প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ৩৮

0
1850

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৮

নিশাত মায়ের কথা কানে তুলল না। এত বড় অন্যায় কর্মকাণ্ড সে করতে পারবে না। প্রহর ভাইকে যেমন সমস্ত মন দিয়ে অপরিসীম ভালোবাসে,তেমনই বাবার প্রতি ভালোবাসার স্তূপটা বেশ উঁচু। কি করে পারবে সে ভালোবাসার পাহাড়টা ভেঙে বাবাকে অসীম দুঃখ উপহার দিতে? বাবা কি তার কাছে অসম্মান, যন্ত্রণা, অপ**মান এসবই পাওনা? তার এক কর্মে মানুষ আঙুল তুলবে বাবার দিকে,উপহাস করে বেড়াবে সুসন্তান গড়তে পারেনি রফিক আজম। সন্তান হয়ে তা মেনে নিয়ে কী পরে সুখী হবে সে প্রহর ভাইয়ের সাথে। প্রকৃতি ছাড় দেয়,ছেড়ে দেয় না। বাবার পাশপাশি মানুষজন তর্জনী তোলবে আলতা ফুপির দিক। মুখে মুখে বলবে যেমন ফুপু তেমন ভাইঝি, একই পথে হাঁটছে। এত এত তিরস্কার মাথায় নিয়ে কীভাবে পৃথিবীতে খুশি থাকবে সে?

এই গ্রামের মানুষগুলো সমালোচনা করতে বেশ ওস্তাদ। মানুষের মনে খুবই সূক্ষ্মভাবে কষ্টের হূল ফুটিয়ে দেয় তারা। বয়সে সপ্তদশী নিশাতের মনে হঠাৎ করেই উদয় হলো বুঝের দ্বিগুণ ক্ষমতা। বর্তমান যন্ত্রণা,জটিল পরিস্থিতি, ভালোবাসার মানুষের থেকে বিচ্ছেদের বেদনা তাকে খুব করে উপলব্ধি করিয়ে দিতে সক্ষম হলো যে, পালিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়,বরং অসম্মানজনক কাজ। মাকে উপেক্ষা করে বসার ঘরে ছুটে এলো সে। রফিক আজম থমথমে মুখে বসে ছিলেন বেতের মোড়ায়। মেজো ভাই আনোয়ারের সঙ্গে আসন্ন মেহমান নিয়ে টুকিটাকি কথা সারছিলেন। ছোট ফুপু, পিংকির মা ঘর গুছাতে মগ্ন বিষন্ন মনে। রবিন বড় ভাইয়ের আদেশে আজ স্কুল কামাই করেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে ভাইয়ের সমুখে। সবাইকে চমকে দিয়ে নিশাত এক অদ্ভুত, অপ্রস্তুত কান্ড করে বসল। ঢলে পড়ল তার আব্বার পায়ের কাছে,ভেঙে পড়ল ঝরঝরে কান্নায়। নরম কণ্ঠে তার বড্ড আকুতি, মিনতি,

” আমাকে বিয়ে দেবেন না আব্বা, আমি ম**রে যাব। প্রহর ভাইকে ছাড়া কষ্ট হবে আমার। দয়া করেন আমার ওপর। বিয়ে দেবেন না। ”

রোকেয়া মেয়ের পিছন পিছন ছুটে এলেন হন্তদন্ত পায়ে। তাকে ধরতে গেলে রফিক আজম হাত তোলে বাঁধা দিলেন। প্রচন্ড গম্ভীর মুখাবয়ব চোখের তারায় ভেসে ওঠতেই মেয়ের জন্য করুণ দৃষ্টি নিয়ে চাইলেন স্বামীর দিকে। চোখ যেন স্পষ্ট বলছে, মেয়েটার আকুতি মেনে নেন। তিনি ভালো করে জানেন বিচ্ছেদে কেবল তাঁর কোমল মনের মেয়েটা কষ্ট পাবে তা নয়, শক্ত, দৃঢ় মনের ছেলেটাও ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তার মেয়ের চেয়েও যে ছেলেটার ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে পাগলপ্রায়। এমন ভালোবাসার মধ্যে দূরত্ব এলে দুইটা জীবনই নষ্ট হবে সেটা কি কঠিন মনের পুরুষটা বুঝতে পারছেন না? এত নিষ্ঠু**র কেন এই লোক?

” আবেগের বশীভূত হয়ে আব্বার পায়ে পড়ে গেলেন ওই বেয়া**দবটার জন্য? পা ছাড়েন, আপনি পা–পে জড়াইছেন,বেয়াদ–বটার লগে ঘুইরা বেড়াইছেন, এখন আপনার শুদ্ধ হবার পালা। ”

ইস্পাতের মতো কঠিন মুখোভঙ্গির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রবিনের অন্তঃপুরে বিদ্রুপের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তার অতি শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের নামে অভিমান জমা আছে তার হৃদয়ের সবচেয়ে গভীরে অন্ততকাল ধরে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সে শুনে এসেছে, তার পরিবারে ঘটতে দেখছেও অহরহ। আলতা বু এর সাথে, নিজের সাথে, অবশেষে এখন ভাতিজির সাথে প্রেমের কারণে অমন অবিচার দেখে ভীষণ প্রতিবাদী হতে মন চাইছে তার। এই ইট পাথরের তৈরি ভিটেতে সে অন্য সকল মানুষের মতোই নিঃশ্বাস ফেলছে। সবার ভিতরে একটা হাসিখুশি ভাব সর্বদা থাকলেও,প্রিয়তমা নিরুকে হারিয়ে ক্ষণে ক্ষণে, বছরের পর বছর তার কষ্ট জর্জরিত হৃদয়ে দুঃখের তরঙ্গ বয়ে চলেছে অবলীলায়। সে জানে,অনুভব করে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে কেমন বিষাদ নিয়ে বাঁচতে হয়, হয়ে যেতে হয় জী*বন্মৃত। অনেক কাল পর মুখ খুলে চলে গেল বাবার মতো সেই শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

” নিশু সত্যিই প্রহরকে ভালোবাসে বলে মনে হচ্ছে ভাইজান। আবেগ বলে মনে হয় না, আপনি আলতাবু রে খবর দিয়ে ওদের বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেন। ”

রফিক আজমের মণিজোড়া লালের আস্তরণে ছেয়ে গেল। রক্তিম চাহনিতে ঝলসে দিতে উদ্যত হলেন ছোট ভাইকে। তাঁর গর্জনে কেঁপে উঠল যেন মজুমদার বাড়ির ইট,পাথর,মানুষের হৃদপিণ্ড।

” তোমার সাহস কী করে হইল এসব বলার? নিজের কুকর্ম ভুলে গেলা? ”

রবিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। নিরুর মৃ**ত্যুর জন্য নিজের সাথে সাথে বড় ভাইকে দায়ী করে সে। আজও চোখের আয়নায় সেই সুন্দর রমণীর চেহারাটা ভেসে ওঠে। রাতের আঁধারে গুমরে ম**রে সে সন্তানকে এই ধরণীর আলো দেখাতে না পেরে। আজ যদি সামনে বসা নির্দয় মনের লোকটা তার ভাই না হতো,তবে নিজ হাতে খু***ন করে নিজেকে খু***নী দাবি করতে গলা কাঁপত না। সে কাঠ কাঠ গলায় দুঃসাহস করে মুখের ওপর বলে উঠল,

” আমি কোনো কুকর্ম করি নি। কেউ না জানুক,আপনি জানতেন নিরুকে আমি আল্লাহকে স্বাক্ষী রেখে কাজী অফিসে বিয়ে করেছি। নিরু আমার স্ত্রী ছিল, আপনি আমার স্ত্রী,সন্তানের খু***নী। এখন নিজের মেয়েটাকে মা**রতে চাইতেছেন। সেদিন সালিসে আপনি আমারে মুখ খুলতে দেন নি নিজে গলায় ফাঁ***সি দিবেন এই হুমকি দিয়ে। উজ্জ্বল ভাই আপনার বাল্যকালের বন্ধু ছিলেন। আপনি ছোট থেকেই হিংসা করতেন মানুষটারে। সেই অমায়িক, ভালো মনের মানুষটা আপনেরে বন্ধু ভাবলেও আপনি ছিলেন উনার মিত্র রূপে শত্রু। উজ্জ্বল ভাই ক্লাসে ফার্স্ট হইতেন, আপনি পড়ে থাকতেন পেছনে এসব আপনার সহ্য হইত না৷ তিনি বিত্তশালী পরিবারের মানুষ এটাও আপনার অপছন্দ ছিল। আলতাবু রে যখন উজ্জ্বল ভাই ভালোবাসেন বলে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন সেদিন আপনি আপনার আসল রূপ দেখাইলেন। বললেন,কোনোদিন উনার কাছে বু রে বিয়ে দিবেন না। আলতাবু রে ব্যবহার করে আপনি উজ্জ্বল ভাইরে একদিক থেকে নিঃস্ব করতে চাইছিলেন। আপনি ভালো করে জানেন ভালোবাসা ছাড়া মানুষ কতটা নিঃস্ব হয়ে যায়। আলতাবু আপনার কান্ডে বাধ্য হয়ে পালিয়ে গেল। আপনার সব হিংসা, শত্রু**তা ওই বাড়ির সাথেই। ওই বাড়ির মেয়েটাকে ভালোবেসেছি এটাও আপনার চোখে দোষ ছিল, নিরুকে চিরতরে মে**রে ফেললেন, আর আমাকে অর্ধ**মৃত বানিয়ে রাখলেন। নিশুর অপ**রাধ সে ওই বাড়িরই ছেলে প্রহরকে ভালোবাসে,অন্য কাউকে ভালোবাসলে মেয়েটার আজ এত কষ্ট পেতে হতো না,ভালোবাসার জন্য ভিক্ষা চাওয়া লাগত না ওর। এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ আপনাকে সম্মান করে বলে দমে ছিল,আনুগত্য করে চলেছে। দেখি নিশুর জীবনে আপনি আপনার মর্জি কীভাবে চালান, আমি নিজে প্রহরকে ফোন দিয়ে বলব নিশুকে নিয়ে যেতে। ”

একটানে দীর্ঘদিনের চাপা কষ্ট মুক্ত করে দিয়ে জীবনে প্রথমবার অসম্মানের দৃষ্টিতে তাকাল ভাইয়ের দিকে। বড় বড় পদলি ফেলে বসার ঘর ত্যাগ করে রবিন বাহিরে চলে গেল। নিশাতের সমগ্র অস্তিত্ব জানল চাচার নিরবতার প্রাচীরের আড়ালে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা বেদনার কাহিনী, আব্বার নির্দয়তার গল্প। কান্নায় ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। বড় বড় চোখ দুটি ভেসে যাচ্ছে শ্রাবণের বৃষ্টিতে। ফের,ফের সে অনুনয়ের সুরে বলল,

” আপনি বলেছেন ভালোবাসা পা**প,সেই পা**পে আমি পা**পী হয়ে থাকতে চাই। শাস্তি দিন,কিন্তু আমাকে ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে চিরকাল মর**ণযন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে বলবেন না। আমি তিলে তিলে মর**তে চাই না আব্বা। প্রহর ভাইয়ের সাথে ভালো থাকতে চাই। আমাকে আর ওই মানুষটারে আপনি শেষ করে দিয়েন না। ”

ছোট ভাইয়ের বেয়াদবি, ঘৃ***ণা, মেয়ের পা**গলের মতো প্রলাপ কিছুই রফিক আজমের অহংকারের উঁচু ইমারত টলাতে পারল না। তিনি কড়া কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন,

” রোকেয়া! মেহমান গ্রামে ঢুকে পড়ছে,মাইয়ারে নিয়ে সাজাও। আজ এই বাড়িতে বিয়ে না হলে প্রলয় হইব। আমার আত্মসম্মানে আঘাত করলে আমি কাউরেই চিনি না। যদি স্বামী, সংসার হারাইতে না চাও নিয়ে রেডি করো ওরে।”

নিশাত অভিমান ভরা জলে টইটুম্বুর দৃষ্টিজোড়া আব্বার দিকে ছুঁড়ে মা”রল। আব্বার কথার ধাঁচে তার বুঝতে বাকি নেই যে মা তার পক্ষপাতিত্ব করলে উনার সংসারে ভয়ংকর ঝড় উঠবে। ছি! আব্বা কেমন করে এমন হুমকি দিতে পারে? রুমে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন রোকেয়া। আশ্বাস দিলেন প্রহর আসবে। সে যেহেতু গ্রামে আছে কোনো না কোনোভাবে বিয়ের কথা তার কানে যাবেই।

কলিজা রঙের বেনারসিটা অ**জগর সা**পের ন্যায় নিশাতের শীর্ণ কায়া পেঁচিয়ে রেখেছে। অশ্রুসিক্ত চোখে কাজল,ঠোঁটে খয়েরী কালার লিপস্টিক, অতীব ছোট্ট একটা গোলাকার কালো টিপ কপালের সামান্যটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে। মেহমান আসায় আব্বার আদেশে নিচে নিয়ে আসা হলো তাকে। জড় পদার্থের মতোই একটা জায়গায় আঁটকে ছিল তার পা দুটো। মনে হচ্ছিল পেরেক গেঁথে লাগিয়ে দিয়েছে কেউ মেঝেতে। রোকেয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েকে ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দিল। অধোমুখী নিশাতকে বলা হলো মুখশ্রী তোলে বসতে। কথামোতাবেক তাকাল সে, চমকে গেল। মস্তিষ্ক জোরেশোরেই বলল পাত্র রূপে বসে থাকা সামনের ছেলেটাকে চেনে সে। দেখেছিল এই গ্রামেই, প্রহরের এনগেজমেন্টের সময়টায়। ওই যে তাকে স্মরণিকা নিবাসের পথের কথা জিজ্ঞেস করেছিল, শেষে বা**জে,অদ্ভুত মন্তব্যও করতে ভোলে নি। এক দৃষ্টে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকল ও। হঠাৎ করে লাজলজ্জা বোধহয় ছেলেটা ভুলেই গিয়েছিল,সরাসরি রফিক আজমকে প্রস্তাব দিলেন,

” আংকেল,আমি কি আপনার মেয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলতে পারি? ”

নিশাতের আব্বা চমৎকার হাসিতে মাখোমাখো হয়ে অনুমতি দিলেন,

” অবশ্যই। ”

মনে মনে তিনি একটু দ্বিধায় আছেন, নিশাত যদি আজেবাজে কিছু বলে ছেলেটাকে। তবে তিনি প্রহরের সাথে প্রেমের কথা নিয়ে বিয়েতে কোনো ভেজাল হবে এটা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন। প্রেমের কাহিনীটুকুর হদিস মেয়ের হবু জামাই-ই দিয়েছে। ছেলেটা কয়েকটা ছবি নিয়ে একদিন উনার দোকানে হাজির হয়। দোকানের সম্মুখে,মাঝ বাজারে অকস্মাৎ গাড়ি থামতেই অনেক অনেক উৎসুক চোখ, জনতা তাকিয়ে দেখতে শুরু করে। দুই দিন আগের কথা, মধ্য দুপুর ছিল। কড়া রোদে ঝিমিয়ে পড়েছে দোকানিরা। অসময়ে গ্রামে নতুন মুখকে এগিয়ে আসতে দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন তিনি। লম্বা,চওড়া,সুন্দর ছেলেটাকে উনার কাছে রাজপুত্রের থেকে কম মনে হলো না। আরো বেশি মুগ্ধ হলেন মোহনীয় কণ্ঠের সালাম শুনে। এত আদব, কায়দা পালন করে, হাসিমুখে দাঁড়ানো ছেলেটাকে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। সালামের জবাব দিতেই ছেলেটা স্পষ্ট গলায় নিজের পরিচয় দিল। চিনতে দেরি কিংবা সংশয় কোনোটাই হলো না উনার। স্বল্প সময়ে পরিচিত ছেলেটা কিছু ছবি দেখালো নিজের মোবাইলে। ক্যামেরায় বন্দী ছিল লাল,নীল,হলুদ ফেরিলাইটের আলোতে হাতে হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখে ভালোবাসা বিনিময় করা নিশাত এবং প্রহর। ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েকে গলা টি**পে হ**ত্যা করতে মনস্পৃহা জাগলেও দমে গেলেন। আদরের মেয়ের কি ক্ষতি করা যায়? বরঞ্চ উনি ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলেন ভালোবাসা নামক গাছটাকে শেকড়সহ উপরে ফেলে দেওয়ার।
* * *

” চেনো তুমি আমাকে?”
নিশাত মেপে মেপে তিন হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। তেজী,সোনালি রোদের ভীষণ দুস্থিতি আজ। মধ্যাহ্নেই কুয়াশার রাজত্ব চারিধারে। পুকুরের অপর পাশ থেকে ধেয়ে এসে সিক্ত ভেজা হাওয়া নিশাতের শরীরে কাঁপুনি তুলল। ঠকঠক কাঁপতে শুরু করল সে। গায়ে কোনো সোয়েটার, চাদর কিছুই নেই। নিশাত জলের পানিতে শাড়ি পরিহিতা একজন নারীর অর্থ্যাৎ নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। ঠান্ডায়, অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিল,
” চিনি। আপনি একজন রাজনীতিবিদ এবং মডেল। ”
” নামটা জানো?”
” জানি,সমীরণ। ”
সমীরণ মৃদু হাসল। এক হাত দুরত্ব নিঃশেষ করে দিয়ে আরেকটু কাছে চলে আসে নিশাতের। নিশাত অবাক হলো। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল সে। সমীরণ থেমে গিয়ে শীতল গলায় বলল,
” একটু পরেই আমার বউ হবে তুমি। আমাকে পছন্দ হয়েছে তোমার?”
নিশাতের চরিত্রে নেই কারো সাথে ব**দ,খারাপ ব্যবহার করার অভদ্র অভ্যেস। যথাসম্ভব উচ্ছ্বসিত রাগটা দমিয়ে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মনের কথাগুলো ব্যক্ত করে,

” আমি একজনকে ভালোবাসি। আপনাকে বিয়ে অথবা পছন্দ কোনোটাই সম্ভব না। আপনি প্লিজ চলে যান। ”

” কাকে ভালোবাসো? তোমার ফুপাতো ভাই,নেতাসাহেব প্রহরকে?”

নিশাত বিস্ফোরিত চক্ষুদ্বয় সোজা সমীরণের মুখের ওপর নিবদ্ধ করল। তনুজার ভাই হওয়ায় প্রহরের নামটা কোনোক্রমেই উচ্চারণ করতে চায় নি ও। কিন্তু এ মুহূর্তে তার মন বলছে সমীরণ একটা ধুরন্ধর চালাক ব্যক্তি। সবকিছু জেনেশুনেই এখানে পা বাড়িয়েছে। সমীরণ তার দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে নিঃশ্বাসের কাছাকাছি উপস্থিত হলো। তপ্ত নিঃশ্বাস নিশাতের আরক্ত চেহারায় লেপ্টে যাচ্ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে, লম্বায় মানুষটা বেশি হবার দরুণ তার উত্তপ্ত নিশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে বক্ষস্থলে।

নিশাতের গলা তরলশূণ্য,শুকিয়ে কাঠ। মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত পথিক মনে হচ্ছে তার নিজেকে। বুকে হাত দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিতে চাইলে খপ করে মুঠোবন্দি করে ফেলে সমীরণ হাতটা। বাঁকা হেসে শুধালো,

” তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে পুচকি। তোমার প্রহর ভাই, জান আসবে না তোমাকে রাজকুমার সেজে নিয়ে যেতে। তাই আমার সাথে পাল্লা নেবার সাহস দেখিয়ো না। ”

নিশাত বিশ্বাসের সাথে জবাব দিল,” প্রহর ভাই আসবে। ”

হো হো করে হেসে উঠল সমীরণ। পুকুরের পানিতে শব্দ হলো। হতে পারে মাছগুলো তার রাক্ষসের ন্যায় হাসিতে বিরক্ত হয়ে গভীরে চলে গিয়েছে।

” নেতাসাহেব আসবেন না। পার্টিতে দ্বন্দ্ব লেগেছে। ভোটের দুই দিন আগে মা**রামা*রি, বুঝোই তো? তিনি থামাতে ছুটে গিয়েছেন। কীভাবে আসবে? আর মিনিট কয়েক পরই বিয়ে। যতক্ষণে তোমার প্রহর ভাই আসবে ততক্ষণে তুমি আমার বউ হয়ে যাবে। ”

পুরো পৃথিবী দুলে উঠল নিশাতের। শরীরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয়ের হানা। আঁখি উপচে জল নেমে এসেছে। ভীষণ বড় বড় অশ্রু ফোঁটা। সমীরণ কৌতুকপূর্ণ স্বরে বলে,

” বাহ! তোমার চোখের জল ভীষণ সুন্দর। কেঁদো না, আমি তোমাকে তোমার প্রহর ভাইয়ের থেকেও বেশি আদর করব। ”

নিশাত রাগে,দুঃখে,ঘৃণা**য়,ক্ষোভে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল, ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল সমীরণকে। সমীরণ মজা পেল এমন ভঙ্গিতে মিটিমিটি হেসে এগিয়ে এসে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,

” শুনো মেয়ে, হার কোনো মানুষেরই পছন্দ না। রাজনৈতিক প্লাটফর্মে প্রহর এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার সবসময়ই তার শক্ত,দাপুটে মনের আড়ালে যে দুর্বলতা লুকিয়ে আছে সেটা দরকার ছিল। সে তোমাকে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আমি ঠিকই জানলাম তার পৃথিবী উজাড় হয়ে যাবে তোমাকে হারালে। তার পৃথিবীকেই যদি আমি আমার দখলে নিয়ে নিই,সে বাঁচবে কেমন করে? তোমাকে আমি সারাজীবন নিজের করে রাখব,শুধুমাত্র তার আত্মার মৃ**ত্যু ঘটাতে। ”

#চলবে,,,
( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here