প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-১০

0
1233

প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

স্বরে নিস্তব্ধতার চাদর জড়িয়ে বসে আছে তাহিয়া। চোখ বন্ধ তার। ব্যাথার তীব্রতাকে আঁধারে বিলীন করার চেষ্টায় মত্ত সে। কিন্তু আদৌ সফল হচ্ছে? এই যে সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটা উদ্ধিগ্নমনে তাকে ওষুধ খাইয়ে ছাদে নিয়ে এলো, শুধুমাত্র তার অনুস্থতা কমবে বলে। কিন্তু আদৌ কমল? টের পাচ্ছে না তাহিয়া। বরং ক্ষণে ক্ষণে তীব্রতা টের পাচ্ছে। তাহিয়া মনে মনে কত প্রার্থনা করছে, তার ব্যাথা নিরাময় হয়ে অভীকের চিন্তা দূর হয়ে যাক। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। বাসায় গিয়ে ঘুমে বিভোর হওয়া ছাড়া এ পীড়া শেষ হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অভীককে চিন্তার সাগরের মাঝ থেকে তীরে আনতে হলেও বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। তাহিয়া নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করেই জিজ্ঞেস করল,
‘ বাসায় কখন যাব?’

তাহিয়ার পাশে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অভীক। এক হাত প্যান্টের পকেটে, অন্য হাতে পেটের বরাবর তোলা, হাতের মুঠোয় ফোন। দৃষ্টি, ফোনের মাঝে নিবদ্ধ। মাঝে মাঝে ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাহিয়াকে পরখ করছে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে কেমন নিশ্চুপ বসে আছে! একটু নড়চড় অবধি করছে না। ব্যাথার পরিমাণ কি এতোই বেশি? জানতে উদ্ধিগ্ন হলো মন। সে ধীর স্বরে প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল,
‘ব্যাথা বেড়ে গিয়েছে?’

তাহিয়া নড়েচড়ে বসল। নেত্রপল্লব আলাদা করে তাকাল অভীকের দিকে। অভীকের চোখে মুখে ভাসছে হাজার অভিপ্রায়। এ অভিপ্রায়ের কেন্দ্রবিন্দু সে। নিজের জন্য কারো চোখে উদ্ধিগ্নতা দেখে ভালো লাগছে। তবে সেই চিন্তার রেখা গাঢ় করতে ইচ্ছে হলো না তাহিয়ার। সঙ্গীর চিন্তা কমাতে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘এতটাও না। বাসায় গিয়ে ভালো একটা ঘুম দিলেই সেরে যাবে।’

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না অভীক। ফোনে চোখ রেখে ভাবনায় ডুব দিল। ফোনের সাদাটে আলো এসে পড়ছে অভীকের চোখমুখে। তাহিয়া অপলকে চেয়ে রইল অর্ধাঙ্গের পানে। ল্যাভেন্ডার কালার টি-শার্টটায় ভালো দেখাচ্ছে লোকটাকে। এখন গম্ভীর দেখাচ্ছে না আবার প্রাণবন্ত ও দেখাচ্ছে না। দুটোর মধ্যবর্তী একটা আভা তার মুখে, কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে উদাসী চেহারায় ফোন দেখছে। চেহারা থেকে চিন্তার রেখা সরে গেলে তাকে প্রাণবন্ত দেখাবে, তখন বোধহয় দেখতে আরও ভালো লাগবে।

ভাবনার সমাপ্তি টেনে অভীক বলল,
‘ ন’টা বাজতে চলল এখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। শুরু হতে দশটা বাজবে বোধহয়, শেষ হতে হতে বারোটা । মাঝরাতে বাসায় ফেরা নিরাপদ হবে না। তা ছাড়া, এই অবেলায় আপু ছাড়বে না। রাতটা এখানে থাকলে খুব কি অসুবিধা হবে?’ অভীকের স্বরটা বেশ কোমল।

আঁতকে উঠল তাহিয়া। অবনীর বাসার বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী এই ভিড়ভাট্টায় ঘুমানো তো দূরে থাকা পা মেলে বসার জায়গা ও পাবেনা। রাতটা না ঘুমিয়ে পার করতে হবে। না ঘুমালে মাথা ব্যাথায় উন্মাদ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। একপালে চিন্তার ভাজ তুলে তাহিয়া বলল,

‘আপুর বাসায় অনেক মানুষ। মানুষের ভীড়ে ঘুমানোর জায়গা হবে বলে মনে না। মাথা ব্যাথা নিয়ে যদি রাত জাগি তবে সকালে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব। ‘

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অভীক। তারপর শান্ত, কোমল স্বরে বলল,
‘বাসায় উপস্থিত প্রায় সব অতিথির বাসা এই এলাকাতেই। অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই বাসায় ফিরে যাবে । তখন তুমি ঘুমানোর জায়গা পেয়ে যাবে।’

তাহিয়া হাফ ছেড়ে বলল,
‘তাহলে সমস্যা হবে না। আমার নিরিবিলি একটা জায়গা হলেই হবে।’

অভীক আলতো স্বরে বলল,
‘ আমি থাকতে তোমাকে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। চিন্তাগুলো আমার মাথায় ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হও। ‘

ইশ! কী সুন্দর কথা! বাক্য দুটো সরাসরি তাহিয়ার অন্তরের অন্তস্থলে গিয়ে ধাক্কা খেল। হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দিল। বহুকালের অচেনা এক প্রশান্তির সাথে পরিচিত হলো তাহিয়া। এই ক্ষণে ওঁর মনে হচ্ছে, ওঁর জীবনে কেউ আছে, আগলে রাখার একটা ঢাল আছে, মাথার উপর একটা ছাদ আছে। যার কাছে সে ভীষণ বিশেষ। তাহিয়া প্রসন্নচিত্তে হাসল। সেই হাসিটা অভীকের অগোচরে আঁধারে মিলিয়ে গেল।


দশটা বাজতেই অবনীর ফোন পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে নিচে নামল অভীক। কেক কাটা হয়নি তখনো। সবাই হলরুমে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। নীলিমা, রেজাউল আহমেদ, অভীক, তানভীর, অবনী সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে টুকটাক আলাপ করছে।
তাদের পাশে সোফায় বসে আছে তাহিয়া। চশমা পরা নববধূ বসে আছে ঘাপটি মেরে। চারদিকে থেকে আসা হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে মাথা ব্যাথাটা আরও বেড়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে রুমে যাওয়া বেমানান বলে এখানেই বসে আছে। হা হুতাশ করার সুযোগহীনতায় কপাল কুঁচকে ব্যাথা হজম করছে। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে কেঁদে ভাসাত। এতটাই অসহনীয় ব্যাথা! ওঁর ব্যাথা সংবরণের মাঝে সামনে এসে দাঁড়াল হলো অয়ন। সাদা শার্টের উপর গাঢ় নীল ওয়েস্ট কোট পরেছে। শুভ্র বর্ণের শরীরটায় ভীষণ মানিয়েছে । অয়নকে পরখ করে তাহিয়া হাসল। গাল টেনে বলল,
‘কিউট লাগছে তোমাকে।’

চমৎকার হাসল অয়ন। তারপর বলল,
‘ তুমি আমাকে কী গিফট দিবে, মামী?’

তাহিয়ার কাছে তার উদ্দেশ্যে ‘মামী’ ডাকটা বেমানান লাগছে। ওঁর মনে হয়, মামীদের হওয়া উচিত বয়স্ক। ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবে। ননাশ,ননদের সন্তানকে ‘বাবা, মা’ সম্বোধন করে কথা বলবে। এমন হলেই ব্যাপারটা মানানসই হবে। তা না, সে হয়ে গেল মামী। তার এখনো মামী হওয়ার বয়স হয়েছে? নানান আপত্তিতে মন ঠেসে থাকলেও মুখ অবধি আনতে পারে না। সব ঠেলে ঠুলে মনেই চাপা দিতে হয়। তাহিয়া হেসে বলল,
‘তোমাকে ইয়া বড়ো একটা গাড়ি দিব। চলবে?’

অয়ন এদিক ওদিক মাথা নাড়াল,
‘না। আমার গাড়ি লাগবে না। আমার অন্য কিছু চাই।’

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। এখন ছেলেটা অন্য গিফট চাইলে এনে দিবে কিভাবে! সময়, সুযোগ কোনটাই নেই। তাও শুনতে চাইল,
‘তা, কী চাই তোমার?’

‘আমার একটা বোন চাই। আমাকে একটা বোন এনে দাও! ওই যে ছোটো ছোটো হাত পা থাকে, আধো আধো ভাবে আ উ করে। আমার বন্ধু রাফিদের বোনের মতো কিউট একটা বোন এনে দাও না! প্লিজ মামী!’

কোমল স্বরে আবদার করল বাচ্চাটা। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তাহিয়া। লজ্জায় গাল লাল হলো তার। ছেলেটা আদৌ জানে, সে কী বলছে? আড়চোখে একবার অভীকের দিকে তাকাল, নাহ্! অভীক বাবা মায়ের সাথে কথা বলছে। ধ্যান মন এদিকে নেই। যার অর্থ, অভীক শুনেনি। তাহিয়া হাফ ছাড়ল। ঘটনা চার কান হওয়ার আগেই ধামাচাপা দিতে অয়নের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

‘তোমার মাকে গিয়ে বলো। তোমার মা এনে দিবে একটা বোন।’

অয়ন দুঃখমাখা গলায় বলল,
‘মাকে বলেছিলাম। মা বলেছে তোমাকে বলতে। প্লিজ, মামী দাও না! আমি তোমাকে আমার জমানো সব টাকা দিয়ে দিব।’

কী বলবে তাহিয়া! এমন হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে ইতঃপূর্বে পড়েনি। কেউ এমন আবদার করেনি কখনো। তাহিয়া অসাড় হয়ে বসে রইল। ভেবেছিল, উত্তর না পেয়ে অয়ন চলে যাবে এবং ঘটনা এখানেই নির্মূল হয়ে যাবে। অভীকের সামনে তাকে লজ্জায় পড়তে হবে না।

তাহিয়ার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে অয়ন গেল অভীকের কাছে। অভীকের হাত ধরে হালকা নাড়াল,
‘মামা?’

বাবা মায়ের সাথে কথা বলছিল অভীক। অয়নের ডাকে কথা থামিয়ে পাশে তাকাল। অয়নের ইঞ্চি তিনেক লম্বা ঝরঝরে চুলে হাত বুলিয়ে হেসে বলল,
‘ কী, মামা?’

‘মামী আমাকে বার্থডে গিফট দিচ্ছে না, তুমি বলো না মামীকে।’ অভিযোগের সুরে বলল অয়ন।

তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল অভীক। তড়িৎ চোখ সরাল তাহিয়া। চোখে মুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অভীক হালকা ঝুকে অয়নের কাধে দু’হাত রেখে বলল,
‘মামী তোর জন্য গিফট এনেছে তো। ‘
‘ওটা না।’
‘তবে কী চাই তোর? যা মামী তোকে দিচ্ছে না, আমাকে বল দেখি। আমি দিতে পারি কি না!’

তাহিয়া মুখ খিচে বসে আছে। বিড়বিড় করছে, প্লিজ অয়ন, ‘বোন’ চাওয়ার কথা বলিস না। অন্য যা ইচ্ছে তা বল। এসব বললে লজ্জায় মরে যাব আমি। দোহাই লাগে বলিস না! আল্লাহ, ওকে থামাও! লা ইলাহা ইল্লা আনতা…

দোয়া ইউনুসের বাকি অংশ পড়ার আগে অয়ন বিস্ফোরণ ঘটাল। আবদারের সুরে বলল,
‘মামীকে বললাম একটা বোন এনে দিতে। মামী দিচ্ছে না। তুমি পারবে আমায় একটা বোন এনে দিতে?’ উত্তরের আশায় চেয়ে রইল অয়ন।

অয়নের কথা বোধগম্য হতেই বিস্ফোরিত চাহনিতে চাইল অভীক। ক্ষণেই খু খু করে কেশে উঠল । বাবা মা পাশে দাঁড়ানো। সে কী বিব্রতকর পরিস্থিতি! আড়চোখে তাহিয়ার দিকে তাকাল। লজ্জায় চোখ মুখ খিচে বসে আছে মেয়েটা। চোখ সরাল তড়িৎ। সটান দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু করছিল। প্রথমবারের মতো ছেলের লজ্জিত মুখ দেখে শব্দযোগে হেসে উঠলেন নীলিমা। রেজাউল আহমেদ না শোনার ভান করে অন্যদিকে চলে গেলেন। আগুনে ঘি ঢালল অবনী। ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘দ্যাখ আমার একটা মাত্র ছেলে। ওর কোন আবদার আমরা অপূর্ণ রাখিনি। আমরা চাইনা অয়নের কোন আবদার অপূর্ণ থাকুক। জন্মদিনে ছেলেটা একটা বায়না ধরেছে। মামা হয়ে ওর আবদার পূরণ কর! এতে তোরও কিন্তু ব্যাপক লাভ আছে, বাবা টাবা হয়ে যেতে পারবি ফ্রিতে। ‘ বলে ঠোঁট চেপে হেসে উঠল।

অভীক নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে। দেহ ভঙিমায় অপ্রস্তুত ভাব। হলরুমে ঘটনা জানাজানি হতে সময় লাগল না। চার কান হতে হাসির রোল পড়ল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে তাহিয়া। কোলে দু’হাত মুঠোবন্দি করে রাখা, চোয়াল ঢাকা লজ্জার আভায়। লজ্জায় মাথা ব্যাথা ভুলে বসেছে।
বিড়বিড় করছে, আল্লাহ মাটি ফাঁক করে দাও।

অয়নের কেঁদে দেয়ার অবস্থা। ভাবখানা এমন যেন সে কোন খেলনার জন্য কাঁদছে,

‘ আমাকে একটা বোন এনে দাও। না দিলে আমি কেক কাটব না। রাফিদের বোন থাকলে আমার কেন থাকবে না, আমার ও বোন থাকতে হবে। তোমাদের এনে দিতে হবে। আমার বোন চাই।’

নীলিমা মৃদুহাসি দিয়ে বললেন,
‘ অভীক-তাহিয়া, এই জন্মদিনে নেতিবাচক কথা বলে ওর মুড অফ করিস না তোরা। বড্ড আশা নিয়ে এসেছে আমার নাতিটা। মামা, মামী হিসেবে তোদের ও তো কিছু দায় দায়িত্ব আছে। দিবি টিবি বলে দে। এই উসিলায় দাদী হয়ে গেলে মন্দ হয়না।’

‘বউ সামলাতে গিয়ে আমি নাস্তানাবুদ । হাজার চেষ্টা করেও কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামি দূর করতে পারিনি। তোমরা এসেছো বাচ্চার আবদার নিয়ে। বউ নিজের হলেই তো বাচ্চা হবে, বউ তো এখনো দূরসম্পর্কের। আবার আসবে বাচ্চা! লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লা।’
বিড়বিড় করে তীর্যক চোখে তাহিয়ার দিকে চাইল। লাজুকলতার মতো নেতিয়ে পড়বে যে কোন সময়। এ না কি আবার বাচ্চার মা হবে! হাস্যকর।

তানভীর শ্যালকের কাধ চাপড়ে হাস্যরসের সাথে বলল,
‘পরের জন্মদিনে ওকে একটা বোন উপহার দিতেই পারো শালাবাবু। আমার ছেলেটা বেশি কিছুতো চায়নি, শুধু একটা বোনই তো চেয়েছে। এনে দাও।’

অভীক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি এসেছে, সব ঠান্ডা মাথায় সামলেছে। অথচ এই মুহুর্তে এসে সে এলোমেলো হয়ে গেছে। এই জটিল মুহুর্তে কিভাবে কাটাতে হয় জানা নেই তার। সে স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা।

অয়ন উত্তর না নিয়ে কেক কাটতে যাবে না। চোখে পানি চলে এসেছে, ঠোঁট উল্টাতে শুরু করেছে। যে কোন মুহুর্তে কার কান্নার আওয়াজ দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হবে। তার বোন চাই-ই-চাই। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজ উদ্যোগে ঘটনা সমাধানে নামল অবনী। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলল,

‘বোন আসতে সময় লাগে তো বাবা। এখন যদি কেক কেটে মামা মামিকে খাইয়ে দিতে পারিস, তবে পরের জন্মদিনে তারা তোকে বোন এনে দিবে। চল, এখন কেক কাটি।’

অয়ন অভীক তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মামা মামী বলছে না কেন!’
‘ওরা লজ্জা পাচ্ছে।’
মুখ চেপে হাসল অবনী। অয়ন আবার প্রশ্ন করল,
‘কেন লজ্জা পাচ্ছে?’

অবনী ছেলেকে টেনে আনল। এ ছেলের সব সময় উদ্ভট প্রশ্ন। এখন এই প্রশ্নের জবাব কী দিবে! বদ্ধমূল বিষয় আশয়, ব্যাখ্যা করতে গেলে লজ্জাকর বিষয়ে গিয়ে ঠেকবে। কোনমতে কথা ঘুরিয়ে অয়নকে কেকের সামনে দাঁড় করাল। কেক কাটার পর্ব শুরু হলো । অভীক চোখ মুখ স্বাভাবিক করে তাহিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু হয়নি এমন ভান করে বলল,
‘ কেক কাটা হচ্ছে, আসো।’

‘আমি জীবনে এই পাঁজি ছেলের সামনে যাব না। কী লজ্জায় ফেলল! ভরা মজলিসে কী লজ্জাই না পেলাম! বেয়াদব ছেলে! দুনিয়ার আর মানুষ পেলি না, আমাকে ধাক্কা দিয়ে লজ্জার কুয়োয় ফেলতে হলো তোর! বেয়াদব।’
মনে মনে অয়নের উপর রাগ ঝাড়ল তাহিয়া। ঠায় বসে রইল। অভীক তাহিয়ার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘এত লজ্জা টজ্জার কিছু নেই। এসব সময়ের ব্যাপার। সময়মতো আপনাআপনি হয়ে যাবে। আমি প্রেশারাইজ না করলেই হলো। আসো। এখন লজ্জা পেয়ে বসে থাকলে আবার কৌতুকের কেন্দ্রবিন্দু হবে। ‘

আপনাআপনি হবে? কীভাবে বলে লোকটা! লজ্জাসরম নেই নাকি! আর লোকটা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, অথচ কিছুক্ষণ আগে নিজেই লজ্জায় লাল হচ্ছিল। বারবার আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিল। ঘোমটা আর চশমার ফাঁকে ঠিকই ঠাহর করেছে সে। চশমা পরার এই এক সুবিধা। চোখ লুকানো যায়। অস্বস্তিঘন চোখ জোড়া মেলে ধরল তাহিয়া। তারপর উঠে দাঁড়াল। অভীকের দিকে না তাকিয়ে সামনে হাটা ধরল। এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল।

কেক কাটার পরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হলো।
খাবার টেবিলে অভীকের একপাশে বসেছে তাহিয়া অন্য পাশে বসেছে নীলিমা। জীবনের বিশেষ দুই নারীর মাঝে বসেছে অভীক। দু’জনের পাতে নিজ উদ্যোগে এটা ওটা নিয়ে দিচ্ছে । মা, চিকেন রেজালা দিই? তাহিয়া, তুমি নিবে? মা চিংড়িটা ভালো হয়েছে, খেয়ে দেখো? তাহিয়া আচারটা টেস্ট করে দেখো? বিরিয়ানি সাথে খেতে ভালো লাগবে। তাহিয়া হ্যাঁ না করছিল, অভীক অল্প অল্প করে দিল। মায়ের পাতে নিজ থেকেই তুলে দিচ্ছে। সব শেষে নিল নিজের পাতে।

টেবিলে দশজন বসেছে। ওরাসহ অবনীর ননদ, ননাশ, ওদের ছেলেমেয়েরা। অবনী খাবার আনা নেয়া করছে। মাঝে একবার এসে অভীককে বলল,
‘আমি তাড়াহুড়ায় তাহিয়ার খাওয়া দাওয়ায় খেয়াল রাখতে পারছিনা। তুই একটু দ্যাখ, ওর কী লাগে না লাগে। ‘

অভীক বোনকে আশ্বাস দিয়েছে,
‘আমি আছি ওর জন্য। তুই যা।’

অবনী দায়িত্ববান ভাইয়ের কাধে দায়িত্ব চেপে দৌড়াদৌড়িতে মত্ত হলো। খাবারের ফাঁকে অবনীর ননাশ মনিরা সুলতানা অভীকের কার্যাদি পরখ করে বললেন,
‘ বউয়ের বেশ খেয়াল রাখছো দেখি, অভীক!’

‘ওর এখানে আসার উসিলা যেহেতু আমি, তাই খেয়াল রাখার দায়িত্বটাও আমার। ‘ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে উত্তর দিল অভীক।

তাহিয়া খাওয়া থামিয়ে বিড়বিড়াল, ‘এই লোকের সাথে টানা একদিন থাকলে আমি বোল্ড হয়ে যাব। অতল প্রেমের সাগরে ডুবে যাব। তিনবছরের ইনিংস তিনদিনে ঘোষণা করব । এসব কেয়ার আমাকে বাধ্য করবে নিশ্চিত।’

তাদের খেয়ে উঠার পর পুরুষদের সাথে খেতে বসলেন রেজাউল সাহেব। অভীক বেসিনে হাত ধুচ্ছে তখন। হাত মুছে এসে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ বাবা, খালি পেটে ওষুধ আছে তোমার। খেয়েছো?’

সবে পাতে হাত দিয়েছেন রেজাউল সাহেব। ছেলের কথায় ভাত মাখতে গিয়ে থেমে গেলেন। হতাশ সুরে বললেন,
‘ভুলে গেছি।’

রেজাউল আহমেদ খাবার ছেড়ে উঠতে নিলেন। অভীক বাবাকে থামিয়ে বলল,
‘তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি।’

দ্রুত বেগে গিয়ে বাবার ব্যাগ হাতড়ে ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো। খোসা ছাড়িয়ে হাতে দিল। গ্লাসে পানি ও ঢেলে দিল। ওষুধ গিলে সুপ্রসন্ন হাসলেন রেজাউল সাহেব। ছেলেটা সবার প্রতি যত্নবান।

খেয়ে মেহমানরা চলে গেল। বাসা খালি হয়ে যাওয়ার পর তাহিয়াকে কোণার একটা রুম দেখিয়ে অভীক বলল,
‘যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও। ‘

তাহিয়া চলে গেল। অভীক অন্য একটা রুমে প্রবেশ করল। বিছানা ঝাড় দিল, অবনীর কাছ থেকে মশারী নিয়ে টাঙাল। মশারী জাঝিমে গুজে বেরিয়ে আসতেই দেখল দরজায় বাবা মা দাঁড়ানো। রুমের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
‘অনেক রাত হয়েছে, এবার শুয়ে পড়ো তোমরা। ‘

নীলিমা মুগ্ধঘন চোখে চেয়ে হাসলেন। শুনেছে বিয়ের পর ছেলেরা বদলে যায়। বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবা মায়ের দায়িত্ব ভুলে বসে। অথচ তার ছেলেটা একসাথে ছেলে,স্বামী দুই দায়িত্বই পালন করছে।

অবনীর বিয়ের আগে বাবা মায়ের খেয়াল রাখতো সে। বিয়ের পর অভীক নিয়েছে সেই দায়িত্ব, সব দিকে খেয়াল থাকে তার।
প্রতিরাতে বাবা মা শোবার আগে বাবা মায়ের বিছানা ঝাড়ু দিয়ে মশারী টাঙাতে ভুলে না, মা বাবার কখন ওষুধ খেতে হবে তা তাদের মনে না থাকলেও অভীকের থাকে, ফজর নামাযের এলার্মটা অবধি ফোন সেট করে দিয়ে যায়। ছোটো থেকে ছোটো জিনিস খেয়াল থেকে ওর। অভীককে নিজের বিছানা ঝাড়ু দিতে দেখে নীলিমা প্রায়শই বিরক্তিস্বরে বলেন,
‘ ঝাড়ু আমাকে দে, এসব মেয়েদের কাজ। ‘

অভিক তখন হেসে বলে,
‘বাবা মায়ের দায়িত্বের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে আবার আলাদা আছে না কি! বাবা মাকে ভালো রাখাটাই মূল। ছেলে কি মেয়ে, তা মূখ্য নয়।’

তখন নীলিমা হাসেন,প্রশান্তিতে বুকটা ভরে আসে। ছেলেটাকে দেখলেই কেমন মগ্ধতা ভর করে, একবারেই অনিন্দ্য সে।

বাবা মাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে অভীক বেরিয়ে এলো। মেয়েটার কিছু লাগবে কি না দেখা দরকার। স্বামী হিসেবে মেয়েটার নিরিবিলি ঘুমের ব্যবস্থা করা এখন একমাত্র কাজ।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here