প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-৪

0
1170

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন মাহমুদা। সবে মাথা আঁচড়াতে চিরুনি ধরেছেন, আকস্মিক মেয়ের কথা শুনে থেমে গেলেন। হাতে থাকা চিরুনিটা মেঝেতে পড়ে গেল বেখেয়ালে। তিনি অবিশ্বাস্য চোখে চাইলেন মেয়ের পানে। তারপর বললেন,
‘সত্যি! তুই বিয়ের জন্য রাজি!’

মাকে দেখে তাহিয়ার গলা পাকিয়ে কান্না আসার উপক্রম। কান্নার দলকে গলাতেই থামিয়ে মাথা নাড়ল। খুশিতে আত্মহারা মাহমুদা তড়িৎ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তার মনে হচ্ছে এমন খুশির সংবাদ তিনি ইতঃপূর্বে শুনেন নি। তার কদিনের অভিনয় কাজে দিয়েছে তবে! মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

‘আমি তোর খারাপ চাই না, আমি চাই তুই সবসময় খুশি থাক। ‘

‘আমি তো বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছি, এবার আমার সাথে স্বাভাবিক হবে?’

মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল তাহিয়া। মাহমুদা হেসে সায় জানালেন। তাহিয়া চেহারায় গম্ভীর্যতা টেনে মাথা উঠাল। মায়ের পানে চেয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘কিন্তু আমার তিনটা শর্ত আছে। এগুলো মানলেই আমি ‘কবুল’ বলব। ‘

মাহমুদা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘কী শর্ত?’

ধীর স্বরে তাহিয়া বলল,
‘প্রথম শর্ত, বিয়েটা একবারে ঘরোয়াভাবে হবে, পরিবারের বাইরে বেশি মানুষ উপস্থিত থাকতে পারবে না।
দ্বিতীয় শর্ত, বিয়ের আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করা অবধি আমি এ বাসায় থাকব। স্যারের বাসায় যাব না।
তৃতীয় শর্ত, বিয়ের কথা কলেজের কাউকে জানানো যাবে না। আমি চাই না, কেউ আমাকে নিয়ে মজা করুক।
বিয়ের কথা বলার আগে শর্তগুলো নীলিমা আন্টিকে জানিয়ে দিবে। ‘

মাহমুদার চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠল। মেয়েটা আবার কী পাগলামো শুরু করেছে! এগুলো কোন ধরণের কথা! রাগের বশবর্তী হয়ে মেয়েকে কয়েকটা কটু কথা শোনার ইচ্ছেটা জাগল, কিন্তু তিনি ইচ্ছেদের দমিয়ে রাখলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়ে রাজি হয়েছে, এখন কিছু বললে আবার বেঁকে যেতে পারে। নীলিমার সাথে কথা বলা দেখা যাক, ও কী বলে। তিনি ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে বললেন,
‘ঠিক আছে। তুই যা চাইবি তাই হবে।’

তাহিয়া মাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কান্নাদের থামানো যাচ্ছে না। মাকে দেখলেই কান্না পাচ্ছে। নিজের রুমে চলে গেল অশ্রু বিসর্জনের উদ্দেশ্যে। তাহিয়া চলে যেতেই মাহমুদা ফোন উঠিয়ে নীলিমাকে কল দিলেন। তাহিয়ার রাজি হওয়ার কথা শুনে বেশ অবাক হলো নীলিমা, সেই সাথে আনন্দিত হতেও দেখা গেল তাকে। আনন্দ মাখা চেহারার আনন্দ উবে গেল তাহিয়ার শর্তের কথা শুনে। একমাত্র ছেলের বিয়ে, আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শি ডেকে ধুমধাম করে বিয়ে দেবার ইচ্ছে তার। সবার অগোচরে এভাবে বিয়ে হয় না কি! আত্মীয় স্বজন কী বলবে! কপালে চিন্তার ভাজ পেলে ভাবতে বসলেন তিনি। ওদিকে মাহমুদা অনুরোধের সুরে বলে গেল, আপাতত তাহিয়ার শর্ত মেনে বিয়েটা হোক, পরেরটা পরে দেখা যাবে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই হলো। এখন আকদ হয়ে থাকুক, তাহিয়া যখন সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নিবে তখন না হয় বড়ো করে অনুষ্ঠান করে শ্বশুর বাসায় যাবে?
বান্ধবীর অনুরোধ ফেলতে পারল না নীলিমা। ইতিবাচক উত্তর দিলেন। মাহমুদা ভেবেচিন্তে বললেন,
‘তাহিয়ার মাথায় কখন কী চলে ও ছাড়া কেউ জানে না। ‘হ্যাঁ’ কখন ‘না’ হয়ে যায় তার ঠিক ঠিকানা নেই। তাই আমি চাইছি আজই ওদের বিয়েটা পড়িয়ে দিতে। কী বলিস?’

নীলিমা তার স্বামী রেজাউল আহমেদের সাথে পরামর্শ করে সায় জানালেন। খুশিমনে ফোন রাখলেন মাহমুদা। ফিরোজ সাহেবকে ফোন দিয়ে আসতে বললেন।

ফোন রেখে নীলিমা ডাইনিং রুমে গেলেন। টেবিলে বসে সকালের নাস্তা করছে অভীক। চোখ মুখে ঘুম ঘুম ভাব। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে কি না! নীলিমা গিয়ে অবনীর পাশে বসলেন। গলা খেঁকারি দিয়ে ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। সফল ও হলেন। অভীক খাওয়া থেকে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘কিছু বলবে মা?’

নীলিমা আমতা আমতা করছিলেন। আকস্মিক বিয়ের কথা বললে অভীক আবার কেমন ভাব প্রকাশ করে তা নিয়েই ভয় তার, তিনি মাহমুদাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন, এখন ছেলে বেঁকে বসল সমস্যা।
মায়ের বিব্রতভাব দেখে আগ বাড়িয়ে বলল,
‘দারুন একটা খবর আছে অভী।’
‘কী খবর?’

কৌতুহলী চোখে প্রশ্ন করল অভীক। অবনী প্রসন্ন হেসে বলল,
‘তাহিয়া বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে। ‘

অভীক অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। এ মেয়ে কদিন আগেই তো বিয়ে না করার জন্য কাঁদছিল। আজ হঠাৎ রাজি হলো কেন! সে ভ্রু কুঁচকাল,

‘কদিন আগেই না বিয়েতে ব্যাপক অমত ছিল ওর, হঠাৎ রাজি হলো কীভাবে!’

‘আন্টি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রাজি না হয়ে উপায় নেই।’

‘ওহ।’
দায়সারা উত্তর দিয়ে খাওয়ায় মন দিল অভীক। নীলিমা আমতা আমতা করে তাহিয়ার শর্তের কথা বললেন। সেই সাথে মাহমুদার সিদ্ধান্তের কথাও বললেন। আকস্মিক বিয়ের কথায় গম্ভীর হলো অভীক। প্রথম দুটো শর্তে আপত্তি না থাকলেও কলেজে না জানানোর ব্যাপারে ও তার বেজায় আপত্তি। মেয়েটা চাইছেটা কী! বিয়ে করবে, অথচ কাউকে জানাবে না। অবিবাহিত ট্যাগ নিয়ে চলার এত শখ হলে বিয়ে করার কী দরকার! মস্তিষ্কে উঁকি দেয়া ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে মায়ের পানে চেয়ে থেমে গেল। নীলিমার চোখে মুখে চিন্তার সরু রেখা ও দেখা যাচ্ছি না, বরং উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে । তাহিয়াকে পুত্রবধূ করার ইচ্ছে যুগ দেড়েকে, সে অজানা নয় অভীকের। বহু দিনের লালিত ইচ্ছে আজ পূরণ হবে ভেবেই বিজয়োল্লাসে মেতেছে নীলিমার চোখ মুখ। মায়ের এই খুশিতে বাগড়া দিতে চাইল না অভীক। আপত্তি ঠেলে সে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘তোমার আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নেই। কখন যেতে হবে বলে দিও, আমি গিয়ে হাজির হব। ‘

নীলিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ তুই সন্ধ্যায় নীলিমার বাসায় চলে যাস। আমরা দুপুরেই চলে যাব। ‘

সংক্ষেপে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে টেবিল ছাড়ল অভীক। কলেজের জন্য তৈরি হয়ে এসে অবনীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘শপিং করতে হবে?’

‘যেমনই হোক বিয়ে তো! শাড়ি গহনা ছাড়া বিয়ে হয় না কি! টুকটাক কেনাকাটা তো লাগবেই।’ উৎফুল্লতার সাথে বলল অবনী। অভীক ওয়ালেট থেকে নিজের ক্রেডিট কার্ড বের করে অবনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘যা কেনার কিনে নিস। আসছি। ‘

অনেকটা তাড়াহুড়ায় চলে গেল অভীক। পাঁচতলা থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করল, ‘ফাজিল মেয়ে! ‘

মধ্যহ্নের প্রথম লগ্ন। আজ সূর্য্যের তাপটা অনন্যদিনের তুলনায় আজ প্রখরতা। ঝলসানো আলোতে গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। এক চিলতে রোদ এসে ঠিকরে পড়ছে তাহিয়ার রুমের বারান্দাটায়। এক মুঠো রোদ্দুর গায়ে মাখিয়ে উদাস মনে মেঝেতে বসে তাহিয়া। খানিক আগেই মাহমুদা এসে বিয়ের কথা জানিয়ে গেলেন। আকস্মিক বিয়ের কথায় বেশ চমকে উঠেছিল তাহিয়া। ‘আজই বিয়ে!’ বিস্মিত স্বরে এমন একটি কথা বলতে গিয়েও মায়ের উৎফুল্ল চেহারা আর প্রাণবন্ত হাসির দিকে চেয়ে থেমে গেল। স্মিত হেসে সায় জানিয়ে ছিল। মাহমুদা চলে যেতেই চিন্তার পসরা সাজিয়ে বসল বারান্দায়। উদাস মনে জীবনের সমীকরণ মেলাতে লাগল। এ বিয়েটায় মায়ের খুশি জড়িয়ে থাকায় ডিভোর্সের কথাও মাথায় আনতে পারবে না। মানিয়ে নিতে পারবে স্যারের সাথে? আচ্ছা, স্যার স্বামী হিসেবে কেমন হবে? লেকচারার অভীকের মতোই রাগী, গম্ভীর? কথায় কথায় তাকে ধমক দিবে, পড়ালেখার চাপ দিবে? সন্ধ্যায় বিয়ে নামক সুতোয় বেঁধে পড়ার পর থেকে কি তাকে পরাধীনতার শিকলে বেধে ফেলবেন স্যার? সব কাজে হুকুম চালাবেন? মনে চলছে জল্পনা কল্পনাদের উড়োউড়ি।

সে যখন গভীর ভাবনায় মগ্ন, তখন বারান্দায় উপস্থিত হলো তুহিন। তাহিয়ার পাশে বসে ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
‘খুব তো না না করছিলি, শেষে অভীক ভাইকেই বিয়ে করতে হচ্ছে। শুধু শুধু আগে কী ঢংটাই না করলি!’

উদাস চোখে রাগ টেনে ভাইয়ের দিকে তাকাল। কাধে থাপ্পড় দিতে বলল,
‘তুই তো দোয়া করছিলি।’

হাত ঢলে তুহিন বলল,
‘ আগে দোয়া করিনি। তবে এখন করছি, অভীক ভাই তোকে সারাক্ষণ পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখুক। বেত নিয়ে সামনে বসে থেকে পড়া ধরুক, এক ভুলের জন্য পাঁচটা আঘাত দিক। সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখুক, আমাকে দেয়া সব মার ধমক তোর উপর বর্তাক। ‘

চোখ রাঙিয়ে আরও কয়েক ঘা বসাল তাহিয়া। তুহিন ও কয়েকটা দিল। মারামারির মাঝে অবনী উপস্থিত হলো। ঝগড়া থামিয়ে শপিংয়ে নিয়ে চলল তাহিয়াকে। যদিও এতে বেশ আপত্তি ছিল তাহিয়া। তবে এ পর্যায়ে তার আপত্তি বেশি সুবিধা করতে পারল না। অবনী এক প্রকার জোরকরে নিয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে লাল বেনারসি কিনল অবনী। সাথে টুকটাক জিনিস পত্র। অভীকের জন্য কিনল মেরুন পাঞ্জাবি। শপিং শেষে ফেরার পথিমধ্যে অবনী প্রশ্ন করল,
‘হঠাৎ বিয়েতে রাজি হলি কী ভেবে?’

তাহিয়া মলিন হেসে বলল,
‘আপাতত মায়ের খুশিতে আমার খুশি।’
‘জেনে গিয়েছিস? কে বলল?’
‘মামা। আপু, মা ঠিক হয়ে যাবে তো?’ কাতর গলায় বলল তাহিয়া। এতক্ষণে বিয়েতে রাজি হওয়ার সঠিক কারণ ধরতে পারল অবনী। সে দৃঢ়তার সাথে অভয় দিল,
‘অনিশ্চয়তা নেই, ঠিক হবে। চিন্তা করিস না।’

অভীক এলো গোধূলি লগ্নে। অবনীর স্বামী আনভীর আর, বাবা রেজাউল আহমেদ ইতিমধ্যেই কাজি নিয়ে হাজির হয়েছে। মাগরিবের নামায পড়ে বিয়ের কাজ শুরু হবে। তাহিয়াকে সাজাচ্ছে অবনী। হালকা সাজে বধূর রূপ আঁকল শরীরে। উদাসীন তাহিয়ার সেদিকে খেয়াল নেই, সে নিজ ভাবনায় মত্ত।

সাজানো শেষ হলো সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। সাজানো শেষ হতেই বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। ছেলেপক্ষ বসার ঘরে, আর মেয়েপক্ষ তাহিয়ার রুমে। কাজি এসে তাহিয়াকে কবুল বলতে বললেন। মায়ের পানে চেয়ে কাঁপা স্বরে কবুল বলল তাহিয়া।
মনটা হালকা হলো মাহমুদার। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন,
‘এবার মরেও শান্তি পাব আমি।’

মায়ের মুখে ‘মৃত্যু’র কথা শুনে হু হু করে কেঁদে দিল তাহিয়া। মাহমুদা ভেবেছেন, বিয়ের ব্যাপারে কাঁদছে। বিশেষ প্রাধান্য দিলেন না।

.

বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর অভীককে তাহিয়ার রুমে নিয়ে আসা হলো। অভীকের সাথে অবনী এসেছে। মাহমুদা তখন মেয়ের পাশে বসা ছিলেন। চোখে ভেসে যাচ্ছে আনন্দাশ্রুতে। অভীককে দেখে প্রসন্ন হেসে উঠে দাঁড়ালেন। তাহিয়ার পাশে বসিয়ে বললেন,
‘বেশ মানিয়েছে তোদের।’

জবাবে অভীক কৃত্রিম হাসল। মায়ের অসুখে দুঃখবিলাসে মত্ত তাহিয়া আকস্মিক অভীকের আগমনে ভড়কাল। মেরুন পাঞ্জাবি পরিধেয় সুপুরুষ যখন তাহিয়ার পাশে বসল তখন দুঃখবিলাস ভুলে অস্বস্তিবিলাসে মত্ত হলো। রাজ্যের অস্বস্তি এসে হানা দিল তার মাঝে। ভয়ের দল এসে যোগ দিয়েছে সাথে। তাহিয়া খানিকটা সরে গিয়ে জড় হয়ে বসল।

মাহমুদা মেয়ের দু’হাত ধরে অভীকের হাতে উপর রাখলেন। চার হাত এক করে অভীকের উদ্দেশ্যে অশ্রুসজল চোখে বললেন,

‘আমার মেয়ের দায়িত্ব এই মুহুর্তে তোমার উপর ন্যস্ত করলাম। আমার বর্তমান, অবর্তমান, সবটা সময়ে ওর খেয়াল রেখো, ওকে আগলে রেখো।’

অভীক ভরসার হাসি দিয়ে বলল,

‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওর খেয়াল রাখব।’

মাহমুদা হেসে বললেন, ‘আজ থেকে আমি নিশ্চিন্ত। ‘

অবনী দুজনকে ‘একান্ত সময়’ উপহার দিতে মাহমুদার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ বিয়ে সমম্পন্ন হওয়ার পর মিষ্টিমুখ করাতে হয়, আন্টি বাইরে আসুন তো। কাজে লেগে পড়ি।’

অবনীর ইঙ্গিত টের পেয়ে দেরি করলেন না মাহমুদা, দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেলেন।

তাহিয়ার হালকা গোলাপি রঙা রুমটায় রয়ে গেল সদ্য বিবাহিত এক দম্পত্তি। তাহিয়ার হাত তখনো অভীকের হাতের মাঝে। অভীক স্পষ্ট টের পেল তাহিয়ার হাত কাঁপছে থরথর করে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক তাকাল নববধূর পানে। লাল বেনারসিতে শ্যামরাঙা মেয়েটাকে খারাপ লাগছে না। অশ্রুভেজা গালটায় হালকা মেকাপের চাপ। মেকাপের উপর স্পষ্ট ফুটে উঠেছে অস্বস্তি ভাব। হাতভর্তি চুড়ি, মাথায় লাল ওড়নার ঘোমটা টানানো। সব বেশ মানানসই লাগলেও নববধূর বিয়ের সাজে চশমা পরাটা কেমন যেন বেনামান দেখাল। অভীক গাঢ় দৃষ্টিতে চশমা ভেদ করে তাহিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তাহিয়ার দৃষ্টি অবনত, স্নায়বিক দৌর্বল্যগ্রস্থতায় ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। সেই জলের সাথে মিশে আসে, লজ্জার আর অস্বস্তির পসরা। মেয়েটা হাঁসফাঁস করছে কেমন যেন। নববধূর অস্বস্তি টের পেয়ে হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করল তাকে।

অস্বস্তিতে ডুবে থাকা তাহিয়া চাপা শ্বাস ফেলে হাত গুটিয়ে নিল। এতক্ষণ শ্বাসটা আটকে ছিল যেন। মায়ের কথা ভেবে বিয়েটা তো করে নিল, এখন এই মানুষটার সাথে মানিয়ে নিবে কিভাবে! ভাবতেই কপালে ঘাম ছুটছে। মা তো তার পুরো অধিকার অভীকের হাতে দিয়ে গেছেন, এখন অভীক যদি দুর্ব্যবহার করে? শাসনের নামে শোষন করে! তাহিয়া ভীত ঢোক গিলল। মনে মনে বলল, আল্লাহ রক্ষা করো!

নিরবতায় গা ঢেকে পাশাপাশি বসে আছে নবদম্পতি। তাহিয়া নড়াচড়া ও করছে না, নিশ্চল বসে আছে। অভীকেও কেমন অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। নববধূর সাথে কিভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতস্ততবোধ করছে। সম্মুখে দৃষ্টি রেখে ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর নিরবতায় মাড়িয়ে কথা গলা খেঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানাল দিল। তাহিয়াকে বুঝাল সে কিছু বলতে চায়, তবুও তাকাল না। নেত্রপল্লব আজ ভীষণ ভারি, উঠানো দায়।

অভীক পকেট হাতড়ে একটা চেক-সমেত খাম বের করে তাহিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ধীর স্বরে প্রথম কথা বলল,

‘তোমার প্রাপ্য দেনমোহর। নাও।’

তাহিয়া কেঁপে উঠল, না কথা বলল, আর না হাত বাড়াল। মূলত সে শ্বাসরুদ্ধতার সাথে সাথে বাকরুদ্ধ ও হয়ে গেছে। তাহিয়ার অসাড়তা দেখে অভীক নিজ উদ্যোগে বিনা স্পর্শে খামটা তাহিয়ার কোলে রেখে দিল। তারপর ধীর স্বরে বলল,

‘তোমার দেয়া শর্তের মধ্য প্রথম শর্তটি পূরণ হয়েছে। বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে, আমার সংখ্যায় বিশাল বন্ধুসমাজের একজন এবং এক ঘনিষ্ঠ গুরুজন নিয়ে বিয়েতে হাজির হয়েছি। এতে আমার মাঝে খুব একটা ভাবাবেগ নেই।

দ্বিতীয় শর্তটি ছিল, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করা অবধি তুমি এ বাসায় থাকবে তাই তো?’
উত্তরের আসায় তাহিয়ার পানে তাকাল অভীক। তাহিয়া মাথা নাড়াল। অভীক শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘বিয়েটা একবারেই আকস্মিক হয়েছে। আমি খানিকটা প্রস্তুত থাকলেও তুমি ছিলে একবারেই অপ্রস্তুত। অনেকটা বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছো। সম্পর্কটা মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগবে তোমার। আমার পক্ষ থেকে আমি তোমাকে যথেষ্ট সময় দিব। তোমার যত ইচ্ছে সময় নাও, আমার কোন আপত্তি নেই। আমি বা আমার সংসারের দায়ভার ও এখন তোমার কাধে কেউ চাপাবে না। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা অবধি তুমি এখানেই থেকো, অতি প্রয়োজন মনে না করা অবধি আমি আসব এ বাসায়। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে তুমি আগানোর আগে আমি আগাব না। সুতরাং, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। ‘

তাহিয়া শুনে গেল, রা করল না। তবে তাহিয়া টের পেল অভীকের কথায় মনে চাপা পড়া পাথরটা সরে যাচ্ছে। অভীকের সাথে থাকলে অভীকের ভয়ে তটস্থ থাকবে সে, সতেজ নিঃশ্বাস নিতে পারে না। অন্তত এ শ্বাসরুদ্ধকর মুহুর্ত থেকে বেছে যাবে। কোলে রাখা হাতের এক্সটেইনশন করা নখের দিকে নজর দিয়ে কত কী ভেবে গেল তাহিয়া। তার ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে পরবর্তী কথাটা বলল অভীক,

‘প্রথম দুটো শর্তে আমার আপত্তি না থাকলেও তৃতীয় শর্তে আমার ব্যাপক আপত্তি। বিয়ের আগে যদি তোমার সাথে কোন সম্পর্ক থাকত তাহলেও কলেজে না জানানোর ব্যাপারে আমার আপত্তি থাকত না। কিন্তু, ইতঃপূর্বে আমাদের মাঝে ছাত্রী শিক্ষকের বাইরে কোন সম্পর্ক ছিল না, এখন যে সম্পর্কটা তৈরি হয়েছে সেটা একটা পবিত্র সম্পর্ক। এ সম্পর্কের কথা সবার জানা উচিত। আমার নামে ‘কবুল’ বলার সাথে সাথে তোমার সব দায় দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বরাবরই আমি দায়িত্ব সচেতন মানুষ। আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে কুণ্ঠাবোধ করব না। কলেজের কাউকে বিয়ের কথা না জানানোর পর যদি কোনভাবে আমাদের একসাথে কেউ দেখে, তখন আমার সুখ্যাতি এবং তোমার সম্মান দুটোই যাবে একসাথে। বর্তমান সময়ে মানুষ ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক বেশি ভাবে। তারা মনগড়া একটা গল্প বানিয়ে হয়তো আমাদের বৈধ সম্পর্কটাকে অবৈধে রূপ দিবে। এখন জানালে মানুষ কিছুটা মজা করবে, কিন্তু পরে নিজে জানলে ছিঃ ছিঃ করবে। তখন ব্যাপারটা আমাদের কারো জন্য শুভকর হবে না। আমি কী বুঝাতে চাচ্ছি, তুমি কি বুঝতে পারছো?’

অভীকের কথা তাহিয়া মনের সরে যাওয়া পাথরটা আবার চেপে বসল। অভীক যে পরোক্ষভাবে কলেজে জানানোর কথা বলছে তা বুঝতে বাকি রইল না তাহিয়ার। আতঙ্কে মুখ নীল হয়ে গেল তার। কদিন আগে অন্য ডিপার্টমেন্টে এক স্যার ছাত্রীকে বিয়ে করেছিল শুনে তিন বান্ধবী মিলে কতই হাসিঠাট্টা করল, এখন তাদের বিয়ের কথা প্রকাশ হলে সবাই তেমনই হাসিঠাট্টা করবে! তাকে দেখলেই স্যারের বউ বলে ক্ষেপাবে। সবচেয়ে বেশি হাসবে, অভীককে তার দেয়া অভিশাপ আওড়িয়ে। এমন হলে তার কলেজ যাওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে।

তার নিরবতায় অভীক বলল,
‘ তোমার সম্মানরক্ষার দায়িত্ব আমার। আমি চাইনা ভবিষ্যতে কেউ তোমাকে খারাপ ভাবুক, তাই আমি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে তোমার আপত্তি আছে?’

সাহসের অভাবে আপত্তি জানাতে পারল না তাহিয়া। এই স্যারের সামনে এলেই কথা বন্ধ হয়ে যায় তার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। উত্তরের আশায় অভীক তাহিয়ার নতমুখে তাকাল। তাহিয়ার কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। অস্বস্তি আর লজ্জার আভা থাকলে ও চিন্তার অস্তিত্ব কিছুক্ষণ আগে ও ছিল না। মেয়েটা কেমন আমতা-আমতা করছে। বোধহয় কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। অভীক যা বুঝার বুঝে নিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ ঠিক আছে। তোমার যখন এতই আপত্তি, তবে আমাদের বিয়ের কথা জানাব না। ‘

পড়ন্ত বিকেলে নীলাভ আকাশে যেমন আকস্মিক শুভ্র মেঘের দল হানা দেয়, তেমনি অভীকের কথা শুনে তাহিয়ার রক্তশূন্য চোয়ালে রক্ত হানা দিল। চিন্তার ভাজ সরে গেল তড়িৎ। চাপা শ্বাসে ঝরে গেল আতঙ্ক।

তাহিয়ার পরিবর্তিত চেহারাকে পরখ করে মুখ ঘুরাল অভীক। আলাপ দীর্ঘ করার কোন কথা খুঁজে না পেয়ে নিস্তব্ধতার চাদরে গা ঢাকল। তাহিয়াও নিরব। রুমটায় পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেল। হাত ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়াল অভীক। দশটা বাজতে চলল, বাসায় ফিরতে হবে। মেরুন পাঞ্জাবি টেনে ঠিক করে সামনের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। কদম পিছিয়ে তাহিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।

তাহিয়া অপ্রস্তুত ভঙিতে সরে এলো। অভীক কী করতে চাইছে তার ধারণার বাইরে। তবে মনে উঁকি দেয়া জল্পনা সত্য হলে অস্বস্তিতে জ্ঞান হারাবে। তার জল্পনাকে ভুল প্রমাণ করে অভীক আলতো হাত রাখল তার মাথায়। দেনমোহর পরিশোধের পর এটা অভীকের নিজ উদ্যোগের প্রথম স্পর্শ, বৈধ স্পর্শ। হৃদপিণ্ড তড়িৎ প্রবাহের স্পন্দন করল। অভীক কোমল স্বরে বলল,

‘ আকস্মিক বিয়ের চাপটা মাথা থেকে সরিয়ে স্বাভাবিক হওয়া চেষ্টা কোরো। নিজের খেয়াল রাখবে, সেই সাথে আন্টিকে সময় দিবে। এখন তোমাকে আন্টির ভীষণ প্রয়োজন । পড়াশোনাটা ঠিক ভাবে করবে। এবার অন্তত কলেজ ব্যাঙ্ক দেয়ার চিন্তাটা বদলিয়ে পড়ায় মনোযোগী হও। ভালো থেকো, আসি।’

কথা শেষ করে চলে গেল অভীক। তাহিয়া চেয়ে রইল তার যাওয়ার পানে। বিস্ময়, অস্বস্তি, লজ্জায় মিলেমিশে একাকার সে। অভীকে যেতেই অবনী এসে হেসে বলল,

‘অবশেষে অভিশাপ দেয়া স্যারের বউ হয়ে গেলি। এখন শুধু দোয়া কর, অভিশাপ যেন না লাগে। লাগলে নিজের অভিশাপে নিজেই শেষ হয়ে যাবি রে তাহিয়া। আমার তো চিন্তায় আজ ঘুম হবে না।’

সে কী হাসি অবনীর! তাহিয়া ভীত ঢোক গিলে বিড়বিড়িয়ে বলল, আল্লাহ রক্ষা করো!’

*
প্রথামাফিক আজ রাত কনে বাড়িতে থাকার কথা অভীকের। কিন্তু অভীক রাতের খাবার খেয়েই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে থাকার জন্য জোর করলেন মাহমুদা। দুজন কাছাকাছি থাকলেই ভাব ভালোবাসা তৈরি হবে। বিয়ে করেই বউ ছেড়ে দূরে থাকা, এ কেমন কথা! নীলিমাও বান্ধবীর কথায় একমত। ছেলেকে থাকার কথা বললেন কয়েকবার। অভীক মানতে নারাজ, কাজের বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। পারতপক্ষে, নববধূর অস্বস্তি কমানোর প্রক্রিয়া ছিল এটি। সিদ্ধান্তটা তাহিয়া কাঁপতে থাকা হাত দেখেই নিয়েছিল। যাবার পথে অবনী বিরক্তভরা চোখে বললেন,

‘ বিয়ের দিন বউ ছেড়ে পালানো, কোন ধরনের কথা?’

অভীক রগড় করে বলল,
‘ আমি আর পাঁচমিনিট তাহিয়ার সামনে থাকলে, অস্বস্তিতে জ্ঞান হারাতো ও। মাঘ মাসের পথচারীদের মতো যেভাবে কাঁপছিল, অবস্থা বেগতিক হলে এতক্ষণে তুই গাড়ির বদলে হাসপাতালে থাকতি। কৃতজ্ঞ থাক।’

খানিকক্ষণ চুপ রইল অবনী। তারপর প্রসন্ন হেসে বলল,
‘বিয়ে করতেই বউয়ের জন্য কত চিন্তা! ‘

‘বউ’ কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকাল অভীক। চোখের সামনে ভাসল তাহিয়ার ভীত চেহারা ভাসল। তাকে অভিশাপ দেয়া মেয়েটা তার স্ত্রী! ভেবেই কেমন অবাক লাগল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here