#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি
||১৩||
চাঁদনি রাত , চাঁদের আলোতে চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে । ছাঁদের ঠিক মাঝ বরাবর মাদুর পেতে শুয়ে আছি আমরা । বালিশ নেই বিধায় সানিম ভাইয়ার হাতের উপর শুয়ে আছি । মাথার উপর বিশাল গোলাকার চাঁদ আলো দিচ্ছে আর তাঁর আশেপাশে ছোট ছোট মেঘেরা খেলা করছে । কিছুক্ষণ আগে আমার বর খুবই আশ্চর্যিত হয়েছিলেন আমার কথা শুনে । আমার একটা কথাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলেছেন সাথে সাথেই । সত্যিই মানুষটা আস্ত পাগল ।
চুপচাপ শুয়ে শতশত তাঁরা গোনার বৃথা চেষ্টা করছি । আমার যে দরকারি কথা বলার আছে আমার স্বামীকে তা ভুলেই গিয়েছি । নিরবতা ভেঙে সানিম ভাইয়া জিজ্ঞেস করল ,
‘ বকুলফুল , আমাকে কিছু কথা বলবে বলেছিলে আজ বলবে নাকি অন্যদিন বলবে ?’
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে মনে পড়ে গেল আমার দরকারি কথার ব্যপারটা তাই শোয়া থেকে চটজলদি উঠে আসন পেতে বসে পড়লাম উনার পাশে । আমাকে এভাবে উঠতে দেখে সানিম ভাইয়া বিরক্তবোধ হলেন তা তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলা শুরু করলাম ,
‘ আজ আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই । ‘
‘ হ্যাঁ বলো , আমি সবসময় তোমার কথা শুনতে প্রস্তুত ।’
‘ আমাদের বিয়ে যেই পরিস্হিতে হোক না কেন এটা চিরন্তন সত্য যে আপনি আমার স্বামী আর আমি আপনার স্ত্রী । আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি । আমার অতীত আপনি জানেন মা-বাবাহীন বড় হয়েছি । অবহেলা লাঞ্ছিত হয়েছি সবসময় কিন্তু এসবের মাঝে একটা কথা হল আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই । আমার স্বপ্ন পূরন করতে চাই । ভবিষ্যতের জন্য আপনার সাপোর্ট চাই । আরো আট দশটা মেয়েদের মত মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই । থাকবেন তো আমার পাশে ?’
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে সানিম ভাইয়ার পানে তাকালাম । খুব মনোযোগ সহকারে আমার কথাগুলো এতক্ষণ শুনছিলেন । আচমকা শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লেন । আমার উনার হাতের ছোঁয়া পেলাম । খুব শক্ত করে হাতজোড়া ধলে বলতে শুরু করলেন ,
‘ প্রথমত , ভালোবাসি বকুলফুল । অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে । সেই প্রথম দিনে দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে । জানি না কেন কিভাবে মন দিয়ে দিয়েছি তোমাকে শুধু এতটুকু জানি তুমিহীনা আমি অচল । যেদিন তোমাকে তিন কবুল বলে বিয়ে করেছি ঠিক সেদিন থেকেই তোমার সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছি । তুমি জানো না , তোমাকে আমাদের ভার্সিটিতে ভর্তির সব ব্যবস্থা করে রেখেছি । আমাকি কিছুদিন সময় দাও পরীক্ষা শেষ হলে সব ঠিক করে দেবো । ততদিনে তোমার বাবাও সুস্থ হয়ে যাবে ।’
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসলো । হঠাৎ কী হলো জানিনা খুব জোরে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আর উনি আলতো করে পিঠে হাত রেখে শ্বান্তনা দিচ্ছেন আমায়। সারারাত চন্দ্রবিলাস করে কাঁটলো আমাদের সেদিনের রাত ।
দেখতে দেখতে সানিম ভাইয়ার পরীক্ষা শেষ হয়ে আসলো । আমি সারাদিন আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মানে মা- বাবার সাথে হাসি মজা করে সময় পাড় করি । সোফার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি সবাই । গরম গরম পুরি আর সাথে সালাদ পরিবেশন করছেন নায়ক চাচা । আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে বিয়ে । সামনের সপ্তাহে বিয়ে । সকল নিয়ম কানুন মেনে চলে আবার বিয়ে হবে আমাদের আর এখন বিয়ের শপিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে । সানিম ভাইয়ার চার বন্ধু বিয়ের সমস্তকিছুর দায়িত্ব নিলেন । দূরের নিকটবর্তী সব আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে । সকলের মধ্যে মনিমার কথা ভুলিনি আমি তাই চট করে বলে ফেললাম , ‘ মনিমাকে বলা হয়েছে বাবা ?’
বাবা অবাক হয়ে আমার পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ,
‘ তুই সানিমের মনিমাকে চিনিস ?’
আমি আমার মাথাটা উপর নিচে করলাম যার অর্থ হ্যাঁ চিনি । তখন বাবা পুনরায় আবার প্রশ্ন করলেন , কিভাবে ? প্রত্যুওরে আমি সেদিনের সমস্ত কথা বাবাকে জানালাম । বাবা শুনে খুব খুশি হলেন । আর ফোন করে মনিমাকে আসতে বললেন ।
রাতে নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছি ঠিক এসময়ে দরজা লাগানোর আওয়াজে ফিরে তাকালাম । সানিম ভাইয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার পানে। উনার চাহুনি আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে । লজ্জায় মাথা নত করে ফেললাম কারন তার চোখে তাকিয়ে থাকা মানে আমার জন্য সর্বনাশ । আস্তে আস্তে আমার পাশে এসে বসলেন । কোমল কন্ঠে ডাক দিলেন ,
‘ বকুলফুল ।’
‘ হুম ‘
‘আজ আমি এখানে থাকি ? ‘
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে বোকা বনে গেলাম । কি বলে এই লোক ? আর এখন কি উওরই বা দেবো আমি । পাশে বসা মানুষটি বসে আছেন আমার স্বামী উনার অধিকার আছে আমার কাছে আসার। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে আসবে তা মানতে কষ্ট হচ্ছে। সানিম ভাইয়ার কথায় ধ্যান ফিরে আমার
‘ কি হলো বকলফুল? আমি থাকবো না চলে যাবো ‘
হালকা নিশ্বাস ফেলে বললাম,
‘থাকুন। আপনার বাড়ি এটা যেখানে ইচ্ছে সেখানেই থাকতে পারেন। সমস্যা নেই। ‘ আমার কথার মাঝে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ রয়েছে তা বুঝেও সানিম ভাইয়া ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন। সানিম ভাইয়া আমার খুব নিকটে চলে আসলেন । আজ যেন উনি নিজের মধ্যে নেই এমন ব্যবহার করছেন আমার সাথে। চোখ বন্ধ করে শুধু চোখের পানি ফেলছি আর আমার স্বামী নামক মানুষটা , উনি উনার কাজে ব্যস্ত । আজকের পর থেকে আপন বলতে আর কেউ রইলো না আমার । স্বামী নামক মানুষটার উপর থেকে বিশ্বাস চলে গিয়েছে আজ।
_____________________________________
একঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল আমি শাওয়ার নিচ্ছি। দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। সানিম ভাইয়া ঘুম থেকে উঠেছেন অনেক আগেই । উঠেই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন আর একটু পর পর সরি বলছেন । আরো বিশ মিনিট সময় নিয়ে গোসলখানা থেকে বের হলাম । কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি । বিছানার উপর আগের মতোই বসে আছেন উনি । আমার পানে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলতে শুরু করলেন,
‘ আ’ম সরি বকুলফুল । জানিনা কাল কিভাবে কি থেকে কি হয়ে গেল । আমি তো এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে ছিলাম কাল । সেখান থেকে কিভাবে কি হল কিছুই বুঝতে পারছিনা । আমা’ ,,,,
হাত দিয়ে ইশারা করে স্বামী নামক মানুষটিকে চুপ করতে বললাম । কিছুটা এগিয়ে এসে বললাম,
‘ আমি কিছু মনে করিনি । আপনি আমার স্বামী যা ইচ্ছে করতে পারেন আমার সাথে । কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না কালকের জন্য । খুব কষ্ট পেয়েছি আমি খুব ।’
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না চলে আসলাম কামড়া থেকে ।
নিচে আসতেই চির চেনা মানুষদের কন্ঠস্বর কানে আসলো । সোফার রুমে বসে আছে আমার পালিত মা-বাবা , নাঈম ভাইয়া আর নাঈমা । সকলেই হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন আমার পানে । আকীবা মা এসে জড়িয়ে ধরে বিলাপ শুরু করলেন ,
‘ বকুল রে , আমার মা , আমার কলিজার টুকরা । কতদিন হয় তোকে দেখিনা ! মা রে , তোরে ছাড়া আমার বাড়িটা একদম শূন্য । ‘ এতটুকু বলে মা থেমে গেলেন । কিন্তু , কি ভেবে মাথায় হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন ,
‘ কিরে বকুল , এতসকালে গোসল নিলি যে ? ‘
মার প্রশ্নে খানিকটা তুতলিয়ে উওর দিলাম ,
‘ না মা এমনি গরম করছিল তাই আর কি ‘
মা হয়তো আমার কথায় বিশ্বাস করেনি তাই প্রশ্নবোধক চাহুনিতে তাকিয়ে রইলেন ।
মার থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকালাম ।
এত বছর পর বাবাকে স্বাভাবিক দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না দৌড়ে চলে গেলাম বাবার কাছে।
‘ কেমন আছিস মা ?’
বছর দুয়েক পর বাবার মুখে কথা শুনে খুশিতে কান্না করছি । খেয়াল করে দেখি বাবা হুইলচেয়ারে বসে। পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে আছেন বাবা । আর এসব কিছ সম্ভব হয়েছে সানিম ভাইয়ার জন্য । মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ জানালাম উনাকে । বাবাকে প্রশ্ন করলাম ,
‘তোমরা হঠাৎ এভাবে এখানে ?’
‘ তোর বিয়ের সময় আমরা কেউ উপস্থিত ছিলাম না তাই চলে আসলাম মেয়ের বিয়ে দেবো বলে ।’
পাশ থেকে আমার শ্বশুর মুখ ফুলিয়ে বলতে শুরু করলেন,
‘এখনত আমাকে কেউ চিনেই না নিজের বাবাকে পেয়ে । ‘
শ্বশুরের কথা শুনে দৌড়ে উনাকেও জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলাম,
‘ তুমি তো আমার নতুন বাবা । এখনতো তোমার কাছেই সবসময় থাকবো ।’
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘ পাগলি ‘
হয়েছে হয়েছে বাবা মায়েদের কান্না কাটি থামিয়ে এবার সবাই নাস্তা করতে আসুন । শ্বাশুড়ি মার কথায় চলে গেলাম উনাকে সাহায্য করতে
সবাই মিলে নাস্তা করছি এমনসময় বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো
নায়ক চাচা সদর দরজা খুলে বললেন ,
আপনি ?
চলবে …
#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি
||১৪||
‘ আরে দিশা তুমি ? ‘
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে সকলে সদর দরজার দিকে তাকালাম । নায়ক চাচা সদর দরজা থেকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন ভেতরে আসার জন্য । শার্ট আর জিন্স পরিহিত মেয়েটিকে দেখে চিনতে অসুবিধা হয়নি আমার । ইনি সহ আরো কয়েকজনই সানিম ভাইয়াদের সাথে রিসোর্টে গিয়েছিলেন। মেয়েটির হঠাৎ আগমনে ভ্রু কুঁচকে আসলো আমার । সানিম ভাইয়া সিড়িদিয়ে নেমে সোজা মেয়েটির কাছে চলে গেলেন । আর মেয়েটি দৌড়ে এসে সোজা সানিম ভাইয়াকে জাপটে ধরে বলা শুরু করল ,
‘ ও সানিম , কেমন আছো ? উফ কতদিন পর তোমাকে দেখতে পেলাম । তুমি জানো , সেই পিকনিক হতে আসার পর থেকে ছটফট করছি তোমাকে দেখার জন্য মাঝে পরীক্ষার জন্যও তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি ফাইনালি আজ তোমাকে পেলাম । কি যে ভালো লাগছে তোমাকে দেখে বলে বোঝাতে পারব না । ‘
খাবারের টেবিলের উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের পানে । শ্বশুর বাবা এঅবস্হা দেখে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন ,
‘ এখানে এসব কি হচ্ছে ? সানিম মেয়েটা কে ? আগে কখনও দেখিনি তো ? ‘
পাশ থেকে শ্বাশুড়ি আম্মু বলে উঠলেন ,
‘ মেয়েটির নাম দিশা । সানিমের সাথেই পড়াশোনা করে । একদম চিপকু টাইপের । ভার্সিটিতেও আমাকে অনেকবার পটাতে চেয়েছিল সানিমের মা হিসেবে কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি । আজ কিভাবে কোথা থেকে উদয় হলো বুঝলাম না ।’
মার কথা শুনে অশ্রুশিক্ত নয়নে সামনে তাকালাম ততক্ষনে দিশা নামক মেয়েটিও সানিম ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়েছে । আর সানিম ভাইয়া অসহায় হয়ে আমার পানে তাকিয়ে আছেন । দিশার পেছনে রাহাত নামের ঐ শয়তান ছেলেটাকেও দেখতে পেলাম । ভয়ে শ্বাশুড়ি আম্মুর হাতশক্ত করে ধরলাম । হাতে পায়ে এখনও জখমের আঘাত বিদ্যমান রাহাতের । সানিম ভাই রাহাতকে দেখে আবার আঘাত করতে গেলেন সেইসময়ে উদয় রাফি ভাইয়া ফিরিয়ে নিলেন ।
দিশা নামের মেয়েটা ন্যাকা কান্না করে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন ,
‘ রাহাতের হয়ে সকলের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি । সেদিনের পর থেকে রাহাতের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে এখন সে কাউকে চিনেনা । এমনকি জেলখানায় যখন ওর সাথে দেখা করতে যেতাম তখন আমাদের দেখে সবসময় চুপচাপ থাকতো । তাই অনেক কষ্টে তাকে ছাড়িয়ে আনি সকলের কাছে ক্ষমা চাইতে । ‘ দিশা কয়েক কদম সামনে এসে আমার হাত ধরে অনুনয়ের সহিত বলা শুরু করল ,
‘ রাহাত আগে খারাপ ছিল এখন সে তার কর্মের ফল পেয়েছে ক্ষমা করে দাও বকুল । ‘ দিশা মেয়েটার কথা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার কেননা রাহাতের চোখে আমি অসহায়ত্ব দেখতে পাচ্ছি না কেমন যেন হিংস্রতা দেখতে পাচ্ছি ।
‘ ক্ষমা করার আমি কেউ না উনি উনার করা কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছেন তাই অনেক । ‘ দিশা মেয়েটা আবারও আমার হাত ধরে বলল ,
‘ তুমি খুব ভালো বকুল দোয়া করি ভালো মনের মানুষ পাও ।’
‘ তোর আর এই দোয়া করতে হবেনা । বকুল তার মনের মতন জীবনসঙ্গীই পেয়েছে ।’
বিনা আপুর এহেন কথায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন দিশা ,
‘ মানে ?’
বিনা আপু খানিকটা এগিয়ে এসে আমার হাত সানিম ভাইয়ার হাতে রেখে বললেন যে ,
‘ মানে হলো বকুল এখন সানিমের কলেমা পড়া বউ। আর সামনের সপ্তাহে তাঁদের রিসেপশন ।’
বিনা আপুর কথায় দিশা কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বললেন ,
‘তাহলে তো ভালোই বন্ধুর বিয়েতে আনন্দ করে তারপর যাবো কি বলো তোমরা ।’
দিশার এহেন কথায় আকীবা মা ফটকরে বলে উঠলেন ,
‘ অবশ্যই মা এটা তোমার বাড়ি মনে করেই থাকতে পারো কি বলেন বেয়াইন সাহেব ।’
আকীবা মায়ের কথায় শ্বাশুড়ি আম্মু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ,
‘ হ্যাঁ ওরা তো সানিমের বন্ধু । বিয়েতে আমন্ত্রিত তারাই।’
এমন হাজারো কথোপকথনের মধ্যে অতিবাহিত হলো এক প্রহর । এবাড়িতে উপরে আপাতত মিরা বিনা আর দিশা আপু এক কক্ষে তো অন্য কক্ষে উদয় রাফি রাহাত ভাইয়া থাকবে । আমার রুমে আকীবা মা বাবা থাকবে নাঈমার জন্য আলাদা কক্ষ আর নাঈম ভাইয়া উনার মেসে থাকবে ।
সানিম ভাইয়ার কক্ষে আমি আর সে । আমার সমস্ত জিনিসপত্র উপরে আসার আগেই নায়ক চাচা সার্ভেন্টদের দিয়ে আনিয়ে রেখেছেন ।
সানিম ভাইয়ার কামরায় বিশ্রাম নিচ্ছি আর ভাবছি কালকের রাতের কথা । কাল আমি এক অন্য সানিমকে আবিষ্কার করেছি । কাল যেন সে তার মধ্যেই ছিলোনা । চোখগুলো অনেক লাল ছিল একদম হিংস্র দেখাচ্ছিল মনে হচ্ছিল কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে । আর সবচেয়ে অবাক হয়েছি তখন যখন সানিম ভাইয়া বললো যে সে তার মধ্যে ছিলনা বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে ছিল । কিছু একটা ভেবে ফোন হাতে নিয়ে মিরা আপুকে একটা মেসেজ করে দিলাম । আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয় তাহলে তো হলোই । ফোন আবার যথাস্থানে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ পেলাম । আমি জানি আগমনকৃত ব্যাক্তিটা কে ! আস্তে আস্তে মানুষটা আমার পাশে শুয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন । খানিকক্ষণ পর মানুষটার কাঁপুনিতে তার পাশে ফিরলাম । একি আমার সুদর্শন পুরুষটার হাসি উজ্জ্বল মুখখানা একেবারে লাল টমেটো হয়ে আছে কেন ? সেকি কান্না করেছে এতক্ষণ ? শান্ত কন্ঠস্বরে তাকে প্রশ্ন করলাম ,
‘ কি হয়েছে আপনার , চোখ মুখের এ অবস্হা কেন ?’
‘ বকুলফুল , আমাকে ক্ষমা করে দাও । কাল সত্যি কিভাবে তোমার কাছে গিয়েছিলাম তা আমার মনে নেই । ‘
‘আমি আপনার উপর রেগে নেই কিন্তু কোথাও একটা কষ্ট কাজ করছে কালকের ব্যপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । ‘
আমার এহেনকথায় সানিম ভাইয়া চুপ করে রইলেন হয়তো কোন উওর নেই তার কাছে । এতদিন যে সব বিপদ থেকে আগলে রেখেছে সে কিভাবে এমন কাজ করলো তা সত্যিই ভাবাচ্ছে আমাকে । জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ই সানিম ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আর আমিও আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম ।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকেল প্রায় । বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে তড়িঘড়ি নেমে পড়লাম ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে মাথা মুছতে মুছতে সানিম ভাইয়া প্রবেশ করলেন । হা করে তাকিয়ে আছি স্বামী নামক সুদর্শন পুরুষটির পানে । ইশ কি সুন্দর আমার বরটা নজর না লাগুক । চোখের সামনে কারোর তুড়ি বাজানোর আওয়াজে হুস আসে,
‘ এই যে ম্যাডাম, আমাকে দেখা শেষ হলে ফ্রেস হয়ে আসুন । সেই সকাল থেকে না খাওয়া আমি । দয়া করে ফ্রেস হয়ে আসলে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ একসাথে করে নিতে পারি। ‘
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম ফ্রেস হতে ।
বিকেল বেলায় সবাই মিলে বাহিরে পাশের এক পার্কে ঘুরতে বের হলাম। দুই বাবা আর আমার শ্বাশুড়ি আম্মু বাসায় রয়ে গেলেন । আকীবা মা শহর দেখেন নাই তাই নাঈমাকে নিয়ে বের হয়েছেন আমার সাথে ।
মিরা রাফি ভাইয়া পাশাপাশি হাতে হাত রেখে হাঁটছেন । আর বিনা উদয় ভাইয়া দরকারি কিসব কথা বলতে বলতে চলছেন । অমাদের পেছনে দিশা রাহাত আসছেন । সামনে তাকিয়ে দেখি একটু পর পর আমারই ছোট বোন নাঈমা রাগান্বিতভাবে তাকিয়ে আছে ব্যপারটা কেমন সন্দেহ হচ্ছে ।
যথা সময়ে পার্কে পৌছে গেলাম সবাই । সানিম ভাইয়া একটানে পাশের এক লেকে নিয়ে গেলেন । অনেক দম্পতি হাঁটছে আর নিজেদের দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করছে । আর আমি , আশেপাশের সবকিছু দেখতে ব্যস্ত । সানিম ভাইয়ার কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আমার
‘বকুলফুল , কিছু খাবে ? পাশে ঝালমুড়ি বিক্রয় হচ্ছে এনে দেই ?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবারও আশেপাশে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ।
জোড়ে গাড়ির হর্ণ কানে আসাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম । আমার থেকে একশ গজ সামনে খুব দ্রুত একটি মালবাহী ট্রাক ছুটে আসছে । বুঝতে পারলাম মৃত্যু খুব সন্নিকটে তাই চোখ বন্ধ করে শেষবারের মতো সানিম ভাইয়ার চেহারা মনে করে নিলাম ।
দূর থেকে সানিম ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম উনি আমায় চিল্লিয়ে সরে যেতে বললেন ।
‘ বকুলফুল সরে যাও ‘
চলবে …