ফাগুন ছোঁয়া পর্ব ১১

0
175

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_১১
#লেখিকা_সারা মেহেক

মিমের প্রাণপাখী যেনো এই মাত্রই খাঁচা হতে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। বুকটা তার ধক্ করে উঠলো। আতঙ্কে নয়নজুগল বড় হলো। এই বুঝি আদ্রিশ তাকে পুকুরে ধাক্কা দিলো! কিন্তু আদ্রিশ তার বাহু ধরে রাখায় সে পড়েনি। আদতে আদ্রিশ তাকে ভয় দেখানোর জন্য কাজটি করলো।
ওদিকে আদ্রিশ ঢের টের পেলো যে মিম বেশ ভয় পেয়েছে। এ নিয়ে সে খানিক হাসলোও বটে। এতে মিমের ভীষণ রাগ হলো। সে আদ্রিশের নিকট হতে বাহু ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকালো। ক্রোধান্বিত চাহনিতে রাগত স্বরে বললো,
” যদি এখনই পড়ে যেতাম তাহলে!”

মিমের এ রাগত মুখশ্রী আদ্রিশের নিকট বিরাট এক হাসির উৎস হলো যেনো। সে ঠোঁট টিপে খানিক হেসে নিলো। তার এ হাসি দেখে মিম ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে অভিমানী চাহনিতে চাইলো। তার রুষ্ট কণ্ঠ মুহূর্তেই অভিমানী হয়ে উঠলো। বললো,
” আপনি ভীষণ খারাপ!”

আদ্রিশ মিমের এরূপ অভিমানী দৃষ্টিতে মুচকি হাসলো। তার দুষ্টুমি কমে স্থির দৃষ্টিজোড়া মিমের উপর নিবদ্ধ হলো। মিমকে নিষ্পলক দেখলো সে। তার এরূপ দৃষ্টিতে মিম ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো৷ মুহূর্তেই দৃষ্টিজোড়া নত করলো। তার গাল দুটো লজ্জায় রক্তিমাভাব ধারণ করলো।

মৃদুমন্দ হাওয়ায় মিমের চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। কিছু কিছু চুল তার মুখের সামনে উড়াউড়ি করছে। আদ্রিশ চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে মিমের কানের পিছনে দিলো। বিমুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
” খোলা চুল আর শাড়িতে তোমাকে ভীষণ মানিয়েছে মিশমিশ। ”

আদ্রিশের সামান্য প্রশংসায় মিম লজ্জায় যেনো আরোও লাল হয়ে উঠলো। তার মন চাইছে এখনই এ জায়গা হতে ছুটে পালিয়ে যেতে। ইশ, এ সামান্য প্রশংসায় এ অবস্থা তার!
আদ্রিশ পুনরায় বললো,
” শোনো, একটা আবদার করবো। রাখবে তো?”

মিম এবার দৃষ্টি তুলে চাইলো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” কি আবদার? ”

আদ্রিশ মিমের কানের পিছে পুনরায় চুল গুঁজে দিতে দিতে বললো,
” রোজকার ক্লান্তিকর ডিউটি শেষে বাসায় এসে তোমাকে কি শাড়ি পরা অবস্থায় দেখতে চাওয়া ভুল আবদার হয়ে যাবে?”

মিম মুচকি হেসে বললো,
” যদি বলি, হ্যাঁ?”

আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
” তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবো। তখন আমার কিছু হয়ে গেলে সব দায়ভার তোমার।”

” সামান্য কষ্টতেই কিছু না কিছু হয়ে যাবে আপনার!”

” হ্যাঁ, হয়ে যেতে পারে। তোমাকে পাওয়ার পর থেকে ভীষণ দূর্বল হয়ে গিয়েছি, বুঝলে। ”

” কারোর প্রতি এতো দূর্বলতা ভালো না ডাক্তার সাহেব। পস্তাতে হতে পারে।”

আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসিমাখা মুখে বললো,
” সারাজীবনের জন্য এই একজনের প্রতি দূর্বলতায় যদি পস্ততাতে হয়, তাহলে আমি পস্তাতে রাজি আছি।”

আদ্রিশের কথা শুনে মিমের দৃষ্টি স্থির হয়ে এলো। অকস্মাৎই সে ভীষণ আবেগী হয়ে পড়লো। আচ্ছা, এসব কি স্বপ্ন? নাকি প্রতিটি ঘটনা সত্য? প্রতিটি কথা সত্য? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কি সত্য? আসলেই কি সে এতোটা ভাগ্যবতী? নাকি এসবই দুদিনের আবেগী মন লাগানো ব্যাপার? সে লক্ষ্য করলো তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। এ কি! সে কান্না করছে! কি লজ্জার ব্যাপার!

হঠাৎ মিমের চোখে জল দেখে আদ্রিশ খানিক ভয় পেলো। আশ্চর্য, সে ভুলে কোনো খারাপ কথা বলে ফেললো নাকি! সে আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার মিশমিশ? কান্না করছো কেনো?”

মিম দ্রুত চোখের কোন হতে জল মুছে নিলো৷ সাথে সাথে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে বললো,
” আপনি বলে পুকুরে নামবেন?”

আদ্রিশ মিমের প্রশ্নের জবাব দিলো না। বরঞ্চ সে নিজের প্রশ্নে অটল রইলো। জিজ্ঞেস করলো,
” আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কান্না করছিলে কেনো?”

” কারণটা আপাতত বলবো না আপনাকে। পরে কোনো এক সময় বলবো। এখন এ নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।”

আদ্রিশ আর কথা বাড়ালো না এ নিয়ে। মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি পুকুরে নামবে?”

মিম তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
” উঁহু উঁহু, আমি সাঁতার পারি না। পুকুরে নেমে কি করবো!”

আদ্রিশ চোখ টিপে বললো,
” তুমি যদি চাও, আমি সাঁতার শিখিয়ে দিতে পারি। এটাতে কিন্তু আমি বেশ পারদর্শী। ”

মিম কয়েক কদম পিছিয়ে এসে চাপা হেসে বললো,
” এতো উপকার করতে হবে না ডাক্তার সাহেব। আমি এভাবেই ঠিক আছি।”

আদ্রিশ আর জোর করলো না। ঘাটে না গিয়ে মিমের পাশ থেকেই পুকুরে ঝাপ দিলো। ফলস্বরূপ পানির ছিটেফোঁটা এসে পড়লো মিমের শরীরে। পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে সে ঘাটের কাছে এলো। এ পুকুরের ঘাট বাঁশের মাচার মতো তৈরী করা। মিম গিয়ে পা পানিতে ডুবিয়ে ঘাটের উপর বসলো। ওদিকে আদ্রিশ সাঁতার কাটছে। আর সে পানিতে পা ডুবিয়ে চারপাশের স্নিগ্ধ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছে।
আদ্রিশ সাঁতার কেটে ঠিক মিমের সোজাসুজি এসে দাঁড়ালো। কিন্তু মিম খেয়াল করলো না তাকে। সে প্রকৃতি দেখায় এতোটাই মত্ত হয়ে গিয়েছিলো যে সামনে একটি মানুষ তাকে অবিরাম পর্যবেক্ষণ করছে তা টের পেলো না সে। আদ্রিশ মিমের বেখেয়ালিপনা দেখে হাসলো। মনে মনে বললো,
” মেয়েটা কি অদ্ভুত। একজন যে তাকে এভাবে নিষ্পলক দেখছে সে টেরই পাচ্ছে না! তবে এভাবে তার অজান্তে তাকে দেখার মাঝে ভীষণ তৃপ্তি আছে। ”
বলেই আদ্রিশ এক মুঠো ভরে পানি নিয়ে মিমের দিকে ছিটিয়ে দিলো। অকস্মাৎ পানির স্পর্শে চমকে উঠলো সে। তৎক্ষনাৎ সম্মুখে তাকালো। দেখলো আদ্রিশ এগিয়ে আসছে তার দিকে। ঘাটের কাছে পানি তুলনামূলক কম থাকায় আদ্রিশের বুকের নিচ পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। সে আদ্রিশকে দেখে চোখমুখ কুঁচকিয়ে বললো,
” আমার গায়ে পানি ছিটালেন কেনো!”

আদ্রিশ কোনো জবাব দিলো না। মিমের একদম কাছে এসে অকস্মাৎ মিমের কোমড় ধরে তাকে পানিতে নামিয়ে দিলো। চোখের পলকে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনাও করেনি মিম। তার চোখেমুখে এখনও অগাধ বিস্ময়। এদিকে তাকে না বলে পানিতে নামানো হয়েছে বলে প্রথমে সে ভারসাম্য রাখতে পারলো না। ফলস্বরূপ পানিতে নামার সাথে সাথেই আদ্রিশের গায়ে ঢলে পড়লো সে। নিচে মাটি থাকায় আদ্রিশ পায়ের নখ দিয়ে তৎক্ষণাৎ মাটি আঁকড়ে ধরলো।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মিম নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। আদ্রিশের উপর অকপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” বললাম পানিতে নামবো না। তারপরও আমাকে নামালেন কেনো!”

আদ্রিশ দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
” একা ভালো লাগছিলো না। তাই তোমাকে নামালাম। ”

” এখানে ভালো না লাগার কি আছে শুনি? আপনি নিজের মতো সাঁতার কা’টছেন। কা’টু’ন। শুধু শুধু আমাকে নামালেন। আমি তো সাঁতার পারি না। ”

” তোমাকে কে সাঁতার পারতে বলেছে। আমার সাথে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। ”

” এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? শুধু শুধু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো কেনো?”

” আচ্ছা, দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা? তাহলে রোমান্স করো। রোমান্টিক একটা সিচুয়েশনও আছে। আমার মুডটাও রোমান্টিক আছে।”
বলেই আদ্রিশ চোখ টিপলো। এদিকে মিম লজ্জায় বাঁচে না। ভীষণ লজ্জায় আদ্রিশের মুখ চেপে ধরলো সে। লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
” বাড়ির ভেতরে মানুষ আছে। আপনার এসব কথা কারোর কানে গেলে কি ভাববে বলুন তো!”

” কি ভাববে? হাসবেন্ড ওয়াইফ রোমান্স করছে। এটাই ভাববে।”

” ইশ, আপনি বড্ড নির্লজ্জ তো! কিছু কিছু কথা আপনার মুখে একেবারেই আটকায় না। ”

” কি করবো বলো। বউ যেখানে এপ্রোচ করে না সেখানে আমাকে তো এগিয়েই আসতে হবে তাই না? নাহলে ফিউচার জেনারেশন এগুবে কি করে!”

মিম যেনো লজ্জায় পুরো পানিতে মিশে গেলো। লজ্জায় সে দু হাত দিয়ে আদ্রিশের মুখখানা ঢেকে বললো,
” কথাবার্তায় একটু লাগাম দিন ডাক্তার সাহেব। মেয়ে মানুষদের এতো লজ্জা দিতে নেই। তারা লজ্জা পেলে আর সামনের মানুষের চোখে চোখ রাখতে পারে না। ”

আদ্রিশ মিমের কোমড় ধরিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার সে এক হাতে কোমড় ধরে মিমকে নিজের দিকে টেনে এনে অপর হাত দিয়ে নিজের মুখ হতে মিমের হাত সরিয়ে বললো,
” মেয়েদের ওমন লজ্জায় রাঙা নত দৃষ্টি দেখতেও ভালো লাগে বুঝলে মিশমিশ। ঐ দৃষ্টি দেখলেও পুরুষেরা প্রেমে পড়ে। তাহলে দোষ কি এতে?”

মিম আর কথা বাড়ালো না। সে এলেমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলো,
” আমার ডাক্তার বউটা কি একটু রোমান্টিক হতে পারে না?”

মিম অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
” আমি এতোটা নির্লজ্জ নই আপনার মতো। ”

” মাঝে মাঝে একটু নির্লজ্জ হলেও তো পারো মিশমিশ। ”

” ইশ, শখ কত! আপনিই থাকুন এমন। আমি ভদ্রই ঠিক আছি।”

” আহহা, হাজবেন্ডের সামনে এতো ভদ্রতা দেখিয়ে কি হবে শুনি?”

” কি হবে তা জানি না। কিন্তু আমি আপনার মতো হতে পারবো না। আপনি এই এক পিসই আছেন।”

আদ্রিশ হেসে উঠলো মিমের কথায়। সাথে মিমও ঠোঁট টিপে হাসলো।
#চলবে
®সারা মেহেক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here