প্রেমোদ্দীপক পর্ব ২৩

0
655

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-২৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

গোধূলি নেমেছে সেইক্ষণে। বৃষ্টি থামার নামটি নেই। প্রবল বৃষ্টির সাথে ঝড়, বজ্রপাত যোগ হয়েছে। অভীকের ভাবনা ছিল সারাদিন ঘুরে একবারে ডিনার করে বাসায় ফিরবে। কিন্তু বৃষ্টি তা হতে দিল কই? সারা বিকেল ঘুরে সন্ধ্যা নামতেই ঝড়ের তান্ডব শুরু হলো। ওরা তখন গাড়িতে বসে আছে। রাস্তায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে। ড্রাইভারকে বলে একটা রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল অভীক। এখন গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে। যদি ও থেমে থাকাও ঝুঁকি হবে। যে কোনসময় গাছ ভেঙে গাড়ির উপর পড়ার আশঙ্কা প্রবল। মৃত্যু ও হতে পারে।
বছর ত্রিশের চালক ফয়সাল সামনে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে দোয়া পড়ছে। প্রার্থনা করছে নিরাপদে বাড়ি ফেরার। বাসায় ছোটো ছোটো দুটো বাচ্চা আছে। রাত নামলেই বাচ্চাদুটো অপেক্ষা করে বসে থাকে। কখন বাবা ফিরবে, কখন বাবার কোলে ছড়বে, বাবার আনা চকলেট চিপস খাবে। বউটাও দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে ছাড়া রাতের খাবারটাও মুখে নেয় না। ঝড়ের কবলে পড়ে তার কিছু হলে বউ বাচ্চার কী হবে? সে ছাড়া যে বউ বাচ্চার কেউ নেই! কত ভাবনা আসছে মনে, ভয়ে আত্মা কাঁপছে, দোয়া পড়ছে বারবার।

ফয়সালের চিন্তা সুস্থভাবে স্ত্রীর কাছে পৌঁছানো। গাড়ির পেছন সিটে বসা অভীকের চিন্তা সুস্থভাবে স্ত্রীকে বাসায় পৌঁছে দেয়া। ওর কিছু হলে সমস্যা নেই, কিন্তু ওর হিয়ারানীর যেন কোন ক্ষতি না হয়। মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। অভীকের বুকে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভয়ংকর বজ্রধ্বনিতে কেঁপে উঠছে। বজ্রধ্বনিগুলো যেন খুব কাছে পড়ছে, কানের পাশে। এগিয়ে আসছে ওদের গাড়ির দিকে। ভয়ংক শব্দে তাহিয়া অভীকের হাত খামছে ধরছে বারংবার। অভীক নিবিড়ভাবে আগলে রেখেছে প্রিয়তমাকে। ওর মুখটা পাংশুটে। বজ্রধ্বনিতে ওর অন্তরাত্মাও কাঁপছে। শীতটাও পড়ছে অনেক। পরিকল্পনা ছাড়া আসায় গরম কাপড় পরে আসেনি কেউ। ঠান্ডায় হাত পায়ের রক্ত জমাট বাধার উপক্রম। এত ভয়ানক পরিস্থিতিতে ইতঃপূর্বে পড়েনি ও। ঝড়ের সময় বাসায় থেকেছে, কাথা মুড়িয়ে আরাম করে ঘুমিয়েছে। তাই কখনো ঝড়ের কবলে পড়েনি। ও দোয়া ইউনুস পড়ছে শুধু। তাহিয়াকে বারবার সাহস যোগাচ্ছে,
‘কিছু হবে না। দোয়া পড়ো, আল্লাহ রক্ষা করবেন। ‘

তাহিয়া কাঁপা স্বরে দোয়া পড়ছে। মিনিট বিশেক চলল এই কঠিন পরিস্থিতি। তারপর ঝড়ের বেগ কমে এলো। বৃষ্টিও থেমে গেছে। তবে পরিবেশ গুমোট। এ ঝড়ের পূর্বাভাস। অভীক বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ফয়সাল, গাড়ি স্টার্ট দাও দ্রুত। যখন তখন আবার ঝড় শুরু হবে। এখন আমাদের ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। তাহিয়াদের এলাকার দিকে এগোও। এখান থেকে কাছে হবে। যত দ্রুত পারো।’

অভীক ওদের বাসায় যাবে? ভয়ের মাঝে খুশি হানা দিল তাহিয়ার মনে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে পরবর্তী ঝড়ের আগে তাহিয়াদের বাসার গেটে পৌঁছানো গেল। এতক্ষণে অন্তরাত্মা কাঁপানো ভয় থেকে বেরুলো তাহিয়া। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অভীক থেকে সরে বসল। স্বাভাবিক হলো। গাড়ি পার্ক করার সময় আকাশ কেঁপে বৃষ্টি নামল আবার। ঝুম বৃষ্টি। অভীক ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলল,
‘গাড়িতে তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকলে নিয়ে বের হও, ফয়সাল।’

এখান থেকে আবার বাড়ি ফিরবে কিভাবে, এই চিন্তায় অস্থির ফয়সাল। অভীকের কথা শুনে প্রশ্ন করল,
‘কেন স্যার?’

‘কারণ তুমি ও এখন আমাদের সাথে বাসায় যাচ্ছো। মনে হচ্ছে না, এই ঝড় সহজে থামবে বলে। ঝড়ের মাঝে গাড়িতে বসে থাকা নিরাপদ নয়। আর এই ঝড় পেরিয়ে বাসায় যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই তাহিয়ার বাসায় চলো। সকালে আমার সাথে একসাথে ফিরে যেও ।’ ধীর স্বরে বলল অভীক। ফয়সাল আমতা-আমতা করে বলল,
‘তা কিভাবে হয়, আমি কিভাবে বাসায়….! ‘

‘ তুমি আমার অধীনে থাকা অবস্থায় তোমার নিরপত্তার ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্ব। গাড়ির সুস্থতা থেকে তোমার সুস্থতা অতি জুরুরি। এই ঝড়ে আমি বাসায় ঘুমাব, আর তুমি গাড়িতে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনবে, তা তো হবে না। চলো বাসায়, বিয়েতে তোমায় দাওয়াত দিতে পারিনি। এ উপলক্ষে চলো, শ্বশুরবাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে এসো।’ অভীক ফয়সালের কাধ চাপড়াল।

পারতপক্ষে, বিকেলে মাহমুদা ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ঝড় বেড়ে গেলে যেন দ্রুত বাসায় ফিরে। আর ড্রাইভারকেও নিয়ে যায়। মাহমুদার পক্ষ থেকে অনুমতি পেয়েই জোর করছে অভীক। নয়তো অনুমতি ছাড়া অচেনা কাউকে বাসায় নেয়ার বিপক্ষে থাকে ও।

অভীকের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হলো ফয়সাল। এর আগে আরও কয়েকজনের পারিবারিক গাড়ি চালিয়েছে সে। কেউ তার সাথে এমন ব্যবহার করেনি। সবার চিন্তা ছিল গাড়ি নিয়ে, চালক নিয়ে নয়। এমন অনেক রাত গেছে যখন ঝড়ে আটকে গাড়িতে রাত পার করতে হয়েছে ওকে। মালিকপক্ষ কখনো ‘ঠিক আছো’ কি না জিজ্ঞেস করেনি। শুধু বজ্রপাতের সময় জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে, বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ানো গাড়ির উপর বজ্রপাত পড়ল না তো! প্রাণপ্রিয় গাড়ির ক্ষতি হলো না তো! কেউ উঁকি দিয়ে দেখেনি, গাড়ির ভেতরে প্রাণটা জীবিত আছে কি-না। চালক শ্রেণীর মানুষকে উচ্চবিত্তরা মানুষ কি আর ভাবে?
এই প্রথম কেউ গাড়ির কথা না ভেবে ওর কথা ভাবল। মনে শীতল ছেয়ে গেল ফয়সালের। এত আনন্দ, এত খুশি লাগল যে, চোখে পানি এসে গেল। দুনিয়াতে এখনো ভালো মানুষ আছে তবে! ফয়সাল তাহিয়ার দিকে তাকাল। যার বাসা সে তো বলছে না, পরে গেলে যদি কিছু বলে? তাহিয়াও জোর করল যেতে, ‘চলুন ভাইয়া।’
খুশিমনে গাড়ি থেকে নামল ফয়সাল।

.
তাহিয়াকে নিয়ে অভীক বেরুল সবে। পার্কিং এরিয়া থেকে বিল্ডিংয়ের নিচে পৌঁছাতে গিয়ে কাকভেজা হয়ে গেল। তাহিয়ার জামা ভিজে গায়ের সাথে মিশে গেছে। সিড়িরুমের লাইটে অভীক তা পরখ করে বলল,
‘তুমি যত দ্রুত উপরে উঠো। বাসায় পৌঁছে সবার আগে চেঞ্জ করবে, তারপর মাথা মুছবে। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

‘একা কেন যাব? আপনি যাবেন না?’ তড়িৎ প্রশ্ন করল তাহিয়া। অভীক ধীরে বলল,
‘আসব। ফয়সাল এখন আমাদের মেহমান। মেহমান দাঁড় করিয়ে একা চলে যাওয়া অভদ্রতা। ওকে বাসা অবধি নিয়ে যাই। ‘

ফয়সাল গাড়ি লক করছে। অভীক সেদিকে তাকিয়ে আছে। তাহিয়া হাঁটা ধরল। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাসল। লোকটা শুধু ওর প্রতিই দায়িত্ববান নয়। আশপাশের সবার প্রতি দায়িত্ববান। একজন ছেলে,একজন ভাই, একজন স্বামী, একজন জামাতা, একজন ভগ্নিপতি, একজন শিক্ষক, একজন মালিক, সব দিক দিয়ে দায়িত্ববান। তার উপর অর্পিত সব দায়িত্ব তিনি নিপুণভাবে পালন করেন। একজন মানুষকে ‘আদর্শ’ উপাধি দেয়ার জন্য কোন একদিক ভালো হওয়া যথেষ্ট নয়। সব দিক বিবেচনায় ভালো হলে তাকে ‘ আদর্শ’ মানুষ বলা যায়। সে হিসেবে অভীক আদর্শ মানুষ। তাহিয়া বিড়বিড়াল, ‘মাই সুপার হিরো।’ নিজেই হাসল বলে।

.

দায়িত্ববান ব্যক্তির সংস্পর্শে থেকে তাহিয়ার মাঝে ও দায়িত্ববোধ চাপল। দ্রুত বাসায় ফিরে চেঞ্জ করল। মাথা মুছতে মুছতে মায়ের রুমে গেল। মাকে জানাল ওদের আসার কথা। মাহমুদা দ্রুত পা ফেললেন রান্নাঘরের দিকে। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে। রিনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেও হাত দিলেন। তাহিয়া মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘মা ফ্রিজে হাঁসের মাংস আছে?’
মাহমুদা ভাবলেন। তারপর বললেন,
‘আছে। কেন? রান্না করতে হবে? আমি তো মুরগী রান্নার কথা ভাবছিলাম। ‘
‘স্যারের হাঁসের মাংস পছন্দ। মুরগী বাদ দিয়ে হাঁসের মাংস রান্না করো।’

ধীরে বলল তাহিয়া। মাহমুদার চমৎকার লাগল কথাটা শুনতে। মেয়েটা স্বামীর খেয়াল রাখতে শুধু করেছে তবে! তিনি প্রসন্ন হাসলেন। বললেন,
‘আচ্ছা। আর কিছু করা লাগবে?’
‘আর চা লাগবে। উনার জন্য গ্রীণ টি, ফায়সাল ভাইয়ার জন্য দুধ চা। ‘

মাহমুদা এবারও হাসলেন, ‘হয়ে যাবে। তুই যা। দেখ, ওরা এলো কি-না।’

তাহিয়া দ্রুত বের হলো রান্নাঘর থেকে। তুহিনের রুমে গিয়ে তুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ স্যারের ড্রাইভার আসছে বাসায়, আমাদের বাসায় ভিজে থাকবে। ভিজে গিয়েছে ফয়সাল ভাই। উনি এলে তুই তোর রুমে নিয়ে আসবি। তোর শার্ট-প্যান্ট দিবি চেঞ্জ করতে। ঠান্ডা পড়ছে, চাদর ও দিস।’

তুহিন পড়ছিল। পড়া থামিয়ে বলল,
‘ আমার জামা কাপড় সব তো দান করে দিবি দেখি। এক সুট ড্রাইভারের, এক সুট তোর জামাইয়ের জন্য। কখন না এসে তুই বলিস, ‘তুহিন, আজ তোর শার্ট প্যান্ট পরতে ইচ্ছে করছে। দে তো’!’

সময় অসময়ে এ ছেলের মজা করার অভ্যাস গেল না। আবার ঝগড়ার সুতো টানছে। তাহিয়ার এখন ঝগড়ার মনোভাব নেই। কত কাজ ওর কাধে! ও ব্যস্ত ভঙিতে বিছানার ঝাড়ু হাতে নিল। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘তোর জামা কাপড় লাগলে আমি কিনে দিব। এক সুট দে শুধু। ফয়সাল ভাইয়ার জন্য লাগবে। আমার জামাইর ব্যাপার আমি সামলে নিব,এতে তোর সাহায্য লাগবে না।’

তাহিয়াকে ইতঃপূর্বে কখনো ওর রুম গোছাতে দেখেনি তুহিন। আজ প্রথম দায়িত্ব নিয়ে সব গুছাতে দেখল। সংসারি মেয়ের মতো দৌড়াদৌড়ি করছে তার ঝগড়ুটে বোনটা। তুহিন অবাক চোখে দেখে গেল। হাসল, বোনটা গুছিয়ে যেতে শুরু করেছে। ভালোই।

তুহিনের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে এগুলো তাহিয়া। অভীক, ফয়সাল সবে এসে পৌঁছেছে। তাহিয়া মাথায় ঘোমটা টেনে গেল ভেতরে। ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ভাইয়া আপনি তুহিনের রুমের গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।’
তারপর তুহিনকে ডেকে ফয়সালকে নিয়ে যেতে বলল। ফয়সাল তুহিনের সাথে যাওয়ার পর অভীকের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনি আসুন আমার সাথে।’

অভীক ভ্রু কুঁচকাল। তাহিয়ার ব্যবহারে খুশি হয়েছে সে। দায়িত্ব নিতে শিখে যাচ্ছে মেয়েটা। ভালো দিক। কথা না বাড়িয়ে তাহিয়ার অনুসরণ করল। তাহিয়া ওর রুমে প্রবেশ করল। অভীক গেল পিছু। পুরো গা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। মাথা চুইয়ে পানি পড়ছে। চেঞ্জ করে কী পরবে এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। এই বাসায় আগে থাকা হয়নি বিধায় কোন জামা কাপড় নেই। তার চিন্তা অবসানে তাহিয়া এসে সামনে দাঁড়াল। অভীকের দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘চেঞ্জ করে নিন।’

অভীক আবার ভ্রু কুঁচকাল। প্যাকেট হাতে নিয়ে চাইল। খুলে দেখল। সাদা ক্যাজুয়াল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট। একবার প্যাকেটের দিকে চাইল, দ্বিতীয়বার তাহিয়ার দিকে। বলল,
‘এগুলো কোথা থেকে এলো?’
‘আমি দু’দিন আগে নিয়েছিলাম আপনার জন্য। ‘ ধীর স্বরে বলল তাহিয়া। অভীক অবাক স্বরে বলল,
‘আমার জন্য!’

তাহিয়া মাথা নাড়াল। অভীক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘কী মনে করে কেনা হয়েছে?’

‘ উপহার দেয়ার ইচ্ছা বা অধিকার কি শুধু আপনার আছে? আমার নেই? আমারও তো ইচ্ছে হয় আপনাকে উপহার দিতে। অনেক অনেক উপহার দিতে। কিন্তু আমার নিজস্ব কোন আয় নেই বলে পারি না। ‘ হতাশার সুরে বলল তাহিয়া। অভীক হাসল,
‘তা এগুলোর টাকা কোথা থেকে এলো? ‘

‘টাকা জমানোর শখ আছে আমার। দুটো ব্যাংক আছে। আম্মু আমাকে যে টিফিনের টাকা দেয়, সেগুলো বেঁচে গেলে আমি ব্যাংকে রেখে দিই। প্রায় এক বছর হয়েছে ব্যাংক ভাঙা হয়নি। দুদিন আগে ওগুলো ভেঙে টাকা বের করেছি। তারপর ওই টাকা দিয়ে আপনার জন্য এগুলো কিনেছি। ভেবেছিলাম, একটা ঘড়ি কিনব। কিন্তু আপনি তো সস্তা ঘড়ি পরেন না, আমার দেয়া ঘড়ি যদি না পরেন তাই কিনি নি। ‘
তাহিয়া গলাটা চঞ্চল শুনাল। এক বাক্যের জবাব দেয়ার স্থানে কত কথা বলে গেল। অভীকের খারাপ লাগল না। টিফিনের জমানো টাকা দিয়ে ওর জন্য উপহার কিনেছে মেয়েটা! অভীকের কী যে ভালো লাগল কথাটা শুনে! ওর মনে হলো, এরচেয়ে মূল্যবান উপহার হতেই পারেনা। এই উপহারে একটা মানুষের অনেক আবেগ জুড়ে আছে।
কাউকে উপহার দিতে ভালো লাগে ওর । এতে একধরনের তৃপ্তি আছে। কিন্তু এই প্রথম অনুধাবন করল, শুধু উপহার দেয়ায় নয়, নেয়ার মাঝেও তৃপ্তি আছে। তা যদি হয় কোন বিশেষ মানুষের, তা হলে তো কথাই নেই। অভীক হাসল। পোশাক খুলে হাতে নিল। ছুঁয়ে আবার হাসল।
বলল,
‘ উপহারের ক্ষেত্রে মূল্যের চেয়ে আবেগের প্রাধান্যতা বেশি। দাম যেমনই হোক ওটা বিশেষ হয়। এই যে তোমার দেয়া পোশাকটা আমার কাছে কিন্তু বিশেষ, লাখ টাকা মূল্যের। তুমি যা-ই দাও, আমি হাসি মুখে নিব। তাই আগামীতে ‘দাম’এর ব্যাপারটা আনবে না। তবে, লক্ষ রাখবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে নেয়া যাবে না, এতে আমি কষ্ট পাব। ‘

থেমে বলল, ‘আমি দ্রুত চেঞ্জ করে আসি। ‘ কেমন হয়েছে বলল না। কিন্তু ওর আগ্রহ সব প্রকাশ করে দিল। অভীক চেঞ্জ করে আসল দ্রুত। তাহিয়া রুমে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে চায়ের কাপ। অভীককে দেখে উদগ্রীব হয়ে বলল,
‘ ঠিকঠাক হয়েছে?’

অভীক মাথা মুছতেছিল। তাহিয়ার কথা শুনে টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘নিজেই দেখো। ‘

তাহিয়া দেখল লাজুক চোখে। তারপর বলল,
‘ভালো দেখাচ্ছে। ‘

অভীক ঝুঁকে এলো ওর দিকে। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ খেয়াল এদিক ওদিক হচ্ছে না কি হিয়ারানী? ‘

নানান বাঁকা খেয়াল হচ্ছে অভীকের হিয়ারানীর। কিন্তু সে স্বীকার করল না। মাথা নাড়াল। অভীক অর্থবহ হেসে বলল,
‘ তোমার খেয়ালের ঠিক ঠিকানা আমার কিন্তু অজানা নয়।’

‘তা বলুন দেখি, কী জানেন আপনি?’ ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল তাহিয়া। অভীক বাঁকা হেসে বলল,
‘বলব? লজ্জা পাবে না তো!’

লোকটার মুখভঙ্গি দেখেই তাহিয়া বুঝতে পারল, লোকটার খেয়াল তাহিয়ার মন অবধি পৌঁছানোর কথাটা মিথ্যা নয়। স্পষ্টভাষী অভীককে এখন নেতিবাচক জবাব দিলে সরাসরি বলে দিবে। লজ্জার ভাগ এসে পড়বে ওর কাধে। তাহিয়া নিশ্চুপ রইল। অভীক কাছে এলো, ঝুঁকে গেল, নিজের চুলে আটকে থাকা পানি ঝাড়ল তাহিয়ার চোখেমুখে। তাহিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবার খুলল। চশমার গ্লাস ঝাপসা হয়ে এসেছে, দেখা যাচ্ছেনা কিছু। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল, কপালে বিরক্তির ভাজ। বিরক্তটা অভীকের উপর নয়, চশমার উপর।
অভীক পরখ করল তা, মৃদুহেসে তাহিয়ার নাকের উপর বসা চশমা খুলে হাতে নিল। ওর পরিধেয় টি-শার্টে মুছে আবার পরিয়ে দিল। তাহিয়া চোখ খুলল। চোখাচোখি হলো। অভীক স্বর নরম করে বলল,
‘ প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। ‘

থেমে বলল, ‘তুমিময় অনুভূতিগুলো ভীষণ জ্বালাচ্ছে। কী করি বলো তো!’

তাহিয়া লাজুক হাসল। দৃষ্টি অবনত করে বলল,
‘আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি জানি না।’

অভীক আবার ভ্রু বাঁকাল। অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। তাহিয়া আড়চোখে দেখে নিল সে মুখভঙ্গি। দৃষ্টি ঘুরাল, ঘুরাল প্রসঙ্গ ও। হাতে থাকা সবুজ চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘চা নিন, ঠান্ডাভাব কেটে যাবে। ‘

অভীক খানিক নিশ্চুপ চেয়ে চা হাতে নিল, চুমুক দিল। তাহিয়া ওকে টেনে বিছানায় বসাল। নিজের টাওয়াল দিয়ে অনন্যচিত্তে অভীকের মাথা মুছে দিল। তারপর ওয়ারড্রব থেকে চাদর নামিয়ে জড়িয়ে দিল অভীকের কাধ হয়ে পিঠে। অভীক চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে তাহিয়ার কাজ পরখ করল, অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে। সবশেষে বলল,
‘হিয়ারানী, তোমাকে আজ নিকটস্থ বউ বউ লাগছে। কারণটা কী বলোতো?’

তাহিয়া অভীকের পাশে বসেছে সবে। অর্ধাঙ্গের কথা শুনে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে বলল,
‘এতদিন লাগে নি?’
‘একদম না।’ তড়িৎ উত্তর দিল অভীক। তাহিয়া কপট রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী লেগেছে তবে?’

‘প্রথমে ছাত্রী, তারপর পাত্রী, তারপর মায়ের পুত্রবধূ, তারপর প্রেমিকা, অবশেষে এখন এসে কাছের বউ লাগছে। একদম নিকটস্থ, ব্যক্তিগত বউ।’ আবার চায়ে চুমুক দিল অভীক। তাহিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘ বউ তো ব্যক্তিগতই হয়। জনসাধারণ বউ হয় না কি!’
‘হয় তো।’
‘জনসাধারণ বউয়ের সংজ্ঞা কী শুনি?’ চশমাটা নাকের ডগায় ঠেলে বলল তাহিয়া।

চায়ের কাপ মুখের সামনে ধরা। চুমুক না দিয়ে অভীক বলল,
‘ আমার আবিষ্কৃত সংজ্ঞা হলো, যে বউ স্বামীর কথা বাদ দিয়ে আশপাশেরর সবার কথা ভাবে, তাকে জনসাধারণ বউ বলে। আর যে বউ সবার কথা বাদ দিয়ে শুধু স্বামীর কথা ভাবে তাকে স্বামীর ব্যক্তিগত, নিকটস্থ বউ বলে। এই মুহুর্তে তোমাকে আমার ব্যক্তিগত বউ মনে হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে?’

তাহিয়ার কাছে জবাব ছিল না এর। ও নিশ্চিত লোকটা ওকে লজ্জায় ফেলতে সব জেনেও কথা ঘুরাচ্ছে। ভীষণ পাজি লোক। জবাব না থাকায় প্রসঙ্গ এড়ানোর মনস্থ করছিল ও। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে মাহমুদার ডাক পড়ল তখন। তড়িৎ উঠে দাঁড়াল তাহিয়া।
সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে বোধহয়। আপনি ফয়সাল ভাইয়ের কাছে যান, দেখুন উনি কী করছেন। তুহিনকে বলেছিলাম, ওর শার্ট-প্যান্ট আর চাদর দিতে। দিয়েছে কি না কে জানে। শীত তো ভালোই পড়ছে। ঠান্ডা না লাগলেই হয়। আপনি গিয়ে দেখুন। তারপর ফয়সাল ভাইকে নিয়ে টেবিলে আসুন।’

বলতে বলতে দরজায় অবধি চলে গেল। অভীক বলল,
‘তুমি এবার জনসাধারণ বউ হয়ে যাচ্ছো। এটা ঠিক না কিন্তু। ‘ তাহিয়ার দায়িত্ববোধ অভীককে মুগ্ধ করছে। ভালো লাগায় ছেয়ে গেছে মন। মনের আনন্দ প্রকাশ করল তাহিয়ার সাথে কৌতুকের মাধ্যমে। তাহিয়ার উত্তর জানতে মন চাইল ওর।

তাহিয়া দরজা অবধি গিয়ে পিছু ফিরল। তারপর বলল,
‘সময় হলে আবার ব্যক্তিগত বউ হয়ে যাব। ‘ বলতে দেরি, লাজুক হাসি টেনে দৌড় দিতে দেরি নেই। অভীক তাকিয়ে রইল প্রিয়তমার যাওয়ার পানে। দৃষ্টির অগোচরে যেতেই হেসে উঠল। সে হাসির শব্দ হলো, আনন্দ প্রকাশের বর্ণ ভাসল চোখে মুখে।


খাওয়ার টেবিলে নিজের পছন্দের হাঁসের মাংস দেখে কিছুটা অবাক হলো অভীক । অবাকের মাত্রা বাড়ল যখন মাহমুদা ওর পাতে মাংস তুলে দেয়ার ফাঁকে বললেন,
‘তাহিয়া বলল, তোর হাঁসের মাংস পছন্দ। এখন দেখি নিচ্ছিসই না। পছন্দের খাবার বেশি করে খেতে হয়। সব শেষ কর।’
তাহিয়ার পক্ষ থেকে ফেরত আসা ছোটো ছোটো যত্নগুলো ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে অভীককে। ও উপভোগ করে আসছে। এবারও উপভোগ করল। তাহিয়া রান্নাঘর থেকে খাবার আনা নেয়া করছে। এখন টেবিলের কাছে নেই। অভীক স্মিত হাসল খেতে খেতে। তাহিয়াকে আসতে দেখা গেল তখন, তাহিয়াকে দেখে হাসির পরিধি বাড়াল। আলতো গলায় বলল,
‘আমাদের কিছু লাগবে না, তুমি খেতে বসো। ‘

খাওয়া শেষে ছেলেরা বসার ঘরে বসল। তাহিয়া তুহিনের রুমটা আবার গুছাল, মশারী টাঙিয়ে ফিরে এলো। নিজের রুমটাও গুছাল। অভীকের ফোন চার্জে লাগাল। সব শেষে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াল। বেধে রাখা ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকানোর চেষ্টা করল। এর মাঝে দরজায় নক হলো। দরজা খোলাই ছিল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, অভীক দাঁড়ানো চৌকাঠে। তাহিয়া হেসে বলল,
‘আসুন।’

অভীক দরজা চাপিয়ে ভেতরে এলো। তাহিয়া চুল শুকানোয় মন দিল। অভীক গিয়ে বসল বিছানায়। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।

চুল শুকিয়ে গেছে। তাহিয়া এবার চিরুনি হাতে নিল। মাথা আঁচড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। কদম বাড়াতেই অভীক এসে সামনে দাঁড়াল। আকস্মিক তাহিয়ার পেছনে নিজের দুহাত নিল। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কবজি ধরল। সরাসরি স্পর্শ না করা সত্ত্বেও তাহিয়া আটকা পরল বন্ধনের মাঝে। চমকাল, ভড়কাল, তীর্যক চোখে তাকাল। দৈবাৎ অভীক স্মিত হেসে গভীর স্বরে আবৃত্তি করল,

‘পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?

বুকের মধ্যে মস্ত বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু’জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে
ক্লান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভ’রে থাকবো চেয়ে…
মনে থাকবে?

এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?

আমি হবো উড়নচণ্ডী
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?

পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো…
মনে থাকবে?

আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো
দোল মঞ্চের আবীর হবো
শিউলিতলার দূর্বো হবো
শরৎকালের আকাশ দেখার―
অনন্তনীল সকাল হবো;
এসব কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো
মনে থাকবে?’

অভীক ‘অরণ্যক বসু’র ‘মনে থাকবে?’ কবিতাটা আবৃত্তি করল তাহিয়ার চোখে চোখ রেখে। আবেগীয় স্বর,দৃষ্টি গভীর। স্বরের সাথে চোখ ও কত কথা বলে গেল। এত আবেগ মিশিয়ে যে কবিতা আবৃতি করা যায় তাহিয়ার জানা ছিল না। অভীক ফারদিন স্যারের ফক্সি ক্লাস করতে গিয়ে যখন কবিতা পড়াত, কখনোই এভাবে আবৃত্তি করত না। সেই কবিতায় কখনোই আবেগ জড়ানো থাকত না, যা শুনে কখনো এমন ভালো লাগা কাজ করত না। যার ধরণ হৃদয় ছুঁতো না। যার প্রতিটা শব্দে হৃদস্পন্দন বাড়াত না। অথচ এই মুহুর্তে সব নেতিবাচক দিক ইতিবাচকে রূপ নিয়েছে। আজ অভীক আবৃত্তি না করলে তাহিয়ার ভুল ধারণা রয়ে যেত। লোকটা ক্লাসে এত আবেগ জড়িয়ে কখনো আবৃত্তি করে না কেন! জিজ্ঞেস করতে হবে পরে কোন সময়। এই সময়টা প্রশ্নোত্তরের নয়, এই সময়টা অনুভূতির। হৃদস্পর্শী অনুভূতির, প্রেমময় আলাপনের। তাহিয়া চাইল, চেয়ে রইল।
অভীক ফিরতি বলল,
‘মনে থাকবে?’

তাহিয়া ইতিবাচক মাথা নাড়াল। অভীক কোমল স্বরে বলল,
‘ তুমি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতেই পারো। তোমার মুখে ‘তুমি’ শব্দটা মারাত্মক শোনায়। সম্পর্ক, সম্বোধন দুটোই এক ধাপ এগিয়ে যেতেই পারে। পারে না?’

তাহিয়া শুনল কথাটা, বুঝার চেষ্টা করল। একটা সময় বুঝতেও পারল। ওর শ্বাস আটকে এলো। হৃদস্পন্দন বাড়ল। দৃষ্টি লাজুক হলো, গাল লাল হলো। মুখের ভাব প্রকাশ করল লাজুক হাসিতে। মাথা গিয়ে ঠেকল প্রেমপুরুষের বুকে।

‘হিয়া উঠো, কলেজে যাবে না?’ ফরমাল ড্রেস পরিহিত অভীক তাহিয়ার পাশে বসে ডেকে যাচ্ছে অবিরত । ওর ঘুম ভেঙেছে সেইক্ষণে। আড়মোড়া ভেঙে ডেকে গেল একবার, তাহিয়া জাগল না। ফ্রেশ হতে যাওয়ার আগে আরেকবার ডেকে গেল, তাও উঠল না। ভেবেছিল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তাহিয়াকে জাগ্রত অবস্থায় পাবে। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে তাহিয়াকে গভীর ঘুমে বিভোর অবস্থায় পেল। ওর দিকে ঝুকে ঠান্ডা হাত গালে লাগিয়ে ফিরতি ডাকল। কপালে বিরক্তির রেখা টেনে নড়েচড়ে উঠল তাহিয়া। গাল থেকে ঠান্ডা স্পর্শ সরিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলল,
‘লেট মি স্লিপ।’

ঘুমন্ত তাহিয়ার মুখে ইংরেজি বাক্য শুনে অভীকের হাসি পেল। কৌতুকের স্বরে বলল,
‘ তিন বিষয়ে ফেইল করে আবার ইংলিশ ও বের হয়! আমি তো ভেবেছি, তুমি বর্ণমালা ছাড়া আর কিছুই পারো না। বর্ণ জোড়া করেও বলতে পারো দেখি। বাহ্! উন্নতি তো ভালোই হয়েছে। ‘

অভীকের টিপ্পনী তাহিয়ার কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। সে তো ঘুমে বিভোর। অভীক আবার ডাকল,
‘উঠো না হিয়া! দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! আমার দশটা পনেরোয় ক্লাস শুরু হবে। অলরেডি ন’টা পেরিয়ে গেছে। ‘

তাহিয়া চোখ খুলল মৃদু। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। অপাশ ফিরে কম্বলে মুখ ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অভীক উঠে তৈরি হওয়া ধরল। ঝটপট তৈরি হয়ে আবার এলো তাহিয়ার কাছে। কম্বল সরাল। তাহিয়ার চুল খোলা, এলোমেলো হয়ে এদিকে ওদিক ছড়িয়ে আছে। এক গোছা চুল কপালে এসে ঠেকেছে, অনন্যচিত্তে চুল সরিয়ে দিল অভীক। এক পা ভাজ করে বসল বিছানায়। প্রথমে আড়দৃষ্টিতে, অতঃপর পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল অর্ধাঙ্গিনীর পানে। শ্যামবতী কী সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে! ভীষণ মায়াবী আর চমৎকার লাগছে। অবশ্য তাহিয়া সব কাজ চমৎকারভাবে করে। প্রতি পদে প্রতি ক্ষণে ওকে মুগ্ধ করে যায়, কখনো আবেগে, কখনো কথায়, কখনো চাহনিতে, কখনো কাজে। অল্প কদিনেই ওকে ভীষণ আপন করে নিয়েছে মেয়েটা, যা অভীকের অকল্পনীয় ছিল। বিয়ের আগে ভেবেছিল, তাহিয়ার মনে জায়গা করে নিতে কম হলেও বছর তো লাগবেই। পবিত্র বন্ধনে আলাদা শক্ত আছে, আল্লাহর রহমত থাকে । নয়তো বিয়ের পর ঝড়ের গতিতে সব হয়ে গেল কিভাবে?
পরিণয়, মায়া, প্রণয় সব কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেল। বাকি যা ছিল তাও হয়ে গেল। সবকিছুর ফলাফল কষে চোখ বুলাতে গেলে একটা কথাই মাথায় আসে, জীবনটা সুন্দর, অনুভূতিগুলো চমৎকার, হৃদস্পর্শী।

অভীক অন্তর্ভেদী চাহনিতে চাইল। ঝুকল, তাহিয়ার কপালে অধর ছোঁয়াল। কানের কাছে গিয়ে কোমল স্বরে ডাকল,
‘হিয়া উঠো, আর কত ঘুমাবে?’

ডাকটা বোধহয় তাহিয়ার কানের পর্দায় গিয়ে বাড়ি খেল। ঘুম ছুটল চোখ থেকে। কত কী মনে এলো। লজ্জায় লাল হলো, হাসল মৃদু। ছোট্টো করে বলল,
‘শুভ সকাল।’

অভীক হাফ ছাড়ল,’হিয়ারানীর ঘুম ভেঙেছে অবশেষে! ‘
‘হু।’
‘উঠো, দ্রুত ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও। কলেজের জন্য দেরি হচ্ছে।’

তাহিয়ার বিড়বিড়াল, ‘ আরো করো লেকচারারকে বিয়ে! সকাল সকাল ভাব-ভালোবাসা বাদ দিয়ে পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকবে।’

অভীক শুনল সে কথা। শব্দযোগে হাসল। তাহিয়াকে টেনে বসাল। বলল,
‘ভাব-ভালোবাসার জন্য পুরো জীবন পড়ে আছে। কিন্তু পড়ালেখার সময় সীমিত। তাই আপাতত ভাব-ভালোবাসা পাশে ঠেলে পড়ালেখার দিকে তাকানোর সিদ্ধান্ত আমার। স্বামীর সিদ্ধান্তের সায় জানানো তোমার কর্তব্য।’ অভীক সরাসরি বললো না, তুমি পড়ালেখায় মনোযোগ দাও। ঘুরিয়ে বলল।

তাহিয়া বিরক্তস্বরে বলল,
‘ থাকুন আপনি আপনার পড়ালেখা নিয়ে, আমি আজ কলেজে যাবোই না। আজ শুধু ঘুরাঘুরি হবে।’

অভীক বারকয়েক সাধল। তাহিয়া নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। আজ অভীকের ক্লাস নেই। তাই গিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। সে যাবে না।

অভীকের মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল, দৈবাৎ। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাহিয়ার চমৎকার কার্যাবলীর আওতায় পড়ে না একমাত্র পড়ালেখা। সব শত্রুতা পড়ালেখার সাথে। সারাদিন বুদ্ধি আঁটে কিভাবে কলেজ বাঙ্ক দিবে, পড়ালেখা না করে বাঁচতে পারবে। এদিকে ওর চিন্তায় অভীকের যে শান্তি নেই তা ওর জানা নেই। মাহমুদাকে কথা দিয়েছে অভীক, তাহিয়াকে পড়ায় মনোযোগী করাবে, ভালো মানের সিজিপিএ নিয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করাবে। ভালো মানের সিজিপিএ তো দূরে থাক পাশের ও কোন লক্ষণ দেখছে না ও। ফার্স্ট ইয়ারর তিন বিষয়ে ফেইল করেছে। সামনের মাসে পরীক্ষা, অথচ বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। এভাবে থাকলে এবারও ফেইল করবে। ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলেই সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হবে, তাহিয়ার সেটা নিয়েও মাথা ব্যাথা নেই। অভীক নিশ্চিত তাহিয়াকে জিজ্ঞেস করলে, একটা বিষয়ের নাম ও বলতে পারবে না। আপাতত অভীকের একটাই চিন্তা, কিভাবে তাহিয়ার মনোযোগ পড়ায় আনবে। চিন্তায় অস্থির ও। শুধু সময়ের অপেক্ষায় তাহিয়াকে কিছু বলতে পারছেনা।

কাউকে কোন বিষয়ে বুঝানোর বা শাসনের আগে লক্ষ্য রাখতে হয়, বিপরীত পক্ষের কাছে তার গুরুত্ব কতটুকু, অধিকার কতখানি। জোর গলায় শাসনের আগে চিন্তা করতে হয়, এই অধিকার আছে না কি! শাসনের জন্য অধিকারের প্রয়োজন হয়। তারপর লক্ষ্য রাখতে হয়, স্থান, কাল ঠিক আছে কি-না। সে যদি রেগে থাকে বা উদাস থাকে তবে বুঝালে বুঝবে না, হিতে বিপরীত হবে। এক্ষেত্রে উচিত, যখন তার মন ভালো থাকে তখন বুঝানো। তারপর যখন বিপরীত পক্ষ নিজ থেকেই সেই প্রসঙ্গে টানে, এবং তার কাছে পরামর্শ চায় তখন বুঝানো উচিত। এতে করে ব্যক্তিটি সহজ কথাগুলো গ্রহণ করতে পারবে। অভীক শেষ দিকটার অপেক্ষায় আছে। সে নিশ্চিত শীঘ্রই এই সু্যোগ আসবে। তখন নরম কথায় কঠিন ধরা দিবে।

এখন রাগ দেখানোর সময় নয়, নয় বুঝানোর। লম্বা শ্বাস ফেলে চোয়াল থেকে গম্ভীরতা সরাল অভীক। কৃত্রিম হাসি টেনে পিছু ঘুরল। শান্ত স্বরে বলল,
‘কলেজ নাই-বা গেলে। অন্তত নাস্তাটা একসাথে করার জন্য হলেও উঠো?’

তাহিয়া উঠল, ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে গেল। নাস্তা সারল পাশাপাশি বসে। ফোন ওয়ালেটের জন্য রুমে এলো অভীক। পিছু এলো তাহিয়া। অভীক ফোন পকেটে রাখছিল তখন। তাহিয়া আবদার জুড়ে বসল,
‘আজ বিকেলে হাঁটতে যাবেন?’
‘বৃষ্টি না থাকলে যাব। ‘ ছোটো করে উত্তর দিল অভীক। তাহিয়া প্রসন্ন হাসল।

অভীক জিনিসপত্র নিয়ে বিদায় নিতে উদ্যত হলো। যাওয়ার আগে তাহিয়ার ভ্রু জোড়ার সন্ধিস্থলে অধর ছুঁইয়ে বলল,
‘নিজের খেয়াল রেখো। ‘

পা বাড়াল। তাহিয়া ডাকল পিছু, ‘শুনুন!’

অভীক পিছু ফিরল, ‘বলুন, হিয়ারানী?’

পরবর্তী কথা বলার আগে সময় নিল তাহিয়া। অভীক আগ্রহী চোখে চাইল শুধু। অপেক্ষার প্রহরের ইতি টেনে তাহিয়া বলল,
‘আপনার আবেগগুলো আর কারো সামনে প্রকাশ করবেন না। হোক সে কবিতা পড়তে কিংবা প্রেমময় উপন্যাসের লাইনে চোখ বুলাতে গিয়ে। কলেজে আবেগহীন, গম্ভীরই থাকুন। কোমল হওয়ার দরকার নেই। ‘

কথার সারমর্ম বুঝতেই অভীক হাসল। বলল,
‘ কে যেন বলেছিল, আমি প্রেমের ‘প’ জানি না। রোমান্টিক কবিতা কিভাবে পড়তে হয় তা জানি না। কবিতা পড়লে নাকি পত্রিকার কালামের মতো শোনায়। ‘

অবনীর সাথে বলা প্রতিটি কথা মনে রেখেছে লোকটা! আবার সঠিক সময়ে ফেরত ও দিচ্ছে! পাজি লোক! তাহিয়া দায়সারা উত্তর দিল,
‘সেটাও আমি বলেছি। এটাও আমি বলছি , যে ক্লাসে পত্রিকার কালামই পড়বেন আপনি। ওভাবে আবৃত্তি করবেন না, একদম না।’

‘এতে তোমার কী সমস্যা?’ কৌতুকের স্বরে বলল অভীক। তাহিয়ার স্পষ্ট জবাব,
‘আমারই তো সমস্যা। ওসব আবেগের মালিকানা আমার হাতে। আমার কাছে ছাড়া কারো কাছে প্রকাশ অবৈধ, নিষিদ্ধ। কিছু ব্যাপারে আমি ভীষণ হিংসুটে, ভাগ টাগ একদম পছন্দ করিনা। সহ্য করতে পারিনা। মনে রাখবেন।’

অভীক পিছু ফিরে এসে তাহিয়ার সামনে দাঁড়াল। গাল টেনে হেসে বলল,
‘আবেগগুলো আপনার জন্য জমানো ছিল বলেই পত্রিকার কালাম পড়তাম। ওভাবে পড়তেই অভ্যস্ত আমি। অভ্যাস বদলাবে না। চিন্তা করবেন না, মিসেস। ‘

চলবে.
ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here