#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃদিশা মনি
আলো জোনাকির হাত ধরে ঢাকা শহরে পা রাখে। ট্রেন থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে নামে তারা। ভাগ্যের কি পরিহাস একদিন এই শহর থেকেই নিজের বাড়িতে আলোকে ফিরে যেতে হয়েছিল আশ্রয়ের খোঁজে। আজ আবার নিজের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে আসতে হলো।
আলো এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছে যে এত বড় শহরে তারা কোথায় থাকবে। এখানে তাদের আপন বলতে যে কেউ নেই। জোনাকি বুঝতে পারে আলো কি ভাবছে।
‘যাদের কেউ নেই তাদের আল্লাহ আছে আলো। আমাদের কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন চল আমার সাথে। আজকের রাতটা নাহয় স্টেশন বসেই কা’টিয়ে দেই।’
আলো মৃদু হাসে। এই অনিশ্চিত জীবনে এখন তাদের কিছুই করার নেই। আলোর ঘুম আসছিল না। জোনাকি বলে,
‘তোর ঘুম আসছেনা তাইনা? তাহলে চল আমি তোকে ছোটবেলায় যেমন গল্প শোনাতাম তেমন গল্প শোনাই।’
‘এখন আর আমি ছোট নই আপু। যখন ছোট ছিলাম তখন রাজপুত্র রাজকন্যার গল্পগুলো শুনে খুব ভালো লাগত। এসব গল্প শুনে আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমার জীবনেও এরকম রাজপুত্র আসবে। এখন আমি বুঝতে পেরেছি বাস্তবতা আসলে কি। আমার জীবনের বাস্তবতা হলো বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়া।’
‘একটু ভালো চিন্তাভাবনা কর আলো। এমন কেউ তোর জীবনে আসতে পারে যে তোকে আলোকিত করবে। তোর বিবর্ণ আলোকবর্ষে রং নিয়ে আসবে।’
‘বেচে থাকব কিনা তারই নিশ্চয়তা নেই আর তুমি আমায় এসব স্বপ্ন দেখাচ্ছ।’
‘ধূর পাগলী আমরা বাচবোনা কেন? আমরা অনেক ভালোভাবে বাচব। আমি ঠিক করেছি তোকে এখানকার একটি ভার্সিটিতে ভর্তি করাবো। ইন্টার পাশ করার পর তুই আর পড়লি না। তোকে আবার পড়তে হবে আলো। নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। মাথা নিচু করে আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছে। আমি চাই মাথা উচু করে তুই আবার ফিরে যাস।’
‘শুধু আমার কথা বলছ কেন আপু? তুমি আর পড়বেনা?’
‘কি যে বলিস তুই। আমি আবার কখন ভালো ছাত্রী ছিলাম। কোনরকম টেনেটুনে পাস করতাম। সেখানে তুই এ প্লাস পেয়ে ইন্টার পাস করেছিস। বিয়ে না করে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে আজ তোর অবস্থা এমন হতো না। আমি দেখি যদি কোন কাজ পাই। তুই এখন ঘুমা।’
আলো হাসে। জোনাকি মোটেও খারাপ ছাত্রী নয়। এটা ঠিক আলো অনেক মেধাবী ছাত্রী। তবে জোনাকিও পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিল।
২৫.
স্টেশনজুড়ে ভিড় বাড়তে থাকে। আলোকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে জোনাকি। ভোরের আলো ফুটেছে আরো অনেক আগেই। আলো জোনাকিকে দেখে জোনাকিকে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল।
‘কি হয়েছে আপু? তোকে এরকম লাগছে কেন?’
‘কিছু না চল আমাদের যেতে হবে।’
‘কোথায় যাবো আমরা?’
‘কাল রাতে একজন মহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। উনি আমাকে নিজের ঠিকানা দিয়েছেন প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করতে বলেছেন। এখন তার কাছেই যাব চল।’
আলো জোনাকির কথা শুনে উঠে পড়ে। জোনাকির সাথে যেতে থাকে। জোনাকিকে দেখে কয়েকজন বলাবলি করে,
‘এটা সেই মেয়েটা না? কাল রাতে ছিনতাইকারীর হাত থেকে যে একজন মহিলার ব্যাগ বাচিয়ে আনল। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে। একা কিরকম নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে ছুটে গেলো। ছিনতাইকারীটা তো মেয়েটার বড় কোন ক্ষতি করে দিত যদি আরো কয়েকজন সেখানে চলে না আসত।’
‘হুম। কাল দেখলাম তো যেই মহিলার ব্যাগ উদ্ধার করে দিল তিনি ওকে টাকা দিতে চাইলে বলল কোন সাহায্য লাগবে না। তখন হাতে কার্ড দিয়ে চলে গেল। মেয়েগুলো মনে হচ্ছে খুব অসহায়।’
জোনাকি একটি সিএনজি দাড় করালো। আলোকে নিয়ে সেই সিএনজিতে উঠে নির্দিষ্ট ঠিকানায় যেতে বলল।
ঠিকানায় পৌছে তারা দেখলো দুইতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই অবস্থা আছে। জোনাকি বাড়ির ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান তাকে আটকে দেয়। জোনাকি তার কাছে থাকা কার্ড দেখিয়ে বলে,
‘সুমনা ম্যাম আমাদের আসতে বলেছেন।’
তখন দারোয়ান তাদের ভিতরে যেতে দেয়। বাড়ির ভেতরে গিয়ে তারা দেখে বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা না সুন্দর ভিতরে তার থেকেও বেশি সুন্দর। আলো চকিত হয়ে যায় বাগান দেখে। কত সুন্দর বাগান। তাতে রঙ বেরঙের কত ফুল। আলো একটি ফুল ছি’ড়তে গেলে মালী এসে বলে,
‘কি করছেন এটা বর্ণ ভাইয়ের অনেক পছন্দের ফুল। এটা ছি’ড়বেন না।’
বর্ণ নামটা শুনে তারা দুজনেই অবাক হয়। আলো ভাবতে থাকে এই বর্ণ কে হতে পারে? জোনাকির কথায় আলোর ভাবনায় বিচ্যুতি হয়। জোনাকির সাথে বাড়ির ভিতরে যায় তারা। কলিং বেজ বাজানোর অনেকক্ষণ পরও যখন কেউ আসেনা তখন আলো দ্বিতীয়বার কলিং বেল বাজায়।
এবার একজন বেশ মোটাসোটা মহিলা এসে দরজা খুলে দেয়। আলো আর জোনাকিকে দেখে তিনি ভ্রু কুচকে বলেন,
‘কি চাই?’
‘আমরা আসলে সুমনা ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘ম্যাম এখন ব্যস্ত আছে। কোন ভি’ক্ষে’টি’ক্ষে দিতে পারবে না যাও এখান থেকে।’
কথাটা বলে তাদের মুখের উপরই দরজা লাগিয়ে দেয় জরিনা। জরিনা এই বাড়ির কাজের লোক। সবাই তাকে পরিবারের লোক ভাবে। আর এটাতেই তার খুব অহংকার। অহংকারে মাটিতে পা ফেলার উপায় নেই।
জরিনা দরজা লাগানোর পরপরই সুমনা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। এসেই জরিনাকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কলিং বেলের শব্দ শুনলাম কে এসেছিল?’
‘দুটো মেয়ে এসেছিল। বলল আপনার সাথে দেখা করতে চায়। ওদের দেখে তো আমার ভিক্ষু’কই মনে হলো। কেমন নোংরা জামাকাপড় পরা। তাই বললাম চলে যেতে।’
‘তুমিও না জরিনা। আমার সাথে কাল স্টেশনে একটা মেয়ের দেখা হয়েছিল। মেয়েটা আমায় কত সাহায্য করল। ওকে আমি আমার ঠিকানা দিয়েছি। মেয়েটা খুব অসহায় সাথে ওর বোনও আসে। ওরা তো আসতে পারে। তুমি যাও দরজাটা খুলে দাও।’
জরিনা বিড়বিড় করতে করতে দরজাটা গিয়ে খুলে দেয়।
২৬.
আলো এতক্ষণ জোনাকির সাথে রাগারাগি করছিল। এভাবে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় যে তার সম্মানে লেগেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
জরিনা দরজা খুলে মুখে ভেংচি কে’টে বলে,
‘ম্যাম তোমাদের ভিতরে ডাকছে। চলে এসো।’
জোনাকি যেতে চাইলে আলো বাধা দিয়ে বলে,
‘কোথাও যাওয়ার দরকার নেই আপু। আমাদের প্রথমে এত অপমান করল ভিক্ষুক বলল এখন আবার কোন মুখে যাব। চল আমরা ফিরে যাই। না খেয়ে ম’রে যাব তবু অপমানিত হবো না।’
‘মাথাটা একটু ঠান্ডা কর আলো। এখন আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে এত সম্মান নিয়ে ভাবলে চলবে না। চুপচাপ চল আমার সাথে।’
আলো কিছু বলতে চাইছিল। জোনাকি তার কোন কথা না শুনে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। সুমনা সোফায় বসে নিউজ পেপার পড়ছিল। জোনাকি তার সামনে গিয়ে বলে,
‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি সেই মেয়েটা না যে কাল রাতে আমায় সাহায্য করেছিলে। কি যেন নাম তোমার,,,,জোনাকি রাইট?’
‘জ্বি ম্যাডাম। আর আমার সাথে যাকে দেখছেন ও হলো আমার বোন আলো।’
‘তোমরা কি ঢাকার স্থানীয়? নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছ?’
‘আমরা ঢাকার নই। আমাদের বাড়ি জামালপুর। খুব অসহায় হয়ে ঢাকায় এসেছি একটু আশ্রয়ের খোঁজে।’
‘বুঝলাম। তো ঢাকায় কি তোমাদের চেনাজানা কেউ আছে?’
‘না নেই।’
‘তাহলে এখানে কোথায় থাকবে তোমরা? আর কি করবে?’
জোনাকি কিছু বলতে পারে না। সুমনা তখন বুঝতে পারে তাদের অবস্থা।
‘তুমি যেহেতু আমার উপকার করেছ তাই আমিও তোমার উপকার করতে চাই। আমার ঐ ব্যাগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল যেগুলো চু’রি হয়ে গেলে অনেক সমস্যা হতো। তোমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব। এখন আপাতত তোমরা রেস্ট নাও। জরিনা তুমি ওদের গেস্ট রুমে নিয়ে যাও।’
জরিনা ইতস্তত হয়ে বলে,
‘ওরা তো অতিথি নয় তাহলে গেস্ট রুমে কেন থাকবে?’
‘বেশি প্রশ্ন না করে তোমায় যা বলছি তাই করো। নিয়ে যাও ওদের।’
জরিনা খুব রেগে যায়। এই মেয়েগুলোর জন্য তাকে এত কথা শুনতে হলো। মনে মনে তাদের অনেক গালি দিয়েও মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলে,
‘চলো আমার সাথে তোমাদের গেস্ট রুমে নিয়ে যাই।’
আলো ও জোনাকি জরিনার সাথে গেস্টরুমের দিকে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় আলোর চোখ আটকে যায় দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে। আলোকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জরিনা বলে,
‘এটা এই বাড়ির ছেলে বর্ষর ছবি।’
বর্ষ নামটা শুনে আলোর মনে অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
>>আসসালামু আলাইকুম গল্পটা নতুন মোড় নিয়েছে ধৈর্য সহকারে পড়বেন। খারাপ লাগবে না ইনশাআল্লাহ। সবাই একট্টু গঠনমূলক মন্তব্য করবেন 🥺🥺