#বাতাসে_তার_সৌরভ–২৮
ডিসেম্বর মাসের চড়চড়ে রোদ মাথার ওপর। রিটেন শেষ করে হল থেকে বের হয়ে নদীর হাত টনটন করছে।মাথায় ভোঁতা ব্যথা, খাতায় কী লিখে এসেছে মনে পড়ছে না। সামনের সপ্তাহ থেকে ভাইবা শুরু। আগে পরীক্ষা এলে অস্থির লাগতো, এবার সব কেমন ভাবলেশহীন লাগছে। সব দুশ্চিন্তার সীমা অতিক্রম করে গেলে এমনই লাগে হয়তো। কলেজে ছন্নছাড়া হয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, নদী একটু একটু করে গেটের দিকে পা বাড়ালো। বুক কাঁপছে,
” ওরে নদী, হিজাব ধরলা নাকি?” পাশ দিয়ে যেতে যেতে শিলা বলে উঠলো। নদী উত্তর দিলো না।
রোদে বের হবার আগে দিয়ে মাথায় ওড়না শক্ত করে জড়িয়ে আজকাল বের হয়। বিষয়টা ধর্ম বা রোদ থেকে বাঁচার জন্য নয়, মুখটা আড়াল করে রাখার জন্য। খোলা আকাশে চলতে আজকাল থেকে থেকে নদীর বুক কাঁপে; যদি কিছু..।
” আম্মা, গাড়ি এই দিকে” গেট পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই নদী ঘুরে তাকালো।মধ্যবয়স্ক বেটেখাটো শক্তপোক্ত মানুষ লোকটার নাম নুরআলী। এই লোকের অটোরিকশায় নদী গত কয়েকদিন ধরে রাবেয়া আন্টির উত্তরারবাসা থেকে পরীক্ষা দিতে আসছে। রাবেয়ার কড়া নির্দেশ নদীকে ছাড়া কোথাও নড়বে না।
তবুও নদীর ভয় যায় না, শাহীনের সেই হিংস্রমুখটা মনে পড়ে। বাইরে বের হলে থেকে থেকে মনে হয় পেছন পেছন কেউ আসছে। দ্বিতীয়বার সে লক্ষ্যচ্যুত হবে না।
– এখন কই যাবো মা ?
নদী একবার ভাবলো ধানমন্ডিতে যান, নিজেকে সংবরণ করে বলল -উত্তরায় যান চাচা।
– আচ্ছা; আম্মা ম্যাডাম আপনাকে ফোন করতে বলসেন।পরীক্ষার সময় আপনার নাম্বার সুইচড অফ ছিল।
নদী ফোন খুলে দেখলো অনেকগুলো মিসড কল এসে জমেছে। সেখানে রাবেয়া কল আছে দুটা আর বাকি আটটা কলের ছয়টা রম্য আর দুটা বড় মামার। রম্য আর বড়মামাকে বাদ দিয়ে রাবেয়াকে কল দিতে যাবে তখন আরেকবার ফোন বেজে উঠলো।নামটা দেখে নদীর মনে হলো কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে তার গায়ে। পরম নির্মমতার সাথে ফোন কেটে দিতেই উদগ্রীব ভারী একটা কন্ঠ–
-হ্যালো নদী কেমন আছ?
নদীর নিজের উপর রাগ লাগছে, চেয়েছিল ফোনটা কেটে দিতে ;উল্টো রিসিভ হয়ে গেছে। ওপাশে থেকে বলে যাচ্ছে
” হ্যালো নদী?
-বলুন
– থ্যাংক গড, আমি সেই কখন থেকে কল দিচ্ছিলাম। রম্যের কন্ঠে একটু স্বস্তি।
– কোন দরকার ছিলো স্যা…( স্যার বলতে বলতেও নদী নিজেকে সংবরণ করল)
– দরকার… রম্য একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল,” না মানে তোমার কোন খবর পাচ্ছি না। ফোন করলে তুলছ না। চিন্তা হচ্ছিলো।
– কেন? নদীর শীতল কণ্ঠ।
রম্য যেন শুনে একটু অবাক হল – এটা কি স্বাভাবিক নয়? শাহীন এখনো এরেস্ট হয়নি…। আর ড্যাডও স্ট্রেসের মধ্যে, তোমাকেই মনে করছিলো, এত চেষ্টা করছি তোমার রেসপন্স নেই।
নদীর চুলের গোড়ায় আগুনের ফুলকি খেলছে। মুখে মুখে দরদ দেখানো পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা কাজের মধ্যে একটা; কঠিন হলো দায়িত্বটা নেওয়া। যদিও সেদিন বিপদ থেকে বাঁচার জন্য রম্যের ভূমিকা অনেক। হাবেভাবে যেই মুহূর্তে মনে হয়ছে নদীর পাশে দাঁড়ানো লোকটা হাতের পানির বোতল বা এলকোহল ছুড়ে দেবে রম্য নদীকে তড়িৎগতিতে সরে গিয়েছিল। তীব্র ভয়ে রম্যকে কতক্ষণ আঁকড়ে ধরে ছিল এখন ভাবলে রাগ লাগে।
” তুমি কোন যোগাযোগ করছ না কিচেনেও আসছ না ,এটা তো হয় না”
” সেমিস্টার ফাইনাল চলছে,আর দ্বিতীয়ত আমি কাজ করব না, ফর সাম পারসোনাল রিজন ”
” আমি জানতে চাই ”
“আপনার জানার অধিকার নেই ”
নদী এমন রুক্ষমূর্তিতে অনভ্যস্ত রম্য সংযম হারিয়ে দ্রুত ইংরেজিতে বলছে” এটা কোন নিয়ম নয়৷ যেকোনো রিজনেই হোক তুমি চাকরি ছাড়তে পারবে না।তুমি ভুলে যাচ্ছে যে এখানে একটা কন্টাক সাইন করে ঢুকেছিলে। সেই ক্লসগুলো দয়া করে পড়ো…
নদী বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলো রম্যের ফোন এমনভাবে কোনদিন কেটে দেবে ভাবতেও পারেনি৷দেয়ালে পিটন ঠেকে গেলে দুঃসাহস একাই জন্ম নেয়। কী ভেবেছে লোকটা, হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে চায় তাকে? মেজাজ সামলানোর চেষ্টায় নদী অটোরিকশাওয়ালাকে একটা ফার্মেসির দিকে নিতে বলল। নিশি যে ঘুমের ওষুধ খেতো সেটা আজ নদীও কিনবে । জগত জাহান্নামে যাক ঘুমিয়ে পার করে দেবে কিছুদিন।
নিশি পৌঁছে ফোন দিয়েছিল দুইবার৷ এক সপ্তাহের ব্রেক নিয়ে নতুন করে হাইস্কুল এডমিশন নেওয়া হয়েছে তার। নার্সিং মেজর কোর্স।এত ব্যস্ততার মধ্যে নদীর জীবনে কী ওলটপালট হয়েছে নিশি অন্তত জানে না। শানু খালা কিছুটা জানেন তবে সবটা নয়–” নদী, শাহীন শুনলাম সাতক্ষীরা নেই। তোর রানুখালা চেঁচামেচি করছিলো।ঢাকা কি এসেছিল নাকি রে। একটু সাবধানে থাকিস জামাইকে বলিস…”
ফোনে শানুখালার কথার কোন উত্তর নদী দেয়নি এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলেগেছে । মূলত তার ঠোঁট যেন অভিমানে সেলাই হয়ে গিয়েছিল, অথচ সেটা খুবই যুক্তিহীন। কেউ কেন তাকে রক্ষা করার দায় নেবে?
সে ঘটনার পর শাহীনের বিরুদ্ধে কেস করেছে সোহরাব সাহেব নিজেই। সাতক্ষীরায় বিষয়টা জানানোও হয়েছে। বড়মামা নদীকে নিতে আসতে চেয়েছিলেন , রাবেয়া কড়া করে না করে দিয়েছেন। ছেলের বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট শুনে নদীর ফোনে রানুখালা কল করেছেন কয়েক দফা, নদীই তোলেনি। কেন যেন কারো সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে না।
রাবেয়ার বাড়িতে তিনি নদীর যত্নে কোন কমতি করছেন না। নদী পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি আসে কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। একটুকরো সুরক্ষিত ছাদ এই শহরে যে মেয়েটির জন্য বরাদ্দ নেই, তার চোখে সম্ভবত ঘুম মানায়ও না।
-ওই আমার হাওয়াই মিঠাই খাইসস ক্যান?
– এহ এইডা আমার…!
নদী ফার্মাসি থেকে ওষুধ নিয়ে ফেরত আসার পথে থেমে গেছে৷ ধুলোমলিন কাপড় জামায় দুজন পথশিশু ভাইবোন।
ম্লান পোশাক হলেও মুখ দুটো বড় মিষ্টি। কিন্তু সেটাও ঠিক দৃষ্টি আকর্ষণের মূল কারণ নয়। নদী এই বাচ্চা দুটোকে চেনে।
গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের সেই ভূত সেজে থাকা বাচ্চারা। মেয়েটার চোখ সবুজ, সেদিন সেই ফ্রিজার রুমেই খেয়াল করেছিল নদী। আর দিনের আলোয় স্পষ্ট। আরে হ্যাঁ, আর দুই গলি পার হলেই তো গ্যাব্রিয়েলস কিচেন। তার মানে এই বাচ্চারা থাকে আশেপাশেই কোথাও। দুই ভাইবোন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খুনসুটি করছে, নদী হেঁটে হাওয়াই মিঠাইওয়ালসর থেকে আরো দুটো কিনে এগিয়ে দিলো।
বাচ্চারা অবাক হলেও সহজ ভাবেই নিলো এমন দাক্ষিণ্য নিয়ে হয়ত অভ্যস্ত৷
– আজ ভূত সাজার ডিউটি নাই?
– কী কন আপনে ?ছোট ছেলেটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
– ওই যে, ওই রেস্টুরেন্টে ভূত সেজে যাও যে, আজকে ভয় দেখানোর ডিউটি নাই?
বাচ্চা ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার চোখ সরু হয়ে গেছে। ভয় পেয়েছে দুইজনই। মেয়েটা সতর্কভাবে ভাইয়ের হাত ধরে হ্যাচকা দিলো। নদী এগিয়ে যেতে যেতে বললো,” কত টাকা পাও ভূত সেজে? আমিও টাকা দেবো শুধু তাদের নামগুলো বল। ”
-কার নাম?ছেলেটা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো
– যাদের জন্য ভূত সাজো তোমাদের সাথে একজন মহিলাও তো আছে তোমাদের মা সাজে, কই উনি?
– কাজে গেছে
– কোন কাজে? বল আমাকে বল,
বাচ্চা ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে, নদী তার পার্সব্যাগ থেকে একশো টাকার চকচকে নোট বের করল।
” দেখো আমার কাছে টাকা আছে, একটা কথা শোনো ”
” ওই আয়! ”
মেয়েটা জোরে টান দিলো। সে কিছুটা বয়সে বড়, কাজ নিয়ে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি না। বাচ্চারা দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে। ছেলে বাচ্চাটা পেছন ফিরে একঝলক নদীকে দেখে সামনে ছুটলো। রাস্তার ওইপারে রবিন্দ্র সরবরের কাছে এলোমেলো ভিড়ের মধ্যে বাচ্চাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবে দৃষ্টির মধ্যেই আছে,এদের পেছন নদীও এগিয়ে যাচ্ছে, জোরে পা চালাচ্ছে। ঝিলের মাঝামাঝি সরু ব্রিজের কাছে এসে বেশটুকু ভিড়; ভাইবোনকে হারিয়ে ফেলল নদী। হাঁটতে গিয়ে হাঁপ ধরে আছে, রাগে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
গোটা পৃথিবী যেন তার দুর্বলতা নিয়ে রসিকতায় মেতেছে, সব অসহ্য লাগছে।
তবে ঢাল তলোয়ারহীন সিপাহীর মেজাজ থাকা হাস্যকর, নদী হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে শান্ত করছে।
অটোরিকশাওয়ালা হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। দুনিয়া যাক জাহান্নামে যে ইচ্ছে ভূত সাজুক যে ইচ্ছে রেস্তোরাঁ চালাক নদীর কী? যাবার মুখে পা আবার থমকে গেল। বেঞ্চের মধ্যে ল্যাপটপের নিমগ্ন একজন ষাটোর্ধ সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ। নদী মোটামুটি রূদ্ধশ্বাসে তাকে কিছুক্ষণ দেখল৷ মরিয়া হয়ে কিছু খুঁজলে খোদ প্রকৃতি তার সাহায্যে হাত বাড়ায় এই কথা তাহলে সত্যি। কিছুক্ষণ পর সাহসে ভর করে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ভদ্রলোকের দিকে,
” আস সালামু আলাইকুম স্যার ”
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। মাথাই তুললেন না, গভীর মনোযোগে স্ক্রিনে ডুবে আছেন। কী বোর্ডে ঝড়ের গতিতে আঙুল চলছে।
নদী আরেকবার সালাম দেওয়ার পরে মাথা উঁচু করে দেখলেন । চোখের কোণায় চাপা বিরক্তিটা সংবরণ করে নিলেন, তরুণী কোন মেয়ের সামনে সরাসরি বিরক্তি দেখাতে নেই। নদী এগিয়ে গিয়ে বলল” স্যার আমি আপনাকে চিনি আপনি নীতিন মন্ডল। ”
ভদ্রলোক ভাবলেশহীন ভাবে হাসলেন” দ্যাটস গুড ফর ইউ, বাট ডু আই নো ইউ ইয়াং লেডি? ”
একটা নামী চ্যানেলে নিউজ এডিটর যাকে প্রতি সপ্তাহে টকশোতে বড় বড় জাঁদরেল মানুষের সাথে তর্ক করতে দেখা যায়, তাকে চেনা খুব একটা দুরহ ব্যাপার নয়।
নদী অস্থিরতা দমিয়ে বলল–
“আপনি রেস্টুরেন্ট এসেছিলেন, গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে মনে পড়ে?এই যে আর দূটো গলি পরেই পাঁচ নম্বর রোডে… ”
এবার নীতিন মন্ডল পূর্ণ চোখে তাকালেন
মাথা নেড়ে বললেন, ” ও ইয়েস , তোমার হাতের চিকেন বাস্কেট খেয়েছিলাম আমার মনে পড়েছে দ্যাট লিটল কুক”
” স্যার, আমার আরেকটা পরিচয় আছে। যেটা শুনলে হয়তো আপনি একটু আগ্রহী হবেন।”
নীতিন তাকিয়ে আছেন নদী তার ব্যাগ থেকে ভোটার আইডি কার্ড বের করলো,
তার মোবাইলের ফোটো এলবামে গিয়ে কিছু ছবি দেখালো,একটু দম নিয়ে বলল, “গ্যাব্রিয়েলস কিচেন একসময় আমাদেরই বাড়ি ছিলো। নাসির সাজ্জাদ আমার বাবা। এইগুলা দুই হাজার সালের দিকে ক্যামেরায় তোলা।”
নীতিন মন্ডল বিস্মিত, নদী আগ বাড়িয়ে ছবিগুলো দেখাতে লাগলো, ” এইটা চন্দ্রমল্লিকার গেটের সামনে আমি আব্বু আম্মু। এটা আমাদের বাড়ির ড্রইংরুমে। এটা আমি। ভালো মতো দেখুন স্যার, আমার চেহারা বিশেষ একটা পরিবর্তন হয়নি। খালার বাড়ি যাবার আগে আগে আমি আমার ফ্যামিলি অ্যালবাম সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ”
নীতিন মন্ডল নদীকে বসতে বললেন ” তুমি ফিরলে কবে,কী করে? ”
“পড়তে এসেছিলাম অন্যভাবে বলতে পারেন ভাগ্য নিয়ে এসেছে”
” ভাগ্য নাকি অন্যকিছু? ”
” বুঝলাম না স্যার ”
” এই শহরে আর কোথাও ঠিকানা পেলে না? নাকি বাড়ির মায়া কাটাতে পারোনি ; কাজটা যে কতটা ঝুঁকির জানলে হয়তো ওইবাড়ির ছায়াও মাড়াতে না।
” আমি সত্যি বুঝতে পারছি না ”
” বোঝার জন্য যথেষ্ট বড়ো নও তুমি। ওই রেস্টুরেন্টের মালিক আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল ভূতুড়ে উপদ্রব নিয়ে যদি একটা ইনভেস্টিগেশন বেইসড রিপোর্ট করি।বিজি ছিলাম, তখন গুরুত্ব দেইনি। হাল্কার ওপর খোঁজ করে কিছু বিষয় জেনেছি তার ভিত্তিতেই কথাগুলো বলছি, মেয়ে তোমার এইখানে থাকা উচিত নয় ”
” কেন স্যার? ”
নীতিন মন্ডল অস্থির হয়ে বললেন বললেন, ” বিষয়টা অনেক কমপ্লিকেটেড ” নীতিন কথা শেষ করতে পারলেন না
অফিস থেকে ঘন ঘন কল আসছিল।তিনি নদীকে নিজের একটা কার্ড দিলেন। দ্রুত নদীর ন্যাশনাল আইডির একটা ছবি তুললেন, মোবাইল নাম্বার নিলেন, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
” একটা ঝামেলা হয়ে গেল, আমি আসলে অন্য একটা কেসে বেশ বিজি আছি এখন কথা আগানো গেল না। তুমি চাইলে আমার বাসাতেও আসতে পারো সাত মসজিদ রোড প্রিয় প্রাঙ্গন অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট সিক্স এ, লিফটের ফাইভ। এককাজ কর নেক্সট ফ্রাইডে এসো ”
“জি আচ্ছা ”
নীতিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘দেখা হবে ছোট্ট মেয়ে, আমি আশাকরি তুমি যেখানে আছ সেই জায়গাটা যথেষ্ট সুরক্ষিত। একটা শক্ত সেল্টার তোমার জন্য জরুরি। ”
বিদায়বেলায় নীতিনের কথাগুলো নদীর মুখ কেমন এক বিদ্রুপের হাসি জন্ম দিয়ে গেল।
******
জেরিন অভিমানী মুখ করে দরজা খুলল। সোহরাব সাহেবের বাসার আলাদা চাবি আছে তার কাছে।গ্যাব্রিয়েলস কিচেন থেকে আজ সেজেগুজে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। দরজা খোলার পর জেরিনের অভিমান সোহরাব যেন খেয়ালও করলেন না। একটু ফ্যাকাসে হেসে ভেতর ঢুকলেন।
জেরিনের জানে মানুষটার কোন ঝামেলা যাচ্ছে। বিশেষ করে ছেলের সাথে ; নিভৃতে বাপ-বেটাকে কয়েক দফা তর্কাতর্কি করতে দেখেছে জেরিন।যদিও এটা ভালো খবর, গ্যাব্রিয়েল ক্ষেপে আমেরিকা চলে গেলেই ভালো ।
তবে তাদের ঝগড়ার মূল কারণ জানলে জেরিনের জন্য আরও সহজ হতো।
তবে জানতে হবে কৌশলে, তাই জেরিন বেশি তর্কাতর্কিতে গেল না। মিষ্টি আচরনে সোহরাবকে ভোলানোর চেষ্টা করল।মমতা নিয়ে সোহরাবের ব্লেজার খুলে দিলো, নিজ হাতে টেবিল সাজালো,
” দেখ তোমার ফেবারিট লবস্টার রেডি করিয়েছি সালেমকে দিয়ে…খাও না, তুমি একেবারে নিজের খেয়াল রাখছো না ”
বাড়তি যত্ন সত্ত্বেও সোহরাব ডিনারে বেশি কিছু খেতে পারছেন না। মাথার মধ্যে অন্য এক চিন্তা ঘুর-পাক খাচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় সান সাইন বিল্ডারসের এমডির সাথে মিটিং ছিল। সাধারন কোন বিল্ডার কোম্পানি নয় খোদ মন্ত্রী ইফতেখারের পরিবার,যারা সব সময় গুছিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে। তাদের প্রস্তুত করা ফেক কাগজ পত্র হলেও তা বেশ জোরালো। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাদের প্লানের এক ইঞ্চি কমাবে না। গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের পনেরো কাঠা জায়গাটা তাদের প্রেজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুরোটা তাদের চাইই।হাতে সময় মাত্র ছয়মাস
সোহরাব তাদের সাথে বাকবিতন্ডায় যেতে চাননি৷ এমনিতেই রম্যের কান্ডে মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। তার কারণে বাচ্চামেয়েটার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে তা কোন ভাবেই কাম্য নয়। গুরুতর পদক্ষেপ নিলে নদীর পরিচয় বাইরে চলে আসবে সেটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
গিট লেগে থাকা ভাবনাগুলো একপাশে জোর করে সরিয়ে প্রিয়তমার দিকে মনোযোগী হতে চাইছেন। জেরিন সান্নিধ্যে আন্তরিকতা ঢেলে দিচ্ছে।সোহরাব সাহেবের মাথায় তৃষ্ণার সংজ্ঞা ঘুরপাক খাচ্ছে, জীবন গড়ানোর সাথে সাথে তৃষ্ণা কত কত মাত্রা পায়। সঙ্গিনীর তৃষ্ণা, ক্ষমতার তৃষ্ণা, প্রভাব-প্রতিপত্তি কৃষ্ণা, সম্মানে তৃষ্ণা, অতিরিক্ত তৃষ্ণায় মানুষ হারায়ও অনেক কিছু।
গলা জরিয়ে গাঢ় আবেগের উতলা ঢেউয়ের মাঝখানে জেরিন হঠাৎ খেয়াল করলো, সোহরাব যেন দারুন ভাবে ঘামছেন, জোরে জোরে শ্বাস টানছেন। ক্লান্ত গলায় বললেন —
” এসিটা বাড়াও”
” এসি তো বাইশে দেওয়া, কী হয়েছে জান? ”
” অনেক গরম লাগছে, সোহরাব উঠে বসলেন, “বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে…
পিপাসা পাচ্ছে একটু পানি আনো ”
কোলেস্টরলের একটা সমস্যা ছিল সোহরাবের সেটা বেড়ে কি গেল? এখন শরীর খারাপ হলে হলে বিয়ের পথে আরেকটা বাধা শতভাবে গুছিয়ে আনলেও একটা না একটা ঝামেলা রয়েই যায়। জেরিন চিন্তিত মুখে পানি আনতে গেল।
সোহরাব সাহেব উঠে বসেছেন, বুকের চাপটা কিছুতেই কমছে না কপাল দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। তিনি কাঁপা হাতে মোবাইল বের করে রম্যকে কল দিলেন।
” হ্যাঁ ড্যাড বল কি অবস্থা? ”
” অবেলায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত রমি, আমি ভালো বোধ করছি না”
“ভালো বোধ করছো না মানে বুঝলাম না” ওপাশের কণ্ঠ উদ্বিগ্ন
“তুমি একটু বাসায় আসতে পারবে?
অসুস্থ লাগছে.. ”
” আমি নিশ্চিত, নাহলে বুঝতে যে তুমি অনিকে কল করেছ রমিকে নয়,ডোন্ট ওয়ারি ড্যাড আমি রমিকে জানাচ্ছি”
তিনদিন পর,
বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালের করিডর। রম্য গম্ভীর মুখে বসে আছে
এখানে সোহরাব সাহেব দুইদিন ধরে ভর্তি। সেই রাতে অর্ণবের কল পেয়েই ছুটে গিয়েছিল, জেরিন দরজায় দাঁড়িয়ে হড়বড় করে অনেক কিছু বলল, কিন্তু রম্য পাত্তা দিলো না। জেরিনের বিব্রত অবস্থা না বাড়িয়ে বাবার দিকে খেয়াল দিলো।ইমার্জেন্সিতেও সবার কেমন ঢিলেঢালা ভাব, চরম বিরক্তিকর দেশের বিরক্তিকর চিকিৎসা ব্যবস্থা।এডমিটের তিন ঘন্টা পরে টেস্টের জন্য পাঠানো হলো। ইসিজি, ইকো নরমাল হলেও ইটিটি পজেটিভ অত:পর এনজিওগ্রামে ধরা পড়লো Lycz রক্তনালিতে প্রায় ৭৫% ব্লকেজ!
অপারেশন দরকার অচীরেই। ডাক্তাররা এর পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন কিন্তু রম্য ভরসা পাচ্ছে না। অনিয়মে ভরা এই দেশে মানুষ চিকিৎসায় নয় মিরাকলে বাঁচে। আচ্ছা ফেসে গেল এই দেশে! সোহরাব সাহেব একসময় খোঁজ করলেন তার।
” ডাক্তার বলল,তুমি নাকি অপারেশন করাতে চাইছ না? “সোহরাব সাহেবের সরাসরি প্রশ্ন।
” করাতে চাইছি না এটা ঠিক না এখানে করাতে চাইছি না, আমাদের টিকিট বুকিং দিয়েছি, জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে হসপিটালে এডমিট করাবো।
সেখানেই যা হবার হবে”
” আর এই দিকে ওই মেয়েটার কী হবে যার তুমি আইনত দায়িত্ব নিয়েছ ”
” ড্যাড ও আমার প্রায়োরিটি না ”
” আমার ছেলে আমার প্রায়োরিটি! যাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন দেখতে আমার কষ্ট হচ্ছে”
সোহরাব সাহেবের কঠিন কন্ঠে রম্য থেমে গিয়েছিল। বাবার সাথে তর্কের অবস্থা ছিলো না। তবে নিশ্চিত হলো যে বাবার যুক্তিবোধ অনেকটাই কমে গেছে। করিডরে হাঁটতে হাঁটতে অর্ণব যেন পরিস্থিতি বুঝেই ফোন দিল —
” ড্যাডকে ব্লেইম করে লাভ নেই ঝামেলা তুইই শুরু করেছিস ”
” তা এই বুদ্ধিটা কার? ”
” দেখ রমি আমার ঘাড়ে চাপাবি না, তুই সাতক্ষীরা থাকতেআমি শুধু সাজেশন দিয়েছিলাম, তুই যে ঝোঁকের বশে করেই ফেলবি আমি তো জানিনা ”
“এটা তোর পুরনো স্টাইল, আমাকে বিপদে ফেলে রেখে সব সময় হাত ধুয়ে পালিয়ে গেছিস ”
” তুই নিজের বোকামিতে বিপদে পড়েছিস, আমি সবসময় তোকে উদ্ধার করতে এসেছি ”
” নমুনা দেখতে পাচ্ছি, একদিক দিয়ে ড্যাড জেদ করছে নদীকে মেনে নিতে, অন্যদিকে গ্যাব্রিয়েল কিচেন হাতছাড়া হচ্ছে আর তুই আছিস…. ‘
” আমি আছি এভার কেয়ার হস্পিটালের রিসিপশনের সামনে ”
রম্য স্তব্ধ হয়ে গেল।অনির পক্ষে অসম্ভব নয়; ফোনে বাক্যব্যয় না করে দ্রুত পা বাড়ালো। চোখ ঘোরালো চারিদিকে, ব্যস্ত চিন্তিত মানুষদের ভিড়ের মাঝে রম্যের নিজের ছদ্মবেশী আয়নারূপকে আবিষ্কার করতে সময় লাগলো তিন মিনিট।
অর্ণব হাসলো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে৷ এই একটা হাসিতেই রম্যের মনে হলো এখন সব ঠিক হয়ে যাবে, পীরবাবা ইজ হিয়ার।
*******
” কই যাও আব্বু?”
” আসতেসি বুড়ি, ভাইকে দেখিস… ”
” আব্বা! আমি যাবো… ” নদীকে পেরিয়ে বাবলু ছুটে যাচ্ছে গেটের দিকে। বাবা ততক্ষণে হেঁটে গলির মুখে চলে গেছেন একবার ঘুরে তাকালেন বাবলু নদী পকেট গেট ধরে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন নাসের ” এই আধাঘন্টার মধ্যে আসছি” কত বড় মিথ্যা ছিল কথাটা। ছিড়ে গেল দৃশ্যটা। পেছনের বাথরুমের গাঢ় অন্ধকারে নদী দাঁড়ানো জঙ্ধরা দরজার খিল আর খুলছে না বাইরে থেকে বাবলুর সুক্ষ্ম চিৎকার…
” আপুইইইই তুমি কইইই আপুউউউউ…”
ভয় পাচ্ছিলো ছয় বছরের বাবলু! সেই শেষ তার কন্ঠ শোনা। আঁধার থেকে মুক্ত হলো যখন বাড়িতে কী ভয়াবহ কোলাহল! ছিড়ে ছিড়ে মনে পড়ছে পেছন বারান্দার কোণায় পড়ে থাকা থ্যাতলানো মাথায় বাবলুর নিথর দেহ…ব্যথা পেয়েছে ডাক্তার দেখাতে হবে। মাকে ছুটে বলতে গিয়ে সবাই নদীকে আগলে ধরলো। হঠাৎ নদীর মনে হলো বাড়ির ছাদ যেন ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে,ছাদ ভেদ করে খোলা আকাশের চড়চড়ে রোদ তাকে ঝলসে দিচ্ছে। এই সব কি বাবার করা কর্মফল? হঠাৎ এই তান্ডবে কেন সব এলোমেলো হবে?
” নদী এই নদী, নদী…”
বাথরুমের দরজার বাইরে হাল্কা টোকা। নদী সম্বিত ফিরিয়ে এনে দ্রুত মুখ ধুয়ে নিলো। নদী বাথরুম থেকে বের হতেই রাবেয়া বললেন ” চোখ ফোলা কেন? ”
” ঘুমাচ্ছিলাম আন্টি”
” ওহ আচ্ছা। যাক একটু ভদ্রস্থ হয়ে এসো, রম্য এসেছে; কথা বলতে চাচ্ছে তোমার সাথে ”
নদী উত্তর দিলো না রাবেয়া দ্রুত বাইরে চলে গেলেন মেহমান আপ্যায়নে।নদী শুনেছে সোহরাব সাহেব একটু অসুস্থ । দেখা করার ইচ্ছে হলেও রম্যকে এড়াতে যায়নি।তবে রাবেয়া দেখতে গিয়েছিলেন, নিয়মিত যোগাযোগও করছেন। রম্যের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি খুবই আগ্রহী।
নদীর দাদাবাড়িতে লম্বা সময় আশ্রিতা ছিলেন রাবেয়া। পরিস্থিতির চাপে নদীকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন ঠিকই, তবে প্রাক্তন বিমানবালা রাবেয়ার একা থাকার অভ্যাস। উত্তরার পরিপাটি ফ্ল্যাটবাড়ি সারাদিন খালিই থাকে; রাতে বুটিকের কাজ সেরে রাবেয়া বাড়ি ফেরেন। তিনি সম্ভবত মিডিয়া জগতের সাথেও জড়িত, বড় বড় মডেলরা আসে হঠাৎ হঠাৎ । রাবেয়া তখন নদীকে বাইরে আসতে নিষেধ করেন । তার একান্ত জীবনে নদীর আগমনে ছন্দপতন হয়েছে এটা স্পষ্ট বোধগম্য।
রম্যের আগমনে নদী ইচ্ছে করলো ব্যাগ গুছিয়ে কোন ভাবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে। বিকাশে জমানো বেতনের পঁচিশ হাজার হাতে আছে, লুকানো ক্যাশ আছে পাঁচ হাজার ;কোন একটা নিরাপদ ঠাঁই কি পাওয়া যাবে না? বা পুরনো বাড়িতেই যদি ফেরে? যে বাড়ির গেটেই শাহীনকে শেষ দেখেছিলো, নদীর চিন্তার বেলুন চুপসে পড়লো। নিজের আত্মসম্মানকে খুন করে বেঁচে থাকাই কিছু কিছু মানুষের নিয়তি। নদী বসার ঘর এড়িয়ে কিচেনে চলে গেল পানি খেতে। রাবেয়ার নতুন কাজের মেয়েটাকে রান্নার নির্দেশ দিয়েছেন।দেখেই বোঝা যাচ্ছে আনাড়ি হাত, বেচারি পেয়াজ কাটতে রক্তারক্তি করেছে। নদী এগিয়ে গিয়ে ছুরি হাতে নিয়ে নিলো। সেকেন্ডের কাঁটার তালে নদীর হাত চলছে। কাজের ছুতো ধরেও যদি কারো দর্শন এড়ানো যায়। তবে শব্দ এড়ানো মুশকিল, বসার ঘর থেকে কথোপকথন শোনা যাচ্ছে —
” অর্ণব এলো না? নদীর সাথে পরিচিত হতো”
” না আন্টি অনি লম্বা জার্নি করে বেশ এক্সজসটেড, ড্যাডের সাথে থাকাই প্রেফার করলো, আমিও ইনসিস্ট করিনি ”
” দ্যাটস সো নাইস অফ হিম, তবে দেখা তো হবেই একসময়, তোমার আব্বুর শরীরটা হঠাৎ এত ভেঙে পড়লো…”
” এইটাই তো স্বাভাবিক আন্টি, এই দেশের অনিয়ম, পল্যুশন, ..
” আর মেনটাল স্ট্রেসও ” রাবেয়ার কন্ঠ তীক্ষ্ণ,” ওই সাইকোকে ধরার কোন অগ্রগতি কি হলো?
” এখনো নয় এই বিষয়টা আমাদের সবাইকে পিসড অফ করে দিচ্ছে!নিয়মিত পুলিশের কাছে আপডেট নিচ্ছি সামান্য একটা মানুষকে ধরতে এত দেরি, গোটা সিস্টেমটাই যেন করাপ্টেড। যার কারণে নদীর সিকিউরিটি নিয়ে ড্যাড বেশি লোড নিচ্ছেন… ‘
” স্বাভাবিক রম্য। আমরা এই এতিম মেয়েটার কোন উপকার করতে পারছি না উল্টো লাইফ রিস্কে ফেলে দিয়েছি, এন্ড অল থ্যাংকস টু ইউ ”
” আন্টি আমি বুঝতে পারছি না তোমরা সবাই অর্থডক্স ইন্ডিয়ানদের মতো বিহেভ কেন করছ। আমাকে কি চেনো না? ওই সিচুয়েশনে আমি শুধু একটা বন্দী মেয়ের হেল্প করতে চাচ্ছিলাম। এখন ওকে মুক্ত করতে চাচ্ছি, বিষয়টা তো সিম্পল! ”
রাবেয়া হেসে বললেন, ” রম্য তোমাদের জেনারেশনের সমস্যা কি জানো? সবকিছুই তোমাদের কাছে সিম্পল। প্রেম করা সিম্পল, বিয়ে করা সিম্পল, আবার ঠাস করে ডিভোর্স দেওয়াও সিম্পল। এত এত সিম্পল কাজ করতে গিয়ে লাইফটাকে কমপ্লিকেটেড করে ফেলো। এই দেশের পরিস্থিতিতে একটা ডিভোর্সি মেয়ের লাইফ কেমন তুমি জানো?
” দুজন মানুষ নিজের সমস্যার জন্য বুঝেসুঝে ডিভোর্স দেবে সেটার জন্য দেশের পরিস্থিতি কেন দেখতে হবে?” রম্যের অবাক হওয়া প্রশ্ন।
নদী কাজের মেয়েটাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলল। কোন ধরনের আওয়াজ তার কান পর্যন্ত আর যেন না পৌঁছে। তাকে নিয়ে এমন মিটিং আজ এই প্রথম নয়, আঠেরো বছরের জীবনে কয়েকদফা হয়েছে। সবচেয়ে প্রথমে হয়েছে বাবা মারা যাবার পর, এতদিন সুবিধা নিয়ে যাওয়া মামা-খালাদের চোখে মুখে দায়িত্ব ঘাড়ে চাপার আতঙ্ক; মা দৃঢ় গলায় বলেছিল কারো কোন সাহায্যের দরকার নেই; আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে চলার ক্ষমতা রাখি।
কিন্তু আল্লাহ সময় মতো তাঁর ক্ষমতা দেখালেন। পরিবারে একমাত্র বেঁচে রইলো নদী, তাকে নিয়ে নতুন মিটিং হলো মামা খালাদের মধ্যে। প্রিয়মুখ যাদের কাছ থেকে এতোকাল শুধু স্নেহ পেয়ে অভ্যস্ত ছিল, তাদের কেমন গাম্ভীর্য আর বিরক্তি মাখা অভিব্যক্তি। অতীত ভাবতে ভাবতেই ভেতরের ক্ষোভটা ফুসে উঠলো গরম তেলে পেয়াজের বাগাড়ে।
” এটা বেশ রিস্কি”
রম্যের কথায় চমকে উঠলো নদী। কিচেনের দরজায় বেশ সাবলীলভাবেই দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে রাতজাগা ক্লান্তি হলেও কিছু মানুষের রূপে বিশেষ পার্থক্য হয় না। গাঢ় নীল টি শার্টে বয়স আরও কমিয়ে কিশোর বালকের মতো লাগছে।অপমানকারীর মুগ্ধ দৃষ্টি প্রাপ্য নয়, নদী মুখ শক্ত করে ঘুরিয়ে নিলো।
” গরম তেলে এভাবে পেয়াজ ছাড়লে হাত পোড়ার সম্ভাবনা থাকে “রম্য কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
“আপনি পেপারস এনেছেন? দিন আমি সাইন করে দেই” নদী ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্যানে থাকা পেয়াজ নাড়ছে।
” পেপারস রেডি করেছিলাম কিন্তু একটা ছুটো সমুস্যা হয়েছে । ”
নদী তাকিয়ে আছে।রম্য স্বগতোক্তি করে বলল,
” ড্যাড দেখা করতে চাচ্ছে তোমার সাথে। আমি তাকে মিথ্যা বলেছি যে শাহীন এরেস্ট হয়েছে, এবং চাচ্ছি তুমিও তাই বল। তার সাথে দেখা করে অন্তত বল যে সব ঠিক আছে ”
” তিনি অসুস্থ বলেই তার সামনে গিয়ে মিথ্যা বলা উচিত নয়”
” নদী বোঝার চেষ্টা করো ড্যাড খুব ছেলেমানুষী জেদ ধরে বসে আছেন। তার করনারি ব্লকেজ হয়েছে ইমিজিয়েট অপরেশন লাগবে, তিনি করাতে চাইছেন না যতক্ষণ না আমি তোমাকে নিজের বাসায় এনে তুলি ”
” যেটা আপনার পক্ষে সম্ভব না”নদী সমস্ত আক্রোশ নিয়ে গরুর মাংসগুলো বেসিনের ট্যাপে কচলে ধুয়ে নিচ্ছে৷
রম্য সালাতের জন্য কেবেজ আর শসা নিয়ে কাটতে কাটতে সরল গলায় বলল,
“ওয়েল যেহেতু ড্যাড চাইছেন না যে তুমি এভাবে এত আনপ্রটেকটেড থাকো। এই বিষয়ে আমার একটা সেকেন্ড থট আছে। ”
নদীর চোখ প্যানের দিকে হলেও কান খাড়া রম্যের কথায়। রম্য আনারস স্লাইস করতে করতে বলল ” এই ম্যাক্সিকান সালাদটা খেয়ে যদি ভালো লাগে তুমি আমার অফারটা রাখবে। ভালো না লাগলে বাতিল”
“অফারটা কী?”
” তুমি আমার বাড়িতে মুভ কর”
” মানে?”
” দেখ রাবেয়া আন্টির বাসা তোমার কলেজ থেকে দূর, যাতায়াতে কষ্ট হচ্ছে।
যেহেতু ব্যাপারটা তোমার সিকিউরিটির , বেটার তুমি আমার বাড়িতে চলে এসো। আমার বাসা যথেষ্ট বড়। তোমার ওয়ার্কপ্লেসও ওইখানে। বাট দ্যা প্রব্লেম ইজ… দিস হাজবেন্ড ওয়াইফ নাটকটা, এই জন্যই আমি ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম ওটা হয়ে গেলে একেবারে নিশ্চিন্তে … ”
“মানে কী ডিভোর্স নিয়ে আমি কোন অধিকার আপনার কাছে থাকবো? ” নদীর হতভম্ব হয়ে বলল।প্যানে তার মশলা পুড়ে যাচ্ছিলো।
“অধিকার! ” রম্য প্যানের মসলায় পানি ঢালতে ঢালতে বলল,” নদী তুমি তাকে ভয় দেখাচ্ছ যে ভূতে বিশ্বাসই করে না।বিয়েটা আমার জন্য তেমনই৷ যা আমি মানিই না তার আবার অধিকার। জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজন আছে তবে ধরাবাঁধা কমিটমেন্টের জঞ্জাল নয়। ন
নদী স্থির তাকিয়ে আছে,রম্য একটু থেমে বলল,
দেখ, আমরা একজন আরেকজনকে মোটামুটি ভালোই চিনি, পছন্দও করি। বিয়েতে না থাকলেও তোমার সাথে লিভ ইনে আমার আপত্তি নেই।”
” আপনি ভূতে বিশ্বাস না করতে পারেন কিন্তু কমিটমেন্টকে ভূতের মতোই ভয় পান, এই ধরনের মানুষের সাথে লিভ ইনে আমার আগ্রহ নেই ”
নদী রম্যের হাতের স্পেচুলা নিয়ে জোরে জোরে প্যান নাড়ছে। উত্তেজিত উঁচুনিচু শ্বাস, নাকে অভ্রমাখা বিন্দু ঘাম, কানের পাশে লতানো চুল, শ্যামলা গাল লালচে,
সেটা আগুনের তাপে না রাগে বোঝা যাচ্ছে না।
“ড্যাম হট! ”
রম্যের মুখ থেকে একাই বেরিয়ে গেল। কুকিং প্যানে বল্কে ওঠা লাল মসলায় কী অসাধারণ এরোমা। রূপবতী কুকের তৈরি সৌরভেই স্বাদের অনেকটা আন্দাজ করা যায়। কী ভয়ংকর রেগে আছে, তবে রাগলেই তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। এই আগুনে ঘি দিতেই রম্য নিচুগলায় বলল,
“আমার সাথে থাকলে আমি তোমাকে আমার কিচেন ব্যবহার করতে দেব, এই অফার আমি কাউকে দিই না ”
” পরম সৌভাগ্য আমার,ধন্য হয়ে গেলাম! কিন্তু লোভ সংবরণ করা শিখে গেছি ” নদী মাংস কষানোয় মনোযোগ দিলো। এই বান্দার সাথে কথা বলাই বেকার।
রম্য গরম চুলোর আঁচ কমাতে কমাতে বলল,” ইমোশন ইগো একটা সাইডে রেখে একটু টেকনিক্যালি ভাবো,ড্যাডকে এখানে আমি কিছুতেই অপারেশন করাবো না। কিন্তু তিনি তোমার সাথে কথা না বলে যাবেন না।
তুমি নিজেকে একটু লাকি ভাবো, তোমার এডুকেশন, ডেইলি নিডস আমি সব কিছু দেখব সব সিকিউরিটি দেব।শুধু এখন তুমি আমাকে একটু সাহায্য কর,বিনিময়ে আমিও ঠকাবো না ”
নদী ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে বলল ” রম্য
আপনি কত লাকি জানেন, আপনার জায়গায় কোন বাংলাদেশী ছেলে যদি এমন আবজাব কথা বলতো, বিনিময়ে আমি তাকে দিতাম চ্যালাকাঠের বাড়ি! ”
রম্যর হতভম্ব দৃষ্টি এড়িয়ে নদী প্রসার কুকারের ঢাকনা লাগালো।” বাবাকে জোর করে নিউইয়র্ক নিয়ে যান। এই দেশের মানুষ আপনার মহান মানবিক যুক্তি বুঝবে না। আর আমিও স্ত্রীর পরিচয় ছাড়া দশজনের সামনে ঢ্যাং ঢ্যাং করে আপনার বাড়িতে থাকতে যাবো না। বেটার আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে চাকরিই ছেড়ে দেই শাহীন আমার মুখ পুড়িয়ে দিলেও সেটা তখন আপনার হেডেক হবে না ”
প্রেসার কুকারে প্রথম সিটি আসছে; নদী স্টোভ মুছে ফেলেছে। কিচেনের কাজ শেষ এখন বের হয়ে যাবে, রম্য সালাদের বাটি এগিয়ে বলল,’ তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছ।”
” আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম ”
নদী কিচেন থেকে দ্রুতই বেরিয়ে গেল। যদিও রম্য চাইছিল নদী সালাদটা টেস্ট করুক । অর্ণবের কথায় এখন অবাক লাগছে ” এখন এটলিস্ট তার সামনে গিয়ে দাঁড়া অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে।এরপর সোজা সরি ডার্লিং বলবি,আরও বলবি তুই বুঝতে পারিসনি যে তুইও তাকে কিভাবে ফিল করিস। এখন ওই এটাকের পর তার জন্য তুই চিন্তিত; মন থেকে পুড়ে যাচ্ছিস, ওর বিরহে মরে যাচ্ছিস এটসেট্রা এটসেট্রা …।
কোনভাবে পটিয়ে-পাটিয়ে আপাতত বাবার সাথে মিট করা,এরপর বাবাকে নিয়ে আমি মুভ করি। তারপর তুই তোর মতো গুছিয়ে ফেল। টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান মেয়েরা একটু ইমোশন দেখলেই গলে পানি হয়ে যায়, সেটার সুযোগ নে। এইসব সত্যবাদীতার ধার দিয়ে গেলে জুতোর বাড়ি জুটবে। ”
ভাইকে ভেবে রম্যের হিংসাই হচ্ছে। অর্ণব একটা মেয়ের ছায়া দেখেই তার ক্যাটাগরি ধরে ফেলে। কিন্তু অর্ণবের কথা শুনে সাতক্ষীরায় ভালোই ধরা খেয়েছিল। দ্বিতীয়বার রম্য ভুল করতে চায়নি। মূলত মিথ্যা আশার ভিত্তিতে কোন সম্পর্কই স্থায়ী হয় না, উল্টো হৃদয় ভাঙে।
” এই যে আপনার আমানত”
নদী ফিরে এসে বাড়ির ব্যাকডোরের চাবি এগিয়ে দিলো,” ওই পেপারসের সাথে এটাও অনেকদিন ধরেই আমার কাছে ছিল, বারবার ফেরত দিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছিলাম ”
” তুমি যদি চাও এই চাবি তোমার হতে পারে, “রম্যের চোখ চকচক করে উঠেছে হঠাৎই, “সোশ্যাল রিলেশন ছাড়া তোমার সবার সামনে বাসায় ঢোকারই সমস্যা তাই না? সেদিন রাতে কিন্তু তুমি সিকিউরিটি পারপাসেই আমার বাসাতে ছিলে, কেউ জানেনি; তুমি চাইলে ভবিষ্যতেও কেউ জানবে না ”
নদী হা করে তাকিয়ে আছে, রম্য ষড়যন্ত্রির মতো বলল,” থিংক এবাউট ইট, আমার বাড়ির এই এট্রেন্সের কথা তেমন কেউই জানে না। তোমার দরকার সিকিউরিটি,আমার দরকার বাবাকে ঠান্ডা করা আর একজন ভালো কম্পেনিয়ন ,একসাথে থাকলে আমাদের দুজনেরই লাভ। এই রিলেশনটা যদি ওপেনই না হয় তাহলে সমস্যাই থাকে না। প্রাইভেসি মেইনটেইনের দায়িত্ব পুরো আমার ”
নদী চুপ করে আছে। কখনো মানুষ সামনের দিকে তাকিয়ে অদৃষ্ট দেখার চেষ্টা করে । রম্য সালাদের বাটি এগিয়ে দিলো,” ট্রাই ইট, ভালো না লাগলে তোমার মর্জি…”
নদী যেন বাস্তবে এলো, মানুষটা কি ঠাট্টা করছিলো তার সাথে অথবা পিতৃশোকে ছেলেমানুষের মত আচরণ করছে বুঝতে পারল না । নতুন তর্কের আশা ছেড়ে একটা ফর্ক দিয়ে সালাদ মুখে দিল, ”
টেস্টি, মিষ্টি, তবে আমি মিষ্টি সালাদ খাই না”
নদী চাবি রেখে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল।
*****
” সব্জির পুরে কি হিং দিয়েছ? ”
ভেজিটেবল সিংগাড়াটা দ্বিতীয়বার কামড় বসিয়ে শোভার প্রশ্ন।প্রত্যুত্তরে নদী মাথা নাড়লো। কারো কর্ম নৈপুণ্যে তারাই মুগ্ধ সরাসরি হননা যারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন শোভারও তাই দশা। শুরুতে বিশ্বাস হচ্ছিলো না এই সিংগাড়াগুলো দু আঙুল মেয়ের হাতের গড়া। খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন নীতিন বাবুও।
” হিং নয় সাথে সসও দিয়েছে, এতে স্বাদ খুলে গেছে, তুমিও পারবে না এমন ”
” কিচেনটা ঠিক হোক এই মেয়ের সাথে কম্পিটিশন করে দেখব কত ভালো রাঁধে হুহ.. ”
স্বামীর কথায় শোভা গজগজ করতে করতে উঠে গেলেন। কয়েকদিন ধরেই তার ফ্ল্যাটে ইন্টেরিয়রের কাজে ভাংচুর হচ্ছে । কিচেনের অবস্থাও বারোটা বেজে আছে। এই নিয়ে শোভা প্রায় প্রতিদিন ঘ্যানঘ্যান করেন স্বামীর কাছে। নদী ঠিকানা খুঁজে প্রিয়প্রাঙ্গণ এপার্টমেন্টসে আসার পর নতুন অতিথিকেও এই কর্মযজ্ঞের অভিযোগ করতে ছাড়েননি। নদী বিব্রত হয়ে বলল,’ আমি মনে হয় এসে ঝামেলায় ফেললাম ”
নীতিন বাবু স্ত্রীর দিক থেকে মনোযোগ দিলেন ছোট্ট রাধুনির দিকে, ” কে বলল, তুমি না এলে আমি নিজেই হয়তো তোমায় খুঁজে বের করতাম ”
“স্যার আমারই ভয় লাগছিল আসতে, সেদিন আমার বাবাকে নিয়ে আপনি কিছু বলছিলেন… ”
“আজও বলব, তার আগে জানতে চাই তুমি তোমার বাবা সম্পর্কে কতটা জানো, কীভাবে তার মৃত্যু হয়, এসব কতটা জানো? ”
-নির্বিবাদী ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন,আর আম্মু হাউস ওয়াইফ। আমার অনেক ছোটকালে রক্তের একটা জটিল অসুখ হয়। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হতো, অনেক খরচ ছিলো,তখন বাবা ব্যাংকে আমার দাদার কেনা ধানমন্ডির বাড়িটা মডগেজ রেখেছিলেন, যেটার ঋণ শোধ হচ্ছিলো না, মামাদের মুখে শুনেছি এইসব টেনশনে স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয় ”
নীতিন মন্ডল দুঃখিত গলায় বললেন – এই তথ্যগুলোই যদি সব হতো তাহলে ভালো ছিলো।কিন্তু এগুলোই সব নয়, সম্ভবত নাসির সাজ্জাদ কোন ভাবে গ্যাম্বলিংয়ের সাথেও জড়িত ছিলেন।
নদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
-তুমি এই বিষয়ে কিছুই জানো না?
– কিছুই না ”
-আমার ইনভেস্টিগেশন টিমের সূত্রমতে বলছি যা তোমার জানা দরকার। এই ঢাকা শহর টা দেখেছ, এই শহরটা যতটা আলোকিত ততটাই আধারিত। শহরের ঝলমলে আলোর নিচে এইগুলা যারা পরিচালনা করে তারা ভিন্ন সমাজেরই মানুষ। এমনই কিছু মানুষ তোমার বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো এবং এই টাকার গড়মিলেই সম্ভবত নাসির সাজ্জাদের হাইপার টেনশনে মৃত্যু হয়!
– অসম্ভব!আমার আব্বু খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
নীতিন হাসলেন – আমি দু:খিত মেহরোজ, বাবা-মা আমাদের জীবনের আইডল, তাদেরকে আমরা সব সময় নিখুঁত দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু বাবা মায়েরা মানুষও হয় তাদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক থাকে। তোমার বাবার বিষয়ে যতটা জেনেছি নিঃসন্দেহে তিনি ভদ্রলোক ছিলেন তবে কোন ভাবে বা বিপদে পড়েই হয়তো তিনি এইপথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। একটু মনে করে দেখ তোমার বাবার কি তাস খেলার নেশা টেশা ছিলো? না থাকলে আমি ভুল…।
নদী থম ধরে বসে রইলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। কারণ নীতিন মন্ডল ভুল বলেননি বাবা খুব ভালো তাস খেলতেন। ব্রিজে বন্ধুদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হতেন। ড্রইংরুমে হইচই করা আসর বসতো রাতের পর রাত। মা চেঁচাতো, বাবা তবুও নেশা কাটাতে পারতেন না।
নীতিন হঠাৎ স্বগতোক্তি করলেন,
“নাসির সাহেবেরর মৃত্যুর ছয়মাস পরে তোমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল; যে ঘটনায় তোমার মা এবং ভাই… আচ্ছা সে কথা বাদ। একটু মনে করে বল, তখন বাড়িতে কি অনেক টাকা পয়সা নিতে পেরেছিল?”
“আমার ঠিক মনে নেই স্যার” বলতে বলতে এক ঝলকে উত্তরটা মনে পড়লো,
বাবা মারা যাবার অল্প কিছুদিন আগের কথা; গভীর রাত,নদী ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার মুহূর্তে বাবা-মায়ের ঘরে আলো জ্বালা দেখেছিলো। ভেড়ানো দরজায় চোখ পড়তেই দেখলো মা আলমিরা থেকে তার গয়নারবাক্স গুলো নামিয়ে বাবার হাতে তুলে দিচ্ছেন।
-দ্যাখ চেষ্টা করে এই দিয়ে হয় নাকি,
– কী বল মিনু! আমার মায়ের এগুলো। নদী আর অয়নের জন্য তুলে রাখা।
– আমরা থাকলে আরও গড়ে দিতে পারব আগে এদের থেকে পিছু ছাড়াও। আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছে আর সহ্য হচ্ছে না। এ কী সর্বনাশ ডেকে আনলে তুমি!
ছেড়ে আসা অতীতের আহাজারি কানে বেজে সমস্ত শরীরে শীতল স্রোত বইয়ে দিচ্ছে নদীর।নীতিন মন্ডল কোমল গলায় বলছেন,
” জুয়ার ভয়ংকর কিছু নিয়ম থাকে।মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব জুয়ার আসরে সম্পদ, রাজ্যপাট এমনকি স্ত্রীও হারিয়ে ছিলেন…। এখন তুমি আমায় এইটার জবাব দাও ঢাকায় বর্তমানে তোমার আসল পরিচয় কে কে জানে? ”
“আমার একজন ফুপু আর সোহরাব সামদানী জানেন”
“গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের মালিক? যে তোমাদের বাসা লিজ নিয়ে রেস্টুরেন্ট চালান, উনি? ইন্টারেস্টিং! ”
নীতিন ভ্রুকুটি করে তাকালেন। কিছু যেন বুঝতে চেষ্টা করছেন। কিছু একটা ভেবে নিজেই বললেন —
” সম্ভবত সোহরাব সাহেবও নাসির সাহেবের বিষয়টা খুব ভালো মত জানেন এইজন্যই নিজের কাছে রেখেছেন তোমাকে, ফর ইউর সিকিউরিটি ”
” উনি সব জানেন? ”
“আমার আন্দাজ, এটা অসম্ভব কিছু না যেহেতু তিনি তোমার বাবার বন্ধু মানুষ ছিলেন। আমার জানামতে সোহরাব সাহেবের প্রফাইল মোটামুটি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার,দেশের কৃতিছাত্র দীর্ঘদিন আমেরিকার সরকারি লইয়ার ছিলেন , পরবর্তীতে ভালো রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, সেলফমেইড ম্যান… উনি বুঝেসুঝেই তোমাকে চোখের সামনে রেখেছেন। সত্যিটা তোমায় জানাননি, তুমি আরেকটু বড় হলে হয়তো জানতে। যতটা আমার মনে হয়, তার ছত্রছায়ায় থাকাই তোমার জন্য ভালো ”
নীতিন মন্ডল আরও অনেক কথাই গুছিয়ে বললেন নদীর সেসব ঠিক মতো কানে যাচ্ছিলো না,
—বড় অবেলায় এলে মেয়ে,আমি অনেক বড় একটা ডকুমেন্টারিতে বিজি বুঝলে ; লম্বা সময় থাকতে হবে ঢাকার বাইরে। ফিরে এসে তোমার বাড়ির কেসটা জোরেশোরে ধরব। আমার আন্দাজ আছে এই বাড়ি নিয়ে ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত,বিশাল রাঘববোয়ালদের দল এরা। কৌশলে আগাতে হবে, সোহরাব সাহেব আর তোমার হয়তো কিছু সাহায্যও লাগবে। ততক্ষণ তুমি সাবধানে থাকবে। ফিরে এসে অবশ্যই আমি এই কেসটা ধরব.., অনেক চেহারা থেকে পর্দা সরবে জেনে রেখো।’
কথাগুলো নদীর বুকে যেন ঝড় তুলছিল; চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল কিছু না মেলানো হিসাব। বড়মামা বার বার কেন এই বাড়ির থেকে নদীকে দূরে থাকতে বলেছিলেন; সোহরাব সাহেবই বা নদীকে রক্ষায় এত উতলা কেন?
নীতিন বাবু যা বললেন তা ঠিক হলে এই মুহূর্তে রবীন্দ্র সরোবরের পাশদিয়ে আনমনা হয়ে হাঁটার মাঝেও তার নিরাপত্তা নেই। থেকে থেকে মনে হচ্ছে সত্যি কেউ যেন পিছনে আসছে।চোখ ঘুরিয়ে ভিড়ের মাঝে তেমন কেউ নজরে আসে না। চাপা দুশ্চিন্তায় খুব অযৌক্তিক ভাবেই রাবেয়া আন্টির কথাগুলো মনে পড়ছে,অথবা নদীর ভেতরের স্বার্থপর সত্তা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—
” অভিমান করা বোকাদের ভোঁতা অস্ত্রের মতো নদী। এতে কোন লাভ হয় না”
” আন্টি আপনি কি বুঝতে পারছেন রম্য কী চাচ্ছে? ”
” তুমি নিজের চাওয়াতে কেন কনসানট্রেইট করছ না ? ঢাকায় পালিয়ে আসার সময় তুমি জীবনের কাছে কী চেয়েছিলে? কারো ঘরনি হয়ে সংসার পাতা?বছর ঘুরতেই ল্যান্ডাপ্যান্ডা মানুষ করা? তাহলে এলেই বা কেন? ”
” সাতক্ষীরায় যা হয়েছে আমি তা চাইনি কিন্তু… ”
” এখনো কিছু বিগড়ে যায়নি নদী। তোমার নিয়তিই এখানে টেনে নিয়ে এসেছে, ধরে নাও তোমার লাইফটা একটু নাহয় আলাদাই। কিছু পেতে চাইলে তার জন্য এফোর্ট দিতে হয়,তুমিও দাও। বিয়ের সম্পর্কটা রম্য বোঝে না, তাকে বোঝাও, তার কাছাকাছি যাও।”
“আমি যাইই করি, ও আমাকে কিছুতেই স্বীকৃতি দেবে না আন্টি ”
” তাহলে স্বীকৃতির পেছনে ছোটাই বন্ধ কর।আপাতত নিজের স্বার্থ বোঝ। একটা সিকিউরড হোম,নির্ঝঞ্ঝাট, নিরিবিলি। বাসাভাড়ার দরকার নেই, খাওয়ার খরচ নেই,নির্বিঘ্নে চাকরি আর পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। তোমার মামা খালারা কি এখন তোমার দায়িত্ব নেবে? ডিভোর্স হলে আরও নেবে না।ওইবাড়িতে তুমি তোমার বিশ্বাস নিয়ে থাকো,তাকে তার বিশ্বাস নিয়ে থাকতে দাও। যে যার মতো থাকো কিন্তু একসাথে থাকো। বারুদ আগুনের কাছাকাছি কতদিন ঠান্ডা থাকবে? অন্তত তুমি তো জানো তুমি ভুল করছ না। জীবনের কিছু মোড়ে অযথা আবেগ, অভিমান, দূরত্ব কোন কাজের কথা হয় না। ব্যাপারটা পজিটিভলি দেখ বোকামেয়ে, রম্যর হিসেবে সে তোমাকে লিভ ইনে ইনভাইট করছে, অন্য অর্থে তুমি চন্দ্রমল্লিকায় ফেরত যাচ্ছ। অধিকার নিয়ে; কারণ ওটা তোমার বাড়ি নদী। হারানো রাজত্ব ফেরত নিতে ইচ্ছে করে না? ”
জমিনে ঘষে চলা পায়ের শব্দে নদী চিন্তার জাল ছিড়লো। মনে হলো রাস্তার বামদিক থেকে সত্যি কেউ যেন আসছে পেছনে।আড় চোখে খেয়াল করলো কালো শার্ট পরা হাতে সিগারেট। একাকী হাঁটা তরুণীর পিছু নেওয়াও নেশার মতো। নদীর মুহূর্তে গলা শুকিয়ে এলো। আরেকটা মোড় ঘুরলেই একটা চেনা ঠিকানা। বুকে তীব্র ভয়,মনে ভয়ংকর দ্বিধা…,কী করবে? পিছন থেকে ছেলেটার পায়ের গতি বাড়ছে।বাবা মা বাবলুর ছায়া ঘেরা পথ উপরে ছাদ হীন বিশাল আকাশ ; নদীর হঠাৎ যেন ক্লান্তিতে পা থেমে যাচ্ছে, বুকে অভিমানের ওজন।
*****
হাস্পাতাল থেকে এসে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়েছে। সোহরাব সাহেব জেদ ছাড়েননি।” আমার মেয়েটার সাথে কথা বলা খুব জরুরি রম্য ওর কোন ক্ষতি আমি এফোর্ট করতে পারব না”
” আমি ওকে বুঝিয়েছি ড্যাড ”
” নিশ্চয়ই তুমি যথেষ্ট কনভিন্সিং ছিলে না।আর মেয়েটা কেনই বা আসবে,তুমি ছেলেখেলা খেলেছ মেয়েটার জীবন নিয়ে
এই দেশে ডিভোর্সের অর্থ জানো? ”
অর্ণব বলল হেসে বলল ” অর্থটা তুমি আমায় ফ্লাইটে যেতে যেতে বুঝিয়ো ড্যাড আপাতত একটু শান্ত হও”
” কোন লাভ নেই অনি, ডাক্তারদের এখানেই অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে বলেছি। তোমরা দায়িত্ব নেবে না, মেয়েটাকে অরক্ষিত রেখে আমি পালাতে চাই না”
অর্ণব বলেছে রাতের মধ্যে বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করবে, তবে রম্য মনের মাঝে অদ্ভুত একটা চাপ নিয়ে বাড়ি এসেছে। মুখ অন্ধকার করে ঘর গোছাচ্ছে, কাপড় দিয়েছে ওয়াশিং মেশিনে, রাতের ডিনার রেডি করছে । আজ অনি বাড়ি আসবে বলেছে। রম্য চাইলে রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করতে পারে, সালেম নিজেই দিয়ে যাবে। কিন্তু কখনো কখনো রাগে একাই মুখে কুলুপ এঁটে যায় । অনি আসতে আসতে তার পছন্দের পাস্তা এন্ড চিজ রেডি করে ফেলবে ।
কাজের মধ্যেও মন বিক্ষিপ্ত, সব কিছুর জন্য কেমন নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। এই দেশে সে এসেছিলো ফ্রাস্ট্রেশন কাটাতে, পরিস্থিতি ঠিক মতো না বুঝেই অদ্ভুত ঝামেলায় জড়িয়ে গেল। অর্ণবের কল আসছে অনেকক্ষণ ধরে রম্য খেয়ালই করেনি।
“বল অনি ”
” হোটেলে ব্যাক করছি, ভয়ংকর জ্যাম রমি। একঘন্টা ধরে গুলশানের ট্রাফিকে দাঁড়ানো, উইয়ার্ড একটা জায়গা! তোরা থাকিস কী করে? ‘
” ড্যাড কেমন? ‘
” আগের মতোই ওই মেয়ের সাথে কথা না বলে নড়বেও না। ”
” তার মানে অপারেশন এখানেই? ”
” মাথা কি খারাপ রমি? এমন অদ্ভুত জায়গায় তোর মনে হয় ড্যাডকে আস্ত বাঁচাতে পারব? আমার অন্য একটা প্ল্যান আছে ..”
” কী প্ল্যান.. ” রম্য কথা বলতে বলতে কান খাড়া করে ফেলল। অর্ণবের কথার গুরুত্ব দিতে পারল না
” কীরে রমি শুনছিস? ”
” না শুনছি না, খুটখুট শব্দ হচ্ছে কোথাও সম্ভবত ঘরের উত্তর দিকে” রম্য দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে গেস্ট রুমের থেকেই স্পষ্ট আওয়াজ আসছে কারো যেন ছায়া সরে গেল সেখানে।
ওপাশ থেকে অর্ণব বলে যাচ্ছে ” ওই বাড়ির ভূত? নো ওয়ে… তাহলে তো আসার দরকার ছিল, ফাইনালি বদগুলোকে ধরতে পারলে… ”
” ইটস ইউ! ” অর্ণব রম্যের বিস্ফোরিত কন্ঠ শুনল।
নদী চমকে ঘুরে তাকিয়েছে। সমস্ত অবয়বে দ্বিধা অস্বস্তি আর আড়ষ্টতা। বিস্ময় কাটিয়ে রম্য এগিয়ে এল
” কখন এলে কীভাবে এলে”
“পেছনের গেটে দিয়ে। আপনি রাবেয়া আন্টির কিচেনে ব্যাকডোরের চাবি রেখে এসেছিলেন”
রম্য অর্ণবকে পরে কল দেবে বলে দ্রুত ফোন রাখলো। অর্ণব কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো, রম্য কিছু লুকাতে চাইলে তার মাথা ধরে। তবে রম্যর ধাক্কাটা সামলাতে সত্যি সময় লাগছে।
নদী একটু সময় নিয়ে বলল,
” এই বাড়ির থাকার অফারটা কি এখনো ওপেন আছে? আমি স্যারের সাথে দেখা করতে চাই!বলতে চাই যে আমি এখন থেকে তার ছেলের সাথেই থাকব যেভাবে সে চায়”
” আর ইউ শিউর? আমি কিন্তু সত্যিই তোমার হাজবেন্ড হতে পারব না ”
” আপনি আমার হাজবেন্ড না হলে ডিভোর্সের প্রশ্নও আসবে না। ঠিক না? ”
” ঠিক! ” রম্য যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যদিও মনে মানছে না যে নদী সত্যি এসেছে ।ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে এগিয়ে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়, নিজেকে বিশ্বাস দিতে সহজভাবেই হাত বাড়িয়ে দিলো,
“আশাকরি এই বাড়িতে তোমার থাকার অভিজ্ঞতা চমৎকার হবে, ওয়েলকাম টু মাই হাউজ নদী ”
“ওয়েলকাম টু চন্দ্রমল্লিকা রম্য ”
নদী করমর্দন করতে করতে স্পষ্ট গলায় বলল।এমন অদ্ভুত প্রতুত্তরে রম্য প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে, যার জবাব তাকে সময়ই বলে দেবে।
(অনলাইন পর্বের এখানেই সমাপ্তি)
Golper baki ta ki kore pabo?