ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ৯

0
363

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|নবম পর্ব |

শীতকালে ভ্রমণ করা অথবা বেড়াতে যাওয়া বড়োই বোকামি। প্রথম কারণ হচ্ছে, শীতকালে আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে শোয়া বসা নিয়ে কষ্ট হয়। নিজের ঘরে আরামে ঘাপটি মেরে বসে থাকা যায় এবং শীত নিবারণের জন্য দুই তিনটা মোটা কম্বল নিয়ে আরামে ঘুমানো যায়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তীব্র শীতল বাতাস এবং কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাস্তায় চলাচলও কষ্টসাধ্য।

প্রভাতের সময়টা যেমন আনন্দে কে’টে’ছে, দ্বিপ্রহরে ততটাই খারাপ কা’ট’ছে। বাড়িতে হৈ হোল্লোর শুরু হয়েছে। বাবার তথা কথিত গাজীপুরের সেই মুন্সী বাড়ির আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে বলেছেন। ভ্রমণের কথা স্বরণে আসতেই আমার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। বর্তমানে যানবাহন চলাচল সহজ নয়। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে আত্মীয়ের বাড়ি সেখানে বাসে আরোহণ করে যেতে হবে। আমাদের এদিকে বাস পাওয়া গেলেও আরোহণ করা কষ্টসাধ্য। তিন বেলায় সর্বমোট পাঁচটা বাস আসে এতে আরোহীগণ অনেক থাকে। মালা, মেহেদীর আনন্দ উল্লাস দেখে মন ঘুরিয়ে আনলাম। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো বলে মনস্থির করলাম। যাবির ভাইয়া আমার অন্তরে সর্বক্ষণ রয়েছেন। তবে চলে গেলে খুব মনে পড়বে। এখন হাতে সময় নেই উনাকে জানানোর। বড়ো মা চুপচাপ কাজ করছেন। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। আমরা চলে যাবো তার জন্য কী? হয়তো, কোনো ভ্রমণে বা বেড়াতে গেলে মাকে সাথে নিয়ে যেতে হয়। বড়ো মা বাহানা দেখিয়ে বাসায় রয়ে যান। তবে আজকের বিষন্নভরা মুখ আমাকে ভাবাচ্ছে। সাহস করে জিজ্ঞেস করব সেই বলটুকু নেই।
গোছগাছ পর্ব শেষ। বলা হয়েছে, মধ্যাহ্নভোজের পর রওনা হবো। মালা খুশিতে খাচ্ছে না। বড়ো মা সোফায় বসে মালাকে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে। খাবার টেবিলে মা তৈরি হয়ে বাবার পাশে বসে আছেন। বাবাকে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছেন আর কি। সবসময়ের মত বাবা চুপচাপ খাচ্ছেন। অন্য বেলায় বড়ো মা খাবার টেবিলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সকলের খাবারের দিকে খেয়াল রাখেন। আজ মালার জন্য হলো না। এই সুযোগে মা কাজে লাগাচ্ছেন।

আমার আপন খালা ফরিদা বেগম। স্বামী মারা গেছেন সতেরো বছর বয়সে। একজন কন্যা সন্তানের জননী। নাম পারভীন। পারভীন আপা আমার থেকে দশ বছরের বড়ো। উনিও ডিভোর্সি। দুই ছেলের মা। দুই ছেলে বাবার কাছেই থাকে আর আপা খালার সাথে। খালার পরিচয় দেওয়ার কারণ হচ্ছে, নানা বাড়ির সব খবরাখবর উনার কাছে থাকে। খাবারের মাঝেই খালার আগমন ঘটে। হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়েন। মুখে কাঠিন্যভাব এনে বললেন, –” খালেদা, খাবার দে। এখনই আমার সাথে ময়মনসিংহ যাবি। শরীফ মায়ের জমি বিক্রি করে দিবে, আমাদের ভাগে পাঁচ লাখ টাকা দিবে শুধু। মগের মুল্লুক পাইছে! আমাদের সমান অধিকার না দিলে কে’স করব কিন্তু।”
আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া খালার কাজ। জমি জমা এমন লোভনীয় বিষয় বস্তু, কারোর ভাগেরটা কেউ ছাড়বে না। মা রাগে গজগজ করে খালার কথার প্রত্যুওরে বলেন, –” আমাদের বড়োদের কথা মানবে তো কার কথা মানবে, এখনই চলো বড়ো আপা। শরীফকে যদি জে’ল খাটাতে হয় সেটাও খাটাবো তবুও নিজের হক ছাড়বো না।”

আমার মনে আনন্দের ঘণ্টা বাজছে। মা যদি খালার সাথে চলে যায় তাহলে বড়ো মা আমাদের সাথে যাবেন। মা বাবার কাছে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। বোরখা পরে, ব্যাগ হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন। বাবা একবার মার দিকে তাকিয়ে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। আমরা এখানে নীরব দর্শক। খাচ্ছি আর তামাশা দেখছি। ইতিমধ্যে বড়ো মা মালাকে খাইয়ে টেবিলের দিকে আসেন। খালাকে দেখে হাসিমুখে, –” ভালো আছেন?” জিজ্ঞেস করলেন। খালা প্রত্যুওরে কিছু বললেন না আপনমনে খেয়ে যাচ্ছেন।
মা বিদায় নিয়ে চলে যাবার পূর্ব মুহূর্তে বাবাকে কি কি যেন বলে গেলেন। দূর থেকে স্পষ্ট বাবার রক্তিম চেহারা দেখতে পাই। যতটকু বুঝেছি, মা হয়তো বাবাকে বড়ো মার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বড়ো মার পুরো কপাল, স্বামী থাকতেও স্বামীর সঙ্গ পায় না।
স্কুল ব্যাগে কাপড় ঢুকাচ্ছি। ছোট পকেট থেকে যাবির ভাইয়ার জন্য বানানো রুমাল বের করে নিলাম। বক্ষঃস্থলের বাম পাশটায় ব্যথা করছে। বেড়াতে গেলে সপ্তাহ পাঁচেক আগে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। এই কয়েকদিন উনার থেকে দূরে থাকবো ভাবতেই কান্না আসছে। আশা করছি, যদি যাওয়ার আগে একটিবার দেখা হতো! আমি জানি তা সম্ভব না কেননা যাবির ভাইয়া আজ ভার্সিটিতে যাবে যা সকালেই বলেছিলেন। আসবেন সন্ধ্যায়। বিষন্ন মনে কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছি। বড়ো মা ঘরে এসেছেন। আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।
–” কিছু বলবে?”
–” তোরা সেখানে গিয়ে শীতে কত কষ্ট করবি। তোর বাবার তো প্রতি নামাজের ওয়াক্তে গরম পানি দরকার হয়। আমি জানি, তুই চুলার পাশেই যাবি না। মানুষটা ঠান্ডা পানি ধরে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

বড়ো মার কথার মানে বুঝতে সময় লাগেনি। মায়ের সাথে দুষ্টুমি করাই যায়। মুচকি হেসে মার উদ্দেশ্যে বললাম, –” তুমি কী আমাদের সাথে যেতে চাও? মা নেই তাই ফায়দা লুটতে চাও?”

বড়ো মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। উনি রক্তিম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এখনই আমাকে গলা টি’পে ধরবেন। মায়ের মতিগতি ঠিক না। তাই হেসে মায়ের কাছে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম এবং বললাম, –” তুমি তো আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বড়ো মা। দুষ্টুমি করেছি তো! তুমি যাবে না তো কে যাবে, তোমার মত কেউ কি বাবাকে সামলাতে পারবে? তোমার জায়গায় কেউ নিতে পারবে না মা! তুমি বাবার কাছে যেমন ফুল ছিলে এখনো সেই ফুলই আছো।’

বড়ো মার শান্ত হলেন। মাঝে মাঝে বড়ো মাকে পুরোই বাচ্চা মনে হয়। যখন তখন আমার সাথে গাল ফুলিয়ে রাখেন। কখনো স্কুল ফেরার পথে চানাচুর মাখানো নিয়ে আসার আবদার করেন আবার কখনো আচার। বড়ো মা আমার কান মলে দিয়ে বললেন, –” বেশি দুষ্ট হয়ে গিয়েছিস। আবার যদি এমন পাকা পাকা কথা বলতে শুনি, তাহলে ধরে বেঁ’ধে বিয়ে দিয়ে দিব।”

আমিও দুষ্টুমির ছলে সত্যি বললাম, –” ও মা, বিয়ে দিয়ে দাও না! মাস্টার দেখে বিয়ে দিবে বুঝছো? আমার না মাস্টারদের খুব পছন্দ।”

আমাদের খুনসুটির মাঝে বাবার আগমন ঘটে। বাবা দরজার সামনে এসে কেশে জানান দেন তিনি এসেছেন। আমরা মা মেয়ে দুজন ঠিক হয়ে যাই। বড়ো মা ঘোমটা টেনে চুপটি করে দাঁড়ান, আর আমি! আমি তো গিয়ে বাবার গলায় ঝুলে পড়ি। বাবা এসে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলেন, –” যেখানে যাচ্ছিস সেখানে ঠান্ডা বেশি।আমি ঠান্ডা সহ্য করতে পারি। কিন্তু তোরা পারবি না। তাই বলছি কি, তোদের সুবিধার জন্য তোর বড় মাকে নিয়ে নিতে পারিস। আমার কোন আপত্তি নেই আর এমনিতেও কোন সমস্যা হবে না।”

বাবা ছাড়া অন্য কেউ যদি একথা বলত, তো মুখের উপর বলে দিতাম ‘তোমার বউ তুমি বলো, আমি বাবা পারব না।’ কিন্তু বাবাকে তো তার বলা যায় না। “আচ্ছা” বলে দিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আছে। পুরো রাজ্যের লজ্জা যেন মায়ের মুখে উপচে পরেছে।
—————-

রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছি। মধ্যাহ্ন শেষে অপরাহ্নের সময় হয়ে গেছে। আর দুইটা বাস আসবে বিকালে একটা আরেকটা রাতে। আমরা পুরো এক ঘণ্টা আগ থেকে অপেক্ষা করছি বাসের জন্য। আমাদের সাথে আরো বিশজন মানুষ। বড়ো মা নিজেকে কালো বোরখা দ্বারা আবৃত করে রেখেছেন। বাবা মালা,মেহেদীর হাত ধরেছেন আর আমি বড়ো মায়ের। বর্তমানে আমাদের একটি পরিপূর্ণ পরিবার মনে হচ্ছে। যেখানে কোনো হিংসে নেই, নেই কোনো বিদ্রুপ।

বাহ্যিকদিকে আমাকে খুব প্রাণোচ্ছন্ন মনে হচ্ছে কিন্তু অভ্যন্তরীণ দিকে আমি খুবই দুঃখী। যাবির ভাইয়াকে যে বলা হয়নি বেড়াতে যাওয়ার কথা। উনি নিশ্চয়ই আগামীকাল স্কুল ছুটির পর আসবেন। আমাকে দেখতে না পেয়ে ভুল বুঝবেন। বাস চলে এসেছে। বাবা আমাদের তাগাদা দিয়ে বাসে চড়ে দিলেন। বড়ো ভা কোথাও যান না তাই বাসে চড়ার অভ্যাস নাই। ভয়ে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা বাসে উঠে পড়েছেন। ভীড় জমেছে, যাত্রীরা বাসে উঠতে চেষ্টা করছে। বাবার যেন কী হলো, বড় মার হাত ধরে টেনে উঠালেন এবং বললেন, –” ভয় পেয়েছো ফুলবানু?”

সামনের সিটে বসার স্থান পেয়েছি বলে স্পষ্টভাবে শুনতে পাই। বাম পাশের দুই সিটে আমি,মালা,মেহেদী বসেছি। বাস ভরে গেছে। পিছনের ডান পাশটায় দুই সিট অবশিষ্ট আছে। বাবা আমাদের এক পলক দেখে বড়ো মাকে আগের ন্যায় হাত ধরে পিছনে চলে গেলেন এবং সিটে বসে পড়লেন। বাস চলতে শুরু করেছে। রাস্তার অবস্থা ভালো না। ভাঙা রাস্তায় দুই ঘণ্টার পথ পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। আমি ছটফট করছি সামনে যাবির ভাইয়ার ভার্সিটি। শুনেছি উনি নাকি ভার্সিটির সামনে চা স্টল থেকে চা পান করেন। আমি খুব করে দোয়া করছি যেন চা স্টলে উনি থাকেন।
আমার দোয়া উপর ওয়ালা হয়তো কবুল করেছেন।নীল পাঞ্জাবী পরিহিত যুবকটি বসে চা পান করছে এবং পাশের জনের সাথে কথা বলছে। কি করব, কীভাবে করব ভেবে পাচ্ছি না। অবশেষে ব্যাগের পাশ পকেট থেকে মেরিলের কৌটা বের করে রুমালে পেঁচিয়ে গিট দিয়ে দিলাম। যাবির ভাইয়ার কাছাকাছি আসতেই ছুড়ে মারলাম উনার কোলে। নিশানা ঠিক ছিল বিধায় আমি উনার নজরে পড়েছি। চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে রুমাল হাতে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বুঝতে পারলেন বিষয় কী। তাৎক্ষনাত এগিয়ে এসে জোরে বললেন, –” কোথায় যাচ্ছো, মায়া? তুমি কী ফিরে আসবে না?”

উনার দুই বাক্যে আমার চোখের অশ্রু টলমল করছে। হাত দিয়ে বিদায় জানিয়ে বললাম, –” আপনার ঠোঁট শীতে শুষ্ক হয়ে আছে। মেরিল দিয়েছি ঠোঁটে লাগিয়ে নিবেন। রুমাল দিয়েছি যত্ন করে পকেটে রেখে দিবেন না। মুখ মুছে নিবেন। আল্লাহ হাফেজ।”

–” মাথা বাইর কইরা রাখছো কেন মাইয়া? আরেকটা বাস আইয়া মাথা ছি’ড়া লইয়া যাইবো গা।”

ঝাপসা চোখে যাবির ভাইয়ার অসহায় চাহনি দেখতে পেলাম। পিছনের একজন যাত্রীর কথায় সিটে এসে মাথা এলিয়ে দিলাম। চোখের জল মুছে বিড়বিড় করে বললাম, –” এত কষ্ট কেনো হচ্ছে? আমাদের আর কী দেখা হবে না?”

চলবে……

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গল্পটা নব্বই দশকের সময় চিন্তা করে লিখছি। পাঠকগণের নিকট অনুরোধ অতীত, বর্তমান নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। ভালো থাকবেন সবাই। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here