ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ৮

0
376

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|অষ্টম পর্ব |

যাবির ভাইয়া দু-হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে চমৎকার হাসি। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছেন। ঐ যে ছোট বাচ্চাদের যেমনভাবে কাছে ডাকে ঠিক সেভাবে। আমি আগাচ্ছি না, ভয় পাচ্ছি। যাবির ভাইয়ার অগোচরে ভালোবেসেছি, মনের সুপ্ত দরজা খুলেছি। তবে সরাসরি এভাবে অনুভব করতে পারিনি। আমার দাঁড়িয়ে থাকা যেন উনাকে বিভ্রান্ত করছে। এক হাত নামিয়ে নিলেন। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, –” আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করেই হাতে হাত রাখি। একে অপরকে সম্মান করি বলে কথা মানি। একে অপরের মনের কথা বুঝতে পারি বলে একসাথে পথ চলি। হাত বাড়িয়েছি, একবার ধরবে? কথা দিচ্ছি আজীবন এভাবেই থাকব, তোমার হয়ে।”

আমার চোখ আজ সবই ভুল দেখছে। কর্ণধারের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। এত সুখ কী আদৌও কপালে ছিল? চোখ ভর্তি জল, মুখে চিলতে হাসির রেখা নিয়ে এগিয়ে আসলাম। যারিব ভাইয়ার হাতে হাত রেখে বললাম, –” এই যে হাতটি ভরসার করে রাখলাম। কখনো ভঙ্গ করবেন না। এই কিশোরীর মনে আপনার জন্য অগাত ভালোবাসা রয়েছে। কথা দিন, কখনো ছেড়ে যাবেন না।”

–” কথা দিলাম।”
——————

হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলা শুরু দুজনের। যাবির ভাইয়া উনার কথা রেখেছে। কখনো কষ্ট দেয়নি। বাবা-মার দৃষ্টির আড়ালে এই মায়াকে সবসময় আগলে রেখেছে। নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি। প্রখর শীত। দিবসের অর্ধেক বেলা কুয়াশায় ঢাকা থাকে পথঘাট। বাহিরে বের হওয়ার জো নেই। তীব্র শীতে মানুষজন রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টা করছে। আজকাল সকাল সকাল আরবি পড়তে যেতে পারি না। আমার উপর বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। ঠান্ডায় কাবু করে রাখা আমাকে ঘরের বাইরে পা দিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমাকে আটকে রাখা কী এতোই সহজ? সকালে গরম শাল গায়ে পরে নিলাম। শালটা বড়ো মার। বড়ো মা এবং বাবার বিয়ের তিন বছর পর বাবা ইন্ডিয়া থেকে এনেছিলেন। বড়ো মায়ের খুব পছন্দের। এজন্যই তো তিনি শীতে কষ্ট করেন কিন্তু এই শাল পরেন না নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
বড়ো মা গরম চা ফ্লাস্কে ভরে দিলেন। সকাল বেলায় উড়ুকথা শুনেছেন যে, ভাবী নাকি অসুস্থ। ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। কথাটা শোনার পর খুব হেসেছি। আমার জীবদ্দশায় শুনে এসেছি ছোট বাবুদের নিউমোনিয়া হয় কিন্তু বড়োদের হয় কী না জানি না। বড়ো মা আমাকে হাত পা মোজা পরিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘরে গেলেন। আমি মনে মনে খুব খুশি। ভাবীর অজুহাতে উনার দর্শনও পাওয়া যাবে।
এমনিতে শীত।
ঘন কুয়াশায় দুইহাত দূরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। বড়ো মা চিতই পিঠা, খেজুরের গুর, আর চায়ের ফ্লাক্স আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন।
শীতের প্রকোপে গুঁজে গুঁজে হাঁটছি তখনই দুই বিচ্ছু সুমু,রুমুর সাথে দেখা হয়। আমাকে প্যাকেট অবস্থায় দেখে দুজনই সমান তালে হাসছে। সুমু রুমুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে , –” তেঁতুল গাছে যেই পেত্নি বসে থাকে, তার নাম দিয়েছিলাম,মায়াভূতী। দেখ রুমু, মায়া আপুকে মায়াভূতী লাগছে।”
–” আমি ভয় পাচ্ছি রে সুমু, চল পাঞ্জাবী কাকুকে বলে আসি।”

আবরি পড়ে দুই দুষ্টু বাড়ির পথে না গিয়ে এখানে ঘুরঘুর করছে। মাথার হিজাব সুন্দর করে না পরে উলটোভাবে বেঁধে চুল বানিয়ে নিয়েছে। আমার আর তাদের গন্তব্য একই। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম এরা পাঞ্জাবী কাকু কাকে বলেছে। ভাই বলা ঠিক ছিল এরা তো একেবারে বাপ,কাকু ডাকছে। রুমু,সুমুর কাণ্ডে হেসে ফেললাম। দুজন দৌড়ে যাবির ভাইয়ার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবী বলে দুইবার ডাক দিলাম।

গলায় মোটা কাপড় প্যাঁচিয়ে, নাক টানতে টানতে ভাবী ঘর থেকে বের হলেন। চোখ দুটোও ফুলে আছে। বাহ্যিক দিক দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুবই অসুস্থ। মায়া হলো খুব। ভাবীকে ধরে বারান্দার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। গা,কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বুঝে বললাম, –” তোমার কী নিউমোনিয়া হয়েছে?”

ভাঙা স্বরেও ভাবী হেসে ফেললেন। ঘ্যারঘ্যার স্বরে প্রত্যুওরে বললেন, –” টাইফয়েড হয়েছে আর তুই আমাকে নিউমোনিয়ার রোগী, অর্থাৎ বাচ্চা বানিয়ে দিলি?”

–” মায়া তো বাচ্চাই, বড়ো হয়েছে কী? শুধু হাত পা লম্বা হয়েছে।”

সুমু, রুমু দুজন যাবির ভাইয়ার দুই হাতে ঝুলছে। কালো শীতের কাপড় পরিহিত উনি। এক পলক দেখেই লজ্জায় পুনরায় তাকাতে ইচ্ছে করছে না। পূর্বে যেমন আড়ালে আবডালে তাখিয়ে থাকতাম, এখন আর পারি না। অজানা লজ্জায় ডুবে যাই। ভাবী বসে থাকতে পারছেন না। ধরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসলাম।

বারান্দায় আসতেই যাবির ভাইয়া আমাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে আসলেন। আমাকে বিছানার উপর বসিয়ে নিজেও বসলেন। আকস্মিক ঘটনা ঘটায় অবাক হয়ে রইলাম পরমুহূর্তে আসল ঘটনা বুঝতে পেরে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু যাবির ভাইয়ের কোন হেলদোল নেই। উনি কিছু হয়নি ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। উনার হাসিতে বারবার খু’ন হয়ে যাই। ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু তা এখন আর সম্ভব না। আগের আমি আর এখন আমির মধ্যে অনেক তফাৎ হয়ে গেছি। দিন দিন লজ্জাবতীর উপাধি পাচ্ছি উনার কাছ থেকে। আমি উনার দিকে এক পলকের বেশি তাকাতে পারি না।
যাবির ভাইয়া আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরলেন। আমার দৃষ্টি তখন জমিনে উনার বিছানার উপর আঁকা লাল সাদা ফুলের উপর নিবদ্ধ। উনার শান্ত স্বর শনতে পেলাম, –” তাকাও মায়া?”

যাবির ভাইয়ের কথায়ও আমার কোন হেলদোল নেই। দুই পাশে মাথা নেড়ে না বোধক ইশারা করলাম যে তাকাব না। উনি নাছোড়বান্দার মত আমার থুতনি উঁচু করে ধরলেন ফলস্বরূপ ওনার আঁখি দয় আমার আঁখি দ্বয়ে মিলিত হল।

–” আমার দিকে এক ঘন্টা তাকিয়ে থাকো তো? ইদানিং তোমার প্রেম প্রেম ভাবটা কমে গেছে। ভালো করে আমাকে দেখোও না। আমি কী আগে থেকে বুড়ো হয়ে গেছি? হলেই বা কি। পছন্দ তো তুমি করেছ। আর আমাকে পাগল বানিয়েছ। আমি বুড়ো হলেও কি আর যুবক হলেও কি। আমার সাথেই তোমার থাকতে হবে।”

–“কেন ডেকেছেন? আপনার হাসি সহ্য হচ্ছে না।”

–” যার জন্য এসেছ, তার সাথে দেখা না করে চলে যাবে? এ কেমন বিচার, মায়া?”

যাবির ভাইয়ার কথায় চোখ বন্ধ করে হেসে ফেললাম। আমার ছটফটে ভাবটা উনি কীভাবে যে বুঝে যায়, নিজেও জানিনা। আমি জানি এখন উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুভব করছি উনি এক হাতে আঙ্গ আমার কপলের উপর থেকে চুল সরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর দূরে চলে গিয়ে বললেন, –” গিন্নিদের মতো একটু কাজ করো তো? যা এনেছো তা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসবে। এটা তোমার পরীক্ষা বলতে পারো। কঠিন সময়ে তুমি কীভাবে ধৈর্যশীল হয়ে থাকবে তা দেখব।”

মাস্টারদের কাজই মাস্টারগিরী করা। উনার দিকে বিরক্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, –” আইছে মাস্টার, খালি পরীক্ষা নেয়।”

পিছন থেকে শুনতে পেলাম যাবির ভাইয়া হাসছেন। হেসে হেসে প্রত্যুওরে বলছেন, –” এই মাস্টারের সাথে সারাজীবন থাকতে হবে, আর সকল পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।”

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গরম গরম ধোয়া উঠানোর চা পান করছি। যাবির ভাইয়া জানালার একপাশে আর আমি অপর পাশে। আমাদের মাঝখানে দূরত্ব প্রায় তিন হাত। দিনে দিনে উনার জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে কেমন যেন নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকে। চায়ের কাপের চুমুক দিচ্ছি আর ঘন কুয়াশা দেখছি। একটু পর কোণা চোখে উনাকেও দেখছি। প্রতিবার তাকানোতে ওনার নির্লজ্জ ভরা হাসিও উপহার হিসেবে দেখছি। চা পান করা শেষ। আমাকে বাহিরে যেতে দিলেন না। আমার হাত ধরলেন তারপর বললেন , –” জাদু দেখবে?”

জাদু দেখতে কারই না ভালো লাগে। আমার খুব ভালো লাগে। অবশ্য জাদু টাদু ঐসব কিছুই না। সোজা বাংলায় বলে হাতের ক্যালমা। আমাদের স্কুলে গতবছল জাদু দেখাতে এসেছিল। শো এর শেষ মুহূর্তে কালো টুপি ওয়ালা আঙ্কেলটাই এই কথা বলে গেছেন। কিছু চালাকি আর কলাকৌশল জানা থাকলেই আপনি জাদু দেখানো যায়। যাবির ভাইয়ার কথা শুনে ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি জাদু দেখাবে। উৎসাহের সহিত বললাম, –” হ্যাঁ দেখব।”

জাদু শুরু হল। উনার বাম হাত দ্বারা আমার হাত ধরে রেখেছেন। কখনো ডান হাতের উপর ঘুরাচ্ছেন তো কখনো নিচে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাত দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন তো কখনো আমার নাকে চিমটি কা’ট’ছে’ন আবার কখনো চুল ধরে টানছেন। জাদুর মধ্যে এসবও হয়? জানা নেই। উনার কাণ্ডে আমি হেসে যাচ্ছি। জোরে জোরে হাসছি। খিলখিল করে হাসছি। আমার হাসিতে যেন কুয়ালা আরো ঘন আরো হচ্ছে। অবশেষে আমার হাসি থেমে যায় আমার বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ভারি কিছু অনুভব হওয়ায়।

চোখের সামনে হাত এনে দেখলাম অনামিকা আঙ্গুলে চিকন একটা সোনার আংটি চিকচিক করছে। হঠাৎ করে কেউ তাকালে বুঝবে না, খুব গভীরভাবে মনোযোগ দিলে দেখতে পারবে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে উনার দিকে তাকালাম। প্রত্যুত্তরে উনি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললেন, –” তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার। ভেবেছিলাম আরো আগে দিব। কিন্তু তখন তো তুমি বাচ্চা ছিলে। আংটির মাপ আমাদের প্রথম দেখায় নিয়েছিলাম। তখন যদি দিতাম তো বলতে,’ কেন দিয়েছেন ভাইয়া? আপনার বাসায় কি স্বর্ণের অভাব পড়েছে? আমার বাবা তো আমাকে অনেক স্বর্ণ দিয়েছে। আমি এটা নিবো না। বড়োমা দেখলে বকবে।’ এখন কিছুই বলতে পারবে না। এখন তো তুমি লজ্জায় মরবে আর আমি মন ভরে দেখব।”

সুখের সময় খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। অতীত হয়ে থেকে যায় সব। সুখ কী সবসময়ই থাকে! কষ্ট আসে না! সুখ দুঃখ নিয়েই তো গল্প তৈরি হয়। ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে জানি না। তবে খুব করে চাই, সকলে মিলে আনন্দে থাকি।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here