#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭
অদ্রি বিরক্ত হয়ে যখন এলার্ম ঘড়িটা একদম ধ্রুব’রর কানের কাছে নিয়ে বাজিয়ে দিলো, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা মানবীকে দেখে লাফিয়ে ওঠে বসলো। রেগে বলল,
— এসব কি করছো? মে’রে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?
অদ্রি মুচকি হেসে বলল,
— না। আন্টি ব্রেকফাস্টে ডেকেছেন বলেই এসেছি। দয়া করে এসে আমাকে উদ্ধার করুন!
ধ্রুব’র গলার স্বর নমনীয় হলো,
— অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে?
— জি, অনেকক্ষণ।
মা অপেক্ষা করছে শুনেই ধ্রুব চট করে ওঠে গেলো। অদ্রি শুধু অবাক হয়ে দেখলো ধ্রুব ওর কথার মাঝে কোনো বাকবিতণ্ডা না করে কি সুন্দর ফ্রেশ হতে চলে গেলো! যতই হোক, অদ্রি দেখেছে লোকটা তার
মায়ের ভালোবাসা পেতে অনেকখানিই ডেসপারেট! এমনকি এই নিয়ে ওর মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাবটা পর্যন্ত আছে। অদ্রির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। কতশত স্মৃতি, বকাঝকা, আদর-ভালোবাসা! অদ্রি কীভাবে মন থেকে সরাবে? নিজের জীবন আর পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে যদি মাকে ফিরিয়ে আনা যেতো অদ্রি তাহলে তাই করতো। মায়ের স্মৃতিগুলো ভেতরে ভেতরে ওকে শেষ করে দিচ্ছে!
ব্রেকফাস্ট টেবিলে শায়লা মোটামুটি স্বাভাবিক ব্যবহার করলন ধ্রুব’র সাথে। সেটা যে অদ্রিকে ঘর শেয়ার করার জন্য তা বেশ বুঝতে পারলো ধ্রুব। একটু ঘর।শেয়ার করার জন্য মা যদি ওর সাথে স্বাভাবিক হয় তাহলে তো ভালোই। মনে মনে স্বস্তি অনুভব করলো ধ্রুব। সকাল সকাল মনটা ভালো হয়ে গেলো। অদ্রি বসেছে ওর বিপরীতে। আধখোলা পনিটেইল, ফোলা চোখ, চেহারায় ঘুমন্ত একটা ভাব মিশে আছে। ঘাড়ের কাছ থেকে শার্টের কলারটাও খানিকটা সরে আছে, ওখানে কি একটা তিল দেখা যাচ্ছে? আশেপাশের মানুষগুলোকে বেমালুম ভুলে ধ্রুব বিবশ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। জরিনা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে শায়লাকে বলল,
— ভাইজানরে আজগে বেশি কইরা খাওন দিন খালাম্মা। খাওনে কোনো মনোযোগ নাই। অন্যদিকেই বেশি মনোযোগ কেন জানি!
ধ্রুব কেশে ওঠলো। প্রচন্ড রেগে চোখ রাঙালো ওকে। জরিনার মুখ এত বেশি চলে মাঝেমাঝে ধ্রুব’র ইচ্ছে করে কয়টা থাপ্পড় দিতে। ওর জন্য এদিকওদিক তাকিয়েও শান্তি নেই। সবকিছু ও খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করে নালিশ জানায় শায়লার কাছে। ধ্রুব নিজের খাবারে মন দিলো, কিন্তু অদ্রিকে লুকিয়ে লক্ষ্য করার সুযোগটা মিস করলো না। কিন্তু অদ্রির এসবে কোনো আগ্রহ নেই। ব্রেডে মাখন মেখে আস্তেধীরে খাচ্ছে, মাঝেমধ্যে কফির মগে চুমুক বসাচ্ছে। কোনোকিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই। ধ্রুব বুকের ভেতর আবারও সেই শেষ রাতের স্নিগ্ধ অনুভূতিটা টের পেলো!
আশফাক সাহেব দৈনিক পত্রিকা দেখছেন। ইদানীং শহরে ডেঙ্গু বাড়ায় সবাইকে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সতর্কবাণী প্রদান করা হচ্ছে৷ জরিনা ব্যাপারটা শুনে বলল,
— দিনকাল আর আগের মতো নাই খালু। কি যে শুরু হইছে দেশে। আমাগো গেরামেও ডেঙ্গু রোগীর অভাব নাই।
আশফাক সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
— তোর গ্রামেও ডেঙ্গু আছে নাকি?
জরিনা অবাক হওয়ার ভান করে উত্তর দিলো,
— আছে মানে? অনেক আছে! ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী।
শায়লা জরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আচ্ছা শোন, আমাদের বাগানের পেছনটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয় না। ধ্রুব’র ঘরটা তো ওদিকেই। একটু দেখিস তো ওদিকটা। কাল দেখলাম অনেক মশা আছে ওখানটায়।
জরিনা হেসে বলল,
— আইচ্ছা খালাম্মা।
বাগান পরিষ্কারের কথা শুনে অদ্রি চোখ তুলে চাইলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শায়লাকে জিজ্ঞেস করলো,
— আন্টি, আমিও বাগান পরিষ্কারে ওকে সাহায্য করতে চাই। এসব কাজ আমার খুব ভালো লাগে।
শায়লা প্রথমে রাজি হলো না। কিন্তু আশফাক সাহেব ইশারায় বুঝালেন ওকে কাজ করতে দিতে। যেহেতু সারাদিন বাসায় বসে বোরিং হয় তাই ব্যস্ত থাকলে হয়তো বোরিংনেস কাটবে ওর। শায়লা ব্যাপারটা বুঝে অদ্রিকে জিজ্ঞেস করলেন,
— তুই পারবি? সমস্যা হবে না তো?
অদ্রির ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠলো,
— অবশ্যই পারবো। কোনো সমস্যা হবে না।
— তুই তাহলে কাজ করতে পারিস?
— সব পারি আলহামদুলিল্লাহ!
— তা কি কি পারিস?
অদ্রি মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। আগ্রহ নিয়ে বলল,
— রান্নাবান্না, ঘর গোছানো সবই পারি। আমি কাজ করলে তোমরা কিন্তু কখনো না করবে না, ওকে? তোমাদের একদিন চিকেন করে খাওয়াবো।
শায়লা মানতে চাইলেন না এই কথা। তিনি চান এই বাড়িতে অদ্রির যাতে কোনোরকম কষ্ট না হয়। বাঁধা দিয়ে বললেন,
— তা খাওয়াবি। কিন্তু সবসময় কাজ করা…
অদ্রি শায়লার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,
— প্লিজ আন্টি। আমি নিজস্বতা হারাতে চাই না। তুমিই তো বলো এটা আমার বাড়ি, আমি কি নিজের বাড়িতে টুকটাক কাজ করতে পারি না?
এরপর শায়লার আর কিছু বলারর থাকতে
পারে না। আর সবসময় পুতুল হয়ে থাকতে কারই
বা ভালো লাগে? যেহেতু অদ্রিকে নিজের বৌমা’র
চেয়ে মেয়ে হিসেবেই বেশি আদর করেন তা-ই অদ্রির ইচ্ছে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। আশফাক সাহেব অদ্রির কথাবার্তা খুবই পছন্দ করলেন। একগাল হেসে বললেন,
— মাশাল্লাহ। তুই মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো।
সবাই প্রশংসা করতে লাগলো অদ্রির। শুনে ও খানিকটা লজ্জা পেলো। ধ্রুব এতক্ষণ আড়চোখে দেখছিলো অদ্রিকে। বেশ মনোযোগ দিয়ে ওর সব কথা শুনছিলো। ব্রেড চিবুতে চিবুতে মনে মনে বলল,
— সুপার ওম্যান!
ধীরেসুস্থে অদ্রি খাওয়া শেষ করলো। নিজের প্লেটটা নিয়ে রান্নাঘরে ধুতে গেলে জরিনা বাঁধা
দিয়ে বলল,
— আফনের ধুইতে হইবো না গো ভাবিজান। দেন আমারে দেন।
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
— আমি ধুলে কি সমস্যা?
— আফনে নতুন বৌ না? আমি কি এইটা হইতে দিতে পারি?
অদ্রি ভ্রু কুঁচকালো,
— শোনো, বাসায় আমি নিজের প্লেট নিজেই ধুতাম। তাহলে? এখানে ধুতে কি সমস্যা? আমি তো জানি আমি এ বাড়ির মেয়ে।
— এরপরেও…
— কোনো সমস্যা নেই। তুমি নিজের কাজ করো। সামান্য প্লেট আমি ধুয়ে নিচ্ছি। বাগান পরিষ্কার করতে গেলে আমাকে ডেকো, ওকে?
জরিনা হা হয়ে বলল,
— আফনে সত্যিই যাইবেন?
অদ্রির প্রচন্ড হাসি পেলো। এই বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য ওকে নিয়ে কতোটা কনসার্ন তা বুঝতে পারলো। ও হেসে বলল,
— আমাকে এলিয়েন ভেবো না প্লিজ। এসব তো স্বাভাবিক বিষয়। এরকম করলে আমার নিজেকে দূরের কেউ মনে হবে, বুঝলে?
জরিনা ওর কথা শুনে মাথা নাড়ালো। নতুন ভাবিকে ওর ঠিক কতোটা পছন্দ হয়েছে তা বলে বুঝাতে পারবে না। আজকালকার অনেক বউরা তো ঘরের কাজ দূর নিজের কাজটাই করতে চায় না। বাড়ির কাজের লোকের সাথেও এতোটা মিশে না,
কথাবার্তা বলতে চায় না। কেননা, তাদের স্ট্যাটাসে
সমস্যা হয়! কিন্তু এক্ষেত্রে অদ্রি একদম বিপরীত। একটু কম কথা বললেও আচরণ বেশ মার্জিত। আর এ ধরনের মেয়ে-বৌ’দের সবাই পছন্দ করে। ও অদ্রিকে হেসে হেসে বলল,
— আফনে যখন খাইতেছিলেন ভাইজানে আফনের দিকে যেমনে তাকায়ছিলো!
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
— কিভাবে তাকিয়েছিলো?
— ভাইজানে মনে হয় আফনের প্রেমে পইড়া গেছে। এমনে কইরা খালি প্রেমিকরাই চাইয়া থাকে।
অদ্রি হেসে বলল,
— ভুল ভাবছো। ওনার মতো কূটবুদ্ধির মানুষ আর যাইহোক প্রেমিক হতে পারে না।
জরিনা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
— কেন ভাবি? আমাগো ভাইজানে কি সুন্দর না দেখতে? অমন লম্বা-ফর্সা পোলাপান পুরা বাংলাদেশে নাই।
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলল,
— তাই নাকি? আমি তো সেভাবে খেয়াল করিনি।
জরিনা বিস্মিত হয়ে গেল,
— কন কি ভাবি? নিজের জামাইরে এতদিনেও খেয়াল কইরা দেহেন নাই? এইটাও সম্ভব? আমি হইলে প্রথম দিনই সব দেইখাটেইখা নিতাম। এই জরিনারে ঠকানো অত সোজা না।
অদ্রি হেসে ফেললো ওর কান্ড দেখে। ভাবুক কন্ঠে বলল,
— ঠকে গেলাম নাকি? খেয়াল করে দেখতে হবে
তো!
ব্রেকফাস্ট সেরে আশফাক সাহেব ধ্রুব’কে নিয়েই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে আশফাক সাহেব উন্নত চাকরি আর জীবনের উদ্দেশ্যে কানাডাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু সবসময় মন পড়ে থাকতো দেশে। কয়েক বছর পরপর দেশে বেড়াতে আসলেও তিনি আর শায়লা একসময় ঠিক করলেন দেশে নিজেদের মতো একটা বাড়ি করবেন, জীবনের বৃদ্ধ হওয়ার দিনগুলো সেখানেই কাটাবেন। একমাত্র ছেলে ধ্রুব। কানাডার পরিবেশে বড় হলেও দেশের শিক্ষা,সংস্কৃতি, ভাষা মোটামুটি সবই জানে। কিন্তু সে এদেশে সেটেল্ড হতে রাজি নয়। এতটুকু পর্যন্ত মানা গেলেও বিয়ে করতে চায় না জানার পর অভিভাবক
হিসেবে তারা খুব কষ্টই পেয়েছিলেন। বিয়ে করতে
না চাওয়ার একমাত্র কারণ হলো কারো প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এই তুচ্ছ কারণে
পুরো জীবন একলা কাটিয়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত হাস্যকর ছাড়া আরকিছুই নয়। তাই ওকে
একপ্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেই দেশে
নিয়ে এসেছিলো শায়লা। নিজেদের ব্যবসাও শুরু করেছে এখানেই। শুধুমাত্র ছেলের জীবন গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের এত তোড়জোড়।
সেজন্যই তো বিয়েটা এভাবে দেওয়া! কথাগুলো
ভেবে শায়লা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ছেলের চোখে আজ অন্যরকম কিছু দেখেছেন তিনি। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বারবার অদ্রিকে লক্ষ্য করছিলো!
শায়লা মুচকি হাসলেন। এবার যদি তার ছেলে
নিজের জীবন ও সঙ্গী নিয়ে একটু সিরিয়াস হয়
তাহলে তিনি নিশ্চিত হবেন।
অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষ করে আশফাক সাহেব-ধ্রুব বাড়ি ফিরলো। একটু দ্রুতই। অদ্রি আর জরিনা মেঝেতে বসে মুড়ি-চানাচুর, বাদাম খাচ্ছে। জরিনা অদ্রিকে ওর গ্রামের ডেঙ্গু কাহিনী শোনাচ্ছিলো। অদ্রি মজা পেয়ে হাসছিলো। মুঠোভর্তি মুড়ি মুখে দিতেই দরজা খুলে ধ্রুব ঢুকলো। দরজার কাছে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সারা ঘরময় বাদামের খোসা ছড়িয়ে আছে, এদিকওদিক কলার খোসা, মুড়ি ছিটিয়ে আছে। অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরের বেহাল দশা দেখে মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণা করলো। জরিনা ওকে দেখেই জিভ কাটলো। নিচু স্বরে অদ্রিকে বলল,
— ভাইজানে এইসব পছন্দ করে না।
অদ্রিও ভড়কালো। বলল,
— এখন কি করবো? চলো পরিষ্কার করে ফেলি।
— ওঠেন। আমি ঝাড়ু নিয়ে আসি।
— দ্রুত যাও। আমি বিছানাটা করে দিচ্ছি। ইশ, কি কান্ড!
জরিনা ওর বলার আগেই ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে ঝাড়ু আনতে ছুট লাগালো। অদ্রি কি করবে ভেবে না পেয়ে ধ্রুব’র দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসে বলল,
— এক্ষুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল,
— আমার ঘর এত নোংরা হয়ে থাকার কারণ কি? দু’জনে মিলে নাচানাচি করছিলে নাকি? আমি কিন্তু এসব একদম এলাও করবো না।
— আমরা তো গল্প করছিলাম, অন্যকিছু না।
ধ্রুব মুখ গোঁজ করে বলল,
— দ্রুত পরিষ্কার করো সবকিছু। ডিজগাস্টিং!
এরপর বেরিয়ে যেতে নিলেই অদ্রি হঠাৎ করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ধ্রুব হকচকিয়ে গেলো। হলো কি মেয়েটার? অদ্রি কিছুক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট উল্টালো। আনমনে বলল,
— উহুম! ঠকে যাইনি। তবে আহামরি এমন কিছুও
নেই আপনার মধ্যে।
ধ্রুব ওর এমন আচরণ দেখে কেশে ওঠলো!
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মন্তব্য জানাতে আপনারা এতো কার্পণ্য করেন কেন? আজ অন্তত দু’জনের পরিবর্তন কেমন লাগছে সেটাই একবাক্যে জানাবেন।]
চলবে…