বাদামী চোখ, পর্ব:৫+৬

0
1087

#বাদামি_চোখ [০৫]

এখন যদি আমি তনয়ের হবু বউ না হয়ে বিয়ে করা বউ হতাম নিশ্চিত আমি এই পরিস্থিতিতে বিরাট খারাপ আচরণ করে বসতাম! কিন্তু এখন তা মানবতার খাতিরে করতে পারছিনা!
এদিকে আমি তনয়ের কথার জবাব খুঁজে না পাওয়ার সাথে সাথে নিজের বদ রাগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না।
দাঁত কিড়মিড় করে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখলাম!
আর তনয়ের কথার প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করে স্বল্প ধাঁচের সাথে বললাম,
” শুনেন, আমি নিজের পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে আপনার মতো করে সাজতে চেয়েছিলাম, আর আপনি কিনা অন্য কারো কথা শুনে নিজের বউকে সাজাতে এমন একটা উদ্ভট রঙের শাড়ী নিয়ে এসেছেন?

আমার কথা শুনে তনয় স্ক্রিনের সামনে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাসছে। আমার রাগী কণ্ঠস্বর তার হাসিকে আরো তীব্রতর করে দিচ্ছে। সে হাসতে হাসতেই ক্যামেরা আবার পেছনে ঘুরিয়ে নিলো। তারপর হাসির তাল ঠিক রেখে বললো,
” নিবিতা কি বোকা তুমি! বিয়েতে কেউ সবুজ শাড়ী পরে? এটা তো পাশের বাসার ভাবির, মানে লিয়নভাইয়ের বউয়ের। আমরা একসাথে শপিংয়ে ছিলাম, তাই কীভাবে যেন এটা ভুলে এখানে চলে আসছে। এদিকে দেখো তোমাকে দেখাতে গিয়ে যখন এটা আমার সামনে চলে আসলো আমি তোমার রাগ পরিক্ষা করতে দুষ্টবুদ্ধির ছলে তোমার সামনে তুলে ধরলাম,আর তুমিও না সত্যি সত্যি কতো রেগে গেছো, হাহাহা!

বলেই তনয় আরো বেশি জোরে জোরে হাসতে হাসতে লাগলো। আমি এবার সত্যিই আশ্চর্যরকম বোকাবনে গেলাম! নিশ্চুপ হয়ে ওর হাসির শব্দ শুনছি, নিজের জন্য নিজেরই বিব্রতবোধ লাগছে! বোকা একটা হাসি এই মূহুর্তে আমাকেও চেপে ধরেছে খুব, কিন্তু লজ্জায় আওয়াজ করে হাসতে পারছিনা!

তারপর তনয় ক্যামেরা রেয়ারে ঠিক করে ধরে ভেতর থেকে একদম টকটকে লাল একটা বেনারসি বের করলো, আর সেটার একটু ভাঁজ খুলে বললো,
” এই যে এইটা আমি এনেছি আমার অপরূপা বউয়ের জন্য! আমি জানি আমার চাঁদবউ এটা পরলে লাল গোলাপের মতো দেখতে হয়ে যাবে!
শুনো বলি তোমায়, বিয়ে মানেই চোখে যেটা ভাসে সেটা হলো লাল বেনারসি, বুঝলে? কোনো সবুজ টবুজ নয়। আর তুমি তো বলেছিলে আমার কল্পনা অনুযায়ী তোমাকে সাজাতে আর আমিও আমার কল্পনাকে প্রাধান্য দিয়েই কিনলাম। কেননা বউদেরকে প্রায় সবাইই সর্বদা লাল রঙে কল্পনা করে, লাল যে সবার মুখে মুখে ভালোবাসার রঙ হিসেবে সমাদৃত নিবিতা!

আমি নিরব হয়ে তনয়ের কথা শুনছি, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিনা! তখন এভাবে না বুঝে রেগে যাওয়ার জন্য এখন নিজের কাছেই কেমন জানি লাগছে! তবে আমার রাগটাও তো মিছে নয়, আর সে ইচ্ছে করেই তো রাগিয়েছে! তবে এটা সত্যি রাগ কমে গেলেও অপরপ্রান্তে সেটা হুট করে বুঝাতে দেওয়া যায়না, সময়ের দরকার হয়! এইজন্যই মূলত আমি চুপ করে আছি!
এদিকে তনয় আরো কয়েকটা জিনিস দেখিয়ে আমাকে বললো,

” তুমি লাইনে আছো তো? আশেপাশের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কিন্তু তোমার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছিনা যে! আচ্ছা নিবিতা আমাকে এটা বলো আমার পছন্দ সম্পর্কে এতো ঠিকঠাক ধারণা কি করে জন্মালো তোমার? কি সুন্দর বলে দিলে সবুজটা আমার পছন্দ হতে পারে না!

আমি এবার সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিলাম। আমি বুঝে গেলাম আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা সঠিক নয়, তনয় লিয়নের ব্যপারে কিছু জানে বলে আপাতত আর মনে হচ্ছেনা।
সুন্দরমতো মৃদু হেসে আমি ক্যামেরা অন করে স্ক্রিনের সামনে আসলাম! তনয় এবার চুপ হয়ে গেলো, কেননা আমি কোনো জবাব না দিয়ে স্ক্রিনে এসে হাসতেছি শুধু!
তনয় এবার নিজেও বিছানায় বসে স্ক্রিনের সামনে আসলো।

ওকে স্ক্রিনে দেখার পরে আমি আস্তে আস্তে বললাম,
” আমার ধারণা নিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন না? কিন্তু আপনি কি জানেন, আমার ধারণা শক্তি মোটেও প্রকট নয়? তবে আপনাকে ধারণা করার দরজা আপনিই আমার জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছেন! তাই আমি বুঝতে পারি আপনার ভেতরের অতি ক্ষুদ্র অনূভুতি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো লাগাকেও!

তনয় নেশা ধরানো একটা মুচকি হাসি ঠোঁটে টানিয়ে বেশ নিরব হয়ে আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি কথা থামিয়ে দেওয়ার পরেও সে কিছু বলছেনা, এমনকি নড়ছেও না, শুধু তার চোখের পলক পড়ছে আর ফ্যানের বাতাসে ওর সামনের চুলগুলো উড়ছে!

আমি ওর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে আমার দুই ভ্রু উপরে তুলে ইশারা করে প্রশ্ন করলাম,
” কি কিছু বলেন!

তনয় চুপ থাকা অবস্থাতেই মাথা নাড়ালো একটু। সে বুঝাতে চাচ্ছে সে চুপ করেই তাকিয়ে থাকতে চায়!

আমি ওকে আবার বললাম,
” আর কি কি এনেছেন দেখালেন না যে?

তনয় আমার দিকে তাকিয়ে ধির কণ্ঠে বললো,
” এসব পরে, আগে তোমাকে দেখি! দুইদিন আগে দেখা হয়েছিলো, মনে হচ্ছে যেন দুই যুগ!

আমি তনয়ের কথা শুনে লজ্জায় ফোনটা বিছানার একপাশে রেখে হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসতে শুরু করে দিলাম। এই হাসিটা হয়তো কারো জীবনে সবচেয়ে দামী মূহুর্তের সাক্ষী! যত গভীর নির্ভেজাল আনন্দ দুনিয়ায় আছে তার অন্যতম উদাহরণ নিজের উপর প্রিয় মানুষটার এই ভালোলাগা বোধটুকু!
এখন লজ্জায় আর স্ক্রিনের সামনেও যেতে পারছিনা, কিন্তু মনে হচ্ছে তনয় এখন সামনে থাকলে নিশ্চয়ই ওর বুকে নিজেকে লুকাতাম! ভীষণ ভীষণ আর ভীষণরকম লজ্জা লাগছে এই মূহুর্তে।

তবে যা বুঝতে পারছি তনয়ের কথা বলার সাহস দিনেদিনে বাড়ছে! সে এখন প্রায় কথাই না আটকে বলে ফেলতে পারে! প্রথম প্রথম আমাকে আপনি ছাড়া সম্বোধনই করতে পারতোনা, আর এখন ভীষণ মায়া জড়িয়ে আমাকে তুমি সম্বোধন করে!
রোজ প্রতি ক্ষনে ক্ষনে আমার ভেতরে তার জন্য ভালোবাসা কেবল বাড়তেই থাকে। আমার এর মধ্যেই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে, সে আমার সাথে থাকলে আমি দুনিয়ার সবকিছু পেছনে ফেলে শুধু তার হাত ধরে ভালো থাকার অতল খুঁজে নিতে পারবো! কয়েকশো বছর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছে পোষণ করে যাবো বারবার!

অনেক্ষণ কলটা এভাবেই থাকলো, একটা সময় আমি কেটে তাকে টেক্সট করলাম।
এদিকে আমি সামনে থেকে চলে যাওয়াতে তনয় অভিমান করে রিপ্লে দিচ্ছে আচ্ছা থাক, বিয়ের পরেই দেখবো, এখনো তো আমি তোমার কেউ না। আরো যতো পাগলাটে প্রেমিকের ন্যায় আচরণ।
তবে ওর এসব ব্যপারকে আমি বেশ উপভোগ করছিলাম, ভীষণ ভালো লাগে আমার প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা, সাথে ছোট ছোট রাগ অভিমানগুলোকেও।


এরপরেরদিন,

আমি সকাল সকাল আমি আম্মুকে গিয়ে বললাম,
” আচ্ছা কাল বাদে পরশু এই বাড়িতে বিয়ে কিন্তু কোনো হইচই নেই কেমন লাগছে এটা? মেহমান সবাইকে দাওয়াত আগে আগে দিলেনা কেন?

আম্মু কিছু দূরে নিউজপেপারে চোখ বুলাতে থাকা আব্বুকে ডেকে বললো,
” কিগো তুমি কি বলোনি নিবিতাকে?

আব্বু চশমার উপর দিয়ে চোখ বের করে বললো,
” কিসের কথা বলছো?

আম্মু মুখ বাঁকিয়ে বললো,
” এই যে আমরা দুই পরিবারের অনুষ্ঠান একই কমিউনিটি সেন্টারে করবো?

বাবা ভ্রু কোঁচকে বললো,
” এটা তো তোমার বলা উচিত ছিল?

আমি মায়ের দিকে তাকাতেই মা বললো,
” আরে নিবিতা আমি আসলে ভেবেছি তুই তনয়ের থেকে জেনে গেছিস আগেই।

আমি এবার জোরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” হ্যাঁ সবদিকেই ভেবে বসে আছে, এইজন বলেছে বোধহয়, ওইজন বলেছে বোধহয়, মধ্যে আমি কারো থেকেই জানলাম না। হুহহহ!

আমি সেখান উঠে চলে গেলাম।
তনয় হয়তো ভেবেছে আমার আব্বু আম্মু এটা বলবে! তবে আমি আসলেই জানতাম না আমাদের বিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান একসাথে হবে।
যাক ভালোই হলো, বিয়ের একদিন আগেও আবার দেখা হবে তাহলে।

গায়ে হলুদের দিন দুপুরের পর পর আমরা সবাই আত্মীয় স্বজনসহ চলে গেলাম।
তনয়দের পরিবারের ইচ্ছেতেই এই সিদ্ধান্ত, হতে পারে তনয় নিজেই চেয়েছে, তবে আমি এটা নিয়ে তনয়কে জিজ্ঞাসা করিনি।
আমাকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে দক্ষ একজনকে পর পর তিনদিন আসার জন্য তনয় নিজে থেকেই সময় বলে দিয়েছে। তিনি নাকি তার পরিচিত, আর খুব ভালো সাজায়!

সন্ধ্যার পর পরে সবাই একদম সেজেগুজে এদিক ওদিক ছুটাছুটি এবং ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আমাকে অনেক্ষণ পরে স্টেজে নেওয়া হলো, তনয় এবং আমি পাশাপাশিই তবে স্টেজটা আলাদা করা।
দুদিকেই হলুদের বিশাল আয়োজন।
আমি গিয়েই বারবার তনয়ের দিকে উঁকি দিয়ে তাকাতে চাচ্ছি কিন্তু ভীড়ে ওকে দেখাই যায়না।
কি জানি আমাদেরকে কখন একসাথে বসে ফটোগ্রাফি করবে?
সব হৈহল্লার ভেতর হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো লিয়নের বউয়ের দিকে, সে কয়েকটা ছেলের সাথে বেশ আনন্দ করছে, হাসছে, ঘেঁষছে আর ছবি তুলছে।
ওর বউকে অন্যদের সাথে দেখে আমার চোখ আগ্রহ নিয়ে ওকে খুঁজতে লাগলো, আমি ডানে বামে ভীড়ের মধ্যেই খুঁজতে লাগলাম, ভালো করে খোঁজারও সুযোগ পাচ্ছিনা, সবাই এসে আমার সাথে ছবি তুলতে চাচ্ছে, কেননা কিছুক্ষণের মধ্যে ভিডিওম্যান ফটোগ্রাফাররা চলে আসলে নিজেদের ফোনে আর তুলবেনা, তখন সবাই সেখানেই লুক দিবে!

আর অল্পসময়ের মধ্যেই আমার ভাইয়া এসে উপস্থিত হলো, আর সবাইকে বলতে লাগলো তোমরা সরো, সবকিছু ঠিকঠাক করে দেই!
সবাই সরতে লাগলো। আর আমার চোখ তখন ঝলমলে বাতিতে আবৃত একটা খুঁটির দিকে পড়লো, আমি দেখলাম লিয়ন একদম চুপচাপ সেখানে একটা চেয়ারে মাথায় দুইহাত ভর করে বসে আছে।

খুব মর্মান্তিক দৃশ্য। তবে কেন জানি ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটলো আমার , অতি ভালো থাকার প্রয়াস আর বাদামি চোখের অজুহাতে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার ভাগ্য তাকে কম ভালোও থাকতে দিচ্ছে তো?

চলবে…….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

#বাদামি_চোখ [০৬]

চোখ সরিয়ে নিলাম আমি! যে চোখ অজুহাতের দায়ে আবদ্ধ, সেই চোখ অপচ্ছায়ার উপর থেকে দূরত্ব বজায় রাখুক।

কিন্তু আমারই বা কি করার আছে? ইচ্ছে করে তো আর সামনে পড়ছিনা। লিয়নই বারবার শুধু সবকিছুতে সামনে আসছে, আবার আসার পেছনেও আছে জোরালো কারণ । দুই পরিবারের ভালো সম্পর্কের খাতিরে সেও না এসে পারবেনা। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বিষয়টা ধিরে ধিরে বিকট আকার ধারণ করবে! বিয়ের পরে দেখা যাবে প্রতিদিনই লিয়নের সাথে আমার দেখা হচ্ছে।
আবার কোনো একদিন প্রসঙ্গের দরুন আমাদের পুরনো সম্পর্কের কথা উঠে আসবে। বিষয়টা তো তখন দুই পরিবারে বিরাট ঝামেলার সৃষ্টি করবে।
তখন তনয়ের পরিবার আবার লিয়নের পরিবারও অল্পকিছুতে আমাদের অতীতের উপর আঙুল তুলবে, আমার আত্মসম্মানবোধ কি তখন অটুট থাকবে? তাছাড়া তনয় হঠাৎ এসব শুনলে আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে!

আচ্ছা আমার কি সবকিছু তনয়কে আগেই জানানো উচিত ? তনয় তো কিছু জানে বলে একদমই সন্দেহ করতে পারছিনা, আবার নিজে থেকে কিছু বলার সাহসও করতে পারছিনা আমি। আজকেই বলবো নাকি অন্য সময়? কিন্তু এসব শুনে সে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটা ভেবেই আমার ভেতরে চাপা ভয় বেড়ে চলেছে।
না না এটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবেনা। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব বলার প্রস্তুতি নিতে হতে হবে।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান।
সবাই নাচছে গাইছে ফূর্তি করছে। আমিও সব ভাবনা তাড়িয়ে এসবের ভীড়েই আটকে গেলাম।
এদিকে তনয়কেও নিয়ে আসা হয়েছে, বিভিন্নভাবে আমাদেরকে শুধু ক্যামেরার মাথা ধরানো ফ্ল্যাশেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে, সবার কথা কথা শুনে শুনে নিজেদের অঙ্গভঙ্গী পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
ওর সাথে একটু কথা বলার সময়টুকুও যে আজ পাবো তারও কোনো সম্ভাবনা দেখছিনা।

ঘড়িতে প্রায় ১২ বেজে পনেরো মিনিট। সবকিছু এখনো পুরো দমেই চলছিলো।
কিন্তু হঠাৎ সেসময় আমার ফোন হাতে ভাবি স্টেজে উঠে বললো,
‘ নিবিতা দেখো তো, বারবার এতো ফোন কে দিচ্ছে?

আমি ফোন হাতে নিয়ে তনয়সহ সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম। নাম্বারটা আমি চিনিনা, তাও আবার অদ্ভুত সংখ্যায়!
আমি ফোন রিসিভ করলাম, আমাদের চারদিকে গান বাজনার আওয়াজে ঠিকমতো কিছু শুনতেও পাচ্ছিনা। লাউডস্পিকার বাড়িয়ে সেটার পরিমাণ একটু কমিয়ে নিয়ে তারপর কানে দিয়ে বললাম,
‘ কে বলছেন প্লিজ জোরে কথা বলুন, এখানে অনেক আওয়াজ।

তখন মেয়েলি কণ্ঠস্বরে আওয়াজ আসলো,
‘ বেশ ফূর্তিতেই আছেন তাহলে বাদামি চোখওয়ালি?

আমি এই ধরনের অদ্ভুত প্রশ্নে প্রচন্ডরকম অবাক হলাম। কে আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারে?
আমি আমার অন্যহাত দিয়ে কথাগুলো স্পিকারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করে বললাম,

‘ আমার বিয়েতে আমি ফূর্তিতে থাকবোনা? এটা কেমন প্রশ্ন? আর আপনি কে বলুন?

ফোনের ওপাশের মেয়েটা জোরালো শব্দে বললো,
‘ আমি কে? আমি কে জিজ্ঞাসা করছো তুমি? শুনো বলি, তুমি যেই আসনে এই মূহুর্তে বসে আছো সেই আসনে আমার বসে থাকার কথা ছিল। আমিই আজ গায়ে হলুদ মেখে নিজের হলুদ সন্ধ্যা সম্পন্ন করতাম!
আর আমার পাশে থাকতো সেই মানুষটা, যে এই মূহুর্তে তোমার পাশে আছে। কিন্তু আমি পারিনি, আমি পারিনি তোমার জন্য। তুমি আমার জীবনটা মারাত্মক পরিধিতে পৌঁছে দিয়ে একদম তছনছ করে দিয়েছো নিবিতা।

মেয়েটার কথা শুনে আমি এবার অবাকের শেষ চূড়ান্তে পৌঁছে গেলাম। ধমকের সাথে বললাম,
‘ কে আপনি? আর এসব কি বলছেন? আর আমার জন্য পারেননি মানে? আমি কি করেছি? আশ্চর্য!

মেয়েটা বেসুরে হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
‘ কারণ আমার চোখ তোমার মতো বাদামি নয়। তাই আমি তোমার স্থানে বসার অধিকার হারিয়েছি। তোমার জন্য আমি আজ কনের বেশে থাকতে পারলাম না মিসস তনয় হায়দার!

এটা শুনে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছি। কি বলছে সে? কে এই মেয়ে? বাদামি চোখ নিয়ে এটা আবার কিরকম নতুন ইস্যু? একজন বিচ্ছেদ ঘটালো এটার অধিকারী বলে , আবার আরেকজন বলছে তার অধিকার হরণ হয়েছে এটা নেই বলে! মধ্যে আমি একটা মাধ্যম! কি আছে এসবের পেছনে?

এদিকে তনয় আমাকে লক্ষ্য করছে, সে হাত নেড়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ কার সাথে এভাবে রেগে কথা বলছো? দেখো ওরা তোমার ফোন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি রাখো এটা।

আমি তনয়ের কথা শুনে ফোনে খেয়াল করে দেখলাম লাইনটা এর মধ্যে কেটে গেছে। আমি বড় করে একটা ঢোক গিলে তনয়কে নাম্বারটা দেখিয়ে বললাম,
‘ নাম্বারটা চিনেন?

তনয় হেসে বললো,
‘ অদ্ভুত নাম্বার। না চিনিনা। কি বললো? আচ্ছা এসব পরে দেখবো। এখন সামনে মনোযোগ দাও।

আমি ফোনটা আমার বসার পাশেই রাখলাম। কিন্তু আমার ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কে এই মেয়ে? তনয়ের সাথে তার কি কোন সম্পর্ক ছিল?
কিন্তু তনয়কে যতটা চিনেছি সে বড্ড সরল, এমন কিছু হলে সে আমাকে অবশ্যই কিছু বলতো। আগে থেকে আমাকে জানাতো!
আমি আমার মনকে স্থির করার চেষ্টা করলাম, এসব নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র। কেউ আমাদের বিয়েটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে ভেঙে দিতে চাইছে।

কিন্তু এসব এই সময়ে এসে কে করবে? লিয়ন?
না না এ তো একটা মেয়ে ছিল! লিয়ন এটা এখন কেন করবে? বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনার প্রথম থেকেই তো সে ছিলো, চাইলে পারতো তখনি কিছু করতে। এসময় এসে অন্তত এসব কিছু করার প্রয়োজন ছিল না।
তবে ওই মেয়েটার কথা কি সত্যি?
কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আমি! মেয়েটার কথা সত্যি হলে তো তনয়ও লিয়নের মতোই একজন অপরাধী, যে আমার সাথে না হোক অন্য কারো সাথে অন্যায় করেছে।

আমি আর আশেপাশে আনন্দ উল্লাসে মনোযোগ দিতে পারছিনা।
তনয় বিষয়টা খেয়াল করছে বারবার। বেশ খানিক্ষন পেরুনোর পরে আমার অস্থিরতার ভেতর ফোনের এসএমএস ভাইব্রেট বেজে ওঠলো। আমি তাড়ার সাথে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেই নাম্বারেই এসএমএসটা এসেছে।
লিখেছে,
‘ শুধু বিয়ে করতে পারবে,কিন্তু সুখী হতে পারবেনা তনয়ের সাথে। আমি থাকতে তা হতে দিবোনা।

এটা দেখতেই আমার বুকে অদ্ভুত একটা কম্পন হলো। আমার সন্দেহ পুরোপুরি পৌঁছালো লিয়নের উপর। আমি উঁকি মেরে ওকে খোঁজার আগেই দেখি সে তার মা’র সাথে বসে কথা বলছে।
আমি তবুও সন্দেহ দূর করতে পারলাম না, কিন্তু আবার আমার সন্দেহের মোড় ঘুরে গেলো নিমিষের মধ্যে , লিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখি আরেকটা এসএমএস এসেছে, লিখেছে..
‘ এখনো সময় আছে কিছু করো।

লিয়নের হাতে তো ফোনও নেই আর কোনো মেয়েও এই। সে এসব করছেনা তাহলে কে আবার এই অন্য মানুষ ? আমি তনয়কে ইশারা করে বেশ সাহস নিয়ে বললাম,
‘ আপনার সাথে আমার কথা আছে, যেভাবেই হোক এখান থেকে উঠে অন্য কোথাও আসার ব্যবস্থা করেন, খুব দ্রুত।

তনয় ভ্রু কোঁচকে বললো,
‘ একি তোমাকে অনেক্ষণ থেকে বিষন্ন দেখছি। সবকিছু ঠিক আছে তো?

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
‘ হ্যাঁ সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা শেয়ার করতে হবে । আপনি এদিকটা সামলে আমার সাথে একটু আলাদা আসুন।

আমার কথা শুনে তনয়ও বেশ ভীত হয়ে বললো,
‘ আচ্ছা তুমি দাঁড়াও, এক্ষুনি আমি এখান থেকে উঠতেছি।

বলেই তনয় তার মাকে ডেকে কানে কানে কিছু বললো।

তনয়ের মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ নিবিতা আসো আমার সাথে।

আমি উনার হাত ধরে সেখান থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছি, তৎক্ষনাৎ একটা মানুষের উপর আমার চোখ আটকে গেলো, আর আমি থমকে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে কিছু উচ্চারণ করতে চাইলাম! কিন্তু তার আগেই তনয়ের মা আমার হাত ধরে সেই জায়গাটা ত্যাগ করলো।

চলবে….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here