#বিকেলের_মৃত্যু (পর্ব – ২)
লেখক: শামীমা জামান
আবিদ কুলকুল করে ঘামছে… তার আগমনের কারণ সে কীভাবে উপস্থাপন করবে আর এবাড়ির লোকেরা কীভাবে তার রিয়েকশন দিবে সে চিন্তায় আবিদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা করছে! মিনুকে যেহেতু তার চাই, তাই ভয় পেলে চলবে না তাকে। সে এক পর্যায়ে মিনুর মাকে সরাসরি বিয়ের কথা জানায়। মিনুর মা প্রথমে বুঝলেন না কী হচ্ছে? যখন বুঝতে পারলেন তখন খুব স্বাভাবিকভাবে আবিদের প্রস্তাব তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। আদতে এটা তাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ সনাতন ধর্মাবলম্বী একটা প্রসিদ্ধ হিন্দু পরিবারের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কখনোই সম্ভব নয় যে, তাদের মেয়ে একটা মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করুক!
চিরাচরিত হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় ফাঁদে আটকে গেল আবিদ আর মিনুর নিখাঁদ ভালোবাসা। শুরু হল তুমুল হৈ চৈ। মিনুর পরিবার চূড়ান্তভাবে অপমান করে আবিদকে। কিন্তু আবিদ সেখানে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে “মিনুকে তার চাই।” আবিদের অভিভাবক আবিদ নিজেই বলে তার দিক থেকে তেমন কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু মিনুর পরিবার থেকে যতটা সম্ভব বাঁধা তৈরি হল। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে নিজের ভালোবাসাকে হারতে দিতে রাজি নয় মিনু নিজেও। অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে যায় আবিদ আর মিনুর উপর দিয়ে। কিন্তু ঝড় যত সর্বগ্রাসীই হোক না কেন আবিদ আর মিনুর ভালোবাসার শেকড় উপরে ফেলতে পারেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে সুবিশাল বটবৃক্ষের মতই তাদের ভালোবাসা শেকড় বাকর বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে আরও মজবুত হয়ে গেড়ে বসতে লাগল।
সম্পর্কের এই ঝড়-ঝাপটার ভেতরেই মিনুর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। সে দিন গুনতে থাকে পরীক্ষা শেষ হবার দিনটা কবে আসবে? অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয় কিন্তু মিনুর জন্য এই দীর্ঘতা যেন আরও বেশি দীর্ঘতর। সে বুকের ভেতর তীব্র দু:সাহস চেপে রেখে শেষ পরীক্ষার দিনটার অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে সেই দিনটা যখন এসেই যায় মিনুর বুকের ভেতর অজানা আশংকা, ভয়, উত্তেজনা বেড়ে গিয়ে ক্রমেই তাকে দ্বিধান্বিত, দুর্বল আর অসহায় করে তুলল। আজ সে এবাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছে আবিদের কাছে! তার এই অধর্ম তাকে হয়ত এবাড়ির চৌকাঠে পা রাখবার অধিকার শুধু এ জন্ম নয় পরবর্তী সাত জন্মের জন্যই কেড়ে নেবে। এবাড়ির ঘর, দেয়াল, উঠোন, তুলসীমঞ্চ, ঠাকুরঘর… তার কী আর কোনদিন দেখার সুযোগ হবে? প্রিয় মুখগুলো মন চাইলেই কী আর দেখতে পারবে সে? তার বুকের ভেতরের শান্ত নদীটা আজ সাগরের উত্তাল ঝোড়ো ঢেউ হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত যে প্রশ্নবাণে সে জর্জরিত হচ্ছিল আজ তা তীরের ফলার মত বিঁধে ক্রমাগত তাকে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। “সে যা করছে তা কী ঠিক করছে? তার পরিবার, তার সমাজ তাকে চিরতরে ত্যাগ করবে। আর তার ধর্ম? ধর্ম কী তার এই অধর্মকে ক্ষমা করতে পারবে? যার জন্য সে নিজেকে নরকের বাসিন্দা করছে সে কী পারবে তাকে স্বর্গ সুখ দিতে? সে ভুল করছে না তো?” সে দুহাতে মাথা চেপে ধরে ভাবল “নাহ্, এই ভাবনা, এই প্রশ্ন কেন শেষ হয় না? তার ভেতরের জেদ মাথাচারা দিয়ে উঠল। কেন দুটো মানুষ চাইলেই নিজের ইচ্ছেয় ভালোবাসতে পারে না? ধর্ম কী এতটাই নির্দয়? ধর্ম তো মানুষের জীবন সহজ করার জন্য, মানুষকে ভালোবাসা শেখাবার জন্য, তাহলে?” সে উঠে ঠাকুরঘরে চলে গেল, হাত জোড় করে মনের যত ঝড় ভগবানের কাছে প্রকাশ করে শান্তি চাইল। করুণা চাইল ঠাকুরের কাছে। তার কৃষ্ণঠাকুর নিশ্চই তাকে বুঝবে? সে ঠাকুরের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে দীর্ঘ প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়ে নিল। এই ঠাকুরঘর তার কাছে আশ্চর্য এক ঘর। এখানে দুদন্ড বসলেই যেন মনের অশান্তিগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়… ঝুপ করেই শান্তি নেমে আসে মনে। কিন্তু আজ এই প্রশান্তির জায়গাটাও মিনুকে শান্ত করতে পারল না। তার চোখের কোল ভিজে উঠল… সে আস্তে করে ঠাকুরের পায়ের কাছে রাখা সিঁদুরদানি থেকে একচিমটি সিঁদুর কাগজে মুড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মায়ের কাছ থেকে পরীক্ষার কথা বলে আশীর্বাদ চেয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলো। তার মনে তখন হুট করেই প্রশ্ন চলে এলো “তার মায়ের এই প্রতিমার মত মুখখানা সে শেষবারের মত দেখছে না তো?” তার বুকের ভেতর থেকে হু হু করে উঠে আসা তীব্র একটা কষ্ট গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আটকে গেল! সে সেটাকে শক্তভাবে চাপা দিয়ে হয়ত শেষবারের মত এবাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করল! শত সংশয় আর দ্বিধা কাটিয়ে নিয়ে পা রাখল অজানা এক নতুন দিগন্তের পথে।
পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আবিদ আর মিনু কাজী অফিসে গিয়ে মুসলিম রীতি অনুযায়ী সেদিনই বিয়ে করেন। যার জন্য মিনু নিজের পরিবার আর ধর্মকে বিসর্জন দিয়েছে তার সকল চাওয়া যে মিনুর নিজের চাওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। মিনু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। শুরু হয় মিনুর জীবনের নতুন এক অজানা অধ্যায়ের। “নিশীতা বন্ধোপাধ্যায় মিনু” থেকে “নাহিদা আক্তার মিনু” হবার জীবন।
কী আশ্চর্য, বিয়ের পর মিনুর ভয় অনেকটাই চলে গেল। তবে সেখানে নতুন করে জায়গা দখল করল সংশয়! “নাহিদা আক্তার” হয়ে ওঠার সংশয়। আবিদ তার ছোট্ট বাসায় মিনুকে নিয়ে ওঠে। আজ তাদের বিয়ের দিন অথচ কোন সাজসজ্জা নেই, অতিথি নেই, বিয়ের বাদ্য নেই… এই অনাড়ম্বার বিয়েতেও মনের সকল সংশয় পাশ কাটিয়ে রেখে মিনু খুশি, কারণ সে তার নিজের চাওয়া মানুষটাকে পেয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে আবিদ তাকে লাল শাড়ি কিনে দিয়েছে, যেটা পরতেই তার নিজেকে কেমন বউ বউ লাগছে! আর আবিদ মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। মিনু লজ্জা ভেঙে বলল-
-কী দেখো?
-আমার সুন্দরী বউকে।
-আগে দেখো নাই?
-আগে তো একান্তই আমার সম্পদ ছিলে না।
-সম্পদ কিন্তু আগলে রাখা জানতে হয়। আগলে রাখা জানলে জীবন সুখের নয়ত বরবাদ হতে হয়।
-বরবাদ তো সেদিনই হয়ে গেছি যেদিন তোমার প্রেমে পড়েছি। এখন যেহেতু তুমি আমার সম্পদ হয়েই গেছ তখন আগলেও রাখতে পারব।
মিনু তখন আবিদের কাছে সরে এসে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে তার কাঁধে পরম নির্ভরতায় মাথা রেখে বলে- একটা কথা বলব?
-একটা কেন? যত খুশি বলবে। আজ তোমার বলার দিন আর আমার শোনার।
-মিনুর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে উঠল। বলল- ভগবানের ইচ্ছায় আজ থেকে আমি তোমার বউ হয়ে গেলাম। আমি তো আমার পরিবার, ধর্ম এমনকি নিজের নামটাও বিসর্জন দিয়ে দিলাম… নিশীতাকে মুছে দিয়ে নাহিদা হয়ে গেলাম। আমার ছোট্ট একটা আবদার রাখবে? শুধু আজকের জন্য?
আবিদ মিনুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভরসা দিয়ে বলল- আল্লাহর ইচ্ছায় সব কিছু হয়েছে। কী আবদার তোমার বলো?
মিনু তার হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে কাগজে মুড়ে আনা সিঁদুর বের করে বলল- হিন্দু মেয়েদের স্বপ্ন থাকে, “আলোয় আলোয় ভরা ছাদনাতলায় বসে মন্ত্র পড়ে অগ্নি স্বাক্ষী করে সাতপাক হবে, বর তার শিথিতে চওড়া সিঁদুর পরিয়ে দিবে, গাঁটছড়া বেঁধে সাত জনমের জন্য নিজের করে নেবে স্বামীকে। মাথা ভরা সিঁদুর পরে সে স্বামীর ঘরে যাবে, স্বামীকে প্রণাম করে স্বর্গীয় সুখ পাবে…” আমি বউ তো হলাম কিন্তু অন্যরকমভাবে… এসব কোন কিছুই হল না আমার। মনে খুব সখ…তুমি যদি শুধু আজকের জন্য আমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে?
-মিনুর কথাগুলো আবিদকে স্পর্শ করল। যে মেয়েটা তার জন্য পুরো পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছে তার জন্য এটুকু অনুভূতির দাম তো সে দিতেই পারে? সে মিনুর হাত থেকে সিঁদুর নিয়ে তাকে পরিয়ে দিল। সিঁদুর পরাতেই মিনুর চোকে মুখে অন্যরকম এক সৌন্দর্য নতুন করে দ্যুতি ছড়াতে লাগল! তার চোখের কোণ চকচক করে উঠল আনন্দে… যে আনন্দের অনেকটা জুড়েই লুকিয়ে আছে পরিবার হারাবার তীব্র বিষাদের ছায়া!
নিজের ধর্মকে বিসর্জন আর একজন মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করার দায়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই মিনু তার পরিবার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের মাঝে আর কোন সম্পর্ক থাকে না। নিজের শেকড় যখন নিজের মানুষগুলোই সমূলে উপড়ে ফেলে এর মত যন্ত্রণা বোধহয় পৃথিবীর আর কিছুতে নেই। মিনু সেই দহনে প্রতি মুহূর্ত পুড়তে থাকল। মিনুর এই দহনবেলা আবিদ তার দায়িত্ব আর ভালোবাসা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই দূর করে দিতে লাগল প্রতিনিয়ত। নিজেদের গুছিয়ে নিল একটু একটু করে। দিন যায় আর মিনু প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করেন নিজেকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে। সে বেঁচে থাকে তার ভালোবাসার মানুষটার ছায়ায় থেকে ছায়া হয়ে।
আবিদ আর মিনুর সংসার বেশ সুখেই কাটতে লাগল। দিন ঘুরে বছর কখন পার হয়ে যাচ্ছিল কেউ যেন টেরই পাচ্ছিল না। তবে বিয়ের পর থেকে আবিদ খেয়াল করেছে মিনু দিন দিন কেমন ভয়ানক রাগী হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও রাগে বেসামাল হয়ে যায়। আবিদ বুঝতে পারে পরিবার হারানোর যন্ত্রণা মিনুর ভেতরে চাপা থেকে থেকে এক সময় তা তীব্র রাগ হয়ে বহি:প্রকাশ ঘটছে। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর তীব্র অবজ্ঞা, অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নেয়া, তাদের কথার তীব্র বান, অভিশাপ, ধর্ম বিসর্জন সব মিলিয়ে তার বুকের ভেতর যে যন্ত্রণার পাহাড় জমা হয়েছে তা সময়ে অসময়ে রাগ হয়ে প্রকাশ হবে এটাই স্বাভাবিক। আবিদ এসব সামলেই নিজেদের গুছিয়ে নেয় একটু একটু করে। তাদের জীবনে সুখের সবটুকু রঙ ঢেলে দিতে জন্ম হয় পুত্র আবীরের। আবীরের জন্ম মিনুর জন্য শুধু আনন্দ নয় প্রবল সৌভাগ্যও নিয়ে এল। তার নিজের পরিবারের সাথে তখন যোগাযোগ হতে শুরু হয়। একটা সময় তার ভাই বোনের যাতায়াতও শুরু হয় তার বাসায়। যোগাযোগ শুরু হলেও ধর্মীয় সংশয়ের কারণে আবিদ কখনো মিনুকে তার মায়ের বাড়িতে যেতে দেয়নি। মিনু ওবাড়ি না গেলেও তার ভাই-বোনের সাথ যোগাযোগের এই ফলপ্রসূতা ডালপালা মেলে গড়িয়েছিল বহুদূর। ইসলামের সৌন্দর্য এতটাই যে মিনুর বড় বোন আর ছোট ভাই যখন মিনুর বাড়িতে বেড়াতে এসে কাছ থেকে এসব উপলব্ধি করার সুযোগ পেল তখন তারাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলেন। কিন্তু এসব কোন কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি মিনুর মাকে। তিনি কখনো মিনুর বাসায় আসেনি। মিনুর উপর তার অভিমান বা রাগ কোনটাই তিনি কমাতে পারেননি।
প্রেগন্যান্সির জার্নিতে প্রতিটা হবু মা-ই তার নিজের মমতাময়ী মাকে পাশে চায় তীব্রভাবে। এমন অনেক কথা, যন্ত্রণা, আবদার থাকে যা কেবল মায়ের কাছেই বলা যায়। কিন্তু মিনু এত দূর্ভাগা যে তার মাকে সে এইসময়ে পাশে পায়নি। এই শূন্যতা সে কী দিয়ে পূরণ করবে? তার ভেতরে জমে থাকা হতাশা বাড়ত, হাহাকার লাগত। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় অনেক মায়েরই বিভিন্নরকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যেটাকে Postpartum disease বলা হয়। প্রথম বারের মত যারা মা হন তাদের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগই এই ডিজিজে আক্রান্ত হন। কোন কারণ ছাড়াই এসব মায়েরা হাসে, কাঁদে, রাগ হয়, বিষণ্ণ হয়, ঝগড়া করেন। মিনু যেহেতু আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে ডিপ্রেশনে বাস করত তাই এই সময়টাতে এসে সে নিজেও কিছুটা মানসিক সমস্যা ফেস করেছিল। আবীরের জন্মের পর থেকে তার বুকের ভেতর জমতে থাকা হাহাকার আর হতাশা তীব্র রাগ হয়ে প্রকাশ পেতে লাগল।
আবীরের জন্মের ৮বছর পর জন্ম হয় কন্যা লিয়ার। লিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল ছেলের তুলনায় অনেক বেশি। দুই সন্তানকে ঘিরে তাদের চলে যাচ্ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ছেলে মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে। তাদের স্কুল, পড়াশোনা নিয়ে মিনুর সমস্ত দিন শত ব্যস্ততায় চড়ুই পাখির মত ফুরুত করে উড়ে চলে যায়! দেখতে দেখতে আবীর যশোর জেলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে উঠে গেল আর লিয়া তখন যশোরের সেক্রেড হার্ড জুনিয়র হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। মেডিকেল সায়েন্স বলে, প্রথম সন্তান মায়ের জিন বেশি পায়। সেই সূত্রেই হয়ত আবীর মায়ের মতই জেদি আর রাগী হয়েছে। তাই ছেলের সাথে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মিনু চূড়ান্তভাবে রাগ হতেন। মিনুর যতই রাগ হোক সে কখনো রাগের প্রভাব অন্যের উপর প্রকাশ করত না, করত নিজের উপর এবং সেটা কখনো কখনো ভয়ানক আকার ধারণ করত। একবার শুধুমাত্র ছেলে পড়তে না বসায় মিনু এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায় যে, রান্নাঘরে গিয়ে দা দিয়ে নিজের কপালে আঘাত করে বসে! রাগের মাথায় সে ২/৩ বার সুইসাইড করবার চেষ্টা পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু আল্লাহ সহায় থাকায় বিশেষ কিছু করতে পারেননি। এতসবের মধ্য দিয়েই তাদের জীবন কাটছিল এবং ভালোভাবেই কাটছিল।
এরই মাঝে হুট করে একদিন আবিদের বাবা আকবর সাহেব তার বাসায় হাজির হন। আবিদের সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না তাই এভাবে তার উপস্থিতি আবিদকে ভীষণভাবে অবাক করে। তার বাবার চেহারা উদ্ভ্রান্ত, রুক্ষ, শুষ্ক এবং ভেঙে পড়া! এত বছরের জমে থাকা শক্ত বরফ বাবার অসহায় চেহারা দেখে মুহূর্তেই গলে যায়। আবিদ তার বাবাকে সাদরেই গ্রহণ করেন। পরে জানতে পারেন আকবর সাহেবের ২য় স্ত্রী তার সমস্ত কিছু নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে! আবিদ কী মনে মনে মুচকি হাসি দিলেন…? মহাকাল কখনো কারো ঋণ রাখে না। সে জুলুম এবং ভালোবাসা দুটোই ফিরিয়ে দেয় এবং সেটা সুদ সমেতই ফিরিয়ে দেয়। আবিদ তার বৃদ্ধ বাবাকে নিজের সাথেই রেখে দিলেন।
লিয়ার তখন আট বছর বয়স, আবিদের ট্রান্সফার হয়ে যায় ঢাকায়। ছেলেমেয়েরা এখানে ভালো স্কুলে পড়ায় আবিদের পক্ষে সম্ভব হল না পুরো পরিবার নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা যাবার। সে তার স্ত্রী সন্তানদের তার এক চাচাত ভাইয়ের দায়িত্বে রেখে একাই পাড়ি জমায় স্বপ্নের শহর ঢাকায়। সেখানে সে খুব অল্পদিনেই নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেয়। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ সব কিছু মিলিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল তার। সপ্তাহে দুদিন আবিদ টেলিফোনে স্ত্রী সন্তানদের সাথে কথা বলে। নিজেদের ল্যান্ড লাইন না থাকায় কথা বলার জন্য মিনুকে প্রতি বৃহস্পতি আর রবিবার বিকেলে তার এক পরিচিত ভাবির বাসায় যেয়ে অপেক্ষা করতে হত এই দিনগুলোতে। মিনুর কাছে সপ্তাহের এই দিন দুটি ছিল তীব্র অপেক্ষার। কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে আর সে তার কন্যাকে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাবে তার জীবনে আসা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটার সাথে একটু গল্প করতে। মানুষটা একা কতদূর থাকে… মিনুর সারাক্ষণই মন কেমন করে তার জন্য! সপ্তাহের এই দিন দুটো অপেক্ষার ছিল ছোট্ট লিয়ার কাছেও। তার ছোট্ট পেটে সে আকাশ পাতাল এক করে কত কথা জমিয়ে রাখত বাবার জন্য! বাবার কাছে তার প্রথম প্রশ্নই থাকত “বাবা তুমি কবে আসবে?” মেয়ের ছোট ছোট আবদার, বাবাকে নিয়ে হাজার প্রশ্ন, স্কুলের গল্প, ভাইয়ার সাথে ঝগড়ার নালিশ সব শুনে আবিদের মন কেমনের ক্ষণ বাড়ত। ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটোকে রেখে দূরে থাকার যন্ত্রণায় তখন সে দিশেহারা হয়ে যেত। শত ব্যস্ততা কাটিয়ে আবিদ অপেক্ষা করত কখন সে তার স্ত্রী সন্তানের গলা শুনতে পাবে? এই বৃহৎ বসুন্ধরা যেমন উজাড় করে দিতে জানে তেমনি এক মুহূর্তে সব কেড়েও নিতে জানে। এরই মহা পরিক্রমায় আবিদ মিনুর সাজানো গোছানো সুখের জগতে এক বিকেলে হুট করেই নেমে আসে মহাপ্রলয়!
বরাবরের মতই এক রবিবার বিকেলে মা মেয়ে মিলে আবিদের সাথে টেলিফোনে কথা বলতে গেল সেই ভাবির বাসায়। কিন্তু সেদিন লিয়ার বাবার সাথে কী এমন কথা হল যে, মিনু কেঁদে একাকার হয়ে গেল! সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তবু মা বাড়ি যাচ্ছে না শুধু কেঁদে যাচ্ছে… লিয়া তার মাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু মা তো তাকে কোন জবাবও দিচ্ছে না? অজানা ভয় তার বুকে জমাট বাঁধতে লাগল। তার বাবার কী কিছু হয়েছে?
বাড়ি ফেরার পুরো রাস্তাটা মিনু কাঁদতে কাঁদতে এলেন। যে মানুষটার কথা শুনবার জন্য তার বুকের ভেতর অহর্নিশি ছলাৎ ছলাৎ করে আজ সেই মানুষটার ছোট্ট একটা কথা তাকে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। মিনু আজ দ্বিতীয় বারের মত নিজের শেকড় উপরে যাবার যন্ত্রণা পেলেন… তার মাথায় কেবলই ঘুরছে, “লিয়ার বাবা ঢাকায় একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে গেছে, তাকে সে বিয়ে করতে চায়!!!”