প্রেমের জোয়ার ভাটা পর্ব ৩

0
532

#প্রেমের_জোয়ার_ভাটা
#পর্ব_০৩
#অধির_রায়

প্রাণের চেয়েও বন্ধু আজ চিরশত্রু। যাকে ছাড়া এক মুহুর্ত কল্পনা করা যেত না আজ তাকে সহ্য করতে পারে না৷ তার অস্তিত্বে দেহের প্রতিটি শিরার রক্ত গরম হয়ে যায়৷ ঘৃণায়, রাগে, ক্ষোভে মে’রে ফেললেও হাত কাঁপবে না৷ ইহান আরুশকে তাদের বাড়িতে দেখেই রাগে রাগান্বিত হয়ে যায়৷ বিদ্যুৎ গতিতে তেড়ে আসে আরুশের দিকে৷ কিছুতেই আরুশকে বাঁচিয়ে রাখবে না৷ একমাত্র আদরের বোন মীরা তার জন্য চোখের জল ফেলে৷ দিন কাটে বিষাদময়। ইহান চিৎকার করে বলল,

“তুই আমার বোনের জীবনটা নরগ বানিয়ে দিয়েছিস৷ আবার এসেছিস আমার বোনকে নরগের অগ্নিতে পোড়াতে ৷ ডিভোর্সের পর কেন এখানে এসেছিস?”

আরুশ ভেজা গলায় বলল,

“আমাকে একবার মীরার সাথে দেখা করার সুযোগ দে৷ আমি আমার মেয়েকে একবার বুকে জড়িয়ে আদর করতে চাই৷”

ইহান ঘৃণায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছে৷ কর্কশ গলায় জবাব দিল,

” তোর চাওয়া কোনদিন পূর্ণ হবে না৷ তোকে দুই মিনিট সময় দিচ্ছি৷ দুই মিনিটের মধ্যে তুই আকন্দপুর থেকে না গেলে তোর রক্তে রাঙাবো মীরার পদচরণ। অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছি। আর তোকে সহ্য করতে পারছি না। এখনই তুই এই আকন্দপুর থেকে চলে যাবি।”

আরুশ বিনয়ী স্বরে ভেজা গলায় বলল,

“তুই তো আমার বন্ধু। প্লিজ বন্ধু হয়ে একবার মীরার সাথে দেখা করতে দে। আমি আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে চাই। বাবার সোহাগ পেতে চাই। আমাকে বাবার সোহাগ থেকে আলাদা করিস না।”

আরুশের কথাই ইহানে অনেক রাগ হয়। ইহান রাগের মাথায় আরুশকে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়৷ ইয়ানে মা বাবা এসে ইহানকে আটকায়। ইহান চিৎকার করে বলল,

“তোর মতো বেইমানের মুখে বন্ধ কথা সোভা পায়না৷ অপবিত্র করবি না বন্ধু শব্দকে৷”

কপাটের ওপার থেকে মীরা আরুশের আত্মনার্ত শুনছে। মীরা রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় আরুশের সামনে আসছে না৷ কিন্তু ভালোবাসার মানুষের আঘাত সহ্য করতে পারছে না। যেন আরুশের প্রতিটি আঘাত মীরার গায়ে লাগছে৷ মীরা নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ কপাট খুলে আরুশের সামনে দাঁড়াল। আরুশ মীরাকে এক পলক দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল৷ মীরার হাত ধরতেই মীরা কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ ঘৃণায় উচ্চ স্বরে বলল,

“আপনাকে কতোবার বলছি আমার সামনে আসবেন না৷ মীরা নামে এখানে কেউ থাকে না৷ মীরা মা’রা গেছে৷ আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে আসলে আমার মৃত দেহ দেখতে পারবেন৷ চলে যান আমাদের বাড়ি থেকে৷”

মীরার কথায় আরুশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ সেই চঞ্চল হাসিখুশি মেয়েরার মুখে তীরের মতো কথা৷ প্রতিটি কথা বিষাক্ত তীরের মতো বুকের কোণে লাগছে৷ মস্তিষ্কের নিউরনে মীরার কথা নাড়া বাজছে। আরুশ কিছু বলতে নিবে তার আগেই মীরা আরুশকে থামিয়ে বলল,

“আপনার কোন কথা শুনতে চাইনা৷ আপনি যদি এখান থেকে না যান তাহলে মা, মেয়ে একসাথে আপনার সামনে দেহত্যাগ করব৷”

আরুশ কিছু বলতে পারল না৷ মীরা দৌড়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল৷ আরুশের কথা শোনার মতো ধৈর্য বা সময় কোনটায় নেই মীরার কাছে৷ ব্যর্থ হয়ে আরুশকে ফিরে আসতে হয় ঢাকায়৷ ভার্সিটিতে ম্মৃতিময় দিনের কথা ভুলে গেল খুব দ্রুত।
_______

রঙ্গন মীরার হাতে চকলেট দিয়ে বলল,

“শুধু ভাইয়ার সাথে কথা বললে হবে। তোমার তো আরও ভাইয়া আছে৷ আমরাও তোমাকে অনেক ভালোবাসি৷”

সাদাফ কবির ভাষায় বলল,

“যখন পড়িবে মনে স্বরণ করিয়ে আমাকে৷ সকল ঝামেলার সাথে মোকাবেলা করাই আমার কর্তব্য।”

মীরা মুচকি হেঁসে বলল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া৷ তেমন কিছু না৷ ভাইয়াকে একটু দরকার ছিল৷ আমার কথা হয়ে গেছে৷ আমি এখন আসছি৷”

ইহান কি বলবে বুঝতে পারছে না? শয়তান বন্ধু পাশে থাকলে শত্রুর অভাব পড়ে না৷ মুখ বুঝে সব সহ্য করছে৷ মীরা চলে যাওয়ার জন্য কদম ফেললে আরুশ বলল,

“ক্লাস করে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছো৷ চল একসাথে ক্যান্টিনে যায়৷”

মীরা ভদ্রতার সাথে বলল,

“না ভাইয়া। হোস্টেলে একটু কাজ আছে৷ অন্যদিন আপনাদের সাথে চায়ের আড্ডা হবে৷”

আরুশ বাংলার পাঁচ করে সাদাফ দিকে তাকাল৷ সাদাফ আরুশের মনের কথা বুঝতে পারে৷ সাদাফ মীরার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,

“তুমি ইহানকে ভয় পাচ্ছো! তুমি কি ইহানের বোন? তুমি আমার বোন৷ চল একসাথে ক্যান্টিনে যাব৷ ইহান কিছু বললে তার দেহ থেকে হাড্ডি আলাদা করে ফেলব৷”

মীরা ভয়ার্ত চোখে ইহানের দিকে তাকাল৷ ইহান চোখের ইশারায় সম্মতি দিতে বলল। ইহানের কথা মতোই মীরাকে চলতে হয়৷ মীরা ঢাকায় এসে বন্ধি খাঁচার পাখির মতো বন্ধি হয়ে গেছে৷ মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করে৷ বন্ধি পাখি মুক্তি কবে পাবে প্রহর গুনতে থাকে৷

সাদাফ ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“মীরা তোমার ফেসবুক একাউন্ট নেই!”

মীরা এক পলক ইহানের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিল৷ মৃদু স্বরে বলল,

“ফেসবুক একাউন্ট আছে৷ তবে ছেলেদেরকে আমার আইডি দিব না৷ বিশেষ করে অপরিচিত কাউকে আমার ফেসবুুস একাউন্ট দিব না৷”

রঙ্গন অভিমানী কন্ঠে বলল,

“তুমি আমাদের আপন ভাবতে পারনি৷ সাদাফ ঠিকই বলছিস৷ গরিব মানুষকে কেউ আপন করে না৷ আজ আমরা দু’জন গরিব বলে আমাদের কেউ পাত্তা দিল না৷”

সাদাফ কান্না কান্না ভাব নিয়ে বলল,

“দোস্ত ঠিক বলছিস৷ কচু গাছের সাথে ফাঁ*সি দিতে হবে৷ এই জীবন রেখে কি লাভ? মোটা তাজা দুইটা কচু গাছের সন্ধান কর! আমরা আর এ প্রাণ রাখব না৷”

সাদাফ রঙ্গের কথায় মীরা হেঁসে ফেলল৷ মুচকি হেঁসে জবাব দিল,

“আমার একাউন্ট ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিবেন৷ আমি আসলাম৷ এমনি অনেক লেট হয়ে গেছে৷”
________

আরুশ সারা রুম পায়চারী করছে৷ মীরাকে রিকুয়েষ্ট দেওয়ার সাথে সাথে রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে৷ কিন্তু কি বলে মেসেজ দিবে? মেসেজ দিলে খারাপ কিছু বলে করবে না! ভাবতে পারছে না আর৷ নিজেকে পা’গল পা’গল লাগছে৷ মীরা সব পোস্টে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে মীরাকে টেক্সট করল,

“মীরা তোমার হাসি অনেক সুন্দর। তোমার হাসিতে ঝর্না জলের শব্দের মতো৷ তোমার চোখ দুটো ডাগর ডাগর মায়ায় ভরা। দক্ষিণা বাতাসে খোলা কেশে তোমায় অপরূপ লাগে।”

মীরা কি রিপ্লাই দিবে বুঝতে পারছে না? সেখানে সবাই কেমন আছেন, কি করেন দিয়ে শুরু করে৷ সেখানে এমন বাক্য মীরার কাছে জটিলতা সৃষ্টি করেছে৷ মীরা কাঁপা হাতে রিপ্লাই দিল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া৷ আপনি তো বলছিলেন আপনি কবি নয়৷ কিন্তু কবিদের ভাষায় আমার বিবরণ দিচ্ছেন৷”
.
মীরার রিপ্লাই পেয়ে আরুশ অনেক খুশি। যেভাবেই হোক মীরার সাথে কথা বলে সময় পার করবে।
.
“তোমাদের গ্রামে তোমায় খোলা কেশে দেখেছি৷ তোমাকে দেখে স্বর্গের অপ্সরা মনে হয়েছিল৷ তুমি সব সময় খোলা চুলে থাকবে৷”
.
“আপনি গ্রাম দেখছেন নাকি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন? আপনি সেদিন থেকে শুরু আমার কথায় বলে যাচ্ছেন৷ কই আমাদের বিশাল নদীর কথা বললেন না? কোকিলের কু কু শব্দের কথা বললেন না?”

“ধীরে ধীরে সবই বলব৷ যেকোন একটা দিয়ে শুরু করতে হবে আগে৷ সত্যি বলছি তোমার গ্রাম খুবই সুন্দর। মন মাতানোর মতো জায়গা৷ মন খারাপ হলে চলে যাব আকন্দপুরে৷”
.
“আমাদের গ্রাম নিয়ে এতো প্রশংসা! আপনার কি কি ভালো লেগেছে? একে একে সব বলেন৷ ধরে নেন এটা আপনার জীবনে একটা পরীক্ষা। ভাইয়ার কাছ থেকে শুনেছি আপনি সবকিছুর মাঝে পরীক্ষা টেনে আনেন৷”
.
“সকালের শীতল হাওয়ার সাথে পাখির ডাক৷ জেলেরা মাছ ধরার জন্য নদীতে ছুটে চলে৷ এক বেলা মাছের জন্য অনেক অপেক্ষা। যেখানে তারা ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়৷ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মাঠে কাজ করার জন্য ছুটে চলা৷ নদীর জলে কচুরিপানা ভেসে যাওয়া৷ যার নিজস্ব কোন গন্তব্য নেই৷ সবাই আমার মনে নাড়া দিয়েছে৷”
.
“আপনি দেখি সবকিছু নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করেছেন৷ আর কি কি দেখলেন?”

“কাছ থেকে প্রকৃতিকে দেখতে পেলাম৷ ছুঁয়ে দিতে পারলাম সোনালী ফসল৷ স্ব চোখে দেখলাম বিনা চাষে গম চাষ৷ পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আভায় নৌকা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো৷ ভয় দেখানোর জন্য নৌকাকে ঝাঁকি খাওয়ানো৷ সবকিছু আমার জীবনে নতুন এক অধ্যায়৷ আরও একটা জিনিস আমার মনে রয়ে গেছে৷”
.
“সে জিনিসটা কি? সেটার কথা জানতে পারি?”
.
“সময় হলে ধীরে ধীরে জানতে পারবে। আন্টির হাতের রান্নার কথা না বললেই নয়৷ উনার রান্না সারাজীবন আমার মুখে লেগে থাকবে৷ আন্টির রান্না এতো পরিমাণে টেস্ট কি বলব?”
.
“গ্রামে সবকিছু টাকটা পাওয়া যায়। সেজন্য সবকিছু স্বাদ আলাদা৷ আপনি কি লুকাতে চান? কোন জিনিস আপনার মনে গেঁথে গেছে৷”
.
“শুনলে রাগ করবে না তো৷ প্রমিজ করলে তোমায় বলতে পারি৷”
.
“কথা দিচ্ছি রাগ করব না।”
.
“তুমি! তুমি রয়ে গেছো আমার মনের গহীন কোণে। তোমাকে এক পলক দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি৷ তোমাকে ভুলার অনেক চেষ্টা করছি৷ কিন্তু তোমাকে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না৷ না পারছি তোমার কাছে যেতে৷ তার কারণ তুমি ইহানের বোন৷ নিজেকে রেখেছি লুকিয়ে। এক তরফা তোমায় ভালোবেসে যাব৷”

ইহানের টেক্সট দেখে মীরার চোখ আকাশ প্রাণে৷ মীরা কি রিপ্লাই দিবে বুঝতে পারল না? সেজন্য মীরা ডাটা বন্ধ করে অফলাইনে চলে গেল৷ ইহান মীরাকে অফলাইনে দেখে নিজেকে ব্যর্থ প্রেমিক মনে করল৷ ভালোবাসা পাওয়ার আগেই ভালোবাসা থেকে ছিঁটকে পড়ল৷

চলবে……

ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷ ভালো না লাগলে ইগনোর করেন৷ প্লিজ রিপোর্ট দিবেন না৷ রিপোর্ট দিলে লেখার মন মানসিকতা হারিয়ে যায়৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here