ফুটপাতের মন্দবাসা- ১

0
719

চুমকির চিকন একটা শরীর। লম্বা লম্বা হাত পায়ে মাংস নেই বললেই চলে। কিন্তু, চিকন চুমকির পেটটা উঁচু হয়ে আছে! ৭ মাস চলছে ওর, দিনদিন পেটটা বেঢপ আকৃতির হচ্ছে।

এই চিকন শরীরে এই উঁচু পেট বেমানান লাগে। তারচেয়ে বড় কথা, এতটুকুন শরীর এই পেটের ভার সইতে পারে না। কিন্তু চুমকি সয়ে যায়। শুধু কি সয়? এই উঁচু পেট নিয়ে কতো কাজ করে রোজ!

চুমকির স্বামীর নাম রকি। ৩ বছর আগের কথা, কোনো এক ফেব্রুয়ারির দিনে নায়কের মতো আবির্ভাব হয়েছিল সে চুমকির জীবনে। চুমকি তার ছোটবোন রুমকির সাথে বাজারে এসেছিল। রুমকি হঠাৎ বায়না ধরল পিয়াজু খাবে। সে বায়না মেটাতে ফুটপাতের ভাজাপোড়া দোকানটায় গেলো ওরা। সেই দোকানেই কাজ করতো রকি। সেখানেই কি যে হলো চোখে চোখে!

ঐ যে, একটা গান আছে না, চোখ যে মনের কথা বলে? অমনই কথা হয়েছিল ওদের। চোখে চোখে কথা হলো, কিছুদিন প্রেম চলল। তারপর ওরা গাঁটছড়া বাঁধল। রকি নিজেই একটা ভাজাপোড়ার দোকান দিলো রেলগেটের পাশে। চুমকি হলো সে দোকানের সহকারী। চুমকি একটু পড়াশোনা করেছিল কিনা, তাই ও হলো ম্যানেজার! চুমকি খাবার দেয় কাস্টমারদের, প্লেট ধুয়ে রাখে, টিস্যু পেপার দেয়, পানির বোতল দেয় আর হিসেব করে টাকা বুঝে নেয়।

আর রকি? সে একের পর এক পিয়াজু ভাজতে থাকে, বেগুনি ভাজতে থাকে, জারকা, সিঙ্গারা, আলুর চাপ ভাজতে থাকে। গরম উত্তপ্ত তেলে চলতে থাকে ওদের সংসার। এদিকে চুমকির পেট বড় হতে থাকে। চিকন শরীরের মেয়েটার পেট জানান দেয়, তাঁদের ভালোবাসার পূর্ণতা আসতে যাচ্ছে।

রাতে ঘুমানোর আগে চুমকির পেটে আলতো করে হাত রাখে রকি। রকির খুব ইচ্ছে, একটা মেয়ে বাচ্চা হোক।

‘আমগো একটা মাইয়া হইবো। আমি নাম ঠিক কইরা রাখছি। ‘

রকির কথায় চুমকি হাসে। বলে, ‘কি নাম রাখছো হুনি?

রকির মাইয়ার নাম হইব রুমঝুম। ওরে আমি নুপুর কিইনা দিমু, ও নাইচা নাইচা বেড়াইব।’ বলতে বলতে হাসে রকি। রকির চোখে আনন্দ দেখা যায়। সে আনন্দ নিখাঁদ, কোনো কৃত্রিমতা নেই সেখানে।

‘আর যদি পোলা হয়? তহন কি করবা হুনি?’ চুমকির একটা ছেলের শখ। সেকথাই জানান দেয় যেন।

‘কি করমু আবার? খুশি হমু। আমগো ছৈইল হইব। এইডাই হইলো খুশির কথা। পোলা হইল না মাইয়া হইল তাতে কিছু যায় আহে না।’ বলে রকি।

‘পোলা হইলে কি নাম রাখবা তাই শুনবার চাইছি।’ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে চুমকি।

‘তোমার তো পোলার শখ। পোলার নাম তুমিই ঠিক কইরা রাইখো।’ বলে রকি হাসে।

তারপর তাঁদের মাঝে আরো গুটুর গুটুর কথা হয়। কথায় কথায় মতবিরোধ হয়, ছোট ছোট ঝগড়া হয়। আবার দুজনেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে হাসির শব্দ যেন বাইরে না যায় তাই চুমকির মুখ চেপে ধরে রকি। চুমকির তাতে আরো বেশি করে হাসি পায়। কী অদ্ভুত!

ক্লান্ত রকি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায় একসময়। ঘুম আসে না চুমকির। ঘুমিয়ে যাওয়া রকির একটা হাত আলতো করে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমকি। তারপর ভাবতে থাকে, ছেলে হলে কি নাম রাখবে সে।

৭ মাস থেকে ৮ মাস হয়ে যায়। পেট বড় হতে থাকে চুমকির। সমস্যা বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। দোকানে থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে যায় দিনদিন। দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিছুক্ষণ পরপরই বসতে হয়। পরক্ষণেই আবার দাঁড়াতে হয়। ফুটপাতের দোকানে বসে থাকার জো আছে?

একদিন রকি বলে, ‘কাল থাইকা তোমারে আর দোকানে যাওন লাগবো না। তুমি বাসায় থাইকো। আমি সব সামলামু দোকানে।’

চুমকি মুচকি হাসে। জানে, দোকান একা সামলানো কোনোমতেই সম্ভব হবে না রকির। ওকে যেতেই হবে দোকানে।

না, চুমকিকে আর দোকানে যেতে হয় না। রকি একটা ছেলে রাখে দোকানে। দিন ৩০০ করে দিতে হবে তাকে।

‘তুমি আমারে না জানাইয়া লোক নিছো কেন দোকানের?’ রেগে গিয়ে বলে চুমকি।

‘তোমার ভালামন্দ দেখতে হইব না আমার? তুমি এহন বাড়িত থাকবা। অনেক কষ্ট করছো। আর না।’ অপরাধীর কণ্ঠে বলে রকি।

‘রোজ যে ৩০০ টাকা দিতে হইব ছেলেটারে। তাইলে আমগো থাকবো কি?’ চুমকি টাকা জমাচ্ছিল রোজ। সেটা আর হবে না ভেবেই কষ্টে চোখ ভিজে আসে ওর। চুমকি জানে, ওর এই শুকনো শরীর বাচ্চা হবার সময় সইবে না। মেডিকেল যেতে হবে। টাকা পাবে কোথায় তখন!

রকি সান্ত্বনা দেয় চুমকিকে, ‘তুমি চিন্তা কইরো না তো। যতো টাকা লাগে আমি ম্যানেজ করমু। তুমি এহন বিশ্রাম নাও। সবকিছু ভালায় ভালায় হইয়া যাক।’

তারপর, চুমকি আর দোকানে যায় না। তাঁর ছোট্ট খুপরিতে বসে থাকে। রান্না করে, কাঁথা সেলাই করে। মাঝে মাঝে আনমনে ভাবে, ছেলে হলে কি নাম রাখবে তার।

আর রকি, সে দোকান করে। গরম তেলে ভাজে সিঙ্গারা, পিয়াজু, বেগুনি, আলুরচপ। ঘেমে একাকার হয়ে যায় গরমে, পরিশ্রমে। তবু তার দম ফেলার সময় হয় না। ওকে টাকা জমাতে হবে যে! চুমকির মেডিকেল খরচ জোগাতে হবে যে!

এমন-ই এক ক্লান্তিতে যখন ঘেমে একাকার হয়ে ছিলো রকি, তখনই খবর নিয়ে আসে রুমকি, চুমকির ছোটবোন। খারাপ খবর, প্রচণ্ডরকম খারাপ খবর নিয়ে আসে সে। গলা শুকিয়ে যায় রকির, গলায় যেন পাথর বাঁধা পরে। হাত থেকে পরে যায় তেলে ভাজার খুন্তি। সে কোনোরকমে শুধু জিজ্ঞেস করে, “চুমকি ঠিক আছে তো?”

__________

সরকারি মেডিকেল কলেজের বড় একটা ওয়ার্ড। চারদিকে মানুষে থৈথৈ করছে। মা ও শিশু ওয়ার্ড কিনা, প্রায় প্রতিটা সময়ই কোনো না কোনো বাচ্চা কান্না করছে।

ভাগ্য ভালো চুমকির, একটা বেড পেয়ে গেছে সে। বিছানায় আলতো হেলান দিয়ে বসেছে সে। পাশেই চেয়ারে বসে বেডে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে রকি। গতকাল ঐ যে মেডিকেল নিয়ে আসলো, তখন থেকেই হাসপাতালে সে। বাসায় ফিরেনি, দোকান খুলেনি। এমনকি খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করেনি।

গতকাল বিকেলে, হঠাৎ কি হয়েছিল কে জানে। চুমকি মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল। তারপরে কি হয়েছে চুমকির কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তার, নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পায়। রকি অবশ্য তাকে বলেছে যে সেরকম কিছুই হয়নি। আজ অথবা কাল বাড়ি ফিরে যাবে আবার।

চুমকির প্রচণ্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে রকির সাথে। কিন্তু রকির ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত সেটাও সম্ভব না। চুমকি জানে, মাথায় হাত রাখা মাত্রই রকি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করবে, ‘ ব্যথা করছে? কিছু লাগবে? কিছু বলবা? খারাপ লাগছে? কিছু খাইবা?’

যতবারই চুমকি নড়ে ওঠেছে, রকি লাগাতার এসব প্রশ্ন করেছে। চুমকি রকির কাণ্ড দেখে মুচকি হাসে। মনে মনে বলে, ‘লোকটা পাগল হই গেছে মনে হয়।’

রকির ঝিমানো ঘুম ভাঙে, কারণ ডাক্তার এসেছে। ডাক্তার চুমকির রিপোর্ট গুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন রুমকি ম্যাম?’

‘এখন একটু ভালা আছি স্যার।’ একটু নড়েচড়ে বসে চুমকি। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দেয়।

‘ভালো থাকলেই তো ভালো। আরো ভালো একটা খবর দেই। আপনার মেয়ে সন্তান হতে যাচ্ছে। এতোক্ষণ ইচ্ছে করেই জানাইনি। সরি।’

রকি, চুমকি দুজনেই খুশি হয়ে ওঠে। দুজনের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।

আবার ডাক্তার বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা, শরীরের এতো অযত্ন নিয়েছেন কেনো বলুন তো? শরীরে কিছুই নেই আপনার। ভালো মন্দ পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এখন। বুঝেছেন?’

‘ছোটবেলা থাইকায় আমার খাওয়ার রুচি কম, স্যার। খাইতে মন চায় না।’

‘মন না চাইলেও খেতে হবে এখন। বাচ্চার জন্য খেতেই হবে। এখন থেকে ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার খাবেন বেশি করে।’

‘আইচ্ছা স্যার।’ বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে চুমকি, প্রচুর ফলমূল, মাছ মাংস খাবে এখন থেকে।

ডাক্তার এবার রকির দিকে ফিরেন। ‘আপনি একটু আমার সাথে আসুন। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, নিয়ে আসবেন।’

ডাক্তারের পিছু পিছু চেম্বারে ঢুকে রকি। ডাক্তার সোজা গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসেন। তারপর রকিকেও বসতে বলেন। রকি বুঝে, ওষুধ লিখে দেয়ার জন্য তাঁকে ডাকা হয়নি। ডাক্তার কিছু বলবেন। যা বলবেন, তা চুমকিকে জানাতে চাচ্ছেন না। সেকারণেই তাকে এখানে ডেকেছেন।

‘আপনার স্ত্রীর বয়স কতো?’ কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।

অপরাধী কণ্ঠে রকি উত্তর দেয়, ‘১৭ বছর হবে স্যার।’

‘১৭! আমার তো মনে হয় বয়স আরো কম হবে। যা হোক, আপনার স্ত্রী খুবই রোগা। শরীরে পুষ্টির ঘাটতি আছে। সেকারণেই গতকাল মাথা ঘুরে পড়ে গেছে সে। আপনাদের ভাগ্য ভালো, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও সেরকম ক্ষতি হয়নি বাচ্চার। কিন্তু!’ বলেই থামেন ডাক্তার।

‘কিন্তু কি স্যার?’

‘আপনার স্ত্রীর শরীরে যথেষ্ট বাজেভাবে আঘাত পেয়েছে। তাকে যথেষ্ট পরিমাণে যত্ন নিতে হবে এখন। পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। নয়তো, বাচ্চা হবার সময় আপনাকে আমার এভাবে বলতে হতে পারে, ‘ মাকে বাচাতে চান নাকি বাচ্চাকে?’ বলে থামেন ডাক্তার।

রকির কথাগুলো বিশ্বাস হয় না। এরকম ঘটনা দেখেছিল সে সিনেমায়। তার সাথেও এমন কিছু হতে পারে কল্পনাও করেনি সে।

‘আপনি আপনার স্ত্রীকে আজ নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু, আবার বলছি, ওকে যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। আর যেসব ওষুধ দিচ্ছি, সেগুলো একদম নিয়মমতো খাওয়াবেন।’ বলে কিছু ওষুধ লিখে দেন ডাক্তার।

‘আরো ভালো ভালো ওষুধ লেইখা দেন স্যার। আমার বউ আর বাচ্চা দুইজনেই যেন ভালা থাকে। কুনু সমস্যা যেন না হয়।’ রকির মনে ভয় ঢুকে গেছে। রকি সে ভয় কাটাতে পারে না।

‘কি সব পাগলের মতো কথা বলছেন? যা প্রয়োজন তাই লিখে দিয়েছি। আর যেসব বললাম সব পালন করবেন।’ বলেন ডাক্তার।

‘আচ্ছা স্যার, আমি তাই করমু।’ রকি উত্তর দেয়।

‘আপনার হাতে মাত্র ১ মাস আছে। আর হ্যাঁ, ব্যথা উঠলেই সোজা মেডিকেল চলে আসবেন। একদম দেরি করবেন না।’

‘আইচ্ছা স্যার।’

আর হ্যাঁ, একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, ‘একটু এদিক ওদিক হলেই হয়তো কেউ একজনকে হারিয়ে ফেলবেন। খুব যত্নে রাখতে হবে এখন, খুব যত্নে।’

রকি আর ডাক্তারের কথার জবাব দেয় না। ওর মাথা ভার হয়ে ওঠে। কি হবে ভেবে কূল হারায় যেন।

চুমকির সামনে যেতেই চুমকি হেসে ওঠে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়, ‘কি কইলো ডাক্তার?’

রকি স্বাভাবিক হয়। হাসিমুখে বলে, তোমারে বাড়ি নিয়া যাইতে কইলো। কিছুক্ষণ পর আমরা বাড়ি যামু।’

চুমকির মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। এই মেডিকেল একদমই ভালো লাগছিলো না তার। এবার বাড়ি ফেরাটা তাঁর কাছে বিশেষ কিছু। কারণ, সে জানে; এবার তাঁর সঙ্গে রুমঝুম যাচ্ছে।

ফুটপাতের মন্দবাসা- ১

আগামী পর্বে সমাপ্ত। কালকেই পোস্ট করা হবে।

Mahmud Hasan

#মাহমুদ_হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here