ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২৬

0
427

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
| ছাব্বিশ তম পর্ব|

আজ শুক্রবার। আমাদের দুজনেরই ছুটির দিন। কলেজে ক্লাস করছি। সকল শিক্ষকদেরর পছন্দের পাত্রী হয়ে গিয়েছি কয়েকদিনের মধ্যেই। আমার সহপাঠীরাও অনেক ভালো। তাদের সাহায্যে আজ যাবির ভাইয়াকে চমকে দিব। জুমাআর নামাজে যেতেই কাজে লেগে পড়লাম।
নীল শাড়ি পরিধান করেছি। মাথায় খোঁপা করেছি। চোখে মোটা করে কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। আমাদের ঘর বর্তমানে জিনিসপত্রে ভরপুর। উনি মাস্টার্স শেষ করেছেন চার মাস পূর্বে। বর্তমানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। বেতন খুব ভালো। প্রথম মাসের টাকা দিয়ে একটা খাট, আরেকটা আলনা কিনেছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, ” একটা আয়না নাও।” আমি রাজি হইনি কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। আমার জন্য একটা আয়না কিনে নিয়ে আসেন। আয়নাটা এত বেশি বড়ো না, ছোটও না। একটা কাঠের বক্সের সাথে আয়নাটা লাগানো, খুব সুন্দর। সাজগোজ করার পর যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখি তখন লাজে ম’রে যাই। একদিন উনি বলেছিলেন, ” তুমি যখন এইভাবে আয়না দেখো আমার কেমন কেমন যেনো লাগে। ইচ্ছে করে এভাবেই সারা জীবন তাকিয়ে থাকি, তোমার পানে।”

উনার কথায় সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। সমস্ত কাজ শেষ করে পুনরায় আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। আজ কেনো যেনো খুব লজ্জা লাগছে। ইচ্ছে করছে কোথাও লুকিয়ে থাকি কিন্তু আমি তো জানি, যেখানে লুকিয়ে থাকি না কেনো উনি আমাকে ঠিকই খুঁজে নিবেন।
ঠিক দুইটার সময় উনি বাসায় আসেন। এসে কিছুক্ষণ আমাকে ডাকাডাকি করেন। আমি পাশের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছি। এখন সামনে যাওয়া মানে বিপদ।
দু’একবার ডেকে উনারা সারা শব্দ শুনতে পেলাম না। উনার খোঁজ করব তার আগেই উনি আমার পিছন দিয়ে জাপটে ধরেন। আমি চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসি। উনি আমার ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলেন, –” রান্না করেছে কে?”

–” ইয়ে মানে আমি করেছি।”

–” এত সুন্দর করে সাজগোজ করার কারণটা কি জানতে পারি? আমার জানামতে আজ তো আমার জন্মদিন না, তোমার জন্মদিনও না। এমনকি আমাদের বিবাহ বার্ষিকও না। তাহলে এত আয়োজন কেনো? এক মিনিট, এক মিনিট, একটু আগে কি বললা? তুমি রান্না করেছো? রান্না কোথায় শিখলে?”

যাবির ভাইয়ার দিকে ফিরে তাকালাম। উনির গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, –” ভাবির কাছে কিছু কিছু শিখেছি। শেফালির মার কাছ থেকে ভালো করে শিখেছি। আন্টি প্রতিদিন টিফিন নিয়ে আসেন। তো টিফিনের সময় গল্প করতে করতে উনার কাছ থেকে শিখে নিয়েছি।”

–” বাহ আমার বউ তো দেখি খুব বড়ো হয়ে গেছে? সব রান্নাবান্না করতে পারে। আমার তো এই জীবনে কষ্টই রইল না।”

–” মানুষ পরিবর্তনশীল। মানুষের মন মিনিটে, সেকেন্ডে, ঘন্টায় পরিবর্তন হয়। আমিও পরিবর্তন হয়েছি। এখনো সেই ছোট্ট নেই, বড়ো হয়ে গেছি। আপনি এখন থেকে শুধু কাজ করে আসবেন আর আরাম করবেন। আর আমি বাসায় বসে সব কাজ শেষ করব।”

আমার কথা শুনে উনি মুচকি হাসলেন। আমাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে রইলেন কিছুক্ষণ।

খাবার খেতে বসেছি দুজন। উনি কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলেন। অভ্যাস মোতাবেক পাঞ্জাবিকে তোয়ালে বানাতে নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই আমি বাঁধা দিয়ে হাতের তোয়ালে তুলে দেই।
আজকে খাবারে একটা মাত্র পাত্র নিয়েছি। সামনে ভাতের এবং তরকারি একটা বাটি রেখে আসন পেতে উনার পাশে চুপচাপ বসে পড়লাম। উনি আমার কার্যকলাপ দেখে বুঝতে পারলেন আজকে উনার হাতে খেতে চাইছি। সর্বপ্রথম লোকমা আমার মুখে দিতে চাইছিলেন তখন আমি বাঁধা দেই।

–” প্রতিদিন তো আগে আমাকে খাওয়ান।আজ না হয় আপনি প্রথম খান। আমি চাইছি আমার হাতের রান্না করা খাবার আপনি প্রথমে পরখ করুন। উনিও তাই করলেন। ভাত মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন। খুব মজার খাবার খেলে যেমন ভাবভঙ্গি করা হয় তেমন উনিও করছেন। অথচ আমি জানি, খাবার এতটাও স্বাদ হয়নি। হয়তো নুন বেশি দিয়েছি ,নয়তো মরিচ বেশি দিয়েছি। একসাথে তিন চার লোকমা খাওয়ার পর উনার খেয়াল হলো যে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি এবং অপেক্ষা করছি উনার হাতে খাবার খাওয়ার। আমার দিকে এক লোকমা এগিয়ে দিলেন। চোখ বড়ো হয়ে আসলো। জীবনের প্রথম রান্না করেছি তবে খুব সুস্বাদু হয়েছে। হালটা একটু মরিচ বেশি কিন্তু খেতে অনেক মজাদার।
খাবারের পর্ব সমাপ্ত করে বিছানায় এসে আরাম করে বসলাম। উনি শুয়ে আছেন আর আমি উনার পাশে বসে উনার হাতে আঁকিবুকি করছি।
–” ইদানিং তুমি এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছ কীভাবে বউ? মুখে অতিরিক্ত কিছু মাখো? নাকি আমার আদর পেয়ে পেয়ে সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো?”

–” ইস আপনার মুখে কিছু আটকায় না। এভাবে বললে, আমি লজ্জা পাই তো।”

আমার কথা শুনে উনি হাহা করে হেসে ফেললেন। আমিও লজ্জায় লাল হয়ে উনার বুকে মাথা ঠেকালাম।

আমাদের জীবন এভাবেই চলছে। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের প্রতিটা সকাল এবং রজনী। শুধু মনে একটা কষ্টই রয়ে গেল। পরিবারকে ছেড়ে আমি একা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আমার শ্বশুর কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরে গিয়েছেন। আমার শাশুড়ি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কথা বলেন না। আমরা ওসব কিছুর পরোয়া করি না। বড়ো ভাইয়া ভাবিও সপ্তাহে দুইবার এসে ঘুরে যান।
——–
কিছুদিন পর প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ইদানিং শরীর একটু দুর্বল মনে হয়। বিয়ের পর নিজের সাথে সাথে শরীরও পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিলাম শুকনা কাঠি, এখনো হয়েছি মোটা আলুর বস্তা। এজন্যই হয়তো শরীর দুর্বল লাগে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আর চিন্তা করছিলাম। তখনি কেউ আপু বলে ডাক দেয়। কন্ঠস্বরটা খুবই পরিচিত। থেমে যাই আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে খোঁজ করি। মনের ভুল ভেবে আবারো এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আবার স্বরে কর্ণধারে ভেসে আসে।
–” আপু আমার সাথে কথা বলবে না?”

এবার থেমে গেলাম। কন্ঠস্বরটা মেহেদীর কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে,” মেহেদী এখানে কোথায় থেকে আসবে?” মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটতে নিতেই কেউ এসে আমার হাত ধরে। পাশ ফিরে তাকাতেই আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। মেহেদীকে এত মাস পর স্বচক্ষে দেখছি। ছেলেটা হাতে পায়ে বড়ো হয়ে গেছে।

–” কেমন আছো আপু?”
মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। কতদিন আমার ভাইটাকে দেখি না। অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। মনে প্রশ্ন জাগলো, ” মেহেদী এখানে কী করছে? চোখের পানি মুছে প্রশ্ন করলাম, –” তুই এখা এখানে কি করছিস? বাবা এসেছে? নাকি বড়ো মা এসেছে? আমি জানতাম উনারা রাগ করে থাকতে পারবেন না। কোথায় উনারা?”

আমার অস্থিরতা দেখে মেহেদীর মুখ কালো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, –” কেউ আসেনি আপু। আমি আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আমি জানতাম না তুমি এখানে থাকো। হঠাৎ তোমার দেখা পেলাম।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিলাম। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বাবা-মা আমাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু না, উনারা আমার সাথে রাগ করেই আছেন।

মেহেদীকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বাড়িঘর দেখে মেহেদী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

–” তুমি এখানে থাকো আপু? স্যার কোথায়? স্যারকে বাসায় আসে না?”

–” তোর স্যার অফিসে। আসবেন বিকেলে। দুপুরে খেয়ে গেছেন। আমি কলেজে ছিলাম।”

–” তুমি পড়াশোনা করো?”
–” হ্যাঁ। এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। এখন ইন্টারে পড়ছি।”

মেহেদী অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। যেই মেয়ে বাসায় কোনো কাজ করেনি সে দিব্বি সংসার করছে দেখে অবাক হওয়ারই কথা।

–” তুই বোস ভাই। আমি তোর জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করি। বাবা কেমন আছে রে? মা কী এখনো বড়ো মার সাথে খারাপ ব্যবহার করে? বড়ো মার শরীর ঠিক আছে তো?”

–” সবাই ভালো আছে। মা বড়ো মাকে আগে থেকে বেশি কাজ করায়, কটু কথা বলি কষ্ট দেয়। আমি এসব দেখে চুপ করে থাকতে পারি না, প্রতিবাদ করি বলে আমাকেও কথা শোনায়।”
মেহেদীর কথায় মুখ মলিন করে বাহিরে চলে এলাম। আমার হাতে লাগানো কিছু ফলের গাছ বুনেছি। পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা, আর শশা গাছ থেকে শসা ছিঁড়ে মেহেদীর জন্য নিয়ে নিলাম।

আমার ভাবতেই আনন্দ লাগছে। আমার হাতের ফল-সবজি আমার ভাই খাবে। কিছু পথ এগিয়ে আসতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল। বর্তমানে যাবির ভাইয়া নেই তাই মেহেদি বলে চিৎকার দিয়ে বসে পড়ি। মেহেদী আমার এই অবস্থা দেখে আমাকে ধরে আস্তে করে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

প্রায় এক ঘন্টা পর যাবির ভাইয়া আসেন। মেহেদীকে দেখে অনেকটা অবাক হন।

–” কেমন আছো মেহেদী? কখন এসেছো? পড়াশোনা কেমন চলছে?”

–” ভালো আছি স্যার। আপু হটাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি অনেক আগেই চলে যেতাম
আপু একা থাকবে বলে যাওয়া হয়নি।”

মেহেদীর কথা শেষ হতেই উনি বিচলিত হয়ে আমার কাছে আসেন। কপালে গালে হাত রেখে শরীরে তাপমাত্রা বুঝতে চেষ্টা করেন। স্বাভাবিক তাপমাত্রা। প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে তাকান।

–” কি হয়েছে বউ? অসুস্থ লাগছে?”

–” কিছুদিন ধরে শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।
আমাকে আগে বলোনি কেনো?”

–” ভেবেছি মোটা হয়েছি এজন্য শরীর দুর্বল লাগে।”

–” আমার তো তা মনে হচ্ছে না। চলো ডাক্তারের কাছে যাই।”

মেহেদীর এখানে আসা এবং আমাদের দেখা হওয়া সবকিছু মেহেদী যাবির ভাইয়াকে জানায়। মেহেদীকে বিদায় দিয়ে দিলাম। বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে মেহেদীকে গাড়িতে তুলে আমরাও রওনা হলাম পাশের একটা ক্লিনিকে।
সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুজনেই কিছুটা ভয় পেয়ে ক্লিনিকের বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় তিন ঘন্টা পরে ফলাফল আসে। ক্লিনিকের ডাক্তার হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানায়। আমাদের জীবনে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। এ বিষয়ে জেনে দুজনেই অবাক হয়ে যাই। আমরা দুজনে প্রস্তুত ছিলাম না এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য।

যাবির ভাইয়া এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে ডাক্তারের সামনে জাপটে ধরে কপালে অধর ছুঁয়ে দেন। গালে হাত রেখে বলেন, –” আমি খুব খুশি বউ। তুমি আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছ। যে আলো তুমি চলে গেলেই নিভে যাবে। এভাবেই পাশে থেকো মায়াবিনী।”

বাড়ি ফিরে আসলাম। বারান্দায় দুজন শীতলপাটি বিছিয়ে বসে রয়েছি। আমার মাথা উনার কাঁধে রেখে নারিকেল গাছের পাতার আড়ালে উজ্জ্বল চাঁদকে দেখছি। সত্যিই জীবনটা সুন্দর। উনি পাশে থাকলে সব কিছু রঙিন মনে হয়। এভাবেই আমাদের জীবন চলবে নাকি কোনো ঝড় তুফান এসে আমাদের সুখের সংসার তছনছ করে দিবে। কে জানে?

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here