#বকুল
#লেখনীতে:Afsana Mimi
||২||
সুদর্শন পুরুষের ব্যাখ্যা যদি কেউ দিতে চায় তো বলবো সামনের মানুষটির ব্যাখ্যা দিতে ।
লম্বায় আনুমানিক পাঁচ ফিট নয় হবে যার কারনে আমার মাথা উঁচিয়ে দেখতে হচ্ছে । গায়ের রং লাল ফর্সা , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর দেখতে মাশাআল্লাহ । আমার মতো পাঁচজন বকুলকে একাই উল্টিয়ে ফেলে দিতে পারবে। কোথা থেকে যেন ডিপডিপ আওয়াজ আসছে খেয়াল করে দেখি পাজি হৃদপিন্ডটা জোরে জোরে লাফাচ্ছে মনে মনে নিজেকেই বকছি ,
‘ ছি বকুল ছি ! চিনিস না জানিস না কি করছিস । জানিস না পরপুরুষের প্রতি এতো নজর দিতে নেই ।’
কিন্তু চোখ আর কই মানলো? হা করে সামনের সুদর্শন পুরুষটাকে পর্যবেক্ষণ করছি এমন সময় চোখের সামনে কেউ তুড়ি বাজালো ,
‘ হেই মিস চিৎপটাং , কাদায় পড়ে কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন ? ‘
খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলাম সুদর্শন পুরুষটির কথা শুনে । আস্তে করে বললাম আপনাকে দেখছি ।
‘ কি কিছু বললেন মিস ?’
জিহ্বায় কামড় দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম
‘ কিছু বলবেন ? কিছু দরকার ছিল আপনার ? ‘
‘ আসলে আমি রিসোর্টের মালিকের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম । একজন বললো এখানে পাওয়া যাবে তাই আসলাম ।’
কিছুটা হেসে উওর দিলাম ,
‘ আপনি কক্ষে যান আমি লতিফ চাচাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ।’
‘ধন্যবাদ মিস ‘
কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে সুদর্শন পুরুষটি প্রশ্ন করল ,
‘ আপনার নামটা জানা হলোনা। কিছু মনে না করলে নামটা কি বলা যাবে ? ‘
‘ অবশ্যই , আমার নাম বকুল । ‘
‘ বকুল , শুধুই বকুল ? আগে পড়ে আর কিছু নেই ?
‘ না শুধুই বকুল । ‘
সুদর্শন পুরুষটি কিছুক্ষণ বিজ্ঞ মানুষের মতো কি ভাবলেন তারপর চট করে বলে ফেললেন ,
‘ শুনো মিস বকুল , শুধু বকুল নাম মানায় না । আর বকুলের সাথে ফুল না থাকলে খালি খালি লাগে তাই আজ থেকে তোমার নাম বকুলফুল । সুন্দর না ? আর তুমি আমার ছোট হবে তাই তুমি করে সম্বোধন করছি। ‘
সুদর্শন পুরুষটির কথা শুনে চোখ গুলো ইয়া বড় হয়ে আসলো । এই প্রথম লতিফ চাচা আরিফা আর রবিন ভাই ছাড়া অন্য কেউ এত সুন্দর করে কথা বললো । এসব সাত পাঁচ চিন্তা করছি তখন কারোর চিল্লানোতে হুস আসে ,
‘ এই যে বকুলফুল এতো ভাবাভাবি বাদ দিয়ে রিসোর্টের মালিককে খবর দাও জরুরী কথা আছে ।’
এতক্ষণ যেন ভিন্ন জগতে ছিলাম । মানুষটার সাথে দুমিনিট কথা বলে আলাদা প্রশান্তি অনুভব করছি । আরিফাকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম ।
ঠিক মধ্যাহ্নের সময় । বিশাল আকাশের বুকে মেঘের ভেলা সরে গিয়ে সূর্যি মামা কিরন দেয়া শুরু করেছে । লতিফ চাচার রিসোর্টটা খুব বেশি বড়ও না আবার খুব বেশি ছোটও না । রিসোর্টের একসাথে তিনপ্রান্তে অনায়েসেই পিকনিক করতে পারবে । বাচ্চাদের জন্য আলাদা খেলার প্রাঙ্গন আছে সেখানে বাচ্চাদের খেলার যাবতীয় সমস্ত সামগ্রী আছে ।
এবারের শিক্ষার্থিরা যারা এসেছে তারা দশদিন থাকবে রিসোর্টে । আরিফাকে সাথে নিয়ে ওয়েলকাম ড্রিংক আর হাল্কা নাস্তা নিয়ে যাচ্ছি রিসোর্টের পুলের পাশে সেখানে নাকি তারা বসে আছে । পুলের পাশের কাছাকাছি বসার ব্যবস্থা করা আছে সেখানে আসতেই লতিফ চাচা হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।
‘ বাবারা , এই হচ্ছে বকুল আমার মেয়ের মতো । আর বকুল তোকে বলা হয়নি আজ যারা এসেছে তাদের মধ্যে একজন আমার ভাইয়ের ছেলে মানে চাচাতো ভাইয়ের ছেলে । মূলত ভাইয়ের ছেলের সাথে এরা সবাই এসেছে …’
চাচার কথার মাঝখানে একজন মানুষ বলে উঠে ,
‘ আরে তুমি সেই মেয়ে না যে আজ সকালে হা হা হা …’
পুরো কথা বলতে পারলোনা আর এমনি হাসি । অবশ্য হাসারই কথা সকালে আমার যা অবস্থা হয়েছিল তা মনে করে নিজেরই হাসি পাচ্ছে ।
‘ এই উদয় থামবি তুই ? যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যায় তোর ?’
পাশ থেকে এক আপুর কথা শুনে বুঝলাম এই কাকের বাসাটার নাম উদয় । যেমন নাম তেমন তার কন্ঠস্বর একদম কাকের স্বরের মতো। সবার দিকে নজর ঘোরালাম । একসাথে দুই আপুকে দেখা যাচ্ছে একইরকম চেহারা বুঝলাম তারা জমজ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তাদের মধ্যকার তফাত খুঁজে বের করলাম । এক আপুর ঠোঁটের কোণে ছোট একটা তিল যা অন্য আপুটার নেই । মোট দশজন শিক্ষার্থী এসেছে আর দুজন শিক্ষক- শিক্ষিকা । লতিফ চাচার কথা অনুযায়ী দশজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঁচজন এখানে দশদিন থাকবে আর বাকিরা আজ সন্ধ্যায় চলে যাবে ।
লতিফ চাচা একজনের হাত ধরে সামনে নিয়ে আসলো যে কিনা পেছনে আমাদের দিকে পিঠ করে বসেছিল
‘ বকুল , এই আমার ভাতিজা সানিম ইয়াসার।জানতোনা এখানে তার এই চাচা আছে । আর ঐ যে সানিমের মা সুরভি ভাবি । আর এরা হচ্ছে সানিমের বন্ধু ।’
‘ বাকি পরিচয় আমি দেই জেঠু ? ‘
‘ হাই মিস , আমি সানিম । আর এরা হলো আমার বন্ধু উদয় , রাফি , বিনা , মিরা । আমরা পাঁচজন বেস্ট ফ্রেন্ড । আর বাকিরা রাহাত ,দিশা , তানিশা , আমার ডিপার্টমেন্টেরই । মিরা বিনাকে দেখেই বুঝে গেছো ওরা জমজ । দশদিন আছি আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কে আরো জানতে পারবে । কি বলিস তোরা ? ‘
সকলের পানে তাকিয়ে দেখি অবাক চোখে সুদর্শন পুরুষটির পানে তাকিয়ে আছে । থতমত খেয়ে সানিম সবার উদ্দেশ্যে বললো
‘ রিলেক্স গাইস , এটা স্বাভাবিক । আমি পরিচয় দিচ্ছি মাত্র ।’
এটুকু বলেই ওয়েলকাম ড্রিংক হাতে নিয়ে চলে গেলেন পুলের অপরপ্রান্তে ।
লতিফ চাচার ভাবি সুরভি কাছে এসে হাত ধরে বললেন
‘ বকুল , খুব মিষ্টি নাম তো তোমার । কিসে পড়ো ? ‘
‘ জ্বি এবার এইচএসসি দিয়েছি । ‘
‘ বাহ্ ! খুব ভালো । আর পড়াশোনা করবেনা ? পরবর্তীতে কোথায় ভর্তি হবার ইচ্ছে আছে ?’
‘ পড়াশোনা করার অনেক ইচ্ছে আছে কিন্তু পারবো কি না জানিনা । দোয়া করবেন ম্যাডাম আমার জন্য।’
‘ অবশ্যই দোয়া করি । ‘
এইবলে নাস্তা করতে চলে খেলেন সুরভি ম্যাডাম।
মানুষটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে । অনেক সুন্দর করে কথা বলে । ধনী গরিব কোন কিছুর বিবেচনা করেনা ।
বিনা মিরা আপু এগিয়ে এসে হাত ধরে তাদের পাশে বসালেন আর এটাসেটা প্রশ্ন করছেন আর আমি চুপচাপ উওর দিচ্ছি । কথার মাঝে হঠাৎ ই বিনা আপু জিজ্ঞেস করলেন আমার পরিবারের কথা । মুহূর্তেই কালো আধার নেমে আসলো চেহারায় । এতক্ষণ হাসি মজার স্থলে ভুলে গিয়েছিলাম পালিত মার কথা ।
সকালে আসার আগে বলে দিয়েছে বাজার করে নিয়ে যেতে আর তার খরচ আমার থেকেই দিতে হবে । মার একটাই কথা বাসায় কাজ না করলে তার পারিশ্রমিক হিসেবে বাজার করে নিতে হবে ।
বিনা মিরা আপুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রবিন ভাইয়ের কাছে চলে আসলাম দুপুরের মেন্যু জানার জন্য ।
যেহেতু তারা শহরের । তাই রবিন ভাই শহরেরই খাবার রান্না করলেন । আমরা হাতে হাতে সাহায্য করেছি মাত্র কারন শহরের এসব খাবার রান্না করতে আমরা পটু নই।
দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় বাঁধলো আরেক ঝামেলা । সবার কথা তাদের সাথে একসাথে বসে খাবার খেতে হবে আমাদের । অগত্য আরো চেয়ারের ব্যবস্থা করে বসে পড়লাম আমরা ।
আমি বাঙালি খাবার খুব পছন্দ করি এসব শহরের খাবারে ফ্রাইড রাইস, চিকেন চিলি , কালা ভুনা অভ্যস্ত নই তাই একটু সমস্যা হচ্ছে ।
সবাই অনেক হাসি মজা করে খাবার খাচ্ছে । এক এক করে সবার দিকে তাকাচ্ছি । সুদর্শন পুরুষের দিকে চোখ পড়তেই উনি চোখ নামিয়ে নিলেন যেন এতোক্ষন আমার পানেই তাকিয়ে ছিলেন । আমার তাকানোতে হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে গেছে তাই অস্বস্তি কাটানোর জন্য চিকেন আগিয়ে দিতে বললো । পাশ থেকে রাফি ভাই বলে উঠল ,
‘ সামিন , তুই চিকেন খাওয়া শুরু করলি কবে থেকে ? ‘
সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামিনের পানে । তখন পাশ থেকে উদয় ভাইয়া ম্যাডামের উদ্দেশ্যে বললেন ,
‘ আন্টি এটা ঠিক না সামিন চিকেন খাওয়া শুরু করেছে আর আপনি আমাদের বললেন না । বললে মসজিদে টাকা দিয়ে আসতাম । সামিন চিকেন খাচ্ছে বলে কথা ! ‘
পাশ থেকে সামিন উদয় ভাইয়ার মাথায় চাটি মেরে বললেন ,
‘ ধুর , তোরা একটা স্বাভাবিক বিষয়কে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলি । আমিতো কালা ভুনা দিতে বলেছিলাম আর তোরা কি মনে করলি তাইনা বকুলফুল ? ‘
‘ বকুলফুউউউউউল ‘
সকলে একসাথে টেনে আমার নাম বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । এদিকে আমি কিছু না বুঝে অবুঝের মতো সবার পানে তাকিয়ে আছি । পাশ থেকে ম্যাডাম সেই কখন উঠে চলে গেছে।
এসব হাসি আড্ডায় খাওয়ার পর্ব শেষ হলো ।
বাহিরে আকাশ মেঘলায় ঢাকা । মধ্যাহ্নভোজের পর মুহূর্ত মনে হচ্ছে না । সকলে মিলে ক্যারাম খেলার বায়না ধরলো যেহেতু বাদলা দিন বাহিরে বের হওয়া সম্ভব না তাই ক্যারাম খেলার আয়োজন ।
ক্যারাম বোর্ড রাখা হয়েছে রিসোর্টের স্টোর রুমে । সবাইকে রেখে ক্যারামবোর্ড আনতে চলে গেলাম । স্টোর রুমের দরজা খুলে ক্যারামবোর্ড খোঁজা শুরু করেছি ঠিক এমন সময় স্টোররুমের দরজা লাগানোর আওয়াজে চমকে গেলাম । পেছনে ফিরে যাকে দেখলাম তাকে দেখে আমার হুস উড়ে গেলো ।
চলবে ……