সকাল সকাল মা এসে ঘরে ঢুকে হলুদ একটা খাম আমার মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলল,
“ছিছি তুই এত নিচে নেমে গেছিস!”
.
কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা ঘর থেকে বের হয়ে দরজা সজোরে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি বিছানায় উঠে বসে খামের দিকে তাকালাম। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের হলুদ খাম। খামে ডেফিনেটিভ ডাকটিকিট লাগানো, ডাকবিভাগের সিল দেওয়া রেজিস্ট্রিকৃত চিঠি। খামের একপাশ খোলা, মা নিশ্চয়ই চিঠিটা পড়েছে। চিঠিতে সম্ভবত এমন কিছু লেখা আছে যা পড়ে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ মা ছিছি করে গেল। খাম থেকে চিঠি বের না করে আমি প্রেরকের ঠিকানায় চোখ দিলাম,
প্রেরক অংশে লেখা,
“তানিয়া চৌধুরী।”
“ভূইয়াবাড়ি, সিংহেশ্বর, ফুলপুর, ময়মনসিংহ।”
ময়মনসিংহে আমার পরিচিত কেউ থাকে না, পূর্বেও ছিল না। চিঠি কে পাঠাল বুঝতে পারছি না। প্রাপকের ঠিকানায়, আমার পুরো নাম নির্ভুলভাবে লেখা আছে, বাবার নাম, বাড়ি নম্বর, রোড নম্বর সব লেখা আছে, অর্থাৎ চিঠি ভুল ঠিকানায় আসেনি। আমি খাম থেকে চিঠি বের করলাম। চিঠি লেখা হয়েছে নোটপ্যাডের সুন্দর একটি পাতায়, হাতের লেখা যথেষ্ট সুন্দর। চিঠিতে লেখা,
প্রিয় মুনেম,
আশা করছি ভাল আছো। তুমি বলেছিলে, কখনো যেন তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি। আমি কখনো যোগাযোগের চেষ্টা করিনি, নিতান্ত বাধ্য হয়ে চিঠিটা পাঠানো। ফোন নম্বর বদলেছ, তোমার বর্তমান ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। একটা বিশেষ খবর পেয়ে লিখতে বসেছি।
শুনলাম, কিছুদিনের মধ্যে তুমি বিয়ে করছ। বিয়ের চূড়ান্ত কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। পাত্রীর নাম অহনা। বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে।
তুমি পারিবারিকভাবে বিয়ে করছ জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। নিশ্চয়ই ভাবছ, স্ত্রীর মর্যাদা পেতে এত কান্নাকাটি করলাম, তাহলে খুশি হলাম কেন? ভেবে দেখলাম, সবার অজান্তে যেভাবে আমাদের বিয়ে হয়েছে, সাধারণ চোখে কেউ তা মেনে নেবে না। সবাই মেনে নিলেও আগের তুমি টাকে আমি আর ফিরে পাব না।
আমি যা পাইনি অন্য কেউ তা পাবে, সেজন্যই খুশি হয়েছি।
পুনশ্চঃ ১- তোমার ছেলের বয়স আড়াই বছর হলো। আমি ওর নাম রেখেছি, তকী।
পুনশ্চঃ ২- চিঠি লেখার মূল উদ্দেশ্য, বিয়ের আগে তুমি আমাকে অবশ্যই মৌখিকভাবে ডিভোর্স দিয়ে যাবে। ফোনে বললেও হবে, ফোন নম্বর আগেরটাই আছে।
.
চিঠি পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এরকম অদ্ভুত চিঠি কে পাঠাতে পারে! কেউ কি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে! তানিয়া নামের মেয়েটা কে! এটা কি তার ছদ্মনাম! আসল নাম কি হতে পারে! আমি দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার চিঠি পড়ে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
.
ভোররাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় ছাতা মাথায় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। চিঠির শব্দগুলো বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুদিন পর অহনার সাথে আমার বিয়ে। বিয়ের কার্ড ইতোমধ্যে ছাপানো হয়ে গেছে। বাবা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার্ড বিলি করতে শুরু করেছেন। এমন সময় এরকম উদ্ভট চিঠি কে পাঠাল! আমি সুক্ষ্মভাবে পুরো বিষয় ঠান্ডা মাথায় ভাবতে করতে শুরু করলাম, ময়মনসিংহে আমার পরিচিত কেউ থাকে না, তানিয়া নামের কাউকে আমি চিনি না, সুতরাং তানিয়া নামের কারো চিঠি পাঠানোর কথা না। চিঠিটা নিশ্চয়ই অন্য কেউ পাঠিয়েছে, যে আমাদের সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানে, কিন্তু কে! বন্ধুদের মধ্যে কেউ কি হতে পারে! সম্প্রতি আমরা বাড়ি বদলে নতুন বাড়িতে উঠেছি। বন্ধুরা ছাড়া নতুন বাড়ির নম্বর, রোড নম্বর, ঁ পুরো নাম, আমার পুরো নাম কেউ জানে না। আত্মীয়-স্বজনরা যদিও বাবা এবং আমার পুরো নাম জানে তবে নতুন বাড়িতে তাঁরা এখনো আসেনি সুতরাং বাড়ির নম্বর তাদের জানার কথা না। বাড়ি বদলাবার সময় বন্ধুরা এসেছিল বলেই ওরা বাড়ির নতুন ঠিকানা জানে।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, চিঠিটা বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন আমাকে ভরকে দেবার জন্য নেহায়েতই দুষ্টুমি করে পাঠিয়েছে। ছদ্মনাম হিসেবে, “তানিয়া চৌধুরী” ব্যবহার করেছে। কাজটা বন্ধুদের মধ্যে যেই করেছে একদম ঠিক করেনি। ফাজলামির একটা ন্যূনতম সীমা থাকা প্রয়োজন।
মা সচরাচর আমার কোনো কিছুতে হাত দেয় না। আজ হঠাৎ কি মনে করে চিঠি খুলল, কে জানে! মা নিশ্চয়ই ভেবে বসে আছে, তাঁর ছেলে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে, সেই ঘরে আমার একটা বাচ্চা ছেলেও আছে, ছেলের নাম- তকী!
.
বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে অফিসে যাবার জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে ডাইনিংয়ে চলে গেলাম।
মা গোমড়া মুখে ডায়নিংয়ে বসে আছে। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। এতে তাঁর কোন ভাবান্তর হলনা। সে এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি বললাম,
” মা, চিঠিটা যে পাঠিয়েছে তাকে আমি চিনি না।”
মা কিছু না বলে চুপসানো মুখে বসে রইল। তাঁর চোখে-মুখে তীব্র দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে।
আমি মা’র চোখে চোখ রেখে বললাম,
” দেখো, তানিয়া নামের কাউকে আমি চিনিই না, এসব তো দূরের কথা।”
মা গম্ভীর গলায় বলল,
” পরিচয় না থাকলে সেই মেয়ে এরকম চিঠি পাঠাল কেন? নাম ঠিকানা জানল কী করে?”
– আমার মনে হচ্ছে, এসব আমার কোনো বন্ধুর কাজ, নিছক ফাজলামো করে চিঠিটা পাঠিয়েছে।
– ফাজলামো করে এমন চিঠি কেউ পাঠায়? ভাগ্যিস কি মনে করে খাম খুলে চিঠিটা পড়েছিলাম, নইলে তো জানতামই না, আমার ছেলে…ছিছি।
– তুমি আমার কথা বিশ্বাস না করে, সাধারণ একটা চিঠির কথা বিশ্বাস করলে, চিঠিতো যে কেউই পাঠাতে পারে। ঠিকানা যোগাড় করা কি এমন কোন কঠিন ব্যাপার?
– যে চিঠি পাঠিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আয়, এরপর বুঝব এসব তুই করিসনি।
মা ডায়নিং থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। নাস্তা না করেই আমি বাসা থেকে বের হলাম।
.
মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। ফাজলামো করার এত এত বিষয় থাকতে বন্ধুরা স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে ফাজলামো করছে। এহেন ফাজলামো করা কি উচিত? অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় মনিরের চায়ের দোকান হয়ে আসতে হবে, বন্ধুদের সবাইকে ওখানেই পাওয়া যাবে।
.
অফিসে কাজের চাপ অত্যধিক, বিয়ের জন্য আগাম ছুটি নিয়ে রেখেছি। সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। রাকিবকে এক কাপ কফি দিতে বলে আমি ডেস্কে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসের সহকর্মী ফিরোজ ভাই আমার ডেস্কে উঁকি মেরে বললেন,
” মুনেম ভাই শুনলাম বিয়ের জন্যে নাকি অগ্রিম ছুটি নিয়েছেন?”
আমি বললাম,
” হ্যাঁ, লম্বা ছুটি নিয়েছি।”
ফিরোজ ভাই উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
” পাত্রী বৃত্তান্ত কী? মেয়ের নাম কী?”
– অহনা।
– বাহ, খুব মিষ্টি নাম। দেখতেও নিশ্চয়ই খুব মিষ্টি। তো ভাবি কী করেন? পড়াশোনা নাকি অন্যকিছু?
– মাস্টার্স শেষ করেছে, আপাতত কিছু করছে না।
– বয়স তো মনে হচ্ছে কাছাকাছি!
– হ্যাঁ, সমবয়সী।”
– আগে থেকে জানাশোনা নাকি ভাই?”
– না ভাই।
– ও আচ্ছা ভাই, এই ব্যাপারে পরে চা খেতে খেতে গল্প করব। অনেক কাজ জমা পড়ে আছে। এখন যাই।
ফিরোজ ভাই চলে যেতেই রাকিব মগ ভর্তি কফি টেবিলে রেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল,
” ভাইয়া আর কিছু লাগবে?”
আমি বললাম,
” আর কিছু লাগবে না। তুমি বসো, কথা আছে।”
.
রাকিব আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। অফিসের সবাইকে রাকিব স্যার বলে ডাকে। আমাকেও স্যার বলে ডাকতো কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভাল লাগত না, তাই আমি ওকে বলেছি আমাকে ও যেন ভাইয়া বলে ডাকে। কি সুন্দর ফর্সা ঝকঝকে চেহারা, চোখে ধ্রুব মায়া, মুখে সবসময় মিষ্টি একটা হাসির প্রলেপ লেগে থাকে, রাকিব যাই-ই পরিধান করে তাতেই ওকে সুন্দর লাগে। ছেলেটাকে পিয়ন পদে ঠিক মানায় না। এরকম ছেলের বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা উচিত। রাকিবের আরেকটা বিষয় হচ্ছে ওর বুদ্ধি অসাধারণ। পড়াশোনা করছে ডিগ্রীতে, পাশাপাশি অফিসে চাকরি করছে। এতটুকুন একটা ছেলে পুরো সংসারের ভার মাথায় নিয়েছে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি রাকিবকে জিজ্ঞাসা করলাম,
” দিনকাল কেমন যাচ্ছে রাকিব?”
– ভাল ভাইয়া।
– পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে তো?
– জি ভাইয়া।
– শুনেছো না, সামনে আমার বিয়ে?
– জি ভাইয়া, শুনেছি।
– তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।
– আচ্ছা ভাইয়া।
আমি পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে রাকিবের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম,
” এটা দিয়ে নতুন জামাকাপড় কিনবে, কেমন?”
রাকিব লজ্জা পেয়ে বলল,
” ভাইয়া আমার তো কাপড় আছে।”
– তাতে কি হয়েছে? আরো কিনবে।
রাকিব মাথা নিচু করে বসে রইল।
.
অফিস শেষে মনিরের চায়ের দোকান পর্যন্ত আসতে আসতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল। বন্ধুদের মধ্যে রবিন বাদে ফয়সাল, রাফি, সুজন সবাই আছে। রবিন না থাকার কারণ হচ্ছে, খালুকে নিয়ে ও চিকিৎসার জন্য হায়দারাবাদে গেছে। সবাই কেরামবোর্ড খেলায় ব্যস্ত। আমি ওদেরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলাম, দোস্ত চিঠিটা কে পাঠিয়েছিস?
ফয়সাল উল্টো জিজ্ঞাসা করল, কিসের চিঠি?
আমি চিঠির ব্যাপারে খুলে বলার পর সুজন বলল, আমরা এইসব কেন করব?
– আমাদের নতুন বাসার ঠিকানা তো তোরা ছাড়া তেমন কেউ জানে না। সত্যি করে বল, কে পাঠিয়েছিস?
ফয়সাল বলল, তুই আমাদেরকে সন্দেহ করছিস?
– দেখ আমি খুব চিন্তায় আছি, যদি করে থাকিস তাহলে বলে দে। বাসায় এ নিয়ে মা খুব রেগে আছে।
রাফি বলল,
” দেখ মুনেম, আমাদের মধ্যে কেউ যদি করত তাহলে অনেক আগেই বলে দিতো। আমরা এমন চিঠি কেন পাঠাব বল তো? এতে আমাদের লাভটা কী? এরপরও যদি তোর বিশ্বাস নাহয় তাহলে আমাদের সাথে মেশা বন্ধ করে দে।”
.
আমি বাসায় ফিরে আসলাম একরাশ চিন্তা নিয়ে। একবার মনে হচ্ছে, বন্ধুরা মিথ্যা বলছে, আবার মনে হচ্ছে, ওরা মিথ্যা কেন বলবে!
শ্রেয়ার কথা মনে পড়ছে। কলেজে পড়তে শ্রেয়ার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কলেজ জীবন শেষ হবার আগেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর জামাই ওকে কানাডায় নিয়ে গেছে, সেও বহুবছর আগের কথা। শ্রেয়া কী এরকম করবে! কেন করবে! আমাদের সম্পর্কটা ও নিজেই ভেঙে দিয়েছিল, সুতরাং শ্রেয়া এমনটা করেছে ভাবা একেবারেই যুক্তিহীন। কেউ একজন নিশ্চয়ই নিজেকে আড়ালে রেখে মজা করছে, এসব নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করে কি লাভ? সময় হলে এমনিতেই নিজে থেকে বলে দেবে।
.
সপ্তাহখানেক চলে গেল। গতকাল খালাতো-মামাতো ভাই-বোনেরা আমাদের বাসায় চলে এসেছে। সকাল সকাল একসাথে বিয়ের কেনাকাটা করতে যাব। আমি জামাকাপড় বদলে প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম, অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। ফোন ধরতেই অপরপাশ থেকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি মুনেম বলছেন?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
– “স্যার আপনার একটা কুরিয়ার আছে। আমি আপনাদের ফ্ল্যাটের সামনে আছি, একটু আসুন।”
– আচ্ছা আসছি।
.
কুরিয়ার থেকে বাইশ কি তেইশ বছরের একটা ছেলে এসেছে। আমাকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আপনিই মুনেম?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। কী এসেছে?”
একটা ছোট প্যাকেট আর রিসিভ পেপার এগিয়ে দিয়ে সে আমাকে বলল, “স্যার একটা স্বাক্ষর করে দিন।”
.
আমি স্বাক্ষর করে প্যাকেট নিয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কুরিয়ার পাঠিয়েছে তানিয়া নামের মেয়েটি। আমি দ্রুত প্যাকেট খুললাম। প্যাকেট খুলতেই ভেতরে একটা চিঠি আরেকটা ইনভেলাপ পেলাম।
চিঠিতে লেখা,
“তুমি কি সবকিছু ভুলে গেছ? অনেক দিন আগের কথা, ভুলে যেতেই পারো। তোমার আমার বেশকিছু স্পর্শকাতর ছবি আমার কাছে খুব যত্ন করে রাখা আছে। অতি শীঘ্রই তুমি যদি আমাকে ডিভোর্স না দাও তাহলে ছবিগুলো তোমার হবু শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হবে।
বিঃদ্রঃ ইনভেলাপে তকীর কিছু ছবি দিলাম।
.
আমি ইনভেলাপ খুললাম, ইনভেলাপে পাঠানো হয়েছে সুন্দর একটা বাচ্চা ছেলের দশটা ছবি। ছবিগুলো বিভিন্ন বয়সের।
চিঠি, ছবি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে কুরিয়ারের প্রেরক অংশে যেই ফোন নম্বর দেওয়া আছে তাতে ফোন করলাম কিন্তু ফোন নম্বর বন্ধ। ইতোমধ্যে খালাতো-মামাতো ভাই-বোনেরা আমার ঘরের দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে। আমি দ্রুত নম্বরটা ফোনে সেভ করে প্রস্তুত হয়ে ওদের সাথে কেনাকাটা করতে চলে গেলাম।
.
আমার সাথে কেনাকাটা করতে এসেছে দুই খালাতো বোন, দুই দুলাভাই, মা আর এক মামাতো ভাই। আমরা মার্কেটের দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছি। দুলাভাইরা নানারকম রসিকতা করতে শুরু করেছে। ঘুরতে ঘুরতে আমার জন্য শেরওয়ানি, পাগড়ি, জুতো, অহনার জন্য শাড়ি, কসমেটিকস কিনে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেতে ঢুকলাম।
.
বর্তমানে আমরা ঢাকাতে থাকলেও আমার কৈশোর জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। স্কুল জীবন পর্যন্ত আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়। চন্দ্রঘোনার জায়গা-জমি সবকিছু বিক্রি করে আমরা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসলেও জায়গাটার প্রতি মায়া আমার একবিন্দুও কমেনি। ছেলেবেলার বন্ধুদের খুব মনে পড়ে। ফোন, ফেসবুকে যোগাযোগ থাকলেও দেখা-সাক্ষাৎ নেই অনেকদিন, তাছাড়া বন্ধুদের ফোন করে বিয়ের দাওয়াত দেওয়াটা আমার কাছে মোটেও ভাল লাগছে না, ইচ্ছা করছে নিজে সশরীরে একটা দিনের জন্যে গিয়ে সবাইকে দাওয়াত করে আসতে। বিয়ের অনুষ্ঠানের সব থেকে বড় ভাগিদার তো বন্ধুরাই কিন্তু তানিয়া চৌধুরীর নামে আসা চিঠি-কুরিয়ার আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে, যদিও ব্যাপারটাকে ফাজলামির বাইরে অন্যকিছু আমি এখনো ভাবছি না তারপরও চিন্তা হচ্ছে, ফাজলামি হোক অথবা যাই হোক যদি চন্দ্রঘোনা যেতেই বাসায় ফের কুরিয়ার অথবা চিঠি আসে! কেনাকাটা করতে গিয়ে সারাটাদিন চন্দ্রঘোনা যাব কি যাব না এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরে এসে চন্দ্রঘোনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।
.
বিয়ের বাকি দেড় সপ্তাহ। বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি এখন ডেকোরেটর, বাবুর্চি নিয়ে ব্যস্ত। লাইটিংয়ের কাজ বেশ আগে থেকেই করা হচ্ছে। বিকেলবেলা লাইটিংয়ের লোকজন এসে লাইট লাগাতে শুরু করেছে। আব্বা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর তদারকি করছেন। আমি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ অহনার বাবা ফোন করে আমাকে বললেন, দ্রুত তাদের বাসায় যেতে।
.
আমি সন্ধ্যার দিকে অহনাদের বাড়িতে গেলাম। অহনার মা এসে দরজা খুলে চোখ গরম করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অহনার বাবা সোফায় বসে ছিলেন, আমি দরজা দিয়ে ঢুকতেই তিনি আমাকে দেখে বললেন,
” বিয়ে ক্যান্সেল।”
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
” মানে?”
– ন্যাকা, মানে বোঝো না?
অহনার বাবা, সোফা থেকে উঠে একটা ইনভেলাপ আমার দিকে ছুড়ে মেরে বললেন,
” বাসায় গিয়ে দেখো। লম্পট কোথাকার!”
______
#বহুরূপী
#পর্ব-০১
#চলবে
লেখা- নাহিদ হাসান নিবিড়