#বাতাসের_তার_সৌরভ–১৬
বিকালের দিকে বেশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামলেও রেস্টুরেন্টের গেস্ট খুব কম ছিলো না।বিকেলে বেকারি কর্ণার বেশি বিজি থাকে।মূলত শুরু থেকেই জায়গাটা গ্যাব্রিয়েল ক্যাফে হিসেবেই পরিচিত ছিলো। এখানকার স্ন্যাকস, পেস্ট্রি আর বিভিন্ন জাতের কফির বাধা খদ্দের আছে৷ তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও তুষারের মনটা অদ্ভুত তারল্যতায় পেয়ে আছে। ভেতর একটা জয়ের আনন্দ। রাফিনকে ফাইনালী ক্যাপচার করে ফেলেছে র্যাব। মূলত এটায় সোহরাব স্যারের রেফারেন্সটা উল্লেখ করায় কাজে এসে গেল। এদিকে স্যারও কিছু জানলো না।
রাফিন এরেস্টেড,তাহলে নদীও খুশি আর নদীর খুশি মানে একটা গ্রীন সিগনাল।মেয়েটা যেন একেবারে খাপে খাপ। পরিশ্রমী,উপার্জনক্ষম, পরিবারের পিছুটান নেই, দেখতেও মন্দ না এমন মেয়ে কায়দা করতে পারলে অর্ধেক লাইফ সেট। দুপুর থেকেই ডিউটির মাঝে খুঁজে ফিরছিলো তুষার,
” রাজিয়াপা বৃষ্টি তো বাড়ছে নদী আসেনি এখনো ডিউটিতে? ”
“আমি কি তার পিএস?” রাজিয়ার ঠান্ডা গলায় হোঁচট খেল তুষার। বুঝলো ভুলক্রমে ভুলমানুষের কাছে মুখ ফসকেছে।তবে ভুলমানুষটা দক্ষ জোহরি।
” তার সাথে ভাব হইসে দেখছি আমি তবে ভুল-টুল কিছু কইরো না তুষার। এক্কেবারে বিপদে পড়বা”
– বুঝলাম না রাজিয়াপা?
” বুঝতে চাইতেসো না। সময়মত টের পাবা।সে অনেক চালু মেয়ে অনেক ওপরে নজর”
” কী বলেন রাজিয়াপা..”
” ঠিক বলি এর জাল কতদূর ছড়ানো জানো? ” রাজিয়া গলা নামিয়ে ফেললেন, ” বড় স্যার একে বের করে দেবার অর্ডার দিসিলেন, গ্যাব্রিয়েল স্যার ডেকেও পাঠালেন। ক্যাবিনে ঢুকে দরজা কি লাগলো, সব কেচ্ছা পালটে গেল।পুরো গনেশ উল্টে গেলো। বেতন বেড়েছে হাফ টাইম ডিউটি তবুও পার্মানেন্ট হয়েছে; আবার পার্টি এটেনডেন্স কমিশন আলাদা।জীবনে শুনেছ এগুলো কোথাও? ”
তুষার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে। রাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল, ” আমরা কি গাধা? কিছু বুঝি না আসল সার্ভিস সে কোথায় দিচ্ছে?এই মেয়ে বাপ ছেলে দুইজনকেই ”
রাজিয়ার দুর্গন্ধময় মুখ থেকে আরও কিছু দুর্বায়ু কথা বের হতো, তবে নদীর আগমনে তা থেমে গেল। ঝুম বৃষ্টির মাঝেই বিকালের ভিড় কম নয়, নদী একরাশ সতেজতা নিয়ে কাজে ঝাঁপ দিয়েছে। ছাদের বৃষ্টিতে ভিজে কেমন ফ্রেশ লাগছে। প্রচন্ড ব্যস্ত অর্ডারের মাঝে লিজাকে আবিস্কার করা হলো ওয়াসরুমে। কেঁপে কেঁপে উঠছে বিশাল শরীর, বোঝা গেলো মাথা নিচু করে কাঁদছে।
-কী সমস্যা লিজা?
লিজ তার ছোটছোট চোখ ফুলিয়ে আরও ছোট করেছে,গজগজ করতে করতে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল।
– কেউ কিছু বলেছে?
– তুমি শুনে কী উল্টাবা?একদিন নিজেই শিকার হবা জানোয়ারটার, লুইচ্চা, লম্পট,..
ঘটনা যা জানা গেল নাফিজ আজ নাকি পর পর দুবার অর্ডার পাসের সময় লিজার পশ্চাদশে হাত দিয়েছে।শেষবার ঘুরে গেল লিজা,
– আপনি কী করলেন?
-তোমায় একটু মজা দিলাম, ভাল্লাগে নাই?
নাফিজের কথায় লিজা সালিস বসাতে গিয়ে রাজিয়া ম্যামের ধমক খেয়েছে।নাফিজ ততক্ষণে কথা ঘুরিয়ে ফেলেছে, সে নাকি থাই সুপের ব্যাপারে বলছিল। লিজা চেখে দেখছিল তা ঠাট্টা করেছে। রাজিয়া এরপর আর কথা শুনতেই রাজি না। তার মতে নাফিজের নাকি রুচি এত নেমে যায়নি যে লিজার হাতির মতো পা*ছায় হাত বোলাবে। এরপরে আর কিছু বলার ছিলো না।
নদী অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিল, লিজা, নাফিজ, রাজিয়া এদের একদলের সদস্য মনে করতো। মাঝেমধ্যেই একজোট হয়ে নদীকে নিয়ে খিল্লি করতে দেখা যেত তিনজনকে তবে বোধ হয় লাম্পট্য সব দলের একতায় ছেদ করে।
– বেতন ছাড়াও গ্যাব্রিয়েল স্যার অনেক হেল্প করেন। ইদের সাথে আমাদের বড়োদিনেও বোনাস দেন। দেশে বাবার কাছে পাঠানো লাগে। তার শ্বাসকষ্টের ওষুধ আছে, বাড়ির বাজার আছে। গেস্ট পার্সেন্টেজ, টিপস.. এইসব তো ফ্যালনা না।হুট করে চাকরি তো ছাড়া যায় না কিন্তু কী করব? আমার মতো কারো শরীরে কেউ হাত দেয় এইটাও কেউ বিশ্বাস করে না। আমি তো সেই হাতি যেটার দাম নাই। হে জিসু তুমি দেখছ… ”
নদী ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সীমিত ক্ষমতার মানুষের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করারও থাকে না। কিন্তু আসলে কিছুই কি করার নেই?
লিজাকে নদী নিজের পক্ষে যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দেবার, দিয়ে বের হলো। ডিউটির মাঝে তুষারের উৎসাহী চোখ ভদ্রতার হাসি দিয়ে এড়াচ্ছে। রাফিন এরেস্ট হলে কালরাতে এই বান্দা ম্যাসেজ দিয়েছে যে আজ তাকে একটু সময় দিতে হবে।একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে।নদী মাথা ধরে গেছে তখনই। সিনেমার নায়িকাদের কৃতজ্ঞতার কারণে বাস্তবে প্রেম হয় না এই চরিত্রকে কে বোঝাবে? এখন তার গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে কীভাবে বাঁচা যায় নদী দ্রুত ভাবছে।
– এক্সকিউজ মি ইয়াংলেডি ক্যান ইউ প্লিজ হেল্প মি?
একটা ভরাট বলিষ্ঠ কন্ঠে নদী সোজা হয়ে গেলো। সামনে একজন পঞ্চাশোর্ধ সৌম্যদর্শন পুরুষ। মাথায় কাঁচপাকা চুল, রুপালী ফ্রেমে মাঝে থাকা চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল । নদী সোজা হেঁটে গেলো বা বলা চলে তুষার থেকে নিজেকে বাঁচালো।
******
” বাকলাভা! টারকির একটা অভিজাত ডেজার্ট, যা সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। টুমরা ঝানো, এটা কত্তো পুরাণ? প্রায় দুই হাজার বছর আগের। এটাকে বলা হয় সুলতান অফ ডেজার্ট।”
আজ যদিও উইকেন্ড নয়, গ্যাব্রিয়েল কিচেনের বুফেট নেই। তবুও কিচেনে জি এস স্যার এসেছেন।ডেজার্ট আইটেমের নতুন কিছু মেনু এড করা হচ্ছে, তারই একটার ক্লাস চলছে, বেকাররা সবাই তটস্থ৷ গ্যাব্রিয়েল সামদানীর ভাঙা বাংলা আর আমেরিকান ইংরেজির মিশেলের মোটামুটি তর্জমাটা বুঝে নিতে হয়,
“বাকলাভার তবে কিছু টুইস্ট আছে।এত শত লেয়ারিং যা দেখতে হেভি কিন্তু মুখে দিলেই গলে ভ্যানিশ হয়ে যায়। আর একটা বিষয় হলো, এটার স্বাদ আহামরি নয়, তবুও একটা খেলে আরেকটা খেতে ইচ্ছে হয়। দ্যাট মিনস, এটা টুমার মাউথের মধ্যে ঢুকে লেয়ারস প্রেম করা শুরু করে দিবে…
বেকার কুক সবাই হাসছে। নদীও মন্ত্র মুগ্ধ। মানুষটা কথা বলতে বলতে বিশাল একটা মাখনে মেশানো ময়দার ডোকে রোল করছেন, এরপর রোলটা ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলছেন। অথচ কথার লয় থামছে না। এরপর ছোট ছোট ডোয়ের টুকরো গুলো একটা একটা করে বিশাল রোলার দিয়ে রোল শুরু করলেন।রোল করে করে বিশাল ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গোটা টেবিলে । নদীর মুগ্ধতার সাথে মন ক্রমে বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমন কতো ধরনের রেসিপি হাতেকলমে শেখার সুযোগ এইখানে ছিলো ।কিন্তু নদী কি সেই সুযোগ পাবে না? ওয়েট্রেস নয়, নদী কিচেনেই ভালো করবে এটা কীভাবে বিশ্বাস করানো যায় এই মানুষটাকে?
” মনে রাখতে হবে প্লেইনড ডো হবে এমন যা স্টিক করবে না, লেয়ারিং শিটগুলো হবে পেপার শিট এর মত। যেখান থেকে তোমার আঙুল দেখতে পারবে লাইক দিস। ”
জি এস একটা ডো শিট তুলে ধরলেন, আসলেও লেয়ারিং শিটের ওইপারে তার আঙুল দেখা যাচ্ছে।সবার মুখে মৃদু গুঞ্জন।
” বিউটিফুল স্যার”
” ইয়েস মেহরোজ “গ্যাব্রিয়াল সোজা তাকিয়ে।
” রিয়েলি বিউটিফুল স্যার “নদী মুগ্ধ গলায় দ্বিরুক্তি করলো।
” থ্যাংকস, বাট হোয়াই আর ইউ বিউটিফুলি হিয়ার? ”
নদী একটু থতমত খেলো ” স্যার আপনার একজন গেস্ট এসেছিল ”
রম্য কিচেন ছেড়ে এলো, ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোককে উঁকি দিয়ে দেখলো।
” নিতিন মন্ডল নাম বললেন ” নদী ভদ্রলোকের কার্ড এগিয়ে দিল। ” বলছেন আজ আপনার সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট ছিলো, ”
রম্য কার্ড দেখে চিনলো বলল-” সময়ের আগেই এসেছেন, যাহোক ওনাকে কমপ্লিমেন্টারি কফি দাও এবং ডেজার্ট ; যা উনি পছন্দ করেন। আমি একটু পর আসছি। ”
গ্যাব্রিয়েল বেশ গম্ভীর মুখে নির্দেশ দিয়ে ক্যাবিনে চলে গেল। রাজিয়ার বাকলাভা বেকিং ক্লাসের পরের প্রসিডিংয়ে যাবে কিনা জানা দরকার ছিলো, বসের ক্যাবিনে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখলো। গ্যাব্রিয়েল কথা নেই, বার্তা নেই টেবিলে রাখা একগ্লাস পানি মাথায় ঢেলে বসে আছে। চুল গড়িয়ে সারামুখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ, বিরবির করে কী যেন বলছে,
” ইজি ইজি রমি,জাস্ট ফরগেট ইট… ”
রাজিয়া বোকা হয়ে ফের্ত এলো। ” সালেম ভাই, জি এসের আচরণ মাঝেমাঝে একটু অদ্ভুত লাগেনা, ঠাণ্ডা দেশের মানুষ তো হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় খুব গরম লাগে ”
“এইটাও জটিল বিষয়, “তাওয়ায় বিফ সিজলার রেডি করতে করতে সালেমের বিজ্ঞের মতো জবাব, ” ঠাণ্ডা দেশের জোয়ান ছেলে একা থাইকা থাইকা গরমে অস্থির হয়, না গরমের জন্য কে কইতারে? ”
“কী বলেন বুঝি না ”
” যার পোড়ে সেই বুঝে, বুঝলেন না..” শেফ সালেমের উদাসী জবাব।
******
কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিতিন মন্ডল মুগ্ধ চোখে চারিদিক দেখে বললেন ”
বলতেই হবে তামান্না এই পোড়োবাড়িটার অসাধারণ রূপ দিয়েছে । বাই দ্যা ওয়ে , তুমি ইঞ্জিনিয়ার, অথচ হয়ে গেছ শেফ!অদ্ভুত, ব্যাপার নয়?
রম্য হাসলো,” আমি নিউইয়র্ক কলিনারি স্কুল থেকে কলিনারি আর্টে ডিপ্লোমা নিয়েছি তবে মেইলবর্নেও গ্রেজুয়েশনের জন্য যেতে হয়েছে ফর সাম পারসোনাল ইস্যুজ ”
নিতিনবাবু হেসে মাথা নাড়ালেন ” আই ক্যান গেস দোজ ইস্যুজ, তোমার বাবা বাঙালি। আমরা মধ্যবিত্ত বাঙালিরা প্যাশন থেকে কেতাদুরস্ত সার্টিফিকেটের পুজাই বেশি করি। যাহোক এখন তুমি আমায় বল যে রেস্টুরেন্টে এমন অদ্ভুত উপদ্রব কি শুরু থেকেই হচ্ছে নাকি সম্প্রতি? ”
” যতদূর আমার জ্ঞান দশ -বারো বছর আগে একটা অকারেন্স হবার পর অনেকদিন বাড়িটা খালি পড়েছিলো৷ মার সাথে ডিভোর্সের পর বাবা আমেরিকার জব ছেড়ে আড়াই তিন বছর আগে চলে আসেন এখানে । তখন এই বাড়িটা লিজ নিয়ে একটা ক্যাফেটেরিয়া চালু করি দু’জন। তখন শুরুতে ভালো যাচ্ছিলো ; হঠাৎ একটা রুমার উঠলো, আমরা নাকি এখানে পর্ক স্টেক করে খাওয়াচ্ছি”
” বল কী! ”
” আমাদের ধারণা বিষয়টি ছড়িয়ে ছিলো আশেপাশের কিছু ওয়েলনোন রেস্টুরেন্টগুলোর থেকে ।তাদের ভাষ্যমতে মালিক যেহেতু আমেরিকান সেহেতু আমরা এখানে নাকি হালালভাবে রান্না করি না। অবশেষে আমাকে পাসপোর্ট শো করে প্রমাণ দিতে হয়েছে যে আমার রিলিজিয়ন মুসলিম, আর যদি নাও হতাম এই দেশের মানুষের ধর্মভ্রষ্ট করার আমার কোন আগ্রহ ছিলো না। ”
নিতিন শ্লেষের সাথে হাসলেন ” এইখানে এমন ঘটনা খুবই সম্ভব। এই দেশে সত্য মিথ্যার থেকে উর্ধ্বে হলো গুজব। দূর থেকে চিলের ছায়া দেখলেই কান উড়ে যাওয়া জাতি আমরা। সুস্থ প্রতিযোগিতায় কেউ যেতে রাজি না, একটা নোংরা গুজব ছড়িয়ে দাও সমস্ত অর্জিত সম্মান মাটিতে লুটে যাবে।”
রমাই বলল,” এই ব্যাপারটা তো একটা লিমিট ছিল স্যার, ছয়মাস আগে ক্যাফেটা রেস্টুরেন্টে কনভার্টের সিদ্ধান্ত নেই।আমি আর বাবা আগের ভাড়া ফ্ল্যাট রেখে এখানে উঠে আসি। ভূতের ঝামেলা তখনই বেড়ে যায়।রেনোভেশনের সময় থেকে বাড়িতে একজন মহিলা আর দুটোবাচ্চার ছায়া দেখা শুরু হলো কয়েকজন ভয় পেয়ে আহতও হলো ”
“আচ্ছা একটু পেছনে যাই, তোমার বাবা কোন ব্যাংক থেকে লিজ নিয়েছিলেন বলতে পারবে?
” মূল মালিক তার বাড়িটা ইউনাইটেড ব্যাংকের কাছে মডগেজ দিয়েছিলো, পরে শোধ করতে পারেনি যার কারণে ব্যাংক এটা দখল নিয়ে নেয় … ”
” ঠিক ভাবে বলো গ্যাব্রিয়েল , তোমরা কি এটা লিজ নিয়েছিলে না ভাড়া? কারণ ব্যাংক সাধারণত তাদের আটকে থাকা টাকা উদ্ধারে মডগেজড প্রপার্টি সেল করে দেয়, লিজ কিন্তু দেয় না ”
গ্যাব্রিয়েল কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে গেল,”আমরা লিজই নিয়েছিলাম। দশবছরের চুক্তিতে। এককালীন প্রায় দেড়কোটি টাকা ব্যাংককে দেয়া হয়েছিলো।আরো ডিটেইল তোমাকে আমার বাবাই বলতে পারবেন, আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসি ”
নিতিনমন্ডল ভ্রুকুটি করে দ্রুত ভাবছেন ” সেটা হয়তোবা একটা লং ডিস্কাশন হতে পারে। দুঃখজনকভাবে আজ আমার অন্য একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট আছে। তুমি যদি কিছু মনে না করো তোমাদের ডিডের একটা কপি আমাকে একটু পাঠাতে পারবে? ”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই ওপরে আমার ক্যাবিনেটেই আছে। আমি তোমায় মেইল করে দেব”
নিতিন মন্ডল বললেন, ” ধন্যবাদ। একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, দশবছর আগে এই বাড়ির ঘটনাটা প্রায় প্রতিটি পেপারই কভার করেছিলো, আমিও কিন্তু একটা রিপোর্ট করেছিলাম। এই ডবল মার্ডারের পেছনে মোটিভ আমার কাছে জোড়ালো মনে হয়নি মোটেও”
গ্যাব্রিয়েল অবাক হয়ে বলল ট্রিপল মার্ডার নয়? আই মিন গৃহকর্ত্রী, তার পুত্র ও কন্যা একসাথে… ”
” এখনেই তো গড়বড় গ্যাব্রিয়েল। কন্যা নয়। শুধু পুত্র। আট বছরের কন্যাটা সে মুহূর্তে ঘরে ছিলো না। সে খুন থেকে বেঁচে গিয়েছিল এখন তারও ভূত ঘুরঘুর করছে বাড়িতে”
” আশ্চর্য ”
” আশ্চর্য তো বটেই। দশ বছর আগে এই খুনের মামলা বেশি দূর যেতে পারেনি কারণ নাসের সাজ্জাদের পক্ষে তেমন কেউ মামলা লড়েইনি। গৃহকর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে৷ কিন্তু ওই পর্যন্তই। অথচ আমার ধারণা এই খুনের পেছনের উদ্দেশ্য শুধু ডাকাতি ছিলো না তার থেকে আরও গভীর কিছু ছিলো৷ আর এর প্রভাবই তোমার বর্তমান রেস্টুরেন্টে পড়ছে।”
গ্যাব্রিয়েল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।সাধারণ দর্শন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটার কথার ধার তার আলাদা পরিচয় দেয়। নিতিন মন্ডল একটা পেনড্রাইভও গ্যাব্রিয়েলকে দিলেন যেটা এখানে আসার আগে তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন। যেখানে এই বাড়ির আগের মালিকের পরিবারের পরিচয় ও পরিণতি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে৷ হতে পারে এটা তাকে একটু সাহায্য করবে।সেই সাথে খুব বিনয়ের সাথে আপসোস করলেন যে এই বিষয়ে এখন সময় দিতে পারছেন না, কারণ আরেকটা বড় হাইপ্রফাইল কেসে তাকে দীর্ঘদিন ঢাকার বাইরে থাকতে হবে৷ ফিরে এসেই তিনি এই বিষয়ে কিছু করার পরিকল্পনা শুরু করবেন।
নিতিন মন্ডল চলে যাবার পরেও গ্যাব্রিয়েলের অস্বস্তি কমলো না৷
তীব্র চিন্তার চাপ তাকে কিছুটা ক্লান্ত করছে। এই প্রজেক্টের গোড়াতেই গলদ হলে সমস্যা কখনো কাটবে না। জানতে হবে বাবা সোহরাব সামদানী কিছু জানেন কি না।
নিতিন বের হয়ে যাবার পর রম্য তুষারকে দিয়ে ডকুমেন্টারি পেনড্রাইভটা ওপরে থিয়েটার রুমে রাখতে পাঠিয়ে দিলো৷ এই বিষয়ে কিছু আলোচনার জন্য বাবা ক্যাবিনের দিকে পা বাড়ালো৷
কিন্তু মুহূর্তে থমকেও গেল। সোহরাবের সামনাসামনি মাথা নত করে বসে আছে মেহরোজ। চিরচারিত সমর্পিতার মত অনুরক্ত দৃষ্টি, সোহরাব পরম মমতা নিয়ে তার হাত ধরে আছেন । হুট করে মাথার চুলের গোড়ায় মনে হলো আগুন ধরে গেল রম্যের। কেন তাকেই এইগুলো সহ্য করতে হয়?
ডিউটির ফাঁকে নদী কথা বলার ফুরসুত পেয়ে গেল। সোহরাব সাহেব সব শুনে তার মাথা হাত রেখেছেন সাবলীল ভাবে৷
– ঠিক আমি এই জন্যই তোমাকে এখান থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম।হয়তো তুমি নিতে পারবে না। এইগুলো আমরা শুরু থেকে ফেস করছি।অনেক বড় একটা মহল উঠে পড়ে লেগেছে গ্যাব্রিয়েলস কিচেন শেষ করে দিতে। ”
” আমার মা ভাইয়ের মৃত্যুকে তামাসা বানিয়ে কেউ কিছু করতে চাইছে স্যার বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারছি না ”
” স্বাভাবিক, কিন্তু বিষয়টি যে ফেইক তা প্রমাণ করা কঠিন। তুমি তো তোমার পরিচয়ও কাউকে দিতে রাজি নও ”
” না স্যার, কারো করুণার পাত্র হতে ইচ্ছে করে না। তবে চাই আপনারা এই বাড়িটা আগলে রাখুন,আমার মনে হয় আপনাদের হাতে চন্দ্রমল্লিকা ভালো থাকবে ”
” এই কথাটা তুমি বিশ্বাস নিয়ে বলছ? ”
” নিশ্চয়ই স্যার”
সোহরাবের কেমন মায়া লাগলো অষ্টাদশী কিশোরী মেয়েটার জন্য। কিন্তু সরলতা যে ছলচাতুরী ভরা পৃথিবীতে অভিশাপের মতো।
*****
” এই ব্লক কি? ”
” জি না স্যার আরেকটু আগে” নদী আড়ষ্ট হয়ে বলল।
গ্যাব্রিয়েল শান্তমুখে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।।নদী আড়ালে নিজের হাত চিমটি কাটছে। বুঝতে চাইছে যে মানুষটার গাড়িতে সে সত্যিই বসে আছে কিনা। এর পেছনে একটা নাটক অবশ্য হয়েছে।
নদীর ডিউটি গোছাতে আজ সাড়ে দশটার ওপর হয়ে গিয়েছিলো। দোতালায় দুটা পার্টি ছিলো কাজেই চাপও ছিলো অনেক। ক্লান্তিতে পা ভেঙে আসছিল
ফোনে কয়েকটি মিসকল উঠেছিল । সবই নিশির। নদী কলব্যাক করলেও উত্তর নেই। যদিও এটা নিশির পুরাতন অভ্যাস।নদী বেশি ঘাটালো না। তার অন্য চিন্তা ছিল। রেস্টুরেন্টের আবাসিক পুরুষ স্টাফ যখন খেতে বসে, লিজা নদী নিজের মতো ডিনারবক্স গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়৷
তবে আজ ডিনারের বক্স গোছানো আগে নদী একটা কাজ করলো। ফ্রিজাররুমে গিয়ে রাজিয়া ম্যামের গোপনে তৈরি করা হাতের ডিজাইনের কেকটা অন্য জায়গায় সরিয়ে রাখলো৷ একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে, দেখা যাক কি হয়। বদমাশকে ভয় পাবার থেকে তাকে শাস্তি দেবার চেষ্টা ঢের শ্রেয়৷ এলোমেলো চিন্তায় ঘরে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আরেকটা বিস্ময়।
রেস্তোরাঁয় কোথাও তুষারের দেখা নেই। বাইকে করে নদীকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া তুষারের অলিখিত নিয়মের মতোই।আজ তুষারের ফোনও দেখা গেল রিচেবেল নয়। একটু মনোক্ষুণ্ণ হলেও একদিকে একটু প্রশান্তি পেল নদী। দূরত্ব তৈরির ছুতো পাওয়া গেল। এখন থেকে তুষারের থেকে সুবিধা কম নেওয়ার অভ্যাস করা ভালো। অগত্যা রিক্সা দেখতে যাচ্ছিলো, সোহরাব সাহেব নিজেই এগিয়ে এলেন, ” এত রাতে একা যাবে কেন, চল আমি তোমাকে নামিয়ে দেই।এই সালেম তোমার বাইকটা ধার নেয়া যাবে তো? ” বড় স্যারকে সালেমের না বলার কারণ নেই। তবুও নদীর প্রতিবাদ, সামদানী সাহেব কথা শুনলেন না,
“কেন নয়,আমার দায়িত্ব এটা। তোমাকে এভাবে একা ছেড়ে উল্টো আমার টেনশনই বাড়বে”
” এই বয়সে টেনশন তোমার জন্য ঠিক নয় ড্যাড ” গ্যাব্রিয়েল কখন নিচে এসেছে টের পায়নি নদী। টকটকে মুখটা অসম্ভব গম্ভীর, দেখে কেমন ভয় লাগলো ; ” তুমি নাহয় ঘরে আরাম কর, আমি এমনিও বের হচ্ছি পথে মেহরোজকে নামিয়ে দেবো ” জিএসের ঘোষণা।
” আরে রাতেরবেলা তুমি চিনে যেতে পারবে? ঢাকার রাস্তায় তুমি এখনো ছেলেমানুষ “.
” আর তুমি বুড়োমানুষ যার হাই ব্লাড প্রেসার, ব্লাড সুগার আর পিউরিনের প্রবলেম আছে। এগুলো তো তোমার মনে রাখা উচিত, নয় ড্যাড? “সোহরাব সামদানীর সাথে পুত্রের তর্ক শুরু হয়ে গেল।বাবার স্বাস্থ্য নিয়ে জিএস বেশ চিন্তিত মনে হলো।ফাঁকেচোরে সালেম ভাইয়ের মুখেও ফাজলামো আটকালো না নদীর পাশে বিড়বিড় করে বলল,
” তোমারে তো সাধারণ ওয়েট্রেস ভাবসিলাম এখন তো আনারকলি হয়ে গেছ। একদিকে সোহরাব সাহেব বাদশাহ আকবর, আরেকদিকে জি এস স্যার সেলিম … ”
“আর আপনি মাঝঝানে দাঁড়ায় খান ডালিম, “নদী দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি ” আল্লাহ হাফিজ সালেম ভাই ”
” আরে পাগল নাকি,বড় স্যারদের মাঝে এখন চলে যাওয়া বেয়াদবি, ওয়েট কর”
সালেমের কথায় না হলেও নদীর বেশি অপেক্ষা করা লাগেনি। সোহরাব সাহেবের কথায় গ্যাব্রিয়েল স্যারের গাড়িতেই তাকে উঠতে হলো। যেতে যেতে খেয়াল করল নাফিজটা জুলজুলে চোখে তাকিয়ে। কপাল ভালো রাজিয়া ম্যাম আগেই চলে গেছেন নয়তো এই বিষয় নিয়ে তার মুখে কি কি রুচতো বলা যায় না। তুষার তাকে ছেড়ে দেয় তাতেই তার মুখে খই ফোঁটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তুষার কোথায় গায়েব!
যদিও নদীর তার কাছ থেকে জটিল কিছু শোনার আগ্রহ ছিল না। আর সত্যি কথা বলতে তেমন কিছু বলার আগ্রহ থাকলেও তুষারের তা উবে গিয়েছিল। ফোন সুইচড অফ করে তুষার মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে ছিলো গ্যাব্রিয়েল কিচেনেরই ছাদে৷ আড়ালে দেখেছে সবই। কিন্তু সে মুহূর্তে তার হাতে একটা ওড়না। জি এসের থিয়েটার রুম থেকে ফিরতি পথে জিমনেসিয়ামে পড়েছিল । বেগুনি বাটিকের জর্জেটের ওড়নাটা অচেনা নয়,সেদিন এটার কোণা দিয়ে ছিড়ে যাওয়ায় নদীর কত আপসোস। এটা এখানে কী করছে এই প্রশ্ন আরও অ
স্পষ্ট হলো ম্যাসেজে পাওয়া একটা ভিডিও লিংকে। ভিডিওর মেয়েটা নিশ্চিত ভাবেই নিশি, নদীরই বোন। রাফিনকে এরেস্টের পেছনে কাহিনিটা এখন পরিষ্কার । রাফিনের র্যাবকে দেয়া তথ্য মতে নিশির পেটের বাচ্চাটাও নাকি অবৈধ। তুষারের গোটা ব্যাপারটা ভাবলে গা গোলাচ্ছে।
বুর্জোয়া সংস্কৃতিতে উড়ে আসা উদবাস্তু এই নদী আর নিশি।দূর থেকে যত চটক কাছ থেকে ততই নোংরা। এইধরনের মেয়েদের নিয়ে আসলেই কোন স্বপ্ন দেখা যায়? এরা শুধু ব্যবহারের জন্য৷ আর নদী তার রাস্তা নিজেই তৈরি করছে। এজন্যই তুষারের সুবিধা নিয়ে গেলেও কথার কোন গুরুত্ব নেই, আরও উঁচু দিকে তার নজর। তুষারের মুখে থুথু জমছে। ঘেন্নায় অথবা হতাশায়।
******
” মেহরোজ কি একাই থাকো? ” গ্যাব্রিয়েল ড্রাইভ করতে করতে সামনে তাকিয়ে।
” জি না আমার কাজিন থাকে সাথে”
” ব্যাস?বাহ ফেসিনেটিং, ঢাকার মতো অরক্ষিত শহরে তোমার সাহসী লিভিং দেখে অবাক হতে হয়। “ইংরেজিতে গ্যাব্রিয়েলে শীতলকন্ঠ,” ড্যাডও খুব প্রাউড তোমাকে নিয়ে”
” উনি মানুষটা চমৎকার ”
“You just graduated high school and admitted to College right? ”
গ্যাব্রিয়েল দ্রুত ইংরেজিতে বলছে।
” জি স্যার ” নদীর মনে হলো জিএস স্যার কিছুটা অস্থির।সেটা কাটাতে কথা বলছেন। । মানুষটার কণ্ঠে কেমন চাপা উত্তাপ।
” That means you are not yet nineteen.It is also not a good enough age to make any major decisions of life .Don’t you think?
(তারমানে তোমার বয়স এখনো উনিশের বেশি নয়। জীবনের বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য এটা যথেষ্ট ভালো বয়সও নয়, তোমার তা মনে হয় না?”)
”
” i don’t understand what are you saying ” নদী টেনেটেনে কথাটা বলল। এখন ঝামেলা লাগছে সেয়িং হবে টকিং?তবে জি এস তার ইংরেজির শুদ্ধতায় গেল না,
” now let me get it very clear,”
নদী চমকে উঠলো, গ্যাব্রিয়েল গাড়িটা রাস্তার সাইডে রেখেছে ঘুরে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে তার দিকে, খুব ঠান্ডা কন্ঠে I know what you are going through, you are at such a wonderful age. At this time, a sense of fascination for strange things might take place . But those who are intelligent don’t give importance to all of these
” স্ট্রেঞ্জ থিংকস “নদী অস্ফুটে বলে ফেলল। ঝড়ের গতিতে বলা লম্বা কথার ভিড়েএ মধ্যে এই শব্দটাই মাথায় খোচাচ্ছে। লোকটা বলতে চাইছে কি?
” its about my dad and you, টুমার কাছে এটা খুব ভালো লাগে? ”
” কী ভালো লাগে?”
” মানে এইগুলো, তোমার কি মনে হয় না এটা পাগলামি?I respect your feelings, but there is no future in here! My father is a sad lonely old man.you have a lot to prove .
টুমি টাকে স্টুপিড কমিটমেন্ট দিয়ে কি বলতে ছাও। ”
” স্টুপিড কমিটমেন্ট” নদীর মাথায় এবারো একটা শব্দ কেমন আকাশ পাতাল হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
“অভিয়াসলি, স্পেন্ডিং কোয়ালিটি টাইমস, এক্সসেপ্টিং কমিটমেন্ট পেন্ডেন্ট এগুলো দিয়ে কী বুঝব? ইউ আর টু ইয়াং ফর দিস…ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?কেন ভুল করছ? ড্যাডের অফারে কেন কনভিন্স হচ্ছ, তুমি বোকামেয়ে”
নদী নিজের গলার লকেটে হাত রাখলো। গ্যাব্রিয়েলকে সত্যি চিনতে পারছে না। কন্ঠস্বর নরম রেখেও লোকটা খুব কড়াভাবে তাকে কিছু বলছে সেটা টের পেল যেন মাত্রই।
” টুমার কি মনে হয় না এত ইয়াং ইন্টেলিজেন্ট হয়েও শুধু শুধু এখানে সময় নষ্ট হচ্ছে?একটা সিক্সটি ইয়ারস ওফ এইজ বুড়োর সাথে নিজেকে, নিজেকে, নিজেকে … রম্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও সঠিক বাংলা শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না।
” গ্যাব্রিয়েল সামদানী ” নদীর স্পষ্ট কন্ঠে রম্য থেমে গেল। নদী ততক্ষণে দ্রুত নিজের গলা থেলে চেইন লকেট খুলে ফেলেছে। ব্যাগ থেকে একট সুদৃশ্য বাক্স বের করে রম্যের দিকে এগিয়ে দিলো,” আপনি যা বলার তা বলেছেন। আমি খুব সাধারণ ছোট একজন মানুষ কিন্তু আমার মনে হয় না এত মিষ্টিভাষায় আমায় এর আগে কেউ অপমান করেছে। যাহোক আই এম নট ইন্টারেস্টেড ইন গ্যাব্রিয়েল কিচেন। ইউ আর লটস অফ মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ”
নদী থেমে গেল রাগের মাথায় ইংরেজি বললে আরও ভজঘট লাগিয়ে ফেলবে দরকার নাই কথা বাড়ানোর।
” ধরেন এটা, বাক্স সহ ধরেন, পেন্ডেন্টটা আমার জন্য আসলেই বিশেষ ছিল। তবে আমার মনে হয় না আমাদের সম্পর্ক আপনার ছোটমন বোঝার ক্ষমতা রাখে।নোংরা দেশের থেকে আসা নোংরা চিন্তার মানুষ ।
রম্য বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চোখ মুখ লাল করে কড় কিছু বলছে। এভাবে কড়া গলায় এই দেশের কেউ কথা বলেনি৷ নদী দরজা খুলতে খুলতে বলল,” ইউ নেরো মাইন্ড!জীবন ধন্য হয়ে গেছে আপনার পরামর্শ শুনে, এখন আমি নামব। থ্যাংকস ফর দি লিফট। ”
নদী নেমে গোল।
মউখ অন্ধকার করে রম্য গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে বাক্সটার দিকে নজর দিলো, জুয়েলারি বাক্সে রুপালি রঙে লেখা —
“To my dearest doughty ”
সম্ভবত ওয়ার্ল্ড ডটারস ডে উপলক্ষে ডিজাইন করা ছিলো। রম্য ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। তার মানে বাবার যার সাথে এফেয়ার সে নদী নয়। যাক একটা রিলিফ! আচ্ছা রিলিফ কিসের জন্য? বিকালে একটা অনিচ্ছায় দেখা দৃশ্যের পর বিচিত্র একটা অপরারাধবোধে পুড়ে মরছিলো ; তার থেকেই কী রিলিফ? ড্যাডের সাথে জড়িত নয় দেখে এখন সেই অনুভব জাস্টিফাই করা যাবে? মানুষের মন কত অদ্ভুত সমীকরণে চলে।
তবে মেয়েটা রেগে মেগে নামার আগে সম্ভবত চোখে জল ছিলো। মন ভাঙাই স্বাভাবিক, না চাইতেই কিছু কিছু হিসেব খুব বাজে ভাবে এলোমেলো হয়ে যায়।
*****
নদী জোরে জোরে সিড়ি ভাঙছে। লিফট এতরাতেও বিজি, অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হলো না। মাথার মাঝে মগজটা গনগন করে ফুটছে মেজাজে। গাড়িটা যখন রাস্তার একপাশে দাঁড় করালো, নদীর বুকের মধ্যে তখন কত আশঙ্কা খেলে উঠেছিলো। কখনো ভয়ের কখনো একটু পুলকের।
এই লোকের মাথায় এমন অদ্ভুত চিন্তা এলো তো এলো কি করে? শুরুতে যেমন শান্ত মিষ্টি গলায় শুরু করেছিল মনের একটা গাধামার্ধা অংশ আজব আজব কল্পনায় মেতে ছিল। অথচ এই লোকের কথার তর্জমা ছিলো যে ” তুমি আমার বাবার সাথে প্রেম করো না! মানে….!! রাগ-ক্রোধ এ শরীর ফুলে ফুলে উঠছে নামার আগে চড় দিয়ে আসলে ভালো হতো। তাকে দেখলে কতটা ভালো লাগতো আসলে ফালতু একটা !
এরপরও নদীর মাথা খারাপ হয়ে যায় নি যে গ্যাব্রিয়েল কিচেনে আর ফেরত যাবে। তবে এই ক্ষোভও কি সে বেশি পুষে রাখতে পারবে? নতুন করে শুরু করতে গেলে অনিশ্চিত হয়ে যাবে পড়াশোনা এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। এইশহরে কপালে আর কত অপমান বাকি আছে নদী মাঝেমধ্যে চিন্তা করে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে। গনগনে রাগ নিয়েই একাধারে কলিংবেল টিপে যাচ্ছে। নিশির কোন খবর নেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে সাবলেট বাড়িয়ালার দরজা ধাক্কাতে হলো। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা এতক্ষণে অফিস থেকে চলে এসেছেন। মহিলার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
” রাতে রাতে এই ডিউটিতে দিতে পারবো না, তোমাদের কাছে ঘরের চাবি না দেওয়া হয়েছে? তারপরও প্রতিদিন এভাবে দরজা ধাক্কালে তো সমস্যা, ”
যদিও নদী বা নিশি এই দরজা দিয়ে কখনোই ঘরে ঢোকে না। তবুও নদী অপরাধীর মতো বলল, ” সরি আপু আসলে আজকে আমার চাবিটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম আর নিশি মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে ”
ঘরে ঢুকে দেখে ফ্যান লাইট সবই চালানো, নিশি ঘরে নেই, বারান্দাতেও নেই। নিশির ফোন পড়ে আছে বিছানায়। লাগোয়া বাথরুমের দরজা আধাভেজানো, তার সামনে মেঝেতে একটা বাদামী ট্রাউজার।জায়গায় জায়গায় রঙ বদলে গেছে। কী হচ্ছে বা হয়েছে তা নদী বুঝলো। না শুধু
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ঝড়ের গতিতে বাথরুমে গিয়ে বিস্ময় আর আতঙ্ক যেন তার গলা চেপে ধরলো যেন।
” হু আর ইউ? “দারোয়ান একটু ভারিক্কি নিয়ে জানতে চাইছে। আগত অতিথি বিলিতি সাহেব বলে কথা।
” আই এম হিয়ার টু মিট মেহরোজ ফ্ল্যাট ফোর এ, এটা কি পসিবল?”
” ফোর এ তে মেহরোজ বলে কেউ নাই ” দারোয়ানের কথায় রম্য পড়লো মুশকিলে। তার ফাইলে এই ঠিকানাই দেয়া। মেয়েটা গাড়িতে তার মোবাইল ফেলে গেছে। রাগের মাথা চলে গেছে কোন কিছু খেয়াল না করেই। রন্যের নিজেরই খারাপ লাগছে। একটু দেখা করে সরি বলা যেতেই পারে কিন্তু সেটা সহজ বলে মনে হচ্ছে না।রাত হয়ে গেছে মেয়েদের এই দেশে অনেক বাইন্ডিং।এই দারোয়ানকে বোঝায় তো বোঝায় কিভাবে?
” রহিম ভাই, আমাকে একটা সি এন জি ডেকে দেন ”
চেনাকন্ঠে ঘুরে তাকালো রম্য। কিছুক্ষণ আগের রণচণ্ডী অবতারের মেহরোজকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ঝড় বয়ে গেছে। আচরণের জন্য দু:খপ্রকাশের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে একাই এসে যায় প্রশ্ন,
” মেহরোজ তুমি ঠিক আছ?
” ঠিক আছি, আপনি এখানে? ” নিজেকে প্রাণপণ সামলে নদীর উত্তর।
” তুমি ফোন রেখে এসেছিলে গাড়িতে, ” নদী হাত বাড়িয়ে ফোন নিলো, কোন কথা বলল না।চোখ জোড়ায় অস্থিরতা সাথে অসহায়ত্ব।অথচ মুখে অদ্ভুত নিরাসক্তি আনার প্রাণপণ চেষ্টা । রম্য কিছু ইতস্তত করে বলল,” আমি দু:খিত আমার কথাগুলো.. ”
” ইট ওকে স্যার, থ্যাংকস ফর দি ফোন ” নদীর কথার মাঝে শীতলতা রম্যকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করে দিলো
” ওকে আই থিংক আই সুড লিভ.. উইল টক টু ইউ লেটার, টেক কেয়ার ”
রম্য আর কি বলবে না বুঝতে পেরে ফিরে যাচ্ছে গাড়িতে। নদী ছটফট করে বেরিয়ে আসছে গেট পেরিয়ে,মুখ বন্ধ চোখ অস্থির একটা সি এন জি খুঁজছে। তীব্র বিবশতায় চিৎকার করে কাঁদতে চাইলেও কাঁদা যাবে না, সম্বিত কিছুতেই হারানো যাবে না। কিন্তু এই চাপ যা তাকে যেন নি:শেষ করে দিচ্ছে। করুণাময় কি আছেন?
“মেহরোজ কোন সমস্যা? ” গাড়ির কাছে গিয়েও রম্য ফিরে এসেছে এই মেয়ের চোখে পানিটা যেন স্বাভাবিক নয়, ” সব ঠিক আছে? সত্যি কড়ে বলো তো”
” ছোট একটা সমস্যা,আমার বোন মরে যাচ্ছে, নিশি মরে যাচ্ছে… ”
নদীর ভেতরটা তখন লড়াইয়ে বড় ক্লান্ত।বাঁধ দিয়ে কিছু প্লাবন কখনো থামে না। পাথর হৃদয় ধারণেও কারো কারো সামনে অশ্রুর প্রলয় অবশ্যাম্ভাবী হয়ে যায় ।
(চলবে)
ডিসক্লেইমার
(কিছু টক্সিক কথা)
*