি ধরে। তার চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। বসা থেকে দাঁড়াতেই কিছুটা দূরত্বে সে জারিফ এবং প্রীতিকে দেখতে পায়। ওরা দুজনও সূচনা এবং জয়কে দেখতে পেয়েছে। তবে জয় তখনো তাদের দেখেনি। সূচনার হাসি হাসি মুখটা গভীর তমসাবৃত তখন। ভয় হচ্ছিল। জারিফ এসে যদি আবার কোনো সিনক্রিয়েট করে? জয়ের ফোন আসে তখন। ফোন রিসিভ করে সূচনার হাত ধরেই জারিফ আর প্রীতিকে পাশ কাটিয়ে যায়। তবে মাঝে দূরত্ব থাকায় এবং সে ফোনে কথা বলাতে ব্যস্ত থাকায় ওদেরকে খেয়াল করেনি। সূচনার ভয় কিন্তু সত্যি হয়নি। জারিফ এমন কিছুই করেনি। সে তো বলেছিল সূচনার অশান্তিতে থাকার কারণ হবে না আর। গতকাল রাতে প্রীতির সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য এখানে ডেকেছিল স্যরি বলবে বলে। তবে সূচনাকে যে দেখতে পাবে, তাও আবার জয়ের সাথে এটা ভাবেনি। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে সূচনা এবং জারিফের চোখাচোখি হয়ে যায়। সূচনার চোখে ভীতি থাকলেও, জারিফের চোখে কী ছিল তা বোধ করি বলার ভাষা রাখে না।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। দু’দিন গল্প দিতে পারিনি, তাই আজ বড়ো পর্ব দিলাম। তবে এখনো একটা ব্যাড নিউজ আছে। ১৩ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর আমার একটা মডেল টেস্ট হবে। সিলেবাস এখনো কমপ্লিট হয়নি। সামনেই এইচএসসি। বুঝতেই পারছেন, কতটা ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বৃহস্পতি আর শুক্র এ দু’দিনে বাকি সিলেবাস যতটুকু পারা যায় কভার করতে হবে। তাই কাল থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত গল্প দিতে পারব না। সকলে ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই পর্বটি সম্পর্কে একটা মন্তব্য করে যাবেন।]