প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ২৪+২৫

0
224

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪

“তুমি নিজের হিতাহিত জ্ঞান কি হারিয়েছো প্রেম? কখন কি করছো সেটা তুমি ভেবে করছো তো? কাল তুমি এঙ্গেজমেন্ট ভেঙে চলে গেলে। সারা রাত বাড়িতে ফিরলে না। সকালে যখন ফিরলে আমাদের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলেই অফিসে চলে গেলে। আর এখন তুমি হুট করে বাড়িতে এসে বলছো এই মেয়ে তোমার ওয়াইফ? তুমি নিজের হুঁশে আছো তো?”

বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো অনর্গল ভাবে বললেন মিসেস. পরিণীতা। প্রেমকে তবুও বিচলিত হতে দেখা গেল না। আগের মতোই শান্ত হয়ে জবাব দিল,
“আমি সজ্ঞানে আছি। আর ওই বিয়ের জন্য তোমরা আমাকে ফোর্স করেছিলে। আমি রাজি হয়েছিলাম তোমাদের খুশির দিকে চেয়ে। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম মাঝে মাঝে নিজের খুশিটাও ভেবে দেখা উচিত। আর রোজকে আমি কখনো খুশি করতে পারব না। বিয়ে মানে সারাজীবন একসাথে থাকা। বিয়ে একটা দায়িত্ব। সেই দায়িত্বে যদি ভালোবাসা থাকে তাহলেই সারাজীবন কাটানো যায়। কিন্তু রোজের প্রতি কোনো ফিলিংস আমার তৈরি হয়নি। সো হুট করে একটা মেয়েকে বিয়ে করে যদি তাকে আমি খুশি না দিতে পারি তবে সেই বিয়ে করা আমার উচিত না।”

“তবে তুমি এই মেয়েকে ভালোবাসো আমাদের একবারের জন্যও বলো নি কেন?”

প্রেম এবার স্তব্ধ হয়ে ঐশ্বর্যের দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। নিজের ঠোঁট আলতো করে ভিজিয়ে বলে,
“আমি বিষয়টা বুঝতে দেরি করে ফেলেছি। আই এম সরি।”

“কি সরি বলছো প্রেম? এতো বড় একটা ডিসিশন নিজে নিজে নিয়ে এখন সরি বলে দিলে সব মিটে যাবে? আর ইউ আউট ওফ ইউর মাইন্ড? রোজের ফ্যামিলি অলরেডি অনেক অসম্মানিত হয়ে গেছে। তবুও রোজের কথায় বিয়ের কথা টিকে ছিল। কিন্তু তুমি সব নষ্ট করে দিলে। ওদের কি জবাব দেব বলো?”

বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল কবির বাবা। মিসেস. পরিণীতা চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর কবির সাহেবের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে কিছু করার নেই আমাদের আর মেনে নেওয়া ছাড়া। রেজিস্ট্রি হয়েছে তোমাদের?”

ঐশ্বর্য আর প্রেমকে কটাক্ষ করে শেষ কথাগুলো বললেন মিসেস. পরিণীতা। প্রেম ও ঐশ্বর্য দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। তারপর মিসেস. পরিণীতা এগিয়ে এলেন ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্যের আপাদমস্তক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন উনি। মেয়েটাকে উনি এর আগে প্রেমের এঙ্গেজমেন্ট পার্টিতে দেখে রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এমন সুন্দর চাঁদের মতো মুখ অগ্রাহ্য করা বড্ড কঠিন! বর্তমানে ঐশ্বর্যের পরনে একটা লেডিস জিন্স যেটা পায়ের অনেকটা ওপরে মুড়িয়ে রেখেছে। পায়ে ছেলেদের মতো কেটস্। আর ওপরে লেডির শার্ট আর একটা চকলেট কালার জ্যাকেট। চুলগুলো ওপরে বেঁধে রেখেছে। মাথায় হালকা করে স্কার্ফ দেওয়া। সেটা যেন জোর করে দিয়ে রাখা হয়েছে। বলতে গেলে মেয়েটির মধ্যে কোনো মেয়েলি হাবভাব দেখতে পেলেন না মিসেস. পরিণীতা। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বাড়িতে কেউ জানে বিয়ের কথা?”

ঐশ্বর্য এবার মুখ তুলে তাকায়। ঘাড় বাঁকিয়ে প্রেমের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
“আমি তো নিজেই জানতাম না আমার বিয়ে। কতই না স্বপ্ন ছিল বিয়ে নিয়ে। ব্ল্যাক লেহেঙ্গা, ব্ল্যাক ওড়না, ব্ল্যাক ডায়মন্ডের সেট একবারে ব্ল্যাক কুইন সেজে বিয়ে করতে বসব। চারিদিকে গান হবে নাচ হবে! বাট শ্বাশুড়ি আন্টি, আপনার ছেলে সেটা পূরণ হতে দিল না। ফোর্স করে বিয়ে করল। আমি তো আগে ভাবতাম আপনার ছেলের নামেই শুধু প্রেম রয়েছে অন্তরে কোনো প্রেম নেই। কিন্তু আজকে যেভাবে ভিলেনের মতো বিয়ে করল আই এম সারপ্রাইজড। এখন মাকে বললে মায়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে তো বাংলা সিনেমার মতো বজ্রপাতের আওয়াজ ঘটবে। সাথে সাথে আমার ওপর দিয়ে টর্নেডো যাবে। এর দায়ভার কি আপনাদের ছেলে নেবে? আর তাছাড়া আপনার ছেলে যে আমাকে মোটেও ভালো…”

কথাগুলো পুরোপুরি সম্পূর্ণ করার আগেই ঐশ্বর্য চেঁচিয়ে উঠল আচমকা। নিজের ডান হাতে বাম দিয়ে ডলতে ডলতে প্রেমের দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“চিমটি দেন কেন? শরম নাই? সদ্য বিবাহিত বউকে নির্যাতন করেন?”

থতমত খেয়ে যায় প্রেম। সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করে। কাশি থামেই না। মেয়েটা আজ তার মানসম্মান ডুবিয়ে দিল ভেবে কাশি বেড়ে যায়। প্রেম ঐশ্বর্যকে চুপ করার ইঙ্গিত দিতে চিমটি কেটেছিল। তার ফলাফলে এমন মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে ভাবতে পারেনি। কোনোমতে কাশি থামিয়ে চোখ গরম করে ঐশ্বর্যকে চুপ করতে বলে প্রেম। এতোক্ষণ মুখে তালা দিয়ে ছিল তাতেই ভালো ছিল। যেই কিনা মুখ খুলেছে মুখ দিয়ে পপকর্ন ফুটছে।

“আবার কিনা চোখ গরমও করছেন? দেখুন শ্বাশুড়ি আন্টি দেখুন! আপনার মতো ভালো একটা মানুষের ছেলে কেমন হয়েছে দেখুন।”

মিসেস. পরিণীতা আর কবির সাহেব হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে কবির সাহেব হালকা কেশে বললেন,
“ঠিকই বলেছো পরি তুমি! কিছু করার নেই। ওদের আর দাঁড় করিয়ে রেখো না তাহলে ভিতরে নিয়ে এসো। আমি বরং মি. সিনহার সাথে কথা বলি এই বিষয়ে। উনারা তো এসব জানেন না। আর প্রেম ঐশ্বর্য যে বলছে তুমি ওকে ফোর্স করেছো কথাটা সত্যি?”

“একচুয়ালি বাবা ও একটু ড্রামাটিক! বিয়ে করার ইচ্ছে ওর নিজেরও ছিল বাট পুরো দোষটা এখন আমার ওপর চাপাচ্ছে।”

প্রেমের এমন কথায় চোখ কপালে তুলে তাকায় ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য প্রেমকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ঠিক কিন্তু এভাবে না। প্রেম তো আজ ফোর্স করেই বিয়ে করেছে। তবে এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না সে। চুপচাপ গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মিসেস. পরিণীতা দুজনকে হলরুমে আনলেন। তারপর ঐশ্বর্য আর প্রেমকে সোফায় বসতে দিয়ে মিতালিকে ডাকলেন। মিতালি আসতেই উনি আদেশের সুরে বললেন,
“আমার সাথে এসো চলো। কিছু জিনিস নিয়ে আসতে হবে।”

মিতালি ছুটে গেল মিসেস. পরিণীতার সাথে ঘরের দিকে। কিছুক্ষণ পর তারা দুজনে এলো। মিতালির হাতে কিছু শাড়ি। আর মিসেস. পরিণীতার হাতে কিছু গয়নার বক্স। এতোক্ষণ চোখ রাঙিয়ে রাঙিয়ে ঝগড়া করছিল ঐশ্বর্য আর প্রেম। তাদের আগমনে চোখ সরিয়ে শান্ত হলো তারা। মিসেস. পরিণীতা ঐশ্বর্যের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এখানে এসো তুমি।”

ঐশ্বর্য উঠে গেল উনার কাছে। সাথে সাথে সব গয়না ধরিয়ে দিল ঐশ্বর্যের হাতে। চোখ তখনি চড়কগাছ হয়ে এলো ঐশ্বর্যের। সেই সময় মিসেস. পরিণীতা বলতে শুরু করলেন,
“যেভাবেই হক যেহেতু আমার বাড়ির বউ হয়েছো সেহেতু তোমাকে মানতে হবে আমাদের। আমার ছেলে তোমায় যখন পছন্দ করে এনেছে তখন নিশ্চয় তোমার মাঝে এমন কিছু আছে যা অন্য কারো মাঝে নেই। আমার ছেলে বলে বলছি না! আমার ছেলের মতো একটা দায়িত্বশীল পুরুষ লাখে একটা পাওয়া যাবে। আর যেহেতু তুমি বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছো তাই এই শাড়িগুলো রাখো। আর আমার মনে হচ্ছে তোমার শাড়ি পড়ে অভ্যেস নেই বাট নতুন বউ হিসেবে মেয়েরা শাড়িই পড়ে। এটা কষ্ট করে তোমাকে ম্যানেজ করে নিতে হবে। আর এখানে কিছু হালকা গয়না আছে যা সবসময় পড়ে থাকবে। তাতে সুন্দর লাগবে তোমায়।”

গয়নাগুলোর বক্স দেখে আঁড়চোখে প্রেমের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ঐশ্বর্য। প্রেম সেটা দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে পায়ে পা তুলে বসল। ঐশ্বর্য যেন ফাঁদে পড়েছে। এ ফাঁদ থেকে যে বাঁচার উপায় নেই!

কবির সাহেব অনুভবের সাথে সবেমাত্র কথা বলে এলেন ফোনে। এসে ঐশ্বর্যকে ডেকে বললেন,
“আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলেছি। এখন তোমার মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এখানে এসে কথা বলো।”

ঐশ্বর্য ঢক গিলে উঠে গিয়ে কবির সাহেবের ফোনটা কানে ধরল। সে জানে এখন মায়ের ঝাড়ি খেতে হবে। কি বলবে মাকে এসব সে জানে না। কারণ মাকে না বলে বেরিয়েছিল সে। আর এখন সে না বলে বিয়েও সেড়ে ফেলেছে। ফলস্বরূপ যে মাধুর্য তাকে বেশ কঠিন কঠিন কথা শোনাবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কানে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মাধুর্যের শান্ত গলা ভেসে এলো ঐশ্বর্যের কর্ণকুহরে।
“কেমন আছো তুমি? বিয়ে করলে নাকি শুনলাম?”

“আসলে ম…মা!”

“থাক। বাহানা দিতে হবেনা। শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে শিখো। তোমার বাচ্চামি, রাগ, জেদ কন্ট্রোল করলে শেখো। তোমার এসব হুকুম ওখানে চালাবে না। ভালো মেয়ের মতো থাকবে বুঝলে?”

ঐশ্বর্য বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সেকেন্ড। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,
“মা! তুমি অবাক হওনি? যে আমি হুট করে বিয়ে করে ফেললাম। তোমার রাগ হচ্ছে না?”

“অবাক তো একটু হয়েছি। আর রাগ করেই বা লাভ কি? যে বন্ধন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে হয় সেখানে রাগ করতে নেই। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা ভুলবে না। তুমি মানুষ নও। তুমি ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। আর এটা তোমাকে প্রেমকে জানাতে হবে। এখন নয়। সঠিক সময় এলে ওকে জানাতে হবে। এমন কিছু করো না যাতে তোমার আসল রুপ সঠিক সময়ের আগে সবার সামনে বেরিয়ে আসে আর সবাই তোমায় ভুল বোঝে। ব্যাস এতটুকুই বলার ছিল। আর বাকিটা আমি কাল গিয়ে তোমায় বলব। এখন রাখছি।”

বলেই ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে দিল মাধুর্য। ঐশ্বর্যকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। হতবিহ্বল হয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে চেয়ে থাকল সে। মাধুর্যের ব্যবহার প্রচন্ড রকম অবাক ঐশ্বর্য। যে মাধুর্য সামান্য কিছু হলেই বকাঝকা করে শেষ করে ফেলতো সেই মাধুর্য ঐশ্বর্যের জীবনের এতো বড় একটা মোড় এলো তবুও শান্ত রইল? যেন যা কিছু হয়েছে সবটা স্বাভাবিক! ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ঐশ্বর্য প্রেমের ডাকে।

রাত প্রায় এগারোটা। বেডে গা এলিয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছে প্রেম। বেশ ঘুম পেয়েছে তার। তবুও জেগে আছে। কারণ একজন ওয়াশরুমে গেছে। সে না আসা পর্যন্ত ঘুমানো যাবেনা। ঘুমালে অনর্থ ঘটে যেতে পারে। তবে ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিটের মতো সে ওয়াশরুমে। প্রেম বিরক্ত! তবুও কিছু বলে না। অবশেষে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হয়। বিরক্তি ভরা চাহনি নিয়ে তাকায় সে ঐশ্বর্যের দিকে। সাথে সাথে চোখ স্থির হয়ে যায় তার। চোখের পলক পড়তে চায় না। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে হা হয়ে যায়। কপালে বেশ কিছু ভাঁজ দেখা যায়। অন্যদিকে সেই রমণী ব্যস্ত নিজের পরিহিত শাড়ি ঠিক করতে। ব্যস্ত সুরে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা শাড়ি পড়া কি ঠিক হয়েছে? আই মিন শাড়ি পড়ার প্রসেসিং ঠিক আছে তো না? ঠিক থাকারই কথা। দ্যা গ্রেট ঐশ্বর্য যে কাজে একবার হাত লাগায় সেটা ঠিক হবেই হবে।”

বলেই সামনের চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে সামনে পা বাড়াতে যায় ঐশ্বর্য। সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে যায় সে। প্রেম ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ঐশ্বর্য মুখ তুলে চোখমুখ লাল করে তাকায়। প্রেম বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ঐশ্বর্যের রক্তিম বর্ণের চোখমুখ এবং তার আপাদমস্তক দেখে উচ্চস্বরে হেঁসে দেয়।

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫

বেশ খানিকক্ষণ হেঁসে অনেক কষ্টে হাসি থামালো প্রেম। ঐশ্বর্যের পলকহীন আর উদ্ভট চাহনিতে ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো তার। মেয়েটা এখনো ফ্লোরেই পড়ে আছে তবে দুই গালে হাত দিয়ে রেখেছে। যেন চরম বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর আশ্চর্যজনক কিছু দেখছে সে। গলা খাঁকারি দিয়ে প্রেম প্রশ্ন করে,
“সারারাত কি এভাবেই থাকার ইচ্ছে রয়েছে?”

ঐশ্বর্য আগের মতোই পাথরের মূর্তির ন্যায় থম মেরে রইল। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। ভ্রুজোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে গেল প্রেমের। সেই সাথে কপালে দেখা গেল কয়েকটি ভাঁজ। আস্তে করে ঐশ্বর্যের দিকে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসল সে। ঐশ্বর্যের সামনে হাত তুলে চোখের সামনে নাড়াতেই নড়েচড়ে উঠল ঐশ্বর্য। প্রেমকে এতো কাছে দেখে হকচকিয়ে উঠে ফট করে উঠে বসে দূরে সরে গিয়ে বলল,
“আপনি এখানে এলেন কখন?”

“যখন তুমি ওইদিকে তাকিয়ে হা হয়ে ছিলে তখন। কি দেখছিলে এভাবে? নাকি পড়ে যাওয়ার চোটে শোক পালন করছিলে?”

“আমি তো আজ পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বের করে ফেলেছি।”
অবাক সুরে উত্তর দিল ঐশ্বর্য। প্রেম আগ্রহ পোষণ করে প্রতিত্তোরে জিজ্ঞেস বলে,

“হোয়াট?”

ঐশ্বর্য বড় একটা শ্বাস নিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বেশ উত্তেজনা নিয়ে বলে,
“ইয়েস। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হচ্ছে মি. শেখ আনন প্রেমের হাসি।”

থতমত খেল এবার প্রেম ঐশ্বর্যের কথায়। ক্ষীণ সুরে বলল,
“কেন? আমিও তো মানুষ নাকি? হাসতে পারি না নাকি?”

ঐশ্বর্য হাসি হাসি মুখ করে বেশ উত্তেজনামূলক সুরে বলল,
“না আপনি ভাবতে পারছেন? মি. আনস্মাইলিং এর স্মাইল। অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যাপার! আপনার সঙ্গে আমি প্রথম সাক্ষাৎ থেকে আপনার মুখে হাসির ছিটেফোঁটা অবধি দেখিনি। সেই মানুষ আজ উচ্চস্বরে হাসলো? ও মাই গড! আমার মাথা ঘুরছে। আমি স্বপ্ন দেখছি কিনা কে জানে! এই এই একটু চিমটি কাটুন তো।”

ক্ষীণ দৃষ্টিতে ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় চিমটি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তৎক্ষনাৎ আবার হাত সরিয়ে নেয় সে। তার স্মরণে আসে তার মায়ের সামনে ঘটা ঘটনাগুলো। একবার চিমটি কেটেছিল বলে যা কীর্তি করেছিল এই মেয়েটা বলা যায় না কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিলেও দিতে পারে। তবে প্রেমের এমন হাত সরিয়ে নিতেই ঐশ্বর্য বিরক্তি চাহনি দিয়ে বলল,
“উহু… হাত সরিয়ে নিলেন কেন? চিমটি কাটুন বলছি।”

প্রেম এবার কটমট করে ঐশ্বর্যকে বেশ জোরেশোরে চিমটি কাটতেই আচানক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল ঐশ্বর্য। প্রেম এবার হকচকিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের আঙ্গুল ঠোঁটে ধরে ফিসফিস করে বলল,
“চুপ চুপ! শাট ইউর মাউথ। বাড়িতে অনেকে আছে। কে কি ভাববে?”

ঐশ্বর্য রাগে ফোঁস ফোঁস করে নিজের চিমটি লাগা স্থানে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“এতোটা জোরে মারবেন তাই বলে! কিছুটা তো দয়ামায়া করুন!”

প্রেম কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। ঐশ্বর্য মিটিমিটি হেঁসে মৃদু সুরে প্রেমকে ডেকে বলল,
“শুনুন একটা কথা!”

প্রেম চোখ গরম করে তাকালো এবার। এর মানে সে আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছুক না। ঐশ্বর্য নাছোড়বান্দা হয়ে বলে,
“আহা, শুনুন না একটা কথা।”

বলে নিজেই কষ্ট করে এগিয়ে যায় প্রেমের দিকে। প্রেম অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রয়েছে। ঐশ্বর্য প্রেমের কানের কাছে মুখ রেখে কিছু বলতে পারছে না। কারণ প্রেম তার থেকে বেশ লম্বা। লম্বা আর প্রশস্ত চওড়া শরীরওয়ালা মানুষদের এই এক সমস্যা। কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে এবার প্রেমের এক গালে হাত দিয়ে প্রেমের কানের কাছে এসে চুপি চুপি বলে,
“না হেঁসে হয়ত ভালোই করেন। আপনার হাসিতে আর একটু হলে জ্ঞান হারাতে চলেছিল এই ঐশ্বর্য। আপনি বরং গম্ভীর মুখ নিয়েই থাকবেন। আমার সামনে হাসবেন ঠিক আছে? আমি চাই না আমার মতো আরো অন্য কোনো মেয়ে আপনার হাসিতে উন্মাদ হয়ে যাক। আমি একদম চাই না মি. আনস্মাইলিং!”

ঐশ্বর্য একটু থামে অতঃপর আবার থেমে থেমে বলে,
“আরেকটা কথা! হাসার সময় আপনাকে একটা চকলেট চকলেট লাগছিল। মনে হচ্ছিল খেয়ে ফেলি।”

বলেই নিজের মুখ চেপে ধরল ঐশ্বর্য। প্রেম বিষম খেয়ে একপলক ঐশ্বর্যের দিকে তাকালো। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে ইতস্তত বোধ করে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“সারারাত এখানে বসে থাকতে হলে থাকো। আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।”

ঐশ্বর্য আশ্চর্য হয়ে বলল,
“আরে আরে, এটা কেমন কথা আপনার ঘুম পাচ্ছে? আমাকে এভাবে ফেলে আপনি ঘুমাবেন?”

“তোমায় পড়ে থাকতে কে বলেছে? উঠতে পারছো না?”

“উঠতে পারলে বসে থাকতাম? আমার কোমড়ে আর দুই কনুইয়ে লেগেছে। আর আমি উঠে দাঁড়ালে আই এম সিউর আবার পড়ে যাব।”

প্রেম হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর হুট করে ঐশ্বর্যের দিকে উপুড় হতেই চোখ ছানাবড়া হয় ঐশ্বর্যের। তাকে আরো এক দফা চমকে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয় প্রেম। নিজেকে সামলাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে ঐশ্বর্য। সে ভাবেও নি প্রেম এমন কোনো কাজ করে বসবে! প্রেমের একহাত ঐশ্বর্যের কোমড়ে ঠেকছে। প্রেম হাত গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে তবে ঐশ্বর্যকে ধরে রাখার জন্য সেটা হচ্ছে না। ঐশ্বর্য বারংবার চোখের পলক ফেলছে। নিশ্বাস ওঠানামা করছে তার। প্রেম এগিয়ে ঐশ্বর্যকে বসিয়ে দিল বেডে। অতঃপর বলল,
“যেটা পড়তে পারো না সেটা পড়ো কেন? একটু আগে ভাব নিয়ে বললে তুমি যে কাজে হাত দাও সেটা নাকি পারফেক্ট হয়। এটা তোমার পারফেক্ট কাজ?”

“কি করব আমি? কখনো তো শাড়ি পড়িনি। প্রথমবার পড়ে কেমন জানি লাগছে।”

প্রেম প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,
“আগে কখনো শাড়ি পড়ো নি?”

ঐশ্বর্য মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
“শাড়ি পড়া তো দূর কখনো সালোয়ার কামিজও পড়িনি।”

প্রেমের এবার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। দাঁতে দাঁত চেপে ঐশ্বর্যের দিকে তাকাতেই তার নজর পড়ে শাড়ির দিকে। লাল রঙের শাড়ি পড়েছে ঐশ্বর্য। এর আগে কখনো ঐশ্বর্যকে লাল রঙে দেখেনি প্রেম। এই প্রথমবার দেখছে। তার চোখে যেন লেগেছে নেশা। তার সামনে থাকা নারী যেন সদ্য একটি ফুল। লাল রঙে লুকায়িত রয়েছে সেই ফুল। যার চোখেমুখে রয়েছে এখনো পানির রেশ। এলোমেলো ঢেউ খেলানো চুলগুলো যেন বৃদ্ধি করেছে তার মাধুর্য। এই মাধুকরী রূপ যে কারোর নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করবে। ঢক গিলে নেয় প্রেম। হজম করতে চায় ঐশ্বর্যের প্রতি তার এমন নেশা। তবে হয় না। তারপর সে খেয়াল করে ঐশ্বর্যের শাড়ি পড়ার ধরণ। ফট করে বলে,
“তুমি পড়বে না কেন বলো? শাড়ি পড়লে শাড়িতে কুঁচি দিতে হয়। জানো তুমি সেটা? কুঁচির রেশমাত্র তো নেই তোমার শাড়িতে।”

ঐশ্বর্য এবার মাথা চুলকে কুঁচি খোঁজার চেষ্টা করে। আর বলে,
“আমি পারি না। আপনি হেল্প করুন।”

প্রেম চোখ বড় বড় করে বলে,
“আমি?”

“হ্যাঁ আপনি।”

“এ…এতো রাতে শাড়ি পড়তে হবে না। যেভাবে আছো সেভাবে ঘুমাও তো।”

থতমত খেয়ে কথাগুলো বলল প্রেম। ঐশ্বর্য অসহায় নয়নে চেয়ে বলল,
“আমি তো এভাবে পাও নাড়াতে পারব না। প্লিজ হেল্প মি!”

“ওহ হো! তুমি বুঝতে কেন পারছো না। তোমাকে হেল্প করতে গেলে এখন পুরো শাড়ি খুলতে হবে। আমার সামনে এখন পুরো শাড়ি কিভাবে…”

বাকিটা বলতে পারল না প্রেম। ঐশ্বর্যও নিরব হয়ে গেল। নিরবতা চলল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঐশ্বর্যের অবস্থা বুঝে বলল,
“ও…ওকে। আমি তোমাকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছি। তুমি সেই অনুযায়ী শাড়ি পড়ে নাও।”

বলেই হাত বাড়িয়ে দিল প্রেম। ঐশ্বর্য সেই হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। প্রেম অন্যদিকে ঘুরে বলল,
“শাড়ি খুলে নতুন করে স্টার্ট করো।”

অতঃপর ঐশ্বর্যের হাতে ফোন ধরিয়ে দিল প্রেম। আর বলল,
“ফোনে দেখো। শাড়ি পড়ার ফুল ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে। ফলো দিস।”

প্রেম অন্যদিকেই ঘুরে রইল। ঐশ্বর্য শাড়ি পড়ছে একটু একটু করে। হঠাৎ করে প্রেমের নজর গেল আয়নাতে। ঐশ্বর্য শাড়ি কিভাবে পড়ছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার নগ্ন পেট দৃশ্যমান। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে শাড়ি ঠিক করছে। কুঁচি করতে চাইছে তবে পারছে না। প্রেমের সারা শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। যেন ভয়ানক কিছু দেখে ফেলেছে। বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। অন্যদিকে ঐশ্বর্যের কুঁচি আর কোনোভাবেই হয় না। হাত-পা ছাড়িয়ে কাঁদতে মন চাইছে তার। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এটা শাড়ি পড়া নাকি যুদ্ধ করা? কুঁচি!”

প্রেম এবার বিরক্ত। ফট করে ঐশ্বর্যের দিকে ঘুরে নিজের হাতে শাড়ির গোছা নিয়ে বলে,
“তোমার দ্বারা জাস্ট কিচ্ছু হবেনা। কিছু না।”

ঐশ্বর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার একটা আঁচল গুঁজে রাখলেও ঠিকঠাক নেই কিছুই। সবমিলিয়ে বড়ই অস্বস্তিকর অবস্থা! ঝটপট করে কোনোরকমে শাড়ির কুঁচি করে ঐশ্বর্যের হাতে ধরিয়ে দিল প্রেম। আর বলল,
“নাও এখন পড়ো।”
হাতে কুঁচি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ঐশ্বর্য। তারপর সেটা গুঁজে নেয়।

বেশ রাত হয়েছে। ঐশ্বর্য দাঁড়িয়ে আছে বেডের এপাশে আর প্রেম দাঁড়িয়ে আছে বেডের ওপাশে দুজনেরই নজর বেডের দিকে। ঐশ্বর্য বলে,
“বেড ছাড়া আমার ঘুম হয় না।”

“আমি বোধহয় বেড ছাড়াই ঘুমায় তোমার মনে হয়?”

ঐশ্বর্য এবার তেজ নিয়ে বলল,
“দেখুন বিয়েটা আপনি করেছেন সো আমার ভালো করে টেক কেয়ার করে রাখার দায়িত্ব আপনার। আমার কোনটা ভালো লাগবে না লাগবে সেটাও দেখার দায়িত্ব আপনার। এখন যতই দয়া দেখিয়ে আর প্রতিদান হিসেবে বিয়ে করুন না কেন!”

প্রেম কিছু বলার আগেই চোখের পলকে ঐশ্বর্যকে বেডে গা এলিয়ে দিতে দেখে। একপাশ হয়ে অলরেডি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সে। প্রেম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতো তাড়াতাড়ি কেউ কি করে একটা কাজ করতে পারে? ঐশ্বর্য চোখ বুঁজেই হালকা কেশে বলে,
“গুড নাইট। আপনি চাইলে আমার পাশে ঘুমাতে পারেন। আই নেভার মাইন্ড!”

প্রেম আশেপাশে তাকায়। তার ঘরে সিঙ্গেল সোফা আছে। সেখানে ঘুমানো অসম্ভব। তাই সে ধীরে ধীরে বেডের একপ্রান্তে শুয়ে পড়ল। আস্তে করে ল্যাম্পশিট অফ করে দিল।

নিস্তব্ধ রাত। প্রেম গভীর ঘুমে। মৃদু বাতাস আসছে খোলা জানালা দিয়ে। ঐশ্বর্যের ঘুম আসছে না। গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে কাঁপছে সে। তার ঠান্ডা একেবারেই পছন্দ নয়। আগুনের পাশে দাঁড়াতে পারলে ভালো লাগতো তার। আগুন তার বেশ প্রিয়। আগুনের আঁচ তার মনে অন্যরকম আনন্দ সৃষ্টি করে। না পেরে একটা সময় উঠে বসল সে। জানালা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতে চাইল। তবে পাশের মানুষটার দিকে চোখ পড়তেই থমকালো সে। কি মায়াবী এক মুখশ্রী। মৃদু আলোয় বেশ লাগছে। প্রেমের এলোমেলো চুলে হাত চলে গেল ঐশ্বর্যের। আলতো করে ঠিক করে দিল। তার মন চাইলো প্রেমের প্রশস্ত বুকে মাথা রাখতে। একটু শান্তি সঞ্চয় করতে। ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে নিজের মাথা প্রেমের বুকে রেখে চোখ বুঁজল ঐশ্বর্য। উষ্ণ এক অনুভূতি। প্রশান্তির এক স্থান! জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের বুকে মাথা রাখা।এই অনুভূতির সীমানা নেই। তড়তড় করে বেড়ে চলেছে হৃৎস্পন্দন।

প্রেমের ঘুম বেশ কাঁচা। একটুতেই ভেঙে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভেঙে গেল ঘুম বুকে ভারি কিছু অনুভূত হওয়ায়। নিভু নিভু চোখে তাকালো। নাকে এসে ঠেকল এক অদ্ভুত ঘ্রাণ। ঐশ্বর্য তার বুকে মাথা রেখেছে ভাবতেই ঝড় বয়ে গেল তার মনে। কেঁপে উঠল তার সমস্ত শিরা-উপশিরা! তবে সরালো না ঐশ্বর্যকে। এই অনুভূতি জোয়ার বইছে বয়ে যাক। কোনো না কোনো কারণেই হক না কেন সে এখন তার অর্ধাঙ্গিনী!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]

লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here