#বকুল
#লেখনীতে:আফসানা মিমি
||৩||
বর্ষাকালের সন্ধ্যায় অসীম ধারায় বৃষ্টি পড়ছে । টিনের চালের উপর টুংটাং আওয়াজে পরিবেশটা মুখরিত হয়ে আছে । এসময়ে এক কাপ কফি বা চা হলে মন্দ হয় না । সকলের মধ্যে বসে আছি আমি । বিনা মিরা আপু দুইজন জরিয়ে ধরে আছে আমাকে দুপাশে । সামনেই সামিন নামের সুদর্শন পুরুষটি রাগে গজগজ করছে । কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়তে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ।
কিছুক্ষণ আগে , স্টোররুমের দরজার সামনে আজকের আসা শিক্ষার্থিদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আছে।
দুপুরে পরিচয় পর্বে নাম বলেছিলো তার নাম রাহাত । কেমন যেন লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে প্রশ্ন করলাম ভাইয়াকে ,
‘ দরজা আটকালেন কেন ভাইয়া ? ‘
‘ সুন্দরী বুঝো না কেন দরজা আটকালাম ? তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে । তাই সুযোগ বুঝে তোমার কাছে আসলাম। আজকের এই বৃষ্টি ভেজা বিকেলে তুমি আর আমি একসাথে। কাছাকাছিতে ।’
রাহাত ভাইয়া এসব খারাপ কথা বলে আমার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নজর ঘোরাচ্ছেন । আর আমি এদিকে থরথর করে কাঁপছি । আকস্মিক এমন হওয়াতে মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে যার কারনে চিল্লাতেও পারছিনা । আস্তে আস্তে রাহাত ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসছেন । পেছনে একটা পুরোনো ফুলের টপ পেলাম যা লুকিয়ে হাতে রেখে দিলাম । নিজেকে নিজেরই রক্ষা করতে হবে আজ। কারন এখান থেকে আমার চিৎকারের আওয়াজ বাহিরে শোনা যাবেনা । রাহাত ভাই বিশ্রী হাসি দিয়ে ওড়নায় হাত দেয়ার জন্য তার হাত বাড়িয়ে দিতেই ফুলের সেই টপ দিয়ে হাতে আঘাত করলাম । ফলস্বরূপ রাহাত ভাই ব্যথায় দূরে সরে গেলেন । মাথার বুদ্ধি আরেকটু খাঁটিয়ে পায়েও আঘাত করলাম যেন পাল্টা আক্রমণ করতে না পারে । পায়ে আঘাত করার সাথে সাথে ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাহাত ভাই । এই সুযোগে সবকিছু ফেলে স্টোর রুমের দরজা খুলে দৌড় দেই। কিছুটা সামনে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখতে পাই ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে । দৌড়ে তার কাছে গিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম । তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে আমার দু বাহু ধরে বলতে শুরু করলেন ,
‘ কি হয়েছে বকুলফুল, এভাবে কাঁদছো কেন ? ‘
‘ স্টোর র’রুমে একজন ….
আর বলতে পারলাম না জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম । যখন জ্ঞান ফিরল আমার তখন রিসোর্টের রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এবং চোখ খুলে দেখলাম আমাকে ঘিরে সবাই বসে আছে ।
বর্তমানে ,
অতিরিক্ত রাগান্বিতভাবে সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটি বলতে শুরু করলো ,
‘ উদয় , তোকে আমি আগেই বলেছিলাম এই রাহাতকে সাথে করে নিয়ে না আসতে । ওর আচার-আচরণ আমার জানা আছে । কলেজ ভার্সিটির মধ্যে এক নাম্বার খারাপ ছেলে এই রাহাত । আমার আগেই বুঝা উচিত ছিলো এখানে এসেও তার আসল চেহারা সবাইকে দেখাবে । আজ যদি বকুলফুলের কিছু হয়ে যেতো তো কি হতো ? ‘
‘ সানিম , ভাই আমার শান্ত হো । রাহাত ওর করা আপরাধের শাস্তি পাবে । যেমনভাবে মেরেছিস ছয় মাসের আগে বেড থেকে উঠতে পারবেনা । আর বকুলের মতো সাহসী মেয়ে যতদিন আছে ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের সাথে খারাপকিছু হবে না । ‘
উদয় ভাইয়ার এসব কথাতেও সুদর্শন পুরুষটি শান্ত হচ্ছে না । আমার পাশ থেকে বিনা আপু উঠে গিয়ে সানিম ভাইয়ার পাশে বসে আস্তে আস্তে কি যেন বললো আর এমনিই উনি শান্ত হয়ে গেলেন । কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। আর আমি ভাবছি উদয় ভাইয়ার বলা কথা। আমার জন্য সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটি মারামারি করেছে তাও তাদের ভার্সিটির ছেলেকে ।
যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তাই এবার বাড়ি ফিরে যাবো । এমনিতেও আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেল। লতিফ চাচার থেকে বিদায় নিতে গেলাম । জানিনা এই মানুষটা কিভাবে আমার মনের কথা বুঝে যায় আসার সময় হাতে কয়েক শত টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন , যাওয়ার সময় বাড়ির জন্য বাজার করে নিয়ে যেতে ।
রিসোর্টের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আছি অটোর জন্য । আজ আর হেঁটে বাসায় যাবোনা । কারন বৃষ্টির কারনে রাস্তার অবস্থা অনেক খারাপ ।
‘ বকুলফুল , এই বকুলফুল ! ‘
পেছন থেকে করোর ডাকে দাঁড়িয়ে গেলাম । ও মা ! এদেখি সুদর্শন পুরুষ । তার আবার আমার সাথে কি কাজ ? দূর থেকে দৌড়ে আসছে আমার কাছে । আমার কাছে এসে দুই হাঁটু ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ,
‘ বকুলফুল , চলো তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি । ‘
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার পানে । একদিন দেখাতে মানুষটি এমনভাবে কথা বলছে যেন যুগ যুগ ধরে চিনে আমাকে । হাসিমুখে উওর দিলাম ,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া , প্রয়োজন নেই আমি অটো নিয়ে চলে যাবো ।’
উওরটা মনে হয় পছন্দ হয়নি তার বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বলা শুরু করলো ,
‘ দেখো আজ যা হয়েছে তার জন্য আমরা দুঃখিত । বুঝতে পারিনি রাহাত এমন কাজ করবে । তাই তোমার সাথে রাহাতের মতো অন্য কেউ যেন খারাপকাজ করতে না পারে তাই তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি ।’
সানিম ভাইয়ার কথায় কিছুটা হেসে বলতে শুরু করলাম ,
‘ বলার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া । আমি গ্রামের মেয়ে। রাস্তাগাটের সবাই আমাকে চেনে । তাই এখানে আমার কোন সমস্যা হবে না । বরং এখানে আপনার সমস্যা হবে যদি কেউ আমার সাথে আপনাকে দেখে। সুতরাং ভালো থাকবেন কাল সকালে আবার দেখা হবে । ‘
সামনে আলফাজ চাচার অটো এসে থামলো । ‘বাসায় যাবে নাকি বকুল ? ‘
‘ হ চাচা , চলেন ।’
আলফাজ চাচার অটোতে চড়ে বাসায় চলে আসলাম। পথিমধ্যে বাড়ির জন্য বাজার আর ফরিদা খালার থেকে জুতা জোড়া নিয়ে নিলাম ।
আমাদের বাসাটা খুব বেশি বড় না । গ্রামাঞ্চলের বাড়ি আর কেমন হবে ! মাটি দিয়ে তৈরি বাড়িতে তিনটি মাত্র কামড়া । একটাতে মা-বাবা থাকে , আরেকটাতে নাঈম ভাইয়া আসলে থাকে আর আরেকটাতে নাঈমা। আর আমি ! আমি থাকি বাহিরের রান্নাঘরের পাশে ছোট একটি কামড়ায় । বাজার নিয়ে বারান্দায় রাখলাম । পাখি এসে একে একে সব দেখছে । পাখি হলো কাজের মেয়ে আমার মার তিন নাম্বার চোখ। তার কাজ হলো আমার সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দোষ বের করা আর বাবার সেবা করা । এই যে , এখন বাজার নিয়ে আসলাম! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কি কম এনেছি । যদি কোনকিছু আনতে কম পরে তো সাথে সাথে মাকে বলে দিবে । আর তা শুনে মা এসে গালিগালাজ শরু করবে । যা বললাম তাই , কি যেন দেখে দৌড়ে আম্মা আম্মা ডাকতে ডাকতে চলে গেল বুঝলাম আজও কপালে বকা আছে ।
রাত এখন আটটা বাজে । সকালে সকাল আর দুপুরের খাবার রান্না করে রেখে গিয়েছিলাম এখন রাতের রান্না করবো । বাজার থেকে এনেছি ছোট মাছ , পটল , আলু আর ঢেড়স । ঝটপট ঢেড়স ভাজি আর ছোট মাছের চড়চড়ি করে ফেললাম পটল আর আলু দিয়ে । রান্না শেষ করে গোসল করতে চলে গেলাম । আজ রাতে পড়তে বসবো । সারাদিন পড়ার সময় পাইনা । এই রাতে পড়ে এইচএসসি পর্যন্ত এসেছি। সামনে ভার্সিটির পরীক্ষা জানিনা ভাগ্যে কি আছে কিন্তু চেষ্টা তো করতে ক্ষতি নেই ।
বড়লোকদের মতো খাবারের টেবিল আমাদের নেই । আমরা মাটিতে পাটি বিছিয়ে খাবার খাই । প্রথমে বাবাকে খাইয়ে এসে মা কে খাবার দিলাম। ভয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি এইভেবে না জানি পাখি এসে কি বলেছে মাকে । খাবারের এক পর্যায়ে মা প্রশ্ন করলো ,
‘ হাতে কতটাকা অবশিষ্ট আছে আর ? তোর বাবার ঔষধ আনতে হবে খাবার খাওয়ার পর টাটাগুলো দিয়ে যাবি । ‘
এবাড়িতে থাকতে হলে মায়ের কথা শুনতে হবে তাই হ্যাঁ বলে দিলাম ।
মা খেতে খেতে আরেকটা প্রশ্ন করলেন ,
‘ শুনলাম লতিফ ভাইয়ের ভাগ্নে আসছে শহর থেকে ? কেমন দেখতে রে ? ‘
মার মুখে এমনকথা শনে ভ্রু- যুগল উঁচু হয় গেল আমার । মা কীভাবে জানতে পারলো রিসোর্টের অভ্যন্তরীণের কথা ? মা কি কোনভাবে আজকের কথা জানতে পেরেছে ? যদি জানতে পারে তো কাল থেকে রিসোর্টে যাওয়া হবেনা আমার । মনে মনে এসব ভাবছি তখন মায়ের ডাকে হুঁশ আসে
‘ কিরে বকুল বল কিছু ?
মায়ের প্রশ্নে সোজাসাপ্টা জবাব দিলাম ,
‘ ছেলে সুন্দর । দেখতে তার মায়ের মতো ।’
মা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন । তারপর খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে । আমিও খাবার খেয়ে সবঠিক করে রেখে এসে পড়তে বসলাম । আমার যে পড়তে হবে অনেক । পড়াশোনার জন্য যা করার তাই করবো । নিজের লক্ষ্যের দিকে পৌছুতেই হবে আমার ।
চলবে ……