বিয়ের সাত দিনের মাথায় কোনো অজানা কারনে জেমিকে ব্লেট দিয়ে নির্মম ভাবে আঘাত করছে ওর স্বামী জায়ান। জেমি ব্যাথায় ছটফট করছে। ওর শাশুড়ি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পান মুখে দিতে দিতে বললো…..
—এই অনুক্ষণে মেয়েটা বাড়িতে পা দিতে না দিতেই বাড়িতে অশান্তি শুরু হলো। বাপের বাড়ির থেইকা কিছু শেখাইয়া পাঠায় নাই। খালি শেখাইছে খাইতে।
জায়ান কয়েকবার আঘাত করে ব্লেট টা ছুড়ে মেরে দিয়ে জেমির গাল চেপে বলে উঠলো…..
–এইটা আমার বাড়ি আর আমার বাড়িতে থাকতে গেলে আমার মন মতো থাকতে হবে, না হয় ফলাফল এর থেকেও খারাপ হবে বুঝতে পেরেছো।
বলেই হন হন করে বেড়িয়ে চলে গেলো। জেমি এখনো নিচে পড়ে আছে। শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে গেছে মুহূর্তেই। ওর চোখ অনবরত পানি ঝড়ছে। যেই মেয়েটার গায়ে ওর বাবা মা আজ অব্দি হাত তুলেনি সেই মেয়েটাই আজ এতটা ব্যাথা মুখ বুঝে সহ্য করছে। জেমি আর জায়ান ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো দুজন।জায়ান কখনো জেমির চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না আর সেই জায়ান এই আজ নির্মম ভাবে আঘাত করলো জেমিকে। জেমি কোনো রকম উঠে দাড়িয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওর শাশুড়ি আদেশ স্বরে বলে উঠলো…..
—এইরকম সব স্বামীরাই একটু আধটু বউয়ের গায়ে হাত তোলে। এখন আমারে তাড়াতাড়ি খাইতে দাও সারাদিন কি না খাওয়াইয়া রাখবা নাকি। খাবারটা আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও।
বলেই সে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।জেমি আর সহ্য করতে না পেরে রান্না ঘরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। তারপর হাটুতে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো। জেমি স্বপ্নে ও ভাবিনি জায়ান কখনো এতটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেই ছেলে বিয়ের সাত দিনের মাথায় বউকে এমন ভাবে মা/রতে পারে সেই ছেলে পরবর্তীতে কি করবে ভেবেই জেমি আতৎকে উঠলো। বাবা মায়ের কাছেও ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই ওর। কোন মুখ নিয়ে গিয়ে দাড়াবে জায়ান কে যে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো ও। এইসব ভেবেই জেমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ওর কান্নার স্বাক্ষী হিসেবে দাড়িয়ে আছে রান্নার ঘরের এই চার দেয়াল। আজ জেমির অসহায়ের মতো কান্না কারোর কানে পৌঁছাচ্ছেনা।শাশুড়ির উচ্চস্বরে হাঁক শুনেই জেমি নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়ে খাবার নিয়ে শাশুড়ির রুমে যেতেই, ওর শাশুড়ি ওকে দেখেই বলতে শুরু করল…..
—এতক্ষন লাগে নাকি আসতে। না খাওয়াইয়া মা’ইরা ফেলতে চাও নাকি তুমি। সামান্য একটু মা’র খেয়ে নাটক করতাছো যতসব।
বলেই খাবার খেতে লাগলো। কথা গুলো শুনেই জেমির গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। নিজের ছেলে চোখের সামনে একটা মেয়েকে এমন ভাবে মা/রলো আর সে দেখেও প্রতিবাদ না করে বরং এইসব বলছে। জেমি এইবার আর চুপ না থেকে কড়া কন্ঠে বলে উঠলো….
–আজ যদি আমার জায়গায় ইভা থাকতো তাহলেও আপনি এই কথাগুলো বলতে পারতেন মা।
জেমির কথা শুনে ওর শাশুড়ি ওর দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে গদগদ করে বলে উঠলো…..
—তুমি তোমার লগে আমার মাইয়ার তুলনা দিতাছো। আমার মাইয়া কোন দিক দিয়ে কম। রুপে গুনে সব দিক দিয়ে হাজারে একজন। আর তোমার খালি রুপেই আছে গুনের ছিটেফোটা ও নেই।আমার ছেলে খালি তোমার রুপ দেইখা গইলা গেছিলো আর কিছুই না। স্বামীর মন জয় করতে পারোনা আবার মুখের উপর কথা বলো।
জেমি ওর শাশুড়ির কথা শুনে আর কিছু না বলে নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করলো। নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো।আজ ওর শাশুড়ি একটা কথা সত্যি বলেছে সেটা হলো জায়ান ওর রুপ দেখেই গলে গিয়েছিলো। জায়ানের মনে জেমির জন্য এক বিন্দুও ভালোবাসা নেই যদি থাকতো তাহলে এমন ব্যবহার করতে পারতো। এতদিন তো ভালোই ছিলো তাহলে আজ হঠাৎ জায়ানের কি হলো যে ও এইভাবে আঘাত করলো। জেমি জায়ানের সাথে পালিয়ে আসায় জেমির বাড়ির থেকেও জেমিকে মেনে নেয়নি।জেমিদের ফ্যামিলির অবস্থা জায়ান দের থেকেও দ্বিগুন ভালো। আজ জেমির মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। আজ ওর শাশুড়ি জায়গায় ওর মা থাকলে কখনোই এই অন্যায় মেনে নিতো না। ভাবতেই জেমি ডুকরে কেঁদে উঠলো।
____________________________________________
ব্যাথায় জেমির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বিছানার এক পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে ও। জ্বরে বার বার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। এই ব্যাথা নিয়েও সারাদিন সব কাজ ওকেই করতে হয়েছে।সারাদিন কাজ করে রাতের বেলা ওর শরীর আর চলছিলোনা তাই সন্ধ্যা বেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো।জায়ান অফিস থেকে ফিরেই জেমিকে সুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা রেগেই জেমির দিকে এগিয়ে যেতেই জেমির পিঠের দিকে দাগের দিকে চোখ যেতেই ও থেমে গেলো। হঠাৎ করেই মনে পড়লো সকালের কথা। নিজের প্রতিই নিজের রাগ হচ্ছে। রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা। রাগের বশে জেমিকে এইভাবে আঘাত করেছে ভাবতেই ওর অনুশোচনা হচ্ছে। জায়ান ড্রয়ার থেকে একটা মলম বের করে আলতো হাতে ওর দাগগুলোয় লাগিয়ে দিতে লাগলো। জেমির গায়ে হাত দিয়েই জায়ান অনুভব করলো জেমির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জায়ানের এইবার আরো রাগ হচ্ছে। সত্যি মিথ্যা বিচার না করেই জায়ানের এত বড় একটা অন্যায় করা ঠিক হয়নি। জায়ান জেমির মাথার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে ভাবতে লাগলো……..
—আমি জানি আজ আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু কি করবো বলো? আমার তোমাকে কারোর সাথে সহ্য হয়না। তোমার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেইও আমার কষ্ট হয়। আমি কখনোই আমার ভালোবাসাটা তোমার প্রকাশ করতে পারিনি।আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ। কিন্তু মা আমাকে যা বললো তা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার অবস্থা এর থেকেও ভয়ংকর হবে। তোমাকে আমি ভালোবাসব, আমি আঘাত করব আবার আমিই ঠিক এইভাবেই আঘাতে মলম লাগিয়ে দিব। কিন্তু তুমি শুধু আমারেই থাকবে।
বলেই ওর মাথায় কিছুক্ষন জল পট্টি দিয়ে উঠে বাইরে চলে গেলো। জেমি জানতেও পারলো না যেই ছেলেটা সকালে ওকে নির্মম ভাবে আঘাত করেছে, সেই ছেলেটাই এখন ওর আঘাতে মলম লাগিয়ে দিয়েছে।
___________________________________________
জায়ান ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছে। এই একটা জিনিস জেমি একদম সহ্য করতে পারেনা। জেমির জন্যই এইসব ছেড়ে দিয়েছিলো ও। কিন্তু আজ মনের মধ্যে অনুশোচনা,
সত্যি মিথ্যার আড়ালে অনেকদিন পর সিগারেট হাতে নিলো। জায়ান কতক্ষন ছাদে পায়চারি করেই নিচে নেমে আসলো। ওকে সত্যিটা জানতে হবে।
জায়ান নিচে নেমেই সোজা ওর মায়ের রুমে চলে আসলো। জায়ান কে এই সময় নিজের রুমে দেখে ইরা বেগম একটু ঘাবড়ে গেলো কিন্তু সেটা জায়ান কে বুঝতে না দিয়ে হাসি মুখে প্রশ্ন করে উঠলো…..
—জায়ান বাবা তুই এইসময় এই রুমে? কিছু হয়েছে নাকি আবার ওই মেয়েটা কিছু করেছে।
জায়ান ওর মায়ের কথ শুনে একটু বিরক্ত হয়ে উওর দিলো…..
—নাহ মামনি জেমি কিছু করেনি। আমি তোমার কাছে একটা প্রশ্নের উওর চাইতে এসেছি। তুমি আমাকে সত্যি উওর দিবে মামনি প্লিজ।
ইরা বেগম জড়তাভরা কন্ঠে বললো…..কি প্রশ্ন?
জায়ান ওর পাশের সামনে বসে ওর মায়ের হাত দুটো আকড়ে ধরে বলে উঠলো….
—তুমি আমাকে সকালে যা যা বলেছিলি সব কি সত্যি ছিলো মামনি?
জায়ানের কথা শুনে ইরা বেগম আমতা আমতা করে বলতে লাগলো….
—হ্যাঁ সত্যিই তো তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস বাবা। তুই তোর নিজের মাকে অবিশ্বাস করছিস।কোনো মা কি চায় তার ছেলের সংসার ভেঙে যাক, তার ছেলের সংসারে অশান্তি শুরু হোক। তুই বল কোনো মা কি চায়?
বলেই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো। জায়ান আর কিছু না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে।
কি করবে ও? কাকে বিশ্বাস করবে? এইসব ভাবতে ভাবতেই নিজের রুমে এসে জেমির পাশে সুয়ে পড়লো।
____________________________________________
–আমি কিছুতেই ওই মেয়েটাকে আমার ছেলের সাথে সংসার করতে দিব না। সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি সময় মতো আগুনে ঘি টা তুমি ঢালবে। আর তারপর আমার ছেলের বউ তো হবে তুমি….
ইরা বেগমের কথা শুনে ফোনের ওপাশে থাকা মেয়েটার মুখে জয়ের হাসি ফুটলো……
#চলবে
#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী(ছদ্মনাম)
#সূচনা_পর্ব
(আসসালামু আলাইকুম। কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দিবেন)