বিবর্ণ_বসন্ত ষষ্ঠ পর্ব

0
508

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
ষষ্ঠ পর্ব

বারো.
রাত প্রায় সাড়ে দশটা তখন, আবিদ একটা বই নিয়ে পড়ছিল, এইসময় ওর নোকিয়া এগারো’শ মডেলের ফোনটা ক্যাটক্যাটিয়ে বেজে উঠে। রিসিভ করার পর ওপারে মায়ের গলা শোনা যায়,

“কেমন আছিস, বাবা? কই তুই এখন? এরকম ভবঘুরের মতো আর কতদিন চলবে? কিছু একটা তো কর!”
শেষের দিকে মায়ের গলায় কিছুটা ক্ষোভের আভাস ছিল।

“মা, একসাথে এতগুলা প্রশ্ন করলে আমি উত্তর কিভাবে দেই বলতো?” হেসে বলে উঠে আবিদ।

“তোর উত্তর আমি জানি। শোন তোর বাবার রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তোর মধ্যে কোনো হেলদোল নেই! একটা ক্যামেরা পাইছিস, সেটা নিয়ে টইটই করে সারা দুনিয়া ঘুরতেছিস। সংসারের দিকে তোর নজর দেয়ার সময়ই হলো না এখনো!” শেষের দিকে গলা ধরে এলো মায়ের।

“মা, মা, মা… শোন না, আর কয়েকটা দিন, প্লিজ! এরপর যদি কিছু না হয় তবে সুবোধ বালকের মতো চাকরি খুঁজতে শুরু করব। তোমার সংসারেও মনোযোগ দেব! মাত্রই তো পড়াশোনা শেষ করলাম, কিছুদিন একটু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি না?” ভীষণ আদুরে গলায় বলে ও।

“তোর যা ইচ্ছা তাই কর। আমি আর কয়দিন!”
“মা, এসব কী বলো তুমি? নাতি নাতনিকে বিয়ে দেয়ার আগে এসব বাজে কথা মাথায়ও আনবে না, বুঝছো?”
“ছেলে আমার সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করতে চলেছে, নাতি-নাতনীদের দেখার কপাল কী আর আছে? কী রে! পেয়েছিস নাকি কারও দেখা? সন্ন্যাসী থেকে গৃহী হবার চিন্তা হঠাৎ?” মায়ের গলায় কৌতুহল আর দুষ্টু হাসির আভাস!

কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো আবিদ, “একজনকে পেয়েছি! বাসায় ফিরে তোমাকে দেখাব! তুমি দেখলে তোমারও ওকে খুব ভালো লাগবে।” ইতস্ততভাবে লজ্জাবনত গলায় বলে ও।
মা অসম্ভব খুশি হলেন, সন্তানের খুশি মাকে স্পর্শ করে ভীষণভাবে, মনে মনে দোয়া করলেন, এ খুশি যেন চিরস্থায়ী হয়!

মুঠোফোন রাখার পরেও কিছুক্ষণ স্থায়ী ছিল লজ্জাটা, যতই বন্ধুত্ব আর খুঁনসুটির সম্পর্ক থাকুক, মা তো, কিছুটা সংকোচ তাই রয়েই গেছে।

আবিদ সব জায়গায় এক বা দুই সপ্তাহ থেকে ছুট লাগায় অন্য জায়গায়, কিন্তু এখানে মাস পেরিয়ে গেছে, তবুও যাবার নাম মুখে নিচ্ছে না। অপার্থিব জিনিস যে পেয়ে গেছে এখানে! অতসী!

অতসীর সংস্পর্শে সময় কখন যে কেটে যায়, সেটাই খেয়াল থাকে না ওর!

তেমনি এক বিকেলে ওদের প্রিয় জায়গায় বসে কথা বলছিল। অতসীর হাতে আবিদের ক্যামেরা, বায়না ধরেছে ফটোগ্রাফি শিখবে। তবেই না হবে সমানে সমান!
আবিদ ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল,
“তুমি যা আছ যেরকম আছ, তাই আমার!”
কিন্তু কিছুতেই মানবেনা ও। বাধ্য হয়ে শেখাচ্ছিল।

সহসা সেখানে তিনজন লোক চলে এলো। লোকগুলোকে খুব একটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না ওর। বিশেষ করে একজনের মধ্যে হামবড়া ভাব। ওদের দেখে অতসী কিছুটা তটস্থ হলো।

“অতসী না? চেয়ারম্যান কাকার মেয়ে? তা এইখানে কী কাজ তুমার, তাও একটা অপরিচিত ছেলের সাথে?” কিছুটা কড়া মেজাজে বলে কথাগুলো, উচ্চারণে কিছুটা আঞ্চলিকতা রয়েছে।

“জ্বি, আমি ছবি তোলা শিখতেছিলাম।” চোখ নামিয়ে অতসীর উত্তর।

আবিদের হাতে ক্যামেরা দিয়ে কোনোরকমে “আসি” বলেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পালালো বলা যায়। আবিদ কিছুটা অবাক হলো, অতসীকে এই দেড়মাসে যতটা চিনেছে, ও কখনো কাউকে পরোয়া করেনি। আজ এতটা ভয় পেয়েছে কেন সেটাই ভাবছে। সম্বিৎ ফিরল লোকটার কথায়,

“আমি জাকি, এইখানকার এমপির ছেলে, পাশের গ্রামেই থাকি। সবাই আমারে একনামে চিনে। তুমি অতিথি পাখি, কয়েক দিন থাকো, ঘুরাঘুরি করবা এরপরে যাবাগা। খামাখা এই এলাকার মেয়েগুলার সাথে ভাব করার চেষ্টা করতেছ কিসের জন্যে?”

দাঁতের সাথে দাঁত চেপে হুমকির সুরে কথাগুলো বলে থামল লোকটা। পড়াশোনা খুব একটা করেছে বলে মনে হয় না। অতি আদরে নষ্ট পুত্র। বয়স ত্রিশের কোঠা পেরিয়েছে মনে হয়। অত্যন্ত গোঁয়ার ধরনের লোক।

আবিদ প্রচন্ড রেগে গেলেও স্বাভাবিক গলায় বলে, “দেখুন, আমার কী করা উচিৎ আর কী নয় সেটা আমি খুব ভালো জানি। সেসব নিয়ে জ্ঞান না দিলেই ভালো হবে। আর বন্ধুত্ব করা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়।”
ঝামেলা বাড়াতে ইচ্ছে করল না বলে কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করল, কিছুটা যাবার পরেই শুনতে পেল,

“খালি যদি আরেকদিন দেখি তাইলে ওর একদিন কী আমার একদিন!” সাগরেদদের বলছিল জাকি।

আবিদ অতসীর কাছ থেকে জেনেছিল জাকি খুব খারাপ লোক, ক্ষমতার প্রভাবে যা খুশি তাই করে বেড়ায়। কেউ কিচ্ছু বলার সাহস পায়না। অতসীকে নিয়ে কিছুটা ভয় পায় ও, যেরকম লোক, কোনো ক্ষতি না করে ফেলে। কিন্তু আরও কিছুদিন চলে গেলেও সব স্বাভাবিক থাকায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও, এরপর ভুলে যায় সব।

তেরো.
দুমাস কেটে যায় স্বপ্ন আর ঘোরে ভর করে, এবার বাস্তবতার আঁচড় পরল বলে! তীব্র আবেগ আর ভালোবাসায় কখন যে মেঘে মেঘে এতটা বেলা হয়ে গেছে টেরই পায়নি ওরা। আবিদ দেশের বাইরে কয়েক জায়গায় ওর তোলা কিছু ছবি জমা দিয়েছিল, সিভিসহ। কানাডা থেকে ডাক এসেছে ওর।
ওখান থেকে কয়েকদিন আগেই ডাক এসেছে, কিন্তু পোস্ট অফিসে কিছুদিন পরে ছিল অবহেলায়। তাই হাতে পেতে দেরী হয়ে গেছে৷ যখন ওদের বাসায় এটা এসে পৌঁছে, তখন হাতে সময় মাত্র একমাস। ভিসা, পাসপোর্ট সহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে সময় লেগেই যাবে, তাই হুট করেই চলে আসতে হয়। হাজার হোক এটা ওর একটা স্বপ্ন। স্যালারি যথেষ্ট ভালো, সুযোগ সুবিধাও মন্দ নয় একেবারে শুরু হিসেবে, সাথে খ্যাতি তো আসবেই।

অতসী কিছুটা ভেঙে পরলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বিদায় দেয়,
“আর দেখা হবে না আমাদের?”
“আরে, দেখা কেন হবে না? আমি কি এখনি যাচ্ছি নাকি! কিছু ফরমালিটিজ বাকি, এসব শেষ করে তারপর না যাব। সব গুছিয়ে নিয়ে যাবার আগে আমি তো আসবই, তখন তো আমাদের দেখা হচ্ছেই। ভেঙে পরো না, প্লিজ!”

অতসীর দ্বিধান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে মন কেমন যেন করে উঠে ওর। মনে হচ্ছে সব ঠিক থাকবেতো! ভেতর থেকে কেউ যেন সতর্কবার্তা দিচ্ছে বারবার। পরিবারের প্রতি ওর কিছু দ্বায়িত্ব আছে, সাথে নিজের পায়ে না দাঁড়ালে অতসীর বাবার কাছে ওর হাত চাইবে কীভাবে! এসব সাতপাঁচ ভেবে দ্বিধা, সংকোচ যেটুকু ছিল কাটিয়ে উঠে পা বাড়ায় আপন গন্তব্যে।

সব গুছিয়ে নিতে নিতেই সময় গড়িয়ে যায়, দেশ ছাড়ার তিনদিন আগে দেখা করতে আসে অতসীর সাথে। কিন্তু ওর যে উদ্ভাসিত স্নিগ্ধ হাসিমুখ সেখানে কোথাও বিষাদের ছায়া দেখেছিল যেন! অথচ জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর মেলেনি,

“তুমি চলে যাবে তো, তাই মন খারাপ। আর কিছু নয়।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে দ্বিধান্বিত স্বরে বলে,
“আচ্ছা, না গেলে হয়না?”

আবিদ আশ্বাস দেয়, “তুমি আমার জন্য দুটো বছর অপেক্ষা করতে পারবে না? আমি তোমাকে কথা দিলাম, যদি বেঁচে থাকি ইনশাআল্লাহ, তবে তোমার কাছেই ফিরব। আমাদের সারাজীবন একসাথে থাকার বন্দোবস্ত করতেই তো যাচ্ছি নাকি?”

তবুও যেন শান্তনা পায়নি ও “যদি হারিয়ে যাই, এই সময়ের মধ্যে। যদি খারাপ কিছু হয়, বিয়ে দিয়ে দেয় যদি!” কাতর গলায় অতসী বলে, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

আবিদ হেসে বলেছিল, “বিয়ে কেন দিয়ে দেবে, তুমি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে, পড়াশোনা করবে খুব মনোযোগ দিয়ে। দুই বছর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে।” প্রবোধ দেয় আবিদ।

“চল, আমরা বিয়ে করে ফেলি, তোমাদের বাসায় আমি থাকলাম নাহয়।” ওর গলায় তীব্র অস্থিরতা।

“বিয়ে! অতসী, এভাবে খামখেয়ালি করে বিয়ে হয় নাকি! আমি ফিরে এলে তোমার পরিবার আমার পরিবার একসাথে বসে আয়োজন করে বিয়ে দেবে আমাদের। এখন একটা বেকার ছেলের কাছে কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে তুলে দেবেন না। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবো।”

মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে আবিদ। আবিদের কাঁধে মাথা রেখে ব্যাকুল হয়ে ও বলে, “আমার পরিবারের কথা বাদ দাও, আমরা লুকিয়ে বিয়ে করি, পরে তোমার বাবা-মাকে বললে তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন।” নাছোড়বান্দা অতসী।

ওর মনে তখন কী চলছে সেটা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত আবিদ তবে হয়তো এই প্রবল আহবান এড়িয়ে যেতে পারতো না!
আবিদ ওর মাথা দু’হাতে তুলে একটা হাত ওর গালে রেখে বলেছিল,

“পাগলামি করো না, অতসী। প্লিজ, বোঝার চেষ্টা কর। আমার উপরে একটু বিশ্বাস রাখো। আমি ফিরবই।”

দৃঢ় গলায় নিশ্চয়তা দেবার চেষ্টা করে ও, ততক্ষণে নিজেও ভেঙে পড়েছে প্রায়। অতসীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, অতল আহবানে ডাকছে ওকে, চোখের জলে যেন ঝরে পরছিল সহস্র আকুতি আর অজস্র ভালোবাসা। কিন্তু ওর তখন সে ভালোবাসা হাত বাড়িয়ে নেবার অবসর নেই। দুজনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নিয়ে নেয় বিদায়! বারবার ফিরে ফিরে দেখছিল সেই কান্নাভেজা তুমুল আরাধ্য মুখটা।

কে ভাবতে পেরেছিল সেটাই ছিল ওদের শেষ দেখা। পরে কত অগণিত বার যে আফসোসে দগ্ধ হয়েছে, তা আর কখনোই পিছু ছাড়েনি। অতসীর প্রবল আহবানের আড়ালের সত্যিটা ও জানতে পেরেছিল অনেক পরে যখন বছর দুয়েক পরে ফিরেছিল হৃদয়ে এতদিনের গড়া ভালোবাসার পূর্নতা দিতে। কিন্তু ততদিনে সব শেষ!

কোনো এক কালবৈশাখী রুদ্রঝড় সব ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তাসের ঘরের মত ভেঙে পরেছিল এতদিনের সাজানো রঙিন স্বপ্ন। কী আশ্চর্য, যখন ওর জীবনে অতসী এসেছিল, সেটাও বসন্তই ছিল! কী রঙিনই না ছিল সে বসন্ত!

আর অন্য আরেক বসন্ত ওকে এক নিমেষে একেবারে সর্বহারা, নিঃস্ব করে দিয়েছিল! মুখোমুখি করেছিল এক ভয়ানক নির্মম সত্যের। কি ভীষণ বিবর্ণ সে বসন্ত!
……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here