#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩৭
ভালোবাসার প্রদীপ যখন নিভু নিভু থাকে,বুকের ভেতর তখন ধিকিধিকি আগুন জ্বলে। চাতকের মতো পথ চেয়ে থাকে তপ্ত হৃদয় শীতল বায়ুর। সেই হিম শীতল, মন ভালো করে দেওয়া বাতাস পাওয়ার লোভে লোভাতুর হয়ে মানব মন দ্রোহ, কষ্ট, যন্ত্রণা সব সহ্য করে,এড়িয়ে ছুটতে থাকে পুরো দমে। মৃন্ময়ীও ছুটছে বেয়ারা হয়ে। সে দুঃখ প্রকাশ করতে পারে না,শেখেনি। পারবে কীভাবে? এ ব্যস্ত নগরীতে পা ফেলার আগে কোনো মনোবেদনা তার মনকে ছুঁয়ে দেয় নি, কাঁদায় নি রাতের পর রাত। এ শহর, এই নগরীর জঘন্য, মুখোশধারী কিছু মানুষ তার জীবনের রংধনুর সাত রং কেঁড়ে নিয়েছে, উপহার স্বরূপ দিয়েছে সাদাকালো, বর্ণহীন একটা জীবন। তার সমস্ত দেহ, মস্তিষ্ক, অন্তর বিদ্রোহ করেছে একযোগে ভালোবাসাকে ঝাপটে ধরতে, পারে নি সে। হেরেছে, বার বার গুমরে মরে**ছে বাস্তবতার কাছে। তার নিভু নিভু অনুরাগের প্রদীপটা হেলাফেলায় নিভে গেছে চিরতরে, জ্বলবে না আর কোনোদিন। আজ সে রিক্ত,শূণ্য। সে জানত, যেচে আসা ভালোবাসাকে তার হারাতে হবে, তবুও কেন এত কাঁদছে ভেতরটা? বহু সাধনা,কষ্ট সহ্য করে যে শক্ত আবরণটা তৈরি করেছে, তা সরিয়ে নরম রূপটা কাউকেই দেখাতে চায় না ও। সে বুঝল,জানল,ভালোবাসার মতোন রঙ,ঢং তার জন্য নয়, সে তো কেবল হারাতেই জানে। কেউ কখনো জানবেও না প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া মৃন্ময়ী নতুন করে প্রেম সমুদ্রে ডুব দিয়েছিল, ওঠে নি আর।
গোলগাল চেহারার মেয়েটাকে এগিয়ে আসতে দেখে সে তড়িঘড়ি করে দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল। তার বুকের গহীনে যে ধ্বংস যজ্ঞ চলছে কাউকে টের পেতে দেবে না ও। মেয়েটার সাথে আজ ওর দ্বিতীয় দেখা। অল্প টুকু সরে গিয়ে মেয়েটাকে বসার জায়গা করে দিয়ে ঝরঝরে কণ্ঠে, হাসি-হাসি মুখে বলল,
” বসুন আপু৷ ক্লাস শেষ আপনাদের? ”
” না। দেখলেন,নিজেও ক্লাস মিস করলাম, আপনাকেও করালাম। ”
তীব্র আফসোস নিয়ে বলল ঊষা। বসতে বসতে সে আরও বলল,
” প্রত্যয় ভাইয়া দেখা করেছে আপনার সাথে? ”
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ীর নিষ্ঠু**র মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। কান্নাবিন্দু মুক্ত হতে চাইল সুন্দর দুটি চোখ ছাপিয়ে। কিন্তু মৃন্ময়ী দেবে না। দুর্বলতা মানায় না তার। জটিল এ ভুবনে পাথরের মতো শক্ত রূপটাই টিকে থাকার জন্য সঠিক, যৌক্তিক। সে খুব আস্তে করে বলল,
” না। ”
ঊষা কপালে ভাঁজ ফেলে,চক্ষুদ্বয় সরু করে প্রশ্ন করল,
” কবে থেকে আর দেখা হয় নি আপনাদের? ”
দুই মাস আগে একবার ভার্সিটিতে ঢুকার সময় গেইটের সামনে মুখোমুখি হয়েছিল প্রত্যয়ের। লোকটা মৃন্ময়ীকে এক পলক দেখে নিয়ে চট করে নজর সরিয়ে চলে গেল অতি সন্তর্পণে। মৃন্ময়ী বার বার পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়েছে, ফিরেও দেখে নি লোকটা একটাবার। বিস্ময়ে কাজল ও তিমুর মুখ হা হয়ে গিয়েছিল। তারা দুজন হতভম্ব স্বরে ওকে প্রশ্ন করেছিল,
” মৃন্ময়ী এটা প্রত্যয় ভাই না? তোকে এড়িয়ে গেল নাকি রে? আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেই ছেলে মেঘ বাদলা,রাত-ভোর, অপ**মান পরোয়া না করে তোর পেছনে পড়ে থাকত,সে কি-না তোকে ইগনোর করল! কী হয়েছে রে? আবার খারাপ কিছু বলেছিস? ”
মৃন্ময়ী সজোড়ে মাথা নেড়ে জবাবে বলেছিল,” কিছু বলি নি। উনাকে এ কয়দিন দেখিই নি৷ কি জানি কী হলো!”
সেদিন মৃন্ময়ী হতবাক হয়েছিল। মানুষের আচরণ এত জলদি পাল্টায়! তারপর মৃন্ময়ীর মনে পড়ল, অনিশ্চিত পৃথিবীতে নিশ্চিত কিছুই নয়, আর মানুষের আচরণ তো প্রকৃতির মতোই রূপ পরিবর্তনে দক্ষ। সে ঊষাকে সিধেসাধা কণ্ঠে বলল,
” আপনার বিয়ের আগের রাতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন না? তার একদিন আগে ভার্সিটিতে দেখেছিলাম, তবে দেখাটা অবশ্য ভুলবশতই হয়েছিল। ”
ঊষার বিস্ময়ের শেষ নেই। প্রত্যয় কি পাল্টে গেছে সত্যিই? ভালোবাসার রং বদলায়? ভালোবাসার নিয়ম হলো ভালোবেসে যেতে হবে আমরণ,চিরকাল। তাহলে পাল্টালো কেমন করে? প্রত্যয়ের প্রতি অভিমানটা আরও কঠিনভাবে জমে গেল মনিকোঠায়। মোহের নেশায় আসক্ত হয়ে একটা মেয়ের পিছু ঘুর ঘুর করা, তাকে স্পর্শ করা, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো একেবারেই অনুচিত। আজ সে স্বচ্ছভাবে মৃন্ময়ীর মতামত জানতে এলো,খোঁজ নিল প্রত্যয়ের অনুভূতির। এতে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে তার। সে একটু মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করল,
” আমার বিয়ের দিন আপনাকে আসতে বলেছিলাম। আপনি কেন আসেন নি? আপনি আসলে হয়ত ঘটনাটা অন্যরকম হত, প্রত্যয় ভাইকে গ্রহণ করে নিলে আপনাদের দুজনের জীবনটা সুন্দর হত। ”
মৃন্ময়ীর ওষ্ঠযুগলে স্মিত হাসি নিরবে,নিঃশব্দে খেলছে। ঊষাকে চমকে দিয়ে বলল,
” কাকে গ্রহণ করার কথা বলছেন? আমাকে ভালোবাসলে, আপনি তার সহধর্মিণী হতেন না৷ আপনাকে ভালোবাসত বলেই বোধ হয় তার জেদ আমাকে কাবু করতে পারে নি। বিয়ের জন্য কংগ্রাচুলেশনস। ”
” আমি ভাইয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। বিয়ের পরের দিনই আমি বাড়ি ছেড়েছি,ফ্রেন্ড এর বাসায় উঠেছি৷ দুইটা মাসে একবারও বাবাকে দেখতে যাই নি। ”
মৃন্ময়ী বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে বলল, ” কেন করেছেন এমনটা? ”
” ভাইয়া অপ**রাধ করেছে, তার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কবুল বলতে বাধ্য হয়েছি বাবার মুখ দেখে, কাকিমণির অশ্রুসজল চোখ দেখে, প্রহর ভাইয়ার কথায়। দায়বদ্ধতার সংসার আমি কেন করব? ”
” ভালোবাসেন বলে কি রাজি হোন নি? জানেন, আমার বুঝার ক্ষমতাটা একটু বেশিই। আমি মানুষের ভালোবাসা ধরতে পারি। কে আমাকে ভালোবাসে, কে বাসে না খুব করে বুঝি। সেদিন রাত্তিরে প্রথম দেখায়,আপনার কথায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম প্রত্যয় ভাইয়ার জন্য আপনি ঠিক কতটা ভালোবাসা হৃদয়ে লুকিয়ে রেখেছেন। আমরা প্রতিটা মানুষ ভুল করি, মাঝে মাঝে আবেগকে-জেদকে বলি ভালোবাসা, আর ভালোবাসাকে আবেগ, মোহ বলে দূরে ঠেলে দিই। হ্যাঁ, উনি অপ**রাধ করেছেন, জেদকে প্রেম দাবি করে আমাকে চেয়েছেন, ভেবেছে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। কিন্তু দেখেন আমার প্রত্যাখানে দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু আপনাকে হারানোর ভয়ে চিরতরে নিজের নামে লিখে নিয়েছে। আমি কখনোই উনার জেদকেও আপন করতে পারতাম না,আমার সেই সাধ্য নেই আপু, আমি এসেছিলাম শুধুই উনাকে পোড়াতে। আমার জীবনের ধ্রুব সত্য হলো আমি একজন বিধবা মেয়ে। ”
কথাটা নিজেকে পরিপাটি করে শক্ত মনে,দৃঢ় কণ্ঠে বলে ফেলল মৃন্ময়ী। ঊষার মনে হলো কোথায় বো**মা বিস্ফো**রণ ঘটেছে। অবিশ্বাস্য গলায় জোরেশোরেই উচ্চারণ করল,
” কী বলছেন?”
কিন্তু মৃন্ময়ী অত্যধিক ঠান্ডাভাবে আরও চমক দিয়ে বলল,
” শুধু তা নয়। আমার চার বছরের একটা ছেলে আছে আপু। আমার জীবনের কঠোর বাস্তবতা একদিন আপনাকে বলব। হাতে সময় কম। শহর ছাড়ার বন্দোবস্ত করছি। যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার সাথে একবার দেখা করে যাব। ডিভোর্স শব্দটা আর উচ্চারণ করবেন না। তাকে তার ভুল বুঝতে দিন, শাস্তি দিন, তবুও ছেড়ে যাবেন না। যারা পা**প করে,ভুল করে তাদের আমরা নিচু করলে তারা কি নিজের ভুলটা বুঝতে পারে? পারে না,বরং সেই মানুষটার পাশে থেকে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিতে হয় সে পাপ করে**ছিল,ভুলের আগুনে হয়েছিল দগ্ধ।
মৃন্ময়ী পার্ক থেকে বেরিয়ে যায়,চলে যায় রহস্য রেখে। ঊষার নিকট এই মেয়েটাকে আরও রহস্যময় লাগছে। মেয়েটার চোখে প্রত্যয়ের জন্য শ্রদ্ধা দেখেছে স্পষ্ট। কত পজিটিভ চিন্তাধারা মেয়েটার! কষ্টের ছাপ লেগেছিল চোখে মুখে। প্রত্যয় ভাই কি কখনো জানবে যাকে আশ্রয় দিয়েছিল জেদের বশীভূত মনে, তার জীবনের সত্যটা?
ঊষা আবার তাড়াহুড়ো করে পা চালাল। আরও একটা ক্লাস আছে ওর। শীতের ঘন কুয়াশা পালিয়েছে মধ্য দুপুরে। তেজহীন রোদ উঁকিঝুকি মা**রছে এদিক সেদিক। বারোটা বাজে। ক্লাসের পর সোজা হলে যাবে ও। বাবাকে দেখা হয় না কতদিন। বাড়ি গেলেই প্রত্যয়ের চোখে ধরা পড়বে। আশ্চর্য হলেও সত্য দুইটা মাসে প্রথমবার বাহিরে এসেছে ও। হল থেকে ক্লাস,ক্লাস থেকে হল এটাই তার গন্তব্য। বাবা ও প্রহর ভাই ছাড়া কারো কল রিসিভ করে না। প্রত্যয়ের নাম্বারটা বিয়ের রাতেই ঠাঁই পেয়েছে ব্লক লিস্টে। কেন জানে না,প্রত্যয়কে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারছে না ও। বার বার মনে হচ্ছে লোকটা অন্যা**য় করেছে ওর সাথে, মৃন্ময়ীর সাথে। বার কয়েক মেডিক্যাল কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রত্যয়,ভিন্ন নাম্বার থেকে কল দিয়েছে। কিন্তু ঊষা রেসপন্স করে নি, তার আসার খবরটা ওর বন্ধু-বান্ধবই দিত। বেশ লুকিয়ে চু**রিয়ে থাকে সে নিজের স্বামীর কাছ থেকে। তবে এখন বেরিয়েই মনে হলো চরম ভুল করে ফেলেছে। সমুখের লম্বাদেহী, এলোমেলো চুলের পুরুষকে দেখে বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ভাবল,মুখ ওড়না দিয়ে ঢেকে কেটে পড়বে,হইল কই? ঠিক ঠিক সেই পুরুষের কাছে ধরা খেয়ে গেল।
মনের মানুষকে চেনার,তার উপস্থিতি টের পাওয়া,তাকে অনুভব করার এক অন্যরকম অদ্ভুত শক্তি থাকে প্রতিটা প্রেমে মত্ত মানুষের। ঊষা যতই মুখ ঢাকুক, নিজেকে আড়াল করুক ঠিক ঠিক প্রত্যয় পেয়ে গেল তাকে,টের পেল তার অস্তিত্ব। পাশ দিয়ে যাবার সময়টায় ওর ওড়নার একটুখানি অংশ পেছন থেকে টেনে ধরল প্রত্যয়। গম্ভীর গলায়,অভিমান জমা কণ্ঠে আদেশ করল,
” গাড়িতে গিয়ে বোস। ”
ঊষা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ ওদের দিক চেয়ে আছে কি-না। না, কেউ দেখছে না। সে না ঘুরেই কলেজের গেইটের দিক দৃষ্টি রেখে কঠিন মুখে বলল,
” ওড়না ছেড়ে দাও। পাবলিক প্লেসে অস***ভ্যতামি কেন করছো?”
প্রত্যয়ের মেজাজ চড়ে গেল। রাগ টগবগ করছে সমস্ত শরীরে। বিয়ের পর পরই বাড়ি ছেড়েছে মেয়েটা,যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। তার সাথে ক্লিয়ার কথা পর্যন্ত বলছে না,বলার সুযোগটাও দিচ্ছে না। অনেক সহ্য করেছে সে। সে মানে এবং জানে বড়সড় অন্যা**য়ে লিপ্ত সে, তাহলে কি কথা বলার সুযোগটুকু দেবে না? জানতে চাইবে না তার কথাগুলো? রাগত্ব স্বরে বলল,
” তুই আমার স্ত্রী। তোর সাথে অস**ভ্যতা কেন করব? তোর ওড়না ধরার পুরো অধিকার আমার আছে। ”
ঊষা এবার ঘুরল, তেজী দৃষ্টিজোড়া সরাসরি ডুবিয়ে দিল প্রত্যয়ের চোখের চাহনিতে। কণ্ঠ অল্প শীতল, মিশে আছে একটুখানি যন্ত্রণার ছাপ,
” আমাকে স্পর্শ করার লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছ বলে, আমার মতামতের বিরুদ্ধে ছুঁয়ে দিবে? হাত দিয়ে ছোঁয়ার আগে,মন দিয়ে ছুঁয়ে দিতে হয় ভাইয়া, মনের মিলন ঘটাতে হয়। ”
প্রত্যয় আহত হলো কথার ধাঁচে। এই ঊষাকে ও চেনে না। এমন করে তার সাথে কথা বলে নি কখনোই। ওড়না ছাড়ল না তবুও। বরঞ্চ আরেকটু টেনে ধরে লহু স্বরে বলে উঠল,
” এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না। আমার সাথে চল। ”
ঊষা একরোখা জেদ ধরে বসল সে যাবেই না। বাধ্য হয়ে প্রত্যয় টানাহেঁচড়া করে গাড়িতে তুললো তাকে। তন্মধ্যে এক ছেলে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে বসে,” আপনি উনার সাথে জোরাজুরি করছেন কেন?” প্রত্যয়ের জবাব ছিল বিশদ, কণ্ঠ ছিল ধারালো,” বউ অভিমান করে পালিয়ে এসেছে, মান ভাঙিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ”
ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেল থতমত খেয়ে। একবার তাকাল ঊষার দিক,ঊষা মুখ ফিরিয়ে চুপটি করে আছে। যা বুঝার বুঝে গেল ছেলেটা। প্রত্যয় গাড়ি ছুটিয়ে কোলাহলের স্থান ত্যাগ করে একটা নির্জন জায়গায় এসে ব্রেক কষল। কোথাও কেউ নেই, একেবারেই নিশ্চুপ একটা জায়গা। গাড়ি থেকে নেমে সে তার হৃদয়ের রাণীকে টেনে বের করল। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মা**রল ঊষার পানে,
” কী সমস্যা তোর? বড় বাবা,ভাই, মা সবাই চাইছে তুই বাড়ি ফিরে যা। কারো সাথেই ঠিকঠাক কথা বলছিস না। তাছাড়া আমি তোর হাসবেন্ড ঊষা, কীভাবে পারছিস আমাকে ছেড়ে এভাবে থাকতে?”
” নাটকীয় বিয়ে নিয়ে এত কীসের অধিকার দেখাচ্ছ তুমি?”
প্রত্যয় ওর দুই হাত ধরে কাছে নিয়ে আসল৷ বন্দী করে ফেলল তার ভোরের পাখিকে বক্ষপিঞ্জিরায়। পিঠে হাত রেখে বুকের সাথে লাগিয়ে গালে গাল ঘষে ধীরভাবে,সুমধুর সুরে বলল,
” বিয়ে কীভাবে করেছি সেটা বড় কথা না, গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো তুই আমার বউ। প্রত্যয় এহসানের বউ হয়ে তুই খুব ঘাড়***ত্যাড়া হয়ে গেছিস ঊষা। ”
ঊষা প্রত্যয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি লুকিয়ে শ্লেষের গলায় বলে উঠল,
” সঙ্গ দোষে স্বভাব নষ্ট। তাই ঘাড়**ত্যাড়ার বউ ঘাড়**ত্যাড়া হবে এটাই নিয়ম। ”
” এই নিয়ম তুই বানিয়েছিস? ”
” পৃথিবীর সকল নিয়ম বানাতে হয় না। কিছু কিছু নিয়ম আপনাআপনি চলে আসে, আমরা কেবল সেগুলো সাদরে গ্রহণ করি। ”
প্রত্যয়ের সম্পূর্ণ চাহনি আঁটকে আছে মায়াবী গড়নের মায়াবতীর মুখশ্রীর অপার সৌন্দর্যে। অপরূপা তার কাছ থেকে আড়ালে ছিল মাসের পর মাস, ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে তাকে। ঊষাকে হারানোর ভয়ে সুপ্ত প্রেমের গর্জনে কেঁপে ওঠেছিল তার মন-প্রাণ-অন্তর। জোরদার হরতাল চলছিল হৃদয় পথে। সে তার করা সকল অন্যা**য়, অবিচার,সবকিছু বক্ষস্থলে থাকা মেয়েটাকে বলতে চায়। অতঃপর যদি গ্রহণ করতে হয় তাকে শা**স্তিসরূপ আবারও দূরত্ব, মাথা পেতে মেনে নিবে সে। তবুও পারবে না মায়াবী রূপের বউটাকে হারাতে।
__________________________
সত্যি সত্যি বাড়িতে এসে জ্বরের উত্তাপে পুড়ছে নিশাতের শীর্ণ কায়া। চোখের মণি রক্তাভ। ফরসা চেহারাটা টমেটোর মতো টকটকে লাল আবিরে মাখোমাখো। তাতে ওর কোনো চিন্তা নেই। এমনকি উত্তাপ ওকে কাবু করতে পারছে না। তার মনের কাননে লাল-নীল প্রজাপতি তিড়িংবিড়িং করে ওড়ছে, দিগন্তে জুড়ে রংধনুর মেলা। স্মরণিকা নিবাস থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসে পৌঁছাল মজুমদার বাড়িতে সে জানে না। মনে হলো অদৃশ্য এক শক্তি টেনে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে মজুমদার বাড়ির চৌকাঠে। লজ্জার রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে কোন পথে হেঁটে এসেছে তা-ও খেয়ালে নেই। মস্তিষ্ক, মন, দেহ সব কেবল বারংবার ওকে নিয়ে যাচ্ছে চুম্ব–নরত মুহূর্তে, অক্ষিকাচে ভেসে ভেসে ওঠছে মাদ–কময় দৃশ্যখানি।
কিশোরী মন আজ বড়ই চঞ্চল। নিশাতের মন চাইছে ডানা মেলে ওড়তে, খুব করে সাজতে, কাউকে কানে কানে ফিসফিস করে বলতে,” জানো, আমার ভালোবাসার মানুষটার চুমু মধুর মতো মিষ্টি, তার ছোঁয়া ফুলের মতোই পবিত্র। ” হ্যাঁ, নিশাত অনুধাবন করেছে সেই পবিত্র ভালোবাসা, অঙ্গে মাখিয়েছে শুদ্ধ ছোঁয়া। জ্বর টর কে সে আর তোয়াক্কা করে না। লক্ষাধিক বার জ্বর এলেও প্রহর ভাইয়ের সান্নিধ্য হাতছাড়া করবে না সে, জ্বরে কাতর হয়ে মানুষটার বুকে পড়ে থাকবে। ফুপি বলেছে বিকেলেই আসবে ওদের বাড়িতে। সেকারণে নিশাত বাম হাত ভরে মেহেদি পড়ল, প্রহর ভাইয়ের দেওয়া হলুদ শাড়িটা নামিয়ে রাখল আলমারি থেকে। এটা পড়বে আজ প্রহর ভাই আর ফুপি ওকে দেখতে আসলে। শাড়িটা তনুজার ওপর রাগ দেখিয়ে পড়ে নি ঊষার হলুদের রাত্রিরে। আকস্মিক মনে পড়ল রোকেয়া রুমে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওকে। দ্রুত দ্রুত মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ল,
” আম্মু ডাকছিলে?”
রোকেয়া স্বামীকে কলম এগিয়ে দিতে দিতে জবাব দিলেন,
” হ, তোর আব্বা ডাকছেন তোরে। ঘরে আয়। ”
রোকেয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের একপাশ ঢেকে রেখেছেন। অবাকই হলো নিশাত। মা কখনোই এরকম করে মাথায় ঘোমটা টানেন না। চমকপ্রদ চাউনি সমেত ঘরে ঢুকল ও। তক্ষুণি বাবার গাম্ভীর্যের ভাষা শুনতে পায়,
” এদিকে আসেন আম্মাজান। ”
গম্ভীর কণ্ঠস্বর,অথচ কি আদুরে! গটগট পায়ে আব্বার সামনে গিয়ে সালাম দিল। ভারী নম্র কণ্ঠে উত্তর দেয়,
” জি,আব্বা। ”
মেয়ের কোমল হাতটা ধরে পাশে বসালেন রফিক আজম। মেহেদী রাঙা হাত দেখে প্রশংসা করলেন খুব,
” সুন্দর হইছে আম্মা। তা আপনার পড়াশোনা কেমন চলতেছে?”
” ভালো আব্বা। “- বিনয়ী কণ্ঠ নিশাতের।
” আব্বা আপনারে ভালোবাসি এটা মানেন?”
” আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাতে সন্দেহ নেই। ”
একটুখানি গলা ঝাড়লেন রফিক আজম। গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলতে লাগলেন,
” কিন্তু আপনি যে আব্বার মুখে চুনকালি মাখতে চাইতেছেন আম্মা, আদর করে বড় করার এই ফলাফল দিতেছেন? ”
নিশাত আঁতকে উঠল। সে আগের চেয়ে কিছু বুঝদার হয়েছে, এখন আর অতটাও বোকা না যে আব্বার কথা ধাঁচ বুঝবে না। কু ডাকছে তার মন। মায়ের দিকে বক্র চাউনি নিক্ষেপ করল সঙ্গে সঙ্গে। চক্ষে পড়ল মায়ের কাতর দৃষ্টি। বুঝার বাকি রইল না কোনো বিপদ আসছে ধেয়ে তার জীবনে। সে মৌন হয়েই রইল।
” রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নেবেন। আপনার মোবাইল নিয়ে নিছি আমি। বোকা আপনি আম্মা। পা**পে জড়িয়ে গেছেন। প্রেম জীবন নষ্ট ছাড়া কিছুই করে না। আপনের কাকারে দেখেন না, বিয়ে করে নাই এখনও? মজনু হইছে সে প্রেমে পইড়া। নষ্ট করছে জীবনটা। আপনের আব্বা আপনের জীবন নষ্ট করতে দিব না, সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার। সুন্দর কইরা রেডি হইবেন, পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে আপনারে। যান,এখন। ”
এক লহমায় নিশাতের সব আনন্দ, খুশি,সুখ পাখি হয়ে দূর আকাশে ওড়ে গেল৷ মৃত্তিকায় বসবাসরত নিশাতের সাধ্য হলো না আকাশ ছোঁয়ার। রক্ষা করতে পারল না ও নিজের সুখগুলোকে। বুঝার বাকি আর কিচ্ছুই নেই যে আব্বা তার এবং প্রহর ভাইয়ের প্রেম টের পেয়ে গেছেন। পা ভেঙে আসছে তার৷ নেতিয়ে পড়েছে সমস্ত দেহ। ভুর ভুর করে জ্বরটাও বেড়ে গেল।
রোকেয়া মেয়ের এমতাবস্থা পরখ করে পিছু পিছু ছুটে এলেন। কোনোমতে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলেন রুমে। নিশাত সমগ্র পৃথিবী ভুলে মা’কে ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। শ্রাবণে ধারা অঝোরে ঝরতে থাকে নেত্রযুগল ছাপিয়ে। অস্পষ্ট স্বরে বার বার উচ্চারণ করতে থাকে,
” আ,,,,আম্মহ,প্রহর ভাইকে খবর দাও। আব্বা যা বলে করেই ছাড়ে। উনি ছাড়া আব্বারে কেউ আটকাতে পারব না। ”
“কেমনে দিমু রে মা? তোর আব্বা বাড়ির সবার মোবাইল নিয়ে গেছে। সবাই তোর আর প্রহরের কথা জানে এখন। সৌরভও নাই,সে তো গত রাইতে ব্যবসার কাজে শহরে গেল। তুই পালাতে পারবি নিশু? আজই তোর বিয়ে হয়ে যাইব, আমি যতদূর জানি। তোর আব্বা দরকার পড়লে তোরে কাট**ব, তবুও প্রহরের হইতে দিব না রে মা। ”
#চলবে,,,,!