#বকুল
||১||
‘তোর মত অলক্ষী মেয়েকে এখন পর্যন্ত আমার ঘরে ঠায় দিয়েছি এটা তোর ভাগ্য । নয়তো এই আকিবা যাকে তাকে ঘরে উঠায়না । ঐ মুখপুড়ি , হে রে তোর মা কেমন মহিলা ছিল ? কোন জাত-বিজাত ছিল নাকি ! সেকালে তোর মার একটুও কি বুক কাঁপলোনা ? আমাদের এখানে এই উটকো ঝামেলা ফেরে রেখে যেতে ? অবশ্য তোরই কি বা দোষ বল ! যার বাবা সন্তান পেটে আছে তা শুনেও অন্য মহিলারে নিয়ে পারাপার হয়ে যায় তার সন্তান কেমন আর থাকবে । উহু যত্তসব ঝামেলা আমার কাঁধেই ঝুলে আছে । এই কইরে পাখি আমার পানের বাটা টা নিয়ে আয়তো ! মুখখানি একবারে পানসে হয়ে আছে ‘
অন্ধকার রুমে গুটিশুটি মেরে বসে আছি । দুহাতে মুখ চেপে ধরে কান্না সংবরণের চেষ্টা করছি । আমার কান্নার আওয়াজ বাহিরে যাওয়া মানা। আমার মত অভাগির কপালে সুখ নেই । বাহিরে যে জোড়ে জোড়ে কথা বলছে সে আমার মা । আসল মা না পালিত মা । আমার আসল মা তো আমার পাঁচ বছর বয়সে উনাদের কাছে রেখে চলে যায় । আমার পালিত মার একটি ছেলে আরেকটা মেয়ে আছে । বড় ভাইয়া নাঈম আর ছোট বোন নাঈমা আর আমি বকুল । সবেমাত্র এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি অনেক কষ্ট করে। গ্রামের সবচেয়ে বড় হোটেলের মালিক লতিফ চাচা রুপনগর গ্রামের বাজারে অনেক বড় হোটেল আছে । এছাড়াও আমাদের গ্রামে একটা রিসোর্ড আছে যার মধ্যে খাবার ডেলিভারি দেয়া হয় আর সেই খাবার আমিই রান্না করি । মেয়ে হলেও আমার অবস্থান এই বাড়িতে কাজের মেয়ের মতো । রুপনগর গ্রামের সবাই অনেক পছন্দ করে আমাকে শুধু মাত্র এই মা ছাড়া । বাবা ঘরে আছে কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই । দুবছর আগে রোড এক্সিডেন্টে পায়ের সাথে সাথে নিজের বাকশক্তিও হারিয়েছে । বাবা সুস্থ থাকাকালীন অত্যাচার হতো কিন্তু কম । বড় ভাইয়া নাইম ঢাকায় পড়াশোনা করে । খুব আদর করে আমাকে । কিন্তু ছোট বোন নাঈমা দুচোখে দেখতে পারেনা । নাঈমার জন্যও মার হাতে কম বকা খেতে হয় না আমাকে ।
আজ আর কক্ষ থেকে বের হবোনা । জানি খাবার আজ কপালে নেই তাই শুধু শুধু বের হয়ে তিক্ত কথা শুনে লাভ নেই। দুই গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম । কাল লতিফ চাচার খাবারের অর্ডার আছে অনেক। শুনলাম শহর থেকে ভার্সিটির শিক্ষা সফরে আসবে রিসোর্ডে তাই কাল সকাল সকাল সাহায্য করতে চলে যেতে হবে । আজ এই এতটুকু পর্যন্ত লতিফ চাচার জন্য আসতে পেরেছি পড়াশোনা করতে পেরেছি।
———————–
আকাশেতে উড়ছি আমি । পড়নে বাহারি রংয়ের পোষাক । অদূরে বিশাল অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে । নিচে নামতেই কেউ একজন হাতে হাত রেখে বিশাল অট্টালিকায় প্রবেশ করাচ্ছে। আশেপাশে হরেক রকমের ফুলের গাছ । পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশ । ফুলের গালিচা বিছানো রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি । যেই না অট্টালিকায় পা দিবো আর এমনিতেই সব ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে কেউ টেনে হিঁচড়ে আমার এই স্বপ্নের রাজ্য থেকে বহু দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
আচমকা পানির ছিটানোতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার । তাকিয়ে দেখি , খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানির ছিঁটে আসছে । স্বপ্নের কথা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল । ইশ কি সুন্দর স্বপ্ন ছিল । বাস্তবে যদি কেউ হাত ধরে আমার স্বপ্নের দিকে ধাবিত করতো। জানি সম্ভব না আমার মতো এই অভাগির কপালে ভালো কিছু নেই।
এখন বর্ষাকাল । আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময় । বাদলে ছেয়ে আছে আকাশ । মেঘেরা ঐ আকাশে ভেলা ভাসিয়ে খেলা করে । খেলা শেষে অধির ধারায় বর্ষণ শুরু করে পৃথিবীর বুকে।
গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হাটু পরিমান কাঁদায় মাখামাখি । আর এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে আমার রিসোর্ডে । সারারাত বৃষ্টির প্রভাব এই কাদা । এখনও আকাশ মেঘলা । দুঃখে-কষ্টে কান্না চলে আসছে ।
পাশে ফরিদা খালার কুঁড়েঘর। ফরিদা খালা বের হয়ে আফসোসের সুরে বলতে শুরু করলো ,
‘ কি রে বকুল , আজ কেমনে রাস্তা পার হবি ? ‘
‘ আজ যে আমার যেতে হবেই খালা । কি করি বলোতো ?’
‘ এক কাম কর , তোর চটিদুটো রেখে যা আমার বাড়ি। আবার আসার সময়ে নিয়ে যাবি ।’
‘ তাই করি খালা । আজ আমার অনেক তাড়া । দোয়া করো মাঝপথে যেন যমের বাড়ি না যাই ।’
আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে খালি পায়ে হাটা শুরু করে দিলাম পিচ্ছিল কাদায়যুক্ত রাস্তার উপর । সকালে মুঠোফোনে লতিফ চাচা বলেছেন সকাল সকাল চলে যেতে তাই তো বাড়ির সব কাজ সেরেই চলে আসলাম।
এঁকেবেঁকে হাঁটছি এমন সময় পেচনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ আর সাথে এক কাকের কন্ঠস্বর ,
‘ হেই ফুল লেডি , রুপনগর রিসোর্ড টা কোথায় বলোতো ? ‘
পেছনে ফিরে যেই না কিছু বলবো আর ওমনিই চিতপটাং । হু হা করে হাসির শব্দ কানে আসছে। বুঝলাম বিশাল আকৃতির গাড়ির ভেতর অনেক কাক-কোকিল আছে আর তাদের সামনে আমার ইজ্জত খুব ভালো ভাবেই শেষ হয়েছে । খুব কষ্ট করে উঠে গাড়ির কাছে আসলাম । আ’ করে কিছু বলতে যাবো তখনই এক মিষ্টি কন্ঠস্বরে মন নরম হয়ে গেল
‘ হেই মিস , আপনি ঠিক আছেনতো ? আসলে আমরা রিসোর্ডের রাস্তাটা চিনিনা দয়াকরে বললে উপকৃত হতাম ।’
একজন পুরুষ মানুষের কন্ঠস্বর এতমিষ্টি কি করে হতে পারে ? না দেখেই আনমনে রিসোর্ড যাওয়ার রাস্তা বলে দিলাম
‘ সামনে গিয়ে বামে মোড় নিবেন ।’
‘ ধন্যবাদ মিস। আপনিও পরিষ্কার করে নিবেন । যা অবস্থা আপনার। পেত্নীর থেকে কম লাগছেনা । ‘
কথাগুলো বলার সাথে সাথেই আবার গাড়ি থেকে ঝি ঝি পোকার আওয়াজে হাসির রোল পড়েছে । মুহূর্তেই ভালোলাগার উপর পাটি চাঁপা দিয়ে হন হন করে সামনে আগাতে নিলাম আর এমনিই ঠাস , মানে পড়ে গেছি ।
গাড়ির ভেতর থেকে কেউ ছেলেদের গলায় পেঁচানো এক রুমাল আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলে উঠলো ,
‘ মিস , শরীর ঢেকে নিন । জানেন না ! লজ্জা ইমানের অঙ্গ ‘
কথাটা শুনে সত্যিই খুব লজ্জা পেলাম । কাদায় দু দুবার পড়ে যাওয়ার কারনে সারা শরীরে কাদায় মাখামাখি অবস্থা । রুমাল দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় তা ঢেকে রওনা হলাম রিসোর্ডের উদ্দেশ্যে ।
রিসোর্ডে প্রবেশ করেই লতিফ চাচার সামনে পড়লাম। আমার এই অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বলা শুরু করলো ,
‘ হ্যাঁ রে বকুল , একি অবস্থা তোর ? সারারাস্তায় পরতে পরতে এসেছিস নাকি ? ‘
‘ আমার কি দোষ বলো চাচা । রাস্তায় যে কোমড় পরিমাণ কাদা আসার সময় পিছলে খেয়ে পড়ে গেছি। এখন বেশি কথা না বলে আরিফাকে বলো এক সেট কাপড় দিতে । ‘
‘ আচ্ছা দিচ্ছি । আর শোন , ছাত্র- ছাত্রীরা সবাই চলে এসেছে । কাপড় পাল্টে হালকা নাস্তার ব্যাবস্থা করে দিস কেমন ?’
‘ আচ্ছা চাচা চিন্তা করোনা ।’
লতিফ চাচাকে দেখে কেউ বলবেনা যে সে এত বড়মাপের কেউ । খুব সাধারণ ভাবে চলাফেরা করেন উনি ।
আরিফার থেকে এক সেট থ্রি পিস নিয়ে কাপড় পাল্টে ফেললাম আমি । চলে গেলাম রান্নার জন্য । রিসোর্ডের রান্নার জন্য আমার সাথে আরো দুইজন আছেন । আরিফা আর রবিন ভাইয়া । আরিফা আমার সমবয়সী কিন্তু রবিনভাই অনেক বড় । খুব ভালো রান্না জানেন রবিনভাই । শুনেছি ঢাকায় বড় এক রেস্টুরেন্টের সেফ ছিলেন উনি । বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে চলে আসেন রুপনগরে আর এখন এখানে রান্না করেন।
‘ বকুল , নাস্তায় কি কি দিচ্ছিস আজ ? ‘
রবিনভাই শরবত বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করলেন
‘ ভাবছি সকালে হাল্কা পাতলা নাস্তা দেই । তুমি তো শরবত বানালে আমি বরং পাস্তা করে দেই । তারপর হাল্কা ফল-ফ্রুট ।’
‘ বেশ হবে । এই আরিফা চুলায় গরম পানি বসিয়ে দে আমি আসছি ‘
রবিনভাই আরিফাকে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন। আর এদিকে আমি ভাবছি সকালের দেখা স্বপ্নের কথা । ইশ কি সুন্দর স্বপ্ন ছিল । যদি সত্যি হতো আমার জীবনেও কেউ আসতো ।
‘ ভেতরে কেউ আছেন ? আসলে একটা সাহায্য লাগতো । ‘
হঠাৎ কিছুক্ষণ আগের শোনা কন্ঠস্বর কানে আসতেই চমকে গেলাম । সামনে তাকিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি ।
চলবে ……
-আফসানা মিমি