বহুরূপী শেষ পর্ব

0
1007

#বহুরূপী, #শেষপর্ব
_______________
হাসপাতালে পৌঁছে আমি ১০২৪ নম্বর কেবিনে চলে গেলাম। সুমন কেবিনের বেডে শুয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ অসুস্থ। অহনা যেই সুমনের ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক দিয়েছে তার সাথে এই সুমনের কোনো মিল নেই। যেই সুমনের ছবি আমি দেখেছি সে দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা, স্বাস্থ্য বেশ ভাল, তাকে আমার প্রাণবন্ত একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে। এখন যাকে দেখছি, তাকে দেখতে কষ্ট হচ্ছে, মুখ হা করে সে শ্বাস নিচ্ছে। শরীর শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। সুমনের স্ত্রী পিয়া বলল,
” মাসখানেক আগে সুমনের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে, কেমো থেরাপী নিতে তারা ঢাকায় এসেছিল, কিন্তু থেরাপী নেবার আগেই ডাক্তাররা জানিয়েছে সুমনের লিভার পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে, তাদের করার মতো কিছু নেই।”
.
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পান্থকুঞ্জ পার্কে গিয়ে বসলাম। সুমনকে দেখার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। কয়দিনের মধ্যে কী অবস্থা হয়েছে মানুষটার!
.
বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ পার্কে বসে থেকে অহনাকে ফোন করলাম। অহনা ফোন ধরেই জিজ্ঞাসা করলো,
“ সুমনের ওখানে গিয়েছিলেন?”
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, “হ্যাঁ।”
– কথা হয়েছে?
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” সুমন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আপনি বি.আর.বি হাসপাতালের ১০২৪ নম্বর কেবিনে গিয়ে সুমনকে একবার দেখে আসুন। সে সম্ভবত আর বাঁচবে না।”
– হোয়াট!
আমি ফোন রেখে দিলাম।
.
মানুষ মরণশীল, যে কোনো সময় যে কারো মৃত্যু হয়ে যেতে পারে এরপরেও মানুষের কত অহংকার! মানুষ মানুষের সাথে কতরকম প্রতারণায় লিপ্ত হয়! পৃথিবীতে মানুষ এবং সকল প্রাণীর জন্য মানুষের মতো ভয়ংকর আর কিছু নেই। আমার বিয়ে ভাঙার জন্য যে উঠে পড়ে লেগেছে সেও একজন মানুষ। মানুষের কারণেই পৃথিবীতে শান্তি নেই।
.
দুপুর একটা পেরিয়ে গেছে, খুব ক্ষুধা লেগেছে। আলম নামের একটা রেস্তোরাঁ বাংলামোটরে আছে, খাবার মোটামুটি ভালো কিন্তু রেস্তোরাঁয় খেতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু গাড়ির হর্ণও সহ্য হচ্ছে না। আমি পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠতে যাব এমন সময় ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলাম, দিপা মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজে সে লিখেছে,
” কী অবস্থা ভাইয়া? কেমন আছেন? আমাকে কি চিনতে পেরেছেন? আমি দিপা।”
আমি প্রত্যুত্তর মেসেজ না পাঠিয়ে দিপার নম্বরে ফোন করলাম। দুইবার রিং বাজতেই দিপা ফোন ধরে জিজ্ঞাসা করলো,
” কেমন আছেন ভাইয়া।”
– এই তো আপু ভাল। আপনি কেমন আছেন?
– খুব ভাল। কী করছেন ভাইয়া? দুপুরে খেয়েছেন?
– বসে আছি, খাওয়া-দাওয়া এখনো হয়নি।
– ওমা! দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে, এখনো খাননি কেন?
– মনটা ভাল নেই।
– কী হয়েছে ভাইয়া? অহনার ব্যাপার নিয়ে কী খুব মন খারাপ?
আমি কিছু বললাম না।
দিপা বলল,
” গতকাল তো অহনার সাথে সামনা-সামনি কথা বললেন, কিছু ঠিক হয়নি?”
আমি বললাম,
” নাহ।”
– ভাইয়া যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলব?
– বলুন আপু।
– কথাটা আসলে বলা ঠিক হবে কি না জানি না তারপরও বলছি। দেখুন ভাইয়া, অহনা আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু, কিন্তু ওর এই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না। এসব না বোঝার কি আছে? আমি কত করে বললাম, দেখ ছবিগুলো তো ফেক হতে পারে, ও আমার কথা শুনছেই না। আর আপনিও পড়ে আছেন অহনার পিছে, পৃথিবীতে কি মেয়ে মানুষের অভাব পড়েছে? যে আপনাকে এই সামান্য ব্যাপারে সন্দেহ করছে তাকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করবেন কী করে?
আমি বললাম,
” আপু, বিয়ের সব এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী সবাইকে দাওয়াত করা হয়ে গেছে, এমন সময় বিয়েটা না হলে কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন?”
– তা অবশ্য ঠিক।
– আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, বিয়ের চেয়ে বড় বিষয়, আমার চরিত্র নিয়ে যেই প্রশ্নটা উঠেছে আমি তা থেকে মুক্তি পেতে চাই।
– এখন কী করবেন?
– যে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করবো।
– ব্যাপারটা তো সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। যে এসব করছে সে তো নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। সে নিজেকে প্রকাশ না করলে কিভাবে খুঁজে বের করবেন? মনে করুন, আমি করেছি, আমি কী আপনাকে বলবো যে আমি করেছি?
আমি হেসে দিয়ে বললাম,
” আপনি এমন করলে অহনাই আপনাকে ধরে ফেলত।”
– তা ঠিক বলেছেন।
– আচ্ছা আপু এখন তাহলে রাখি।
– ঠিক আছে ভাইয়া, ভালো থাকবেন। আর এত বেশি চিন্তা করবেন না।
.
ফোন রেখে আমি পার্ক থেকে বের হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে এসে রিকশা নিলাম।
.
টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে যাবার সময় হঠাৎ রাকিব ফোন করল। আমি ফোন ধরতেই রাকিব তাড়াহুড়ো করে বলল,
” ভাইয়া আপনার সাথে আমার খুব দেখা করা প্রয়োজন।”
– কেন রাকিব? কী হয়েছে?
– একটা সমস্যা হয়েছে ভাইয়া।
– কী হয়েছে বলো।”
– ভাইয়া, ডিউটিতে তো ফোনে কথা বলা নিষেধ, একটু পরপর স্যাররা ডাকেন। তাছাড়া কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে হবে।
– আচ্ছা আমি বসকে ফোন করে ব্যবস্থা করছি, তুমি আমার বাসায় চলে এসো। আমার বাসা চেনো তো?
– ভাইয়া বাসা তো চিনি না।
– আচ্ছা ধুপখোলা মাঠে এসে আমাকে ফোন কোরো, আমি বলে দেবো।
.
রাকিবের সাথে কথা বলা শেষ করে আমি বসকে ফোন করলাম। বস বললেন, অফিসে কয়েকজন অতিথি আসবেন, রাকিবকে গিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে। অতিথিরা আসার পর রাকিবকে ছাড়তে পারবেন।
.
আমি বাসায় ফিরে গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে বিকাল চারটার দিকে ধুপখোলা মাঠে এসে বসলাম। একটা সময় মাঠের চারপাশ ফাঁকা ছিল, খুব বাতাস থাকত। বর্তমানে মানুষ চারিদিকে বহুতল ভবন, দোকানপাট করে মাঠে বাতাস প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। খুব গরম লাগছে, একটু বাতাসও নেই।
.
ঘন্টাখানেক থেকে ধুপখোলা মাঠে বসে আছি। সন্ধ্যার আগে রাকিবের সাথে দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
আমি আবারও বাসায় ফিরে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবা বারান্দায় এসে বললেন,
” আগামীকাল অহনাদের বাড়িতে কাকে কাকে পাঠানো যায়রে?”
আমি বললাম,
” কেন বাবা?”
বাবা কপাল কুঁচকে বললেন,
” শাড়ি-গয়নাগাটি পাঠাতে হবে না?”
– ও হ্যাঁ, কখন পাঠাবেন?
– বিকেলের দিকে গেলে ভাল হয় না?
– হুঁ, বিকেলের দিকে রোদটা কম থাকে।
– তোর মা যাক, সাথে আর কে কে যাবে?
– রিফাত, সিফাতকে পাঠিয়ে দিন। কাকা গেলে ভাল হয়, আপনি যাবেন না?
– আমি যাব নারে।
– তাহলে ছোট খালা আর কাকাকে ফোন করে বলে দিন চলে আসতে। খালাকে বলবেন, সেতুদেরকেও যেন নিয়ে আসে।
– কালকে কি তোর কোনো কাজ আছে?
– কেন বাবা?
– ফ্রি থাকলে, তোকে নিয়ে বের হোতাম। বার বার গাড়ি ভাড়া করতে আর ভাল লাগে না। নিজেদের একটা গাড়ি দরকার। একটা গাড়ি কিনে ফেলি, কী বলিস?
.
গাড়ি কেনার কথা শুনে আমার খুশি হবার কথা ছিল, কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। গাড়ি কিনতে গেলে অনেকগুলো সময় নষ্ট হবে। আমার হাতে সময় খুব কম।
আমি হাসিমুখে বললাম,
” এতদিনে বুঝলেন আমাদের গাড়ি দরকার?”
বাবা বললেন,
” যাবি নাকি তাই বল।”
– আমি কাল সকালে জানাই, একটু কাজ আছে।
– আচ্ছা জানাস।
.
বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে আমি বাড়ির ছাদে গিয়ে বসলাম। ছাদে ইতোমধ্যে আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ বানানো হয়েছে। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এসব টিকবে তো!
.
অহনা সুমনকে দেখে এসে সন্ধ্যার দিকে আমাকে ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
” কী অবস্থা হয়েছে মানুষটার!”
আমি বললাম,
” আপনার সাথে কী কোনো কথা হয়েছে? আমি যখন গিয়েছিলাম তখন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন।”
অহনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কথা হয়েছে। আমি যাবার কিছুক্ষণ আগে ও ঘুম থেকে জেগেছে। আমাকে দেখে কেঁদে ফেলেছে। পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে।”
এরপর অহনা চুপ করে রইল, আমিও কিছু বলতে পারলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষকে আমি সান্ত্বনা দেবার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাই না। বেশকিছুক্ষণ ফোন ধরে রাখার পর অহনা নিজে থেকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।
অহনা ফোন রেখে দিতেই আমি রাকিবকে ফোন করলাম। রাকিব ফোন ধরে জানালো, ও মাত্রই অফিস থেকে ধুপখোলা মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
.
রাকিবের আসতে আসতে কম করে হলেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাদের এক কোণে বসে গত কয়েকদিনের কথা ভাবতে শুরু করলাম,
“হুট করে একটা চিঠি আসলো, এরপর আসলো কুরিয়ার। অহনাদের বাড়িতেও কুরিয়ার পাঠানো হলো। যে কুরিয়ার করেছে, সে তার নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর ভুল দিয়েছে। আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানে আবার অহনাদের বাড়ির ঠিকানাও সে জানে। সুমনের সাথে অহনার সম্পর্কের কথা তো অহনার পরিচিত কেউ ছাড়া জানার কথা না! অহনার সাথে গতকাল দেখা হবার ব্যাপারটা দিপা জানলো কী করে!”
আসলেই তো দিপা জানল কী করে! অহনার কাছ থেকে! সেরকম তো মনে হচ্ছে না। আমি সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে অহনাকে ফোন করলাম। অহনা ফোন ধরে চুপ করে রইলো। আমি বললাম,
” আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। আপনার মানসিক অবস্থা ভাল নেই। বুঝতে পারছি না বলব নাকি বলব না।”
অহনা মৃদুস্বরে বলল,
” বলুন, আমি ঠিক আছি।”
– আপনার বন্ধু দিপাকে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে।
অহনা সাথে সাথে বলল,
” আপনি পাগল হয়েছেন? দিপা এসব করবে কেন? ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আপনি জানেন না?”
– সন্দেহ হবার কারণ আছে। আপনি একটু ভেবে দেখুন। যে এসব করছে, সে যেমন আপনার বাড়ির ঠিকানা জানে, তেমনি আমার বাড়ির ঠিকানাও জানে। বেশকিছুদিন আগে আমরা বাড়ি বদলেছি, বন্ধুরা ছাড়া বাড়ির ঠিকানা তেমন কেউ জানে না। আমার বন্ধুরা এমন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া দেখুন, আমার বন্ধুদের সুমনের সাথে আপনার সম্পর্কের কথা জানার কথা না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, যে এসব করছে সে আপনার খুব কাছের মানুষ। দিপা আপনার ভালো বন্ধু, আপনার সাথে তার নানা বিষয়ে নিশ্চয়ই কথা হয়।
– আপনি দিপার কথা বলছেন তো। দিপাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ আছে?
– গতকাল আপনার সাথে আমার দেখা হবার ব্যাপারে দিপার সাথে কোন কথা হয়েছে?
– কই, না তো!
– তাহলে দিপা জানলো কী করে আপনার সাথে আমার সামনা-সামনি কথা হয়েছে?
– ও আপনাকে এরকম কিছু বলেছে?
– দুপুরবেলা আপনার সাথে কথা বলার পর উনার সাথে আমার কথা হয়েছিল। তখন গতকাল আপনার সাথে আমার সামনা-সামনি কথা হয়েছে, এটা সে বলেছে।
– আর কী কী বলেছে?
– আমার ব্যাপারে আপনাকে সে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, আপনি নাকি কিছুতেই মানছেন না। আমি কেন আপনাকে নিয়ে পড়ে আছি, পৃথিবীতে কী মেয়ে মানুষের অভাব হয়েছে।
– আপনি সত্যি বলছেন?
– মিথ্যা বলার কোনো কারণ নেই।
– আর কী বলেছে?
– আর তেমন কিছু বলেনি। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আমার ফোন নম্বর সে পেয়েছে কোথায়? আপনার কাছ থেকে নিয়েছে?”
– না তো!
– আশ্চর্য! তাহলে আমার ফোন নম্বর সে পেল কোথা থেকে?
– আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?
– নাহ। আমি যেদিন প্রথম দিপাকে ফোন করি সে ফোন ধরেই জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন ভাইয়া। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কী আমাকে চিনতে পেরেছেন, সে বলল চিনব না কেন। তার সাথে আগে আমার কখনো কথা হয়নি, আমি কখনো তাকে ফোন নম্বর দেইনি, তাহলে চিনবে কি করে! ঘটনাটা তখন মাথায় আসেনি।
– আপনি আমাকে কনফিউজড করে দিলেন। দিপা কেন এরকম করবে?
রাকিব ফোন দিচ্ছে। আমি অহনার সাথে কথা শেষ করে রাকিবকে ফোন করলাম। ও ধুপখোলা মাঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছাদ থেকে নেমে মাঠের দিকে চলে গেলাম।
.
রাকিবের সাথে দেখা হবার পর ওকে নিয়ে চা খেয়ে, মাঠের এক কোনায় গিয়ে বসে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
” রাকিব, কী যেনো বলতে চাইছিলে?”
রাকিব, বিব্রতগলায় বলল,
” ভাইয়া আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।”
– কেমন অপরাধ?
– আপনাকে না জানিয়ে আপনার একজন ফেসবুক বন্ধুকে রিকোয়েস্ট দিয়েছি।
– এখানে অপরাধের কী আছে রাকিব?
– তারপরও অনুমতি নেওয়া দরকার ছিল।
– এটাই কী তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল?
– না ভাইয়া। কথাটা ঠিক কিভাবে বলব, বুঝতে পারছি না।
– এত না ভেবে বলে ফেলো।
– ভাইয়া, দিপালী চৌধুরীকে কি আপনি চেনেন?
– হ্যাঁ। চিনব না কেন! কী হয়েছে বলো তো।
.
রাকিব পকেট থেকে ফোন বের করে দিপার সাথে ওর হওয়া কথোপকথনের চ্যাটবক্স বের করে দিয়ে বলল,
” ভাইয়া পড়ে দেখুন।”
.
রাকিবের সাথে দিপার গত একমাসের কথোপকথন:
৭ই জুন, ২০২১
” হ্যালো আপু, কেমন আছেন?”
– ভাল, আপনি কেমন আছেন?
– আমিও ভাল, আপু আমি তো আপনার চেয়ে অনেক ছোট, আমাকে তুমি অথবা তুই করে বললে খুশি হবো।
– আচ্ছা।
– আপু কি করছেন?
– বসে আছি। তুমি কি করছো?
– রান্না করছি আপু।”
– তুমি রান্না করছো কেন? বাসায় কেউ নেই?
– আপু আমি তো মেসে থাকি। বুয়া দুদিন থেকে আসছে না।
– ও আচ্ছা। তুমি রাঁধতে পারো?
– মোটামুটি পারি।
– এখন কি রাঁধছো?
– আলু ভাজি করছি।
– ওয়াও! একদিন আমাকে দাওয়াত কোরো।
– আচ্ছা।
.
১২ই জুন, ২০২১
” হ্যালো আপু!”
– কি অবস্থা? কেমন আছো?
– আপু ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভাল না।
– কেন আপু, শরীর খারাপ?
– নাহ।
– মন খারাপ?
– হু।
– কেন আপু? কি হয়েছে?
– এমনিতেই।
– বলা যাবে না?
কোনো রিপ্লাই নেই…
– আপু! হ্যালো, আপু কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? আপু?
কোনো রিপ্লাই নেই…
.
১৬ই জুন, ২০২১
” আপু কেমন আছেন?”
– ভালো না।
– কেন আপু?
– এমনিতেই।
– মন খারাপ আপু?
কোন রিপ্লাই নেই…
.
রাত দুইটা,
” আপু মন ভাল হয়েছে?”
– না।
– আমাকে বলা যাবে কি হয়েছে?
– জেনে কি করবে?
– আপু আমার আপনার মতো একজন বোন ছিল, সে আমি ছোট থাকতে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আপনাকে আপু বলে ডাকি, আপনার মন খারাপ থাকলে, আমারও খারাপ লাগে।
– কে বলেছে তোর বোন নাই, এখন থেকে আমিই তোর বোন। এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবি।
– আচ্ছা, আপু তোমার মন খারাপ কেন?
– কিছু ভাল লাগে নারে। যাকেই আমি চাই সেই আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ঘুমা, পরে কথা হবে।
.
২৫শে জুন, ২০২১
” আপু, কেমন আছো?”
– ভালো না।
– তোমার মন সবসময় এত খারাপ থাকে কেন আপু?
– ভাইয়া তোকে একজনের ছবি পাঠাচ্ছি, তুই কম্পেয়ার করে আমাকে সত্যি সত্যি জানাবি কে বেশি সুন্দর, সে নাকি আমি। মিথ্যা বলবি না।
– আচ্ছা।
.
দিপা অহনার ছবি পাঠিয়েছে। রাকিব লিখেছে, “তুমি বেশি সুন্দর আপু। এতে কোন সন্দেহ নাই।”
– মিথ্যা বলছিস?
– নাহ আপু। বোনকে কি কেউ মিথ্যা বলে?
– আচ্ছা বাবা হয়েছে।
.
২৮শে জুন, ২০২১
” আপু কি করছো?
– বসে আছি।”
– কেমন আছো?
– খুব ভাল।
– আজকে হঠাৎ এত ভালো আছো?
– আজকে আমি অনেক খুশি।
– এত খুশির কারণ কি?
– পরে বলবো।
.
৩০শে জুন, ২১
” ভাইয়া কেমন আছিস?”
– ভাল, তুমি কেমন আছো?
– ভালো রে।
– তুমি তো আর বললে না?
– কী?
– ঐদিন এত খুশি ছিলে কেন?
– তোকে একটা মেয়ের ছবি দিছিলাম না? ওর বিয়ে ভেঙে গেছে।
– এতে তুমি এত খুশি কেন?
– ওর সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তাকে আমি ভালোবাসি।
– বিয়ে ভাঙল কেন? কে ভেঙেছে ছেলেপক্ষ?
– নারে আমিই ভেঙে দিছি।
– তাহলে তো খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু কিভাবে ভাঙলে?
– পরে বলবো।
.
রাকিবের সাথে দিপার মেসেজের মাধ্যমে কথাবার্তা এই পর্যন্তই, এছাড়া মাঝেমধ্যে ফোনকলে দীর্ঘসময় কথা হয়েছে। আমি রাকিবকে জিজ্ঞাসা করলাম,
” তুমি কি শেষপর্যন্ত অহনাকে চিনতে পেরেছ?”
– জি ভাইয়া।
– কিভাবে চিনলে?
– আজ দুপুরে ফিরোজ স্যার সবাইকে ভাবির ছবি দেখাচ্ছিলেন। সেখান থেকে দেখেছি। ভাইয়া স্যরি, আমার ভুল হয়ে গেছে।
– তুমি কী জানো তুমি আমার কত বড় একটা উপকার করেছো?
– কেমন ভাইয়া?
– রাকিব, কয়দিন আগে অহনাদের বাসায় একজন কুরিয়ারে করে আমার অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। ছবিগুলো ফেক। আমি এই কয়দিন অনেক চিন্তা করেও কে এমন কাজ করলো ধরতে পারছিলাম না, আজ সন্ধ্যা থেকে দিপাকে সন্দেহ করছিলাম, কিন্তু প্রমাণ পাচ্ছিলাম না। তুমি আজকে রাতে আমাদের বাসায় থাকো। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে তোমার ভাবিদের বাসায় যাব। তোমার আপুর কর্মকাণ্ড ফ্ল্যাশ করে দিলে সমস্যা নেই তো?
– ভাইয়া কী যে বলেন!
.
রাতে রাকিবকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি অহনাকে ফোন করে বললাম,
– খুশির সংবাদ আছে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে। আপনি দিপাকে সকাল দশটার দিকে আপনাদের বাসায় আসতে বলে দিবেন।
অহনা জিজ্ঞাসা করলো,
” কোত্থেকে প্রমাণ পেলে? স্যরি, কোত্থেকে প্রমাণ পেলেন?”
– কাল সকালে বলবো। আর হ্যাঁ, দিপাকে কিন্তু এসব ব্যাপারে কিছু বোলো না, স্যরি বলবেন না। সে যেন কিছু জানতে না পারে।
– আচ্ছা।
.
ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম, না হয় দিপা আমাকে ভালোবাসে, কখনো তাহলে বলল না কেন! সে আমাকে কবে থেকে চেনে! অহনার সাথে বিয়ের কথাবার্তা হবার সময় থেকে নাকি আরও আগে থেকে! মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়া!
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাবা বললেন,
” যাবি আজকে?”
আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম,
” বাবা আজকে একটা কাজ আছে, কাল যাই?”
– আচ্ছা। কাল তাহলে মিস করিস না। এখন উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা কর।
.
আমি বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে রাকিবকে নিয়ে নাস্তা করে সকাল সাড়ে নয়টায় অহনাদের বাসায় চলে গেলাম।
.
আমি, রাকিব, অহনা আর অহনার বাবা বসার ঘরে বসে আছি। অহনা রাকিবের ফোনে দিপার মেসেজ পড়ছে আর জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। আমি আর রাকিব মাথা নিচু করে বসে আছি। অহনার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছেন। মনে হচ্ছে, তিনি আমাকে এইমুহূর্তে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারলে শান্তি পান।
.
দিপা সকাল দশটার পরপর অহনাদের বাসায় চলে আসলো। বসার ঘরে ঢুকতে গিয়ে রাকিবকে দেখে তার হাসিমুখ একমহুর্তে চুপসে গেল। হবু শ্বশুরমশাই দিপাকে বললেন,
” আসো মা আসো।”
দিপা শ্বশুর মশাইয়ের পাশের সোফায় গিয়ে বসল।
আমি আনন্দিত গলায় বললাম,
” মিস দিপা, ঘটনাটা কী আপনি বলবেন? নাকি রাকিব দেখাবে?”
দিপা মাথা নিচু করে বসে রইল। শ্বশুর মশাই বললেন, ” ঘটনাটা কী?”
দিপা একবার মাথা উঁচু করে কিছু বলতে গিয়েও আবার মাথা নিচু করে ফেলল।
আমি অহনার বাবাকে বললাম,
” বাবা, আপনি যেই ছবিগুলোর কারণে আমাকে লম্পট বলেছিলেন, সেই ছবিগুলো মিথ্যা ছিল। ছবিগুলো উনার বানানো।”
শ্বশুর মশাই দিপার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে শুরু করলেন। অহনা দিপার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলল,
” দিপা, তোকে আমি এত বিশ্বাস করতাম, আর তুই এমন করলি? ছি! ছি!”
শ্বশুর মশাইয়ের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি বিরক্তমুখে অহনাকে বললেন,
” কী হচ্ছে এসব?”
অহনা বলল,
” বাবা তোমাকে আমি পরে সব বুঝিয়ে বলব।”
দিপা কোনো কথা বলছে না।
অহনা ফের দিপাকে বলল,
” তুই এইসব কেন করলি? আমাকে একটাবার বলতে পারলি না?”
দিপা সোফা থেকে উঠে চেঁচিয়ে বলল,
” করেছি, বেশ করেছি।”
বলেই সে দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল।
.
বিয়ের মাসখানেক পরের কথা…
রাতে অহনাকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়েছি। বগুড়া যাব ঠিক করেছি। বগুড়ায় দুদিন থেকে ঘুরে-ফিরে বাড়ি ফিরব। সিরাজগঞ্জ পেরিয়ে অহনাকে বললাম,
” দিপা মেয়েটার খবর কী?”
অহনা চট করে বলল,
” ওর খবর আমি জানবো কী করে?”
– বেস্ট ফ্রেন্ড না? খোঁজ-খবর রাখবে না?
– ঐরকম বেস্ট ফ্রেন্ড আমার দরকার নেই।
– মেয়েটার মাথায় কিন্তু বেশ বুদ্ধি আছে।
অহনা কোনো কথা বলল না।
আমি বললাম,
” যদি শেষ পর্যন্ত দিপার কর্মকাণ্ড ধরা না পড়তো তাহলে কী হতো বলো তো?”
অহনা ঘুমঘুম গলায় বলল,
” কী আর হতো তোমার সাথে আমার বিয়েটা হতো না।”
– আরো একটা ঘটনা ঘটতো।
– কী?
– আমি গলায় রশি দিয়ে মরতাম।
– হোয়াট?
– সত্য কথা বললাম, এমন সুন্দরী বউ পেয়ে হাতছাড়া হয়ে গেলে, গলায় রশি দেওয়া ছাড়া আর কী কোনো উপায় আছে?
– খুব পটানোর চেষ্টা হচ্ছে তাই না?
– বিয়ের আগে তো প্রেম করতে পারলাম না, এখন একটু চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?
অহনা হাই তুলতে তুলতে বলল,
” ঢং, না? বুঝি বুঝি আমি সব বুঝি।
– আর কী কী বোঝো তুমি?
অহনা বিরক্ত হবার ভঙ্গি করে বলল,
” Shut up and drive”
_____
সমাপ্ত

লেখা:
নাহিদ হাসান নিবিড়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here