বিরহের নাম তুমি পর্ব-১১

0
507

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
২৭.
সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। হুড খোলা রিকশা বাতাসের তোড়ের সাথে সাঁই সাঁই করে পাল্লা দিয়ে চলছে। নির্বাক সূচনা আরও নির্বাক হয়ে পড়েছে যেন। জ্যামজটের ঢাকা-শহরের অপার সৌন্দর্য বোধ হয় রাতেই আবির্ভূত হয়। হালকা শীতল বাতাস, পাশে প্রিয় মানুষ। মন খুশি করার জন্য আর কী-ই বা লাগে?

ভাবনার মাঝে জয় প্রশ্ন করে বসল,’আইসক্রিম খাবে সূচনা?’
সূচনা মাথা নাড়াল। রিকশা একটা দোকানের সামনে থামিয়ে জয় গিয়ে দুটো কোণ আইসক্রিম নিয়ে আসে। সূচনার ভেতরের সর্বস্বজুড়ে শুধু বিস্ময়ের বসবাস এখন। সে কি আদতে কখনো ভেবেছিল, এমন একটা দিন তার জীবনে আসবে? সুখ সুখ অনুভূতি শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই ওদের। তবে গন্তব্যহীন যাত্রাও যে আনন্দের হতে পারে, তা আজ জয়ের সঙ্গে বের না হলে জানতে পারত না সূচনা। সে যেন অজানা এক সুখের সমুদ্রে বারংবার খাবি খাচ্ছে। রিকশা এসে থামে একটা বাড়ির সামনে। সূচনা বুঝতে পারল না, তাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জয় বলে,’নামো।’
সূচনা নামে। জয়কে অনুসরণ করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। ঘরের চৌকাঠ মাড়ানোর আগেই জয় ‘দিগন্ত’ বলে জোরে একটা হাঁক ছাড়ে। ঘরের ভেতর থেকে প্রত্যুত্তর আসে,’আসছি দা’ভাই।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ে দিগন্ত। জয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সূচনাকে দেখে তার চোখ দুটি লাড্ডুর ন্যায় গোল গোল হয়ে যায়। দিগন্তের এমন চাউনীতে বিব্রতবোধ করে সূচনা। সে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘কাকি কোথায় রে?’ জয়ের প্রশ্নে বিস্মিত ভাবটা কেটে যায় দিগন্তের। তবে সেটা এখনো পুরোপুরি নয়। এত সুন্দর মেয়েটা দা’ভাইয়ের কী হয়? সে এসব চিন্তা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বলল,’মা তো ঘরেই।’
‘কাকিকে ডাক।’
‘ডাকতে হবে না। আমি চলে এসেছি।’ দরজার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে কথাটি বললেন কাকি। তার হাতে বরণডালা। প্রদীপের আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সূচনা এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। কাকি হাসিমুখে বরণ করার জন্য ডালা সূচনার সামনে আনতেই ডান হাত দিয়ে ডালাটি আটকে ধরে জয়। কাকি ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তার চক্ষুদ্বয় বিরক্ততিতে কাদাকাদা হয়ে আছে। এমন অলুক্ষণে কাজ কেউ করে? জয় শীতলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,’এসব কী করছ কাকিমা?’
কাকি নাক-মুখ কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করলেন,’তার আগে তুই বল, তুই কী করলি? এভাবে কেউ বরণডালা আটকায়?’
‘তুমি বরণ কেন করছ?’
‘আশ্চর্য! বাড়িতে বউ আজ প্রথম আসছে। বরণ করব না?’
এ কথায় জয় এবং সূচনা দুজনেই ভড়কে যায়। জয় থতমত খেয়ে বলে,’কী আজব! ও আমার বউ হতে যাবে কেন?’
‘তাহলে ও কে? তোর সব মেয়ে বন্ধুদের আমি চিনি। তাছাড়া তোর সাথে তো আমার কথা হয়েছিল, তুই একদিন ওকে নিয়ে আসবি।’

সূচনা এবার বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকায়। সূচনার কথা কাকিকে সে কী বলেছিল? বুকের ভেতরটাতে কেমন হাতুড়ি পেটানো শব্দ হচ্ছে। জয় কিছু্ক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বুঝতে পারে, কাকি আসলে সূচনাকে অন্বেষা ভেবেছিল। একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। মলিনস্বরে বলে,’তোমার ভুল হচ্ছে কাকিমা। এটা অন্বেষা নয়।’
‘অন্বেষা নয়! তাহলে ও কে?’
‘সূচনা। আমার বন্ধু। অন্বেষার সঙ্গে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।’
এবার কাকি যেন একটু থামাল। মা মরা ছেলেটার গার্লফ্রেন্ডও ব্রেকাপও করে ফেলল? তবে তিনি হতাশ হলেন না। এক পর্যায়ে মনে মনে আনন্দিত হলেন। সূচনা মেয়েটি ওর বন্ধু। বন্ধু থেকে কি বউ হওয়া যায় না? মেয়েটি অসম্ভব সৌন্দর্যের অধিকারিণী। দেখামাত্রই তার দু’চোখ জুড়িয়ে গেছে। তিনি হাসিমুখে বললেন,’বন্ধু তাতে কী হলো রে? বরণ করতে তো অসুবিধে নেই।’
‘সূচনা মুসলিম!’ এ কথাটা যেন অনেক কষ্টে বের হলো তার কণ্ঠনালী থেকে। দিগন্ত এবং কাকিমা দুজনেই যেন প্রচণ্ড অবাক হলেন এই কথাটিতে। এমনটা হওয়া কি খুব জরুরী ছিল? কাকিমা পরিস্থিতি সামলাতে বললেন,’ও। আচ্ছা ওকে নিয়ে ভেতরে আয়।’

সূচনা দিগন্তর সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। কাকি খাবারের আয়োজন করছে। আর জয় কোথায় গিয়েছে জানা নেই। চুপচাপ বসে থাকতে দিগন্ত এবং সূচনা দুজনেরই অস্বস্তি লাগছিল। তাই কথার প্রসঙ্গ দিগন্তই তুলল। বলল,’দা’ভাই তাহলে আপনার কথাই বলেছিল।’
এতক্ষণ মাথা নত করে রেখেছিল সূচনা। এই কথা শোনার পর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দিগন্তর দিকে ফিরে তাকায়। দিগন্ত বলে চলল,’আপনার অনেক প্রসংশা শুনেছি দা’ভাইয়ের মুখে। এত এত গল্প শুনেছি যে, আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু এভাবে যে সেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে যাবে, তা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি।’
একটু থেমে আবার বলল,’জানেন, শুধু আমি নই। দা’ভাইয়ের কয়েকজন কাছের ফ্রেন্ডস রয়েছে। তাদেরকেও আপনার কথা বলেছে। আমার মতো কিন্তু ওরাও আপনাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে। যদি জানে, আপনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন তাহলে হুড়মুড়িয়ে এক্ষুণী চলে আসবে।’ এতটুকু বলে দিগন্ত হাসে। ওর হাসিতে তাল মিলিয়ে সূচনাও মৃদু হাসে। তবে তার মনের ভেতর চলছিল অন্যরকম কালবৈশাখীর ঝড়। জয় কেন সবার কাছে সূচনার কথা বলেছে? তার ভাবনার ঘোর শেষ হওয়ার আগেই জয় আর কাকি একসাথে ড্রয়িংরুমে আসে। কাকির হাতে ট্রে। তিনি ট্রে-টি টি-টেবিলের ওপর রাখলেন। সেখানে হরেক রকমের ফলমূল, মিষ্টি, দই,বিস্কুট আর চা রয়েছে।’

কাকি বসতে বসতে বললেন,’নাও, নাস্তা করো।’
সূচনার সংকোচবোধ হচ্ছিল। তবুও সে সংকোচ কাটিয়ে এক টুকরো আপেল হাতে তুলে নিল। দিগন্ত আর জয় বিস্কুট নিল। কাকি বললেন,’তারপর তোমার সম্পর্কে কিছু বলো। কোথায় থাকো, কী করো কিছুই তো জানিনা।’ সূচনার উদ্দেশ্যে কথাটি বললেন কাকি। সূচনা একবার জয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে হাতের নখ খুঁটতে থাকে। জয় তখন বলে,’সূচনা কথা বলতে পারে না কাকিমা!’
এবার যেন দিগন্ত এবং কাকির মাথায় বজ্রপাত হলো। এত সুন্দর মেয়েটা কথা বলতে পারে না? বিধাতা মেয়েটিকে ধরণীর সব সৌন্দর্য দু’হাত তুলে দিয়েছেন। কিন্তু দেননি শুধু একটু কথা বলার ক্ষমতা! ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট অনুভব করে তারা। জয় সূচনার অনেক বেশি গল্প করেছে এ কথা সত্য। তবে দিগন্ত কিংবা ওর কোনো বন্ধুর কাছেই এটা বলেনি যে, সূচনা মুসলিম এবং কথা বলতে পারে না। বিব্রতকর পরিস্থিতিটা কাটিয়ে উঠতে একটু বেগ পেতে হলো সকলকে। সাহায্য করল জয়-ই। সে বলল,’সূচনা আর দিগন্ত একই ক্লাসে পড়ে। মানে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। সায়েন্স নিয়ে পড়তেছে। আগে ওর চাচার বাড়িতে থেকেই পড়ত। তবে এখন হোস্টেলে থাকে।’
সূচনা চোরাচোখে তাকায় জয়ের দিকে। এই মানুষটা সবসময় সব বিপদে-আপদে, সময়ে-অসময়ে তাকে আগলে রাখে। আল্লাহ্ কি এজন্যই জয়কে শুভাকাঙ্ক্ষী করে পাঠিয়েছে? শুধুই শুভাকাঙ্ক্ষী; ভালোবাসার মানুষ হিসেবে নয়!

ওরা আরও কিছুক্ষণ গল্প করে। ওদিকে হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কাকি অনেক করে বলেছেন, রাতের খাবারটা খেয়ে যেতে। কিন্তু সময়ের অভাবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। হোস্টেলে আসার পথে জয়ের সম্পর্কে আরও কিছু জানতে পারে সে। জয় এখন স্টুডেন্ট। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। পাশাপাশি টুকটাক ফটোগ্রাফি করে। ফটোগ্রাফিকে সে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাইলেও বাবার এতে ঘোর আপত্তি। তিনি জয়ের এই কাজটিকে একদমই পছন্দ করেন না। যার দরুণ জয়, ফটোগ্রাফি লুকিয়ে করে।
_________
২৮.
শাশুড়ির সাথে হাতে হাতে কাজ করছে ভূমিকা। এমনিতে সে কখনো রান্নাঘরে প্রয়োজন ছাড়া আসে না। রাসেল ভূমিকে নিয়ে যাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে আছেন। কোনো রকম বাক্যব্যয় তিনি ভূমিকার সাথে করছেন না। রান্নার জন্য সবজি কাটছিলেন তিনি। ভূমিকা কণ্ঠ নিচু করে বলল,’আমাকে দিন মা। আমি কেটে দিচ্ছি।’
তিনি নিশ্চুপ রইলেন। ভূমিকা আবারও একই কথা বলল। এবার তিনি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,’এত আদিখ্যেতা দেখাতে হইব না। আমি নিজের কাম নিজেই করতে পারমু।’
‘আপনি কেন রেগে আছেন? আপনার ছেলে তো বলেছে আপনাকেও যেতে। চলুন না মা! আমরা সবাই একসাথে থাকব।’
তিনি কটমট করে তাকিয়ে বললেন,’দরদ উতলাইয়া উঠতাছে তোমার? তোমার পেটে পেটে যে শয়তানি হেইডা আমি ভালো কইরাই বুঝবার পারছি। তুমি আমার চক্ষের সামনে থেইকা যাও। বিরক্ত লাগতাছে আমার।’
ভূমিকা অনুনয় করে বোঝানোর চেষ্টা করল বার কয়েক। তিনি ক্ষিপ্র হয়ে বললেন,’তুমি কি যাইবা এইখান থেইকা? আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ হইতাছে।’
শাশুড়ির অমন রাগের তোপের মুখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ভূমি। বাধ্য হয়েই রান্নাঘর থেকে ফিরে এলো। কী থেকে যে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারল না।

ঘরে এসে বিছানায় বসামাত্র ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। রাসেল ম্যাসেজ করেছে ইমোতে।
‘সামনের মাসের মধ্যেই তোমার আসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ্। ভালোবাসি মিষ্টিবউ।’
ভূমির ঠোঁটের কোণে শান্তির একটা হাসি ফুঁটে ওঠে। ভালোবাসার মানুষটাকে সে সামনে থেকে দেখবে। কিছুদিন পর থেকে সে ঘুম থেকে উঠলেই রাসেলের মায়া মায়া মুখটা দেখতে পারবে। অন্যরকম সুখের দোলা তার মনের ঘরে কড়া নাড়তে থাকে।
বাড়ির কলিংবেলের দস্যিপনা শুরু হয় তখন। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে ভূমি দরজা খুলে দেয়। জারিফ এসেছে। ভূমির মুখে হাসি ফুঁটে ওঠে। কিন্তু জারিফকে খুবই বিধ্বস্ত এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ভূমি বলল,’ভেতরে আয়।’
জারিফ ভেতরে যেতে যেতে বলল,’তোমার ঘরে চলো।’
নিজের ঘরেই নিয়ে গেল জারিফকে। বলল,’তুই বোস। আমি আসছি।’
জারিফ বাঁধা দিয়ে বলল,’এখন খাবার-টাবার কিছু আনা লাগবে না। তুমি বসো। কথা আছে।’
জারিফের সঙ্গে জোরাজুরিতে লাভ হলো না। বসার পর ভূমি বলল,’কী এমন জরুরী কথা, বল শুনি।’
‘সূচনা হোস্টেলে থাকে তুমি জানো?’
ভূমি অবাক হয়ে বলল,’না তো!’
‘আব্বু তোমায় জানায়নি?’
‘না। কী হয়েছে?’
‘আমি রাগে মেরেছিলাম সূচনাকে। আব্বু এজন্য ওকে হোস্টেলে দিয়ে এসেছে।’
ভূমিকা কিছু্ক্ষণ চুপ করে থাকে। জারিফ নিঃসঙ্কোচে কীভাবে বলে ফেলল, সূচনাকে মেরেছে!
‘তুই ওর গায়ে হাত তুলেছিস কেন? মারার মতো এমন কী করেছিল?’
জারিফ কিছু্ক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবল সত্যি কথাটাই বলবে, নাকি বাড়িতে যে কথা বলেছিল ভূমিকে একই কথা বলবে!
____________
২৯.
রুমমেটরা সবাই বেশ স্বাভাবিকভাবেই সূচনাকে মেনে নিয়েছে। বাকি সবার মতো তাদের মধ্যেও একটা আক্ষেপ; এত সুন্দর মেয়েটা কথা বলতে পারে না? রুমে সূচনাসহ চারজন থাকে। এটা কলেজের কোনো হোস্টেল নয়। এখানে বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন পেশার মেয়ে,মহিলারা রয়েছে। কেউ চাকরী করে, কেউ বা পড়াশোনা করে। সূচনাদের রুমে একজন মাঝারী বয়সের মহিলা রয়েছে। নাম ফাতেমা আক্তার। বছর তিনেক হবে ডিভোর্স হয়েছে। এরপর আর বিয়ে করেনি। বাড়িতে বিয়ের জন্য জোরাজুরি করে বলে চাকরী করে আলাদা থাকে। আরেকজন ভার্সিটিতে পড়ার পাশাপাশি চাকরী করছে। নাম সাথী। সবচেয়ে ছোটো যে ওর নাম সুখী। ক্লাস টেনে পড়ে। সকলের সঙ্গেই অল্প সময়ে সূচনার সখ্যতা গড়ে ওঠে। নতুন জীবনের সূচনাটা সে মন দিয়ে উপভোগ করে।

ফাতেমা আক্তার সূচনাকে বললেন,’সাথী আর সুখী কিন্তু আমায় খালামনি ডাকে। তুমিও মনে মনে আমায় খালামনি ডাকবে কেমন?’
সূচনা স্মিত হেসে সায় দেয়। সাথী হাসতে হাসতে বলে,’একটা জিনিস কি খেয়াল করেছ খালামনি?’
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাতেমা জিজ্ঞেস করে,’কী?’
‘তোমার তিন মেয়ের নাম কিন্তুই ‘স’ দিয়ে। সাথী, সূচনা আর সুখী।’
তিনিও বিষয়টা খেয়াল করে উচ্ছস্বিত হয়ে বলেন,’তাই তো! যাক মানুষকে বললে তারাও বুঝতে পারবে তোরা আমার মেয়ে। তাই তোদের নামের প্রথম অক্ষরও এক।’
‘এখন থেকে তুমি সূচনা আপুকে বেশি ভালোবাসবে তাই না খালামনি?’ প্রশ্নটা করল সুখী। তার মুখটা হাসি হাসি। মেয়েটা কি এভাবেই হাসে সবসময়? হাসাই উচিত। তাহলেই না তার নামের সঠিক মর্মার্থ রক্ষা হবে। ফাতেমা কপট রাগ দেখিয়ে বলেন,’তুই যে হিংসুটে জানতাম না তো!’
‘ইশ! আমি হিংসুটে কেন হব?’
‘শোন, পরিবারের ছোটো সন্তানরা সবসময়েই আদরের থাকে বুঝলি? আর আমরা তো একটা পরিবারই।’
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাঁটল সাথী। নাকের পাটা ফুলিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,’ওহ আচ্ছা! আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি তাই না?’

ফাতেমা অসহায় ভঙ্গিতে কপাল চাপড়ান। এই তিনজনের কাণ্ড দেখে হেসে কুটিকুটি অবস্থা সূচনার। মানুষ তিনটে এত্ত ভালো কেন? ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয় তখন। সুখী গিয়ে দরজা খুলে দেয়। পারভীন শেখ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,’সূচনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ওকে নিচে যেতে বলো।’
কথা শেষ করেই তিনি চলে যান। বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ ব্যস্ত আছে। সুখী সূচনাকে পারভীন শেখের বলা কথাটাই বলল। চাচা এসেছে বুঝতে পারে সূচনা। সে উদগ্রীব হয়ে নিচে নামে। মেইন গেইট পার হয়ে বাইরে এসে থমকে দাঁড়ায়। চাচা তো আসেনি। সামনেই বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে জারিফ। চোখ দুটি ভীষণ ক্লান্ত তার। সূচনার হাসি হাসি মুখটা থেকে হাসি উবে যায়। সূচনাকে দেখতে পেয়ে সিগারেট মাটিতে ফেলে এগিয়ে আসে জারিফ। মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। তবে তারচেয়েও বেশি নাকে প্রবেশ করছে জারিফের পারফিউমের ঘ্রাণ। কতক্ষণ নিরব হয়ে জারিফ ওর দিকে তাকিয়ে ছিল জানা নেই। ভূমিকাকে সে কোনো উত্তর না দিয়ে, কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। ভূমিকা কী ভেবে বসে আছে সেটা তার জানা নেই। জানতেও চাচ্ছে না। সূচনার নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। কয়েক সেকেণ্ড পর জারিফ হুংকার দিয়ে বলে,’বুবির বাচ্চা! হোস্টেলে এসে খুব ভালো আছিস তাই না?’
সূচনা চমকে যায়। আশেপাশে তাকায় একবার। না কেউ নেই। তবে সে ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টিতে নিষ্পলকভাবে চেয়ে আছে জারিফের বিমর্ষ মুখটির দিকে। সুন্দর মানুষটার মুখে এখন সৌন্দর্যের পরিবর্তে মুখটি ভীষণ ম্লান দেখাচ্ছে। চোখ দুটি অস্থির এবং অস্বাভাবিক। সূচনাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জারিফ পূণরায় ধমক দিয়ে বলে উঠল,’তাকিয়ে আছিস কেন? কথা কানে যায় না? খুব ভালো আছিস তুই?’
সূচনা কেঁপে ওঠে। জারিফ বলে,’যা তোর ব্যাগপত্র সব নিয়ে আয়। তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি।’
সূচনা ভ্রুকুটি করে তাকায়। লম্বা শ্বাস ত্যাগ করে দু’হাতের ইশারায় বলে,’আমি হোস্টেল ছেড়ে কোথাও যাব না।’
মুহূর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করে জারিফের দু’চোখ। রাগে থরথর করে কাঁপছে তার ঠোঁট, হাত-পা। মুখের ওপর হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। বার কয়েক লম্বা শ্বাস নেয়। সূচনার হাত ধরে বলে,’আমি বলেছি তুই যাবি। এখনই যাবি, আমার সাথে।’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here