বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
সূচনা পর্ব
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
বর্ষাকাল। মেঘলা আকাশ। ঝুপঝাপ বৃষ্টি ঝরছে সারাদিন। তাঁতিবাজার মোরের শেষ গলির তিন নাম্বার বাড়িটায় ঢুকল চাঁদ। ঢোকার আগে হাতের কাগজে একবার চোখ বুলালো। ঠিকানা ঠিকঠাক আছে তো! ঘরের দরজায় করাঘাত করল। মিনিট দুএক পর দরজা খুলল আষাঢ়। দরজার সামনে চাঁদকে দেখে চমকে উঠল। ভর সন্ধ্যায় কাঁধে ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। চুল চুয়ে চুয়ে পানি ঝরছে। রক্তিম ফোলা ফোলা চোখ। লাল টকটকে নাক টানছে বারবার। ভড়কে গেল আষাঢ়। জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি! এই সময় এখানে?’
চাঁদ উত্তর দিলো না। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে আষাঢ়ের মুখপানে একপলক তাকালো। পাশকাটিয়ে হনহন করে ভিতরে ঢুকল।ধপ করে নড়বড়ে কাঠের সোফায় গিয়ে বসলো। নাক উঁচু করে ভারী স্বরে বলল,
‘ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। এখন থেকে এখানে থাকবো।’
আষাঢ় হতভম্ব দৃষ্টিতে চাঁদের দিক চেয়ে। কি হচ্ছে সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
আষাঢ়ের মা মালা বেগম কলেজ শিক্ষিকা। খানিক পূর্বে বাড়ি ফিরে চুলায় রান্না চড়িয়েছে। বাড়িতে কেউ এসেছে শুনে রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। বসার ঘরে চাঁদকে দেখে খানিক চমকালো। মেয়েটিকে এর আগে দুই তিনবার দেখেছে। পাশের এলাকার শিকদার সাহেবের ছোট মেয়ে। শিকদার সাহেব এই মফস্বলে নামকরা ধনি ব্যক্তিদের একজন। যেমন টাকা পয়সা তেমন তার ক্ষমতা। উনার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে রুবেলের সাথে আষাঢ়ের ভালো বন্ধুত্ব। দুজন ক্লাসমেট, ছোট থেকে এক সাথে পড়াশোনা করেছে। সেই সুবাদে ওই বাড়ির সাথে ভালো সম্পর্ক তাদের। উৎসব-পার্বণে আসা যাওয়া হয়। তখনি দেখেছিল। মেয়েটির থেকে চোখ ফিরাতে পারেনি। যেমন দেখতে চাঁদের মত সুন্দর, তেমন তার কোমল ব্যবহার। এত প্রাচুর্য বিলাসিতায় বড় হওয়ার পরও, বিন্দুমাত্র দম্ভ অহংকার ছোঁয়নি তাকে। কী নমনীয় ব্যবহার। রুবেলের অনুরোধে বছর দেড়- এক যাবৎ আষাঢ় চাঁদকে পড়াচ্ছে।আগামীতে চাঁদ উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষা দিবে।
অসময় চাঁদকে এখানে দেখে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল মালা বেগম। অধর কোনে হাসি টেনে বিভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এ কি মা! এই অসময়ে তুমি আমাদের বাড়িতে। পড়াশোনা বিষয়ক কোন প্রয়োজনে কি? খুব জরুরী কিছু হলে আষাঢ়কে ফোন করতে। বাড়ি গিয়ে দেখিয়ে দিতো। ‘
চাঁদের ভণিতা বিহীন নির্ভীক কন্ঠের সোজাসাপটা আওয়াজ,
‘ আমি আষাঢ় ভাইকে পছন্দ করি আন্টি। আব্বা ব্যবসায়ীক সম্পর্ক মজবুত করতে আমার মতের বি/রুদ্ধে গিয়ে বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আগামীকাল বাগদান করে রাখতে চাইছে তারা। তাই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। এখন থেকে এখানে থাকবো।’
মালা বেগম আঁ/তকে উঠল। ছেলের মুখপানে বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল। আষাঢ়ের অসহায় চাহনি। চোখের চাহনিতে মাকে জানালো, সে কিছু করেনি। মালা বেগম চাঁদের দিক এগিয়ে এলো। মাথায় হাত রেখে বোঝানোর কন্ঠে বলল,
‘ তুমি বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। আমরা সামান্য সাধারণ মানুষ। তোমাদের সাথে আমাদের যায়না। এসব কিছু গল্প উপন্যাসে মানায়। বাস্তব জীবন ভীষণ কঠিন হয়। দারিদ্রতায় দুচারদিন কা/টালে সকল ফ্যান্টাসি ঝরে যায়।’
‘ আমার আব্বা এক কথার লোক। যা একবার মাথায় আসে তা করেই ক্ষান্ত হয়। তিনি তার বন্ধুকে কথা দিয়েছে। উনার ছেলের সাথেই আমার বিয়ে দিবে। আর প্রশ্ন যখন ওয়াদা রক্ষার আমার আব্বা সবকিছু বি সর্জন দিতে পারে। এমনকি তার একমাত্র মেয়েকেও। একজনকে ভালোবেসে, অন্যজনকে বিয়ে করা অ/ন্যায় নয়কি! আবেগ থেকে বলছিনা, মন থেকে আষাঢ় ভাইকে পছন্দ করি। আমি বড্ড অসহায় হয়ে এখানে এসেছি। আপনারা ফিরিয়ে দিলে আমার গলায় দ/ড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা। কারণ আমার বিবেক আব্বার পছন্দ করা ছেলেকে কোনদিন মেনে নিবেনা।’
চাঁদের কথার পিঠে কথা খুঁজে পেলনা মালা বেগম। মেয়েটিকে কি করবে? ছেলের দিক প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো।
এদিকে অল্প সময়ের ভেতর ব্যাপারটা লোক জানাজানি হয়ে গেছে। এই ঝড়ঝাপটার মধ্যে ভর সন্ধ্যায় এত সুন্দরী, বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে আচমকা বাড়ি এসে উঠেছে। কোন কারণ, সম্পর্ক ছাড়াই কি! বাড়িতে বিয়ে লায়েক ছেলে। নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে। দরজার সামনে পাড়াপ্রতিবেশিরা এসে ভীড় জমিয়েছে। জানালা দরজায় উৎসুক দৃষ্টি মেলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ভিতরে কি ঘটছে তাদের জানার ভীষণ কৌতূহল।
রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না আষাঢ়। চাঁদের হাত টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। পা দিয়ে চেয়ার টেনে সামনে এনে চাঁদের মুখোমুখি বসলো। চোয়াল শক্ত। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চাঁদের মুখপানে চেয়ে।
আপাতত সেদিকে ধ্যান নেই চাঁদের। তার মনযোগী দৃষ্টি কাঠের চেয়ারে রাখা ছোট পাতিলটায়। যেখানে মাথার উপরে থাকা টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। চাঁদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আষাঢ় সেদিকে তাকালো। রাগটা আরো বেড়ে গেল। এসব বিষয় তাদের নিজস্ব, ভীষণ একান্ত। যা বাহিরের লোকের সামনে প্রকাশ পেলে লজ্জার। মধ্যবিত্তদের চক্ষুলজ্জা তাদের প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয়। আষাঢ় ধমকের স্বরে বলল,
‘ কি সমস্য তোমার? ওইদিকে কি দেখছ! বললাম তো আমার তোমাকে পছন্দ না। তবুও ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাড়ি চলে এলে কেন? সহজ কথা, সহজ ভাষায় বুঝোনা? নিজের কথা না ভাবো, পরিবারের মান সম্মানের কথা অন্তত একবার ভাবো।’
‘ কেন আমাকে পছন্দ করেন না? কি কমতি আছে আমার?’
‘ তোমার কোনো কমতি নেই চাঁদ, তুমি নিখুঁত। কমতি আমাতে, তুমি আমার সামর্থ্যের বাহিরে।’
‘ উহু, ভুল বলছেন। আপনি আমার সামর্থ্যের বাহিরে তাইতো এভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছেন! অনুভূতি প্রকাশের পর থেকে এড়িয়ে চলছেন। বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করেছেন। আচ্ছা, কাউকে ভালোবাসা কি অপরাধ? কেন আমাকে শা/স্তি দিচ্ছেন। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? একজন ছেলে ভালোবাসা প্রকাশ করলে, তা ভালোবাসা, আর মেয়েরা প্রকাশ করলে তা বেহা/য়াপনা, জে/দ? ‘
চাঁদের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির টলমল চাহমিতে। আষাঢ়ের অস্বস্তি বাড়লো। নড়েচড়ে বসলো। চেয়ারটা সামনে টেনে এনে লজ্জা জড়তা ভেঙ্গে বোঝানোর কন্ঠে বলল,
‘ মা সিঙ্গেল মাদার। জন্মের পর বাবাকে দেখিনি কখনো। আমার আর আরশির জন্মের দুমাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। সেই সাথে সাথে কাছের আত্মীয় স্বজনও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাবার ফেলে যাওয়া ঋণে ডুবা কারখানা আর এই সংসার মা একা হাতে সামাল দিয়েছে। উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় ঠেকতে হয়নি কোথাও। আমাদের বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজন বাড়লো। সব খরচাপাতি বাদ দিয়ে, কারখানার ওই সামান্য টাকায় পোষাচ্ছিল না। মা কলেজে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। টানাপোড়নের মাঝে আমার আর আরশির বেড়ে উঠা। মাধ্যমিকের পর পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ফেলে যাওয়া ছোট ব্যবসাটায় হাত লাগাই। বছর তিনেক আগে আরশির বিয়ে আর কারখানার কিছু খরচা বাবদ বাড়ি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে টাকা তুলি। যার লোন প্রতি মাসে বিশহাজার। তোমাদের বাড়ির মত এখানে রোজ শপিং, আউটিং এসব হয়না। একশত টাকা বাড়তি খরচ করলেও সেটা মাস শেষে হিসাবের খাতায় টান দিতে হয়। এখানে গরম তাড়াতে এয়ারকন্ডিশন, এয়ারকুলারের ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টি হলে টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি পরে। এবার বলো, এখনো এখানে থাকতে চাও! মানিয়ে নিতে পারবে এই পরিবারে?’
চাঁদ নিশ্চুপ। উত্তরের খানিক অপেক্ষা করল আষাঢ়। চাঁদের কোনপ্রকার হেলদোল না পেয়ে। নিজে থেকে বলল আবার,
‘ তোমার বয়স অল্প, সবে আঠারো কি উনিশ। আবেগের সময়। অগাধ প্রাচুর্য, বিলাসিতায় বড় হয়েছ। আমার সাতাইশ, মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনে ভরা জীবন। কোনোদিক দিয়ে আমাদের যায় না চাঁদ।’
চোখ তুলে তাকালো চাঁদ। নিমিষ সুরে বলল,
‘ খুব বেশি কিছু চাইনা। আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারবেন?’
আশাহত তপ্ত নিশ্বাস ফেলল আষাঢ়। এতক্ষণ যাবৎ কাকে কি বুঝালো। মেয়েটা কি আদৌ তার কোন কথা কানে তুলেছে? এত জে/দি, ঘাড়ত্যা/ড়া কেন মেয়েটা!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আষাঢ়। রাগী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কোন ঝামেলা চাইছিনা। তোমার ভাইকে ফোন করছি। এসে নিয়ে যাবে।’
অসহায়, নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চাঁদ। টলমল চাহনি তার। আষাঢ় সে দিকে তাকালো না। হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
চলবে কি?
( ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Afroja Akter jhuma বান্ধবী❤️🌺